।। ১৬।।
আড় চোখে দেখলাম, রাত দেড়টা প্রায়। আমার শরীরটা ক্রমশ: ভারী হচ্ছে যেন। রাতের ভারী খাবারের পর উঠোনের দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর বেশ কসরত হয়নি আমার। বসেই আছি সেই থেকে। অথচ আব্বাকে দেখি এখনও সতেজ, শুরুতে যে অস্বস্তি ছিল সেটাও কেটে গেছে অনেকক্ষণ, একটা দৃঢ় চেতনা নিয়ে বলে যাচ্ছেন যেন এ ইতিহাস জানা দরকার। অন্তত তাঁর দামাদের সে জানা প্রয়োজন!
আব্বার খোলা চোখে ছাদের দিকে করা ধ্যানটা ভাঙাতেই বললাম...
-- সুনীল...
-- হুমম, শুনেছি সেই ড্রাইভারই না-কি কীভাবে সুনীলের নাম্বার পেয়েছে, পকেটে ছিল বোধহয়।
-- তারপর?
-- হুঁ, তারপর, তারপর আর কী, আমাদের সুনীলের ঘরে থাকার কথাটা ছড়িয়ে পড়ল তাঁদের এলাকায়। সুনীলদের উত্ত্যক্ত করা শুরু হল ঘরে বাইরে। প্রায় সপ্তাদিন পরেই একদিন ফজরের নামাজটা পড়েই বেরিয়ে পড়ি আমরা তিনজন। জায়গায় জায়গায় তখন পুলিশের টহল। ভোরের বাতাসে পোড়া গন্ধটা আরও ঝাঁঝিয়ে লাগছে আমাদের নাকে, মুখে। কিছুদূর যেতেই ক'জন পুলিশ আটকাল আমাদের, বলল, কোথায় যাবেন, বললাম শাহপুর। শাহপুর রিফিউজি ক্যাম্পটা তখন এ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় স্থল। ওরাই গাড়িতে করে পৌঁছে দিল আমাদের সেখানে।
-- মানুষ, হায় মানুষ!
আব্বা আবারও যেন কাঁদো কাঁদো অবস্থায়। আমি বলতে ও পারি না, আব্বা থাক, ঘুমান, পাছে মন আরও খারাপ হয়ে যায়। আসলে মানুষের মন খারাপের কথাগুলো শুনতে হয়, আটকাতে নেই, বেরিয়ে এলেই বোঝাটা হালকা হয়। আব্বা আবার শুরু করলেন...
সেখানে প্রায় দিন পনেরো ছিলাম। কী দুর্বিষহ অবস্থা। প্রিয়জন হারানোর শোকে কেউ কারুর দিকে মনোযোগ দেয়ার মত নেই। কারুর মা, কারুর বোন, কারুর বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল সকাল বেরিয়ে যান নিজ নিজ হারানো স্বজনদের খোঁজে, কেউ খুঁজে পান, কেউ পান না। যারা পান তারা আরও ভেঙে পড়েন। আহমেদাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের বর্জ্য বাহী ট্র্যাক্টরে আসে লাশের ঢের, শাহপুর বড় মসজিদের কবরিস্থানে বিশাল সাইজের গর্ত করে একসাথে পনেরো, বিশটা করে লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হত। জীবিতের খোঁজে লাশের স্তূপে ভিড় জমাত আধ মরাদের দল।
এবার আমার চোখে পানি। ছোট্ট নাদিয়ার কথা ভেবে বুক ফেটে যাচ্ছে যেন আমার! আব্বাকে বললাম আর নাদিয়া?
নাদিয়ার কান্না হাজারো শিশুর কান্নার সাথে মিশে একাকার। আমরা সবাই এক! আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা রিফিউজি!
-- আর অফিস?
--- হ্যাঁ, অফিস তখন অর্ধ দিন হত। সুনীল আমাদের খোঁজে এফ আই আর দিয়েছে থানায়। একদিন অফিসে দেখেই জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আমার কেন জানি আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না সেখানে। মনে পড়ে যাচ্ছিল সুনীলের ভূপালের দিনগুলোর কথা। সেদিন তার বুকে বোধহয় এমনই যন্ত্রণা ছিল! কে জানে! সুনীলকে বললাম আমি চাকরি ছাড়ছি। সে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, বলল সব ঠিক হয়ে যাবে! এমনকি আমাদের আবার শাহপুর থেকে তার ঘরে নিতে চাইল। কিন্তু অবিশ্বাসের বাতাস তখন কোণায় কোণায়, ওলিমা কিছুতেই শাহপুর ছাড়তে রাজি নয়। বাঁচলে সে সেখানেই বাঁচবে আর মরলে ও সেখানে! সুনীল আমাকে ভূপালে চলে যেতে বলল, সে সব ঠিক করে দেবে! তারপর মার্চের পঁচিশ তারিখ আহমেদাবাদ ছেড়ে সোজা এইখানে!
মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। আল্লাহু আকবার আল্লা হু আকবার...
চুপচাপ বসে আছি দু'জন মানুষ! আব্বা এতো সাহস দেখিয়ে ও যে কথাটি মুখ ফুটে বলার সাহস রাখতে পারলেন না, সে আমি নীরবে বুঝে গেলাম।
নাদিয়া কুরেশি, নাদিম কুরেশি আর আয়েশা কুরেশির সেই আদরের দুলাল!
আমি কান্নায় ভেঙে পড়ছি, আমার দুচোখে অশ্রুর বন্যা!
ক্রমশ:
#যেকটাদিনপৃথিবীতে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন