“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২০

মিষ্টির শিশু দিবস

 

                      

               

                ।।  মাসকুরা বেগম ।।

 

(C)Imageঃছবি

           ডাক্তার মিঃ আহমদ ও  মিসেস আহমদের এক ছেলে, এক মেয়ে। ওরা শহরের নামকরা বেসরকারি স্কুলে পড়ে। ছেলে আদিল ক্লাস নাইনে পড়ে। মেয়ে আয়েশা ক্লাস ফাইভে। ছেলেটা রাত দিন  পড়াশোনা, মিউজিক, যোগা, ব্যায়াম, ইত্যাদি নিয়ে আপনাতে ব্যস্ত থাকে। বন্ধু বান্ধব বলতে স্কুলের সম-মনস্ক গুটি কয়েক ছেলে। মা-বাবার গর্ব আদিল। আয়েশা পড়াশোনায় দারুণ, চটপটে মেয়ে, অমায়িক আর মিশুকে।স্কুলের শিক্ষক - শিক্ষিকারা খুব ভালোবাসেন। ও আঁকতে, কবিতা আবৃত্তি করতে, গল্পের বই পড়তে আর বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসে। মা-বাবার ওকে নিয়ে যত চিন্তা। নিজের মা-বাবার সোশ্যাল স্ট্যাটাস ও তো বুঝে না। ভিখারি দেখলে ও গল্প জোড়ে দে, ফুটপাতের বাচ্চাদের  সাথে ও বন্ধুত্ব করতে চায়। কাজের লোকের সাথেও ভাব জমে যায়। নিজের খাবার ওদেরকে দিয়ে দেয়। 

 

       ১৪ই নভেম্বর শিশু দিবস। দিনটি পালনের তোড়জোড় চতুর্দিকে। আয়েশা ও আদিলের স্কুলে ও সেলিব্রেশন। আয়েশা ' অঙ্কন প্রতিযোগিতায়' আর 'গল্প বলা প্রতিযোগিতায়' অংশগ্রহণ করবে। মা-বাবার ইচ্ছে মিউজিকে ও অংশগ্রহণ করুক । ওর মিউজিকে এতো আগ্রহ নেই তবুও মা-বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে নাম দিল একটা দলীয় সঙ্গীতে আর একটা দলীয় নৃত্যে । আধুনিকতার দৌড়ে তাদের ছেলে-মেয়েরা যাতে পিছিয়ে না যায়, সবসময় খেয়াল রাখেন মিঃ আহমদ ও মিসেস আহমদ। তাদের ছেলে-মেয়ের পারফরম্যান্সটা ও তো সোশ্যাল মিডিয়ায়  আপলোড করতে হবে। সেদিন মিসেস আহমদের এক বান্ধবী শেয়ার করেছেন, স্বাধীনতা দিবস উৎযাপন উপলক্ষে তার মেয়ে কি চমৎকার  নৃত্য পরিবেশন করেছে ! তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়েশা সঙ্গীত পরিবেশনে আর নৃত্য পরিবেশনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য। ওর আর ভাইজানের জন্য মা-বাবার সারপ্রাইজ গিফট তো আছেই শিশু দিবসে।

 

      সেদিন নভেম্বরের ১৩ তারিখ। মা পেরেশান আগামী কালের প্রস্তুতি নিয়ে। বাজারে থেকে গাড়ি ভর্তি কেনাকাটা করে ঘরে ফিরলেন। তাদের ঘরে আরো একটি প্রাণী আছে। বারো বছরের কাজের মেয়ে মিষ্টি। 'যেমনি নাম তেমনি  মিষ্টি' - আয়েশার মতে।

 

     --- এই পোড়ারমুখী তুই এতক্ষণ কী করছিলি? ঘরের সব কাজকর্ম এখনও পড়ে আছে। কালকের প্রস্তুতি করতে হবে বুঝতে পারছিস না।

 মা বাজার থেকে এসে চেঁচাতে লাগলেন।

 

    -- ওতো সারা দিন কাজই করছিল....আয়েশা বলতে গিয়ে শেষ করার আগেই ওর উপর মা রেগে গেলেন। ও চুপচাপ সামনে থেকে চলে গেল। 

   

        মায়ের রাগ দেখে ভয়ে মিষ্টির হাত থেকে মায়ের জন্য নিয়ে আসা জলের গ্লাসটা পড়ে যায় মেঝে।

    

    এক চড় বসিয়ে মা বললেন,

-       গত বৎসর কাঠমান্ডু থেকে নিয়ে আসা আমার এতো দামি গ্লাসের সেটটার একটা গ্লাস রাগ করে ভেঙে দিলি। 

 

       ১৪ই নভেম্বর সকালে মা-বাবা রঙিন কাগজে মোড়া সারপ্রাইজ গিফট বের করলেন ছেলে আদিল ও মেয়ে আয়েশার জন্য । আদিল গিফট হাতে নিয়ে খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে মা-বাবাকে আদর করলো।

     --আয়েশার  গিফট দেখে পরে আমারটা খুলবো। আদিল বলল।

       আয়েশা গিফট হাতে না নিয়ে জিজ্ঞেস করল

-       মিষ্টিদির জন্য কী এনেছ মা?

 

       মা কিছু বললেন না, আজকে শিশু দিবস মেয়েকে দুঃখ দিতে ইচ্ছে করলো না বোধহয়।  তারপর প্রাতরাশে ওদের পছন্দের অনেক খাবার। কিন্তু আয়েশা খুশি নয়।ও সাধারণ খাবার খেয়ে উঠে চলে গেল। মা চুপচাপ লক্ষ্য করলেন। স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়ে এলো আয়েশা, ভাই,বাবা ও প্রস্তুত হয়ে এলেন। 

-       মা তুমি রেডি হলে না। আয়েশা বলল।

-       না, তোমরা যাও। মা বললেন।

-       ওকে। বাই। বলে ওরা বাবার সাথে চলে গেলো।

    

       স্কুলে অনুষ্ঠান আরম্ভ হল। প্রিন্সিপাল মহোদয়ের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন, সভাপতির ভাষণ সবাইকে খুব আকৃষ্ট করল, অতিথিদের ভাষণ, ছাত্র ছাত্রীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন সবাইকে খুব আনন্দিত করল। শিশুদিবসশিশু অধিকার ও শিশু নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেন। এবার এলো ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে গল্প বলার পালা । আয়েশার খুব ভালো লাগে গল্প বলতে। ওর নাম ডাকা হলো। ও মঞ্চে উঠে বলতে শুরু করলো

       

      - "একটি মেয়ের গল্প। ওদের চার ভাইবোনদের রেখে বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অনেক দিন পঙ্গু হয়ে বিছানায় ছিলেন। আগে তিনি পেশায় মিস্ত্রী ছিলেন। কোনোমতে সংসারটা চলে যেত। ওরা ওদের ঘরের পাশেই একটা সরকারি স্কুলে পড়তো। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পর মায়ের উপর সংসারের বোঝা এসে পড়ে  আর তিনি অন্য লোকের ঘরে  কাজ করতে শুরু করলেন। একদিন বাবা এই পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন ওপারে। মা নিজে  কাজ করেও  সংসার চলছে না দেখে বড় মেয়ে মেহেরুন্নেছা উরফে মিষ্টিকেও দিয়ে দেন কাজে। মাসে মাসে টাকা ও পাচ্ছেন। সংসার খরচে সাহায্য হচ্ছে। কিন্তু মিষ্টির স্কুল যাওয়া বন্ধ। ও এখন অনেক সমঝদার। দুষ্টুমি করে না। অনেক বড় হয়ে গেছে। কেউ যাতে কোনো কষ্ট না পায় সবসময় খেয়াল থাকে ওর। আনন্দ ফুর্তি করে না। দুঃখ ও করে না। একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকে মিষ্টির মুখে। মিষ্টির কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার কিছু পেলেই পড়ে। আজ আমার জন্য কি সুন্দর ওর শুভেচ্ছা " HAPPY CHILDREN's DAY dear". লেখা খুব সুন্দরভাবে আঁকা একটা হাতে বানানো কার্ড আয়েশা বের করে দেখায় আর উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করে বলে উঠে,

     

       - এখানে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় গুরুজন মণ্ডলী আপনারা কেউ কি মিষ্টির পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারবেন

     

       তখন সভাপতি মহোদয়  বললেন, - হ্যাঁ আয়েশা। একজন মিষ্টির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। বলে ঘোষণা করলেন

     - আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মিসেস আহমদকে এই মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার জন্য।

   

         মঞ্চে মিষ্টিকে সাথে করে ওর মাকে উপস্থিত হতে দেখে আয়েশা নির্বাক হয়ে নিষ্পলক  তাকিয়ে থাকে ! কী সুন্দর পোশাকে সেজেগুঁজে মিষ্টি ! 

 

           - "........আমি মিষ্টির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। ওর পড়াশোনা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার আর ওর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও করে যাবো রীতিমত। আমার মেয়ে আয়েশা সোনামনিকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই আমার মধ্যে মানবিকতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য।" বলে আয়েশার মা কোলে তোলে নেন আয়েশাকে। আর আয়েশা ওর মাকে ও মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে মহানন্দে।          

         

          বাজতে থাকে করতালি । চতুর্দিকে। আর 'Happy children's day' স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সমস্ত অডিটোরিয়াম!

        

 

কোন মন্তব্য নেই: