“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

হেঁয়ালি



।। সিক্তা বিশ্বাস ।।


হেঁয়ালি
=========


মন বিহঙ্গের কত রূপ... 
খেয়াল-খুশিতে অসীম অরূপ... 
অবাধ গতি যেন উড়োজাহাজ
বাহারি সাজে কেবল খুশির মেজাজ...

কখনও সে যে শিশু প্রায়
খোলা মাঠে কেবলই দৌড়ায়...
কৈশোরের ছোঁয়া লাগলে তায়
উড়ন্ত দ্বিজ রঙিন নেশায়...

যৌবনের ছটায় ভরা নেশা... 
পলে পলে সে যে স্বপ্ন দেখায়... 
দু'চোখ ভরা শুধু স্বপ্ন আশার... 
স্বপ্ন সাকারে পিপাসা ছোটার...

ছোটার নেশা মেজাজে মেশা
ফাঁকে ফাঁকে কেবল হিসেব কষা! 
ছুটতে ছুটতে অসার ক্লান্ত
প্রতিটি পদে শুধুই ভ্রান্ত!
          *********

রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

স্বাধীন নীড়ের সন্ধান

         

             

              ।। মাসকুরা বেগম ।।

  

(C)Imageঃছবি

        " মা মাগো মা......ভাবি এসে গেছে।"

        গাড়ির হর্ন শুনে আর আহ্লাদে আটখানা নাশিদ ও বাচ্চাদের চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন মা।বাড়ির সামনে একটি সাদা ট্যাক্সি এসে থেমেছে । মাথায় কালো স্কার্ফ, সাদা পোশাকের উপরে কালো কোট পরিধান করা সুশ্রী সাদাসিধে চেহারার জাস্টিস নৌরিন আহমদ নুরী গাড়ি থেকে নেমে সালাম করে, শাশুড়ি মায়ের পা ছুঁয়ে নেয়। এক ঝটকায় শাশুড়ি জড়িয়ে ধরেন বউকে ! নুরীর সঙ্গে তার স্বামী প্রফেসর নাভিদ আহমদ। নুরীর শাশুড়ির লালিত-পালিত অনাথ বাচ্চাগুলোর হাততালিতে আর কলতানে মুখরিত হয়ে উঠে সারাটা বাড়ি।

 

         খুশির বন্যা বইছে আজ শহরতলির এক  ছিমছাম আসাম টাইপ বাড়িতে। আজ এ বাড়ির বউ এর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ! শাশুড়ি মায়ের  ছুটোছুটির অন্ত নেই। বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করেছেন। লোকজন ডেকেছেন কারণ বউমা আজ আসছে হাইকোর্টের জাস্টিস হিসেবে নিযুক্তি লাভ করে। নুরীর কিন্তু আজ সকাল থেকে খুব মনে পড়ছে তার একজন হাইকোর্টের জাস্টিস হয়ে উঠার কাহিনী।

 

 

         নুরীর বয়স যখন মাত্র পনেরো বছর  তার বাবা মারা গেছেন। তার বড় দুই ভাই, এক বোন আছে। বড় দাদা এমবিএ করে বাবার প্রতিষ্ঠিত ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি চালাচ্ছেন সফলতার সঙ্গে। তারপর নিজের প্রচেষ্টায় এখন ব্যবসায় আরও ডালপালা গজিয়েছেন। নাম করা ব্রান্ডেড কোম্পানি হয়ে উঠেছে ওদের ইন্ডাস্ট্রি । সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায়  নিজ বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বড়দা  উন্নতির শিখরে। বিয়ে করে দু'জন পুত্র ও আছে। ছোট দাদা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে ও করে নিয়েছেন  । দিদির বিয়ে হয়ে দুই বাচ্চার মা। স্বামী ডাক্তার। সবাই খুব আরাম-আয়েশে, আদর-সোহাগে রাখতেন নুরীকে। কোনো দিন কোনো বস্তুর অভাব অনুভব করতে পারে নি নুরী।

 

      নুরী বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে একটি জিনিষ  হারাতে থাকে তা হলো - স্বাধীনতা ! সে যেন এক কাঠের পুতুল । যে যেমন বলতো তেমনি চলত। মা নিজেই তো ছেলেদের  কথায় চলেন। সেটার কারণ কি ভয় নাকি ভালোবাসা নুরী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। স্বামী পরকালে চলে যাবার পর তিনি ছেলেদের অধীনস্থ তাই  ভয় পান, নাকি ছেলে হওয়ার অগ্রাধিকার হিসেবে আলাদা ভালোবাসার টান ? 

 

          বড় বউদি হাতে সংসারের চাবি। সবার সম্মানের পাত্রী তিনি। নুরীকে খুব দেখে শুনে রাখেন।  তিনি নুরীকে উপদেশ দেন, " শুনো সোনাবোন, তুমি মেয়ে মানুষ তাই মাথা নিচু করে চলবে, নিচু গলায় কথা বলবে, স্কুলে যাবে এদিকে ওদিকে তাকাবে না, যখন যা দরকার নির্দ্বিধায় বলবে.......।" তিনি নিজে কিন্তু এসব উপদেশের ঊর্ধ্বে। মা থেকে শুরু করে সবাই বড়বৌদির কথার খুব মান্য করে। বড়লোকের বুদ্ধিমান মেয়ে কি না! 

 

      মায়ের উপদেশ, "  বড় ভাইদের কথা মতো চলবে। বর্তমানে তাঁরাই আমাদের অন্নদাতা ! নিজের ইচ্ছে মত কিছু করতে যেওনা কোনোদিন।.....।"

 

      দিদির উপদেশ, " ঠিকঠাক পড়াশোনা করলে বড় লোকের বউ হবে। সবসময় বড়লোক ঘরের মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব কর......"। 

 

        বড়দা বলেন, "মনে রেখো, কোনদিন আমাদের মান সম্মানে যেন এতটুকু আঁচ না লাগে তোমার জন্য। তোমার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে আমরা প্রস্তুত। যখন যা ইচ্ছে চাইতে পারো।"

 

        ছোড়দা তো কিছুই বলেন না । স্বল্পভাষী মানুষ তিনি। নুরীকে স্নেহ করেন কি না তা সে অনুভব করতে পারে না। কিন্তু তার পড়াশোনার প্রতি লক্ষ্য রাখেন তাই ও যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে ।

 

       ছোটবৌদি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।কারো প্রতি কোনো খেয়াল যেন নেই।

 

       সবার উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করে নুরী। ছোটবেলা থেকে সে যে খুব বাধ্য মেয়ে। দামি দামি পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়না-ঘাঁটি, আদর-যত্ন কোনো কিছুর অভাব হয়নি কোনো দিন।  তারপর ও কি কারণে আড়ালে নুরীর চোখের জল পড়ে ! মন ছটফট করে !

 

       বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে যেন স্বপ্ন দেখাই ছেড়ে দিয়েছে, আপন স্বত্বাকেও ভুলে গেছে ! না না কিছুই ভুলে যায়নি, তার দেখা স্বপ্ন গুলো ওকে কুরে কুরে খায় ! সে যে ভালো মেয়ে, বাধ্য মেয়ে হবার অভিনয় করে যাচ্ছে অবিরত !নিজেকে প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে ভালো মেয়ের সংজ্ঞাটা কি ? কিছু নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলা ?  ভালো মেয়েরা কি নিজেরা চিন্তা চর্চা করে না ?  ভালো মেয়েরা ভাগ্যবান হয় কারণ বড়লোক বাড়ির বউ হতে পারে। বড়লোক বরের বউ হতে পারাটাই কি ভালো মেয়ের যোগ্যতার প্রমাণ ? নুরীর বিবেক কোনটারই হ্যাঁ বোধক উত্তর দেয় না। তবুও সে নিজের বিবেককে ধমক দিয়ে সবকয়টা প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর সাজায়। কিন্তু বাবার দেওয়া জ্ঞান আর বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি বিতর্কে হেরে গিয়ে "আল ইয ওয়েল" বলে কেটে পড়ে। 

 

       সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এসে দেখলো পরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বসে আছেন লিভিং রুমে। দিদি ও এসেছেন। শান্ত থমথমে পরিবেশ! 

 

     " দিদি  কখন এলে ? নিলি-টুটু এসেছে কি ?"

দিদিকে জিজ্ঞেস করে কোনো জবাব পেল না নুরী। তাই সে নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হতেই বড়দা গম্ভীর গলায় হাঁক পাড়লেন,

"যেওনা নুরী। শুনে যাও।"

 ঘুরে দাঁড়ালো নুরী।

      

        "আজ ক্লাস ছেড়ে কার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলে ?"

         নুরী হা করে তাকিয়ে থাকে। 

        " আমার প্রশ্নের জবাব দাও।"

        " আমি তো বেড়াতে যাই নি।"

        " মিথ্যা কথা বলা শুরু করে দিয়েছ। বাহ্ দিন দিন খুব উন্নতি হচ্ছে যে তোমার। পরিবারের মান ইজ্জত কিছুর ই মূল্য নেই তোমার কাছে। ছিঃ এতো নিচে নেমে গেলে তুমি। আমাদের এতো আদর ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে। তোমাকে শিক্ষা দেওয়াতে আমাদের  কোথাও কমতি রয়ে গেছে। কাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ।"

বলে দাদা উঠে চলে গেলেন। পিছে পিছে বউদি ও চলে গেলেন।

 

       তারপর মা ও দিদির কাছ থেকে জানতে পারলো যে তাকে নাকি একটা ছেলের সাথে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে  দেখা গেছে বলে দাদার কাছে খবর এসেছে। শুনে আসল ঘটনাটা সে বলল কিন্তু কে কতটুকু বিশ্বাস করলো জানে না। 

 

      "একটা ছেলে আমার পেছনে খুব ঘুরছে কয়েক দিন থেকে। প্রায়ই  বিরক্ত করে। তাই তাকে বুঝাতে ডেকে ছিলাম ক্যান্টিনে । সঙ্গে এক  বান্ধবীও ছিলো । তাই আমি এই সাক্ষাতটাকে ঠিক বেড়ানো বলে ধরে নিতে পারিনি। মিথ্যা বলতে চায় নি।আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কী করবো। কাকে বলবো ছেলেটির কথা । সে আমার পিছনে ঘুরে তাতে আমার দোষ কী? আমার পছন্দের ছেলে সে নয়। আমি এধরনের ছেলেদের পছন্দই করি না। আমার পড়াশোনাটা বন্ধ করে দিও না। প্লিজ।"

 

          "হ্যাঁ তোমার দোষ ! ছেলেরা চোখ তুলে তাকালেই মেয়েদের দোষ ! মনে রেখো, সে কেন, কোনো ছেলেকেই নিজে পছন্দ করার অধিকার নেই তোমার এ ঘরে।" মা স্পষ্ট করে বলে দিলেন।

 

        "আমার সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। প্লিজ দিদি। আমার পড়াটা কমপ্লিট করতে দাও।"

 

       "আমি বড়দার সাথে কথা বলছি। কিন্তু তোমাকে প্রমিজ করতে হবে এ ছেলেটির সাথে আর মিশবে না।" 

       

         "প্লিজ বিলিভ মি । আই হ্যাভ নো রিলেশন উইথ হিম। আমাকে বিশ্বাস করো। এখনও পর্যন্ত আমি কোনো ছেলেকেই পছন্দ করি নি। ছেলেটি পিছনে ঘুরে তাতে আমার দোষ কী?" বলে হাউ মাউ করে কাঁদে নুরী।

   

        তারপর ছোড়দার কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেলো। কারণ ফাইনাল ইয়ারে কলেজ বন্ধ করলে লোকে কী ভাববে। এতে মান সম্মানের আরো হানি  হবে। তাদের নিজস্ব গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া আসা করতে হবে। গ্রামের বাড়ি থেকে ছোট কাকাকে ডেকে আনা হলো তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া আসার জন্য। একা এখন আর তাকে ভরসা করা যায় না।

 

         যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ হয়নি তাই নুরী খুশি হয়ে উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লো। ছোটকাকুকে খুব ভালো লাগে তার। যদিও পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছে তিনি মূল্যহীন । কিন্তু তিনি খুব বড় মনের মানুষ। গ্রামের গরিব দুঃখীদের পাশে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। বাবা থাকতে বার বার আসতেন । এখন আর এতো বেশি আসেন না। বোধহয় এখানে নিজের জায়গাটা অনুভব করতে পারেন ! গ্রামের বাড়িতে যেতে খুব ভালো লাগে নুরীর কিন্তু বড়দার গাঁয়ের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় না। তাই বাবা মারা যাওয়ার পরে আর যাওয়া হয়নি। কোনো কোনো সময় নুরী ভাবে বড়দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে আর তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এতো অমিল কেন ? নিজের মধ্যে অপরাধবোধ হয় । এতো ভুল ভাবনা আসে কেন তার মনে ! সবাই কতো সমীহ করে বড়দাকে ! আসলে নুরীর মধ্যে আছে এক নিজস্ব স্বকীয়তা , যা তাকে বিনা যুক্তিতে কিছু মেনে নিতে দেয় না।  দাম্ভিকতা পছন্দ করে না সে, খুব বিনয়ী তার বাবার মতো। 

 

        বাবার কাছে বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বাস্তব গল্প শুনে শুনে সে বলতো, "বাবা আমি বড় হয়ে  জাস্টিস হবো । প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেব আর যারা দোষী নয় তাদের নির্দোষ প্রমাণিত করবো।" 

        বাবা বলতেন,  " আল্লাহ তোমার ইচ্ছে নিশ্চয়ই পূরণ করবেন। সৎ উদ্দেশ্য যাদের থাকে তাদের প্রার্থনা তিনি শুনেন, মা।.......।" সেই ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন বুকে নিয়ে নুরী ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। যদিও সবাই শিক্ষিত তবুও নুরীর পরিবারের কেউই মেয়েদের চাকুরী করা সমর্থন করেন না। তাই নুরী তার স্বপ্নের কথা ঘরে প্রকাশ করে না। বাবা পৃথিবীতে থাকলে নিশ্চয়ই সমর্থন করতেন।

 

        সেদিন প্রফেসর ভট্টাচার্যের অফিসে এসাইনমেন্ট জমা দিতে যায় নুরী। 

       " মে আই কাম ইন স্যার।"

      " ইয়া ইয়েস ! মিস নৌরিন আহমদ নুরী কাম ইন !" প্রবেশ মাত্রই তিনি নুরীকে বসতে বললেন।  

       নুরী এসাইনমেন্টের ফাইলটা দিতে গেলে বললেন, "এতো তাড়া কীসের ! বসো । একজন মহান হৃদয় ব্যক্তির সাথে আলাপ করিয়ে দেই। এ হচ্ছে নাভিদ। অন্ধের যষ্টি মানে বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সে  কেমিস্ট্রিতে এম এস সি, বি এড করে এখন পি.এইচ.ডি গবেষণা করছে । এদিকে সরকারি বিদ্যালয়ে তিন মাস আগে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেছে। সব থেকে বড় পরিচয় ওর সে এক সমাজকর্মী। সমাজের অবহেলিত শোষিত মানুষের কাছের মানুষ নাভিদ। এই তৃতীয় লিঙ্গ নাশিদকে নিয়ে এসেছে আইন বিভাগে ভর্তি করাতে।"

 

      "কেন এই নগণ্যকে লজ্জা দিচ্ছেন স্যার!" নাভিদ বললো।

 

     "তৃতীয় লিঙ্গ!" বলে আঁতকে উঠে বোকার মত তাকিয়ে রইলো নুরী । স্যারের কথায় আবার সম্বিৎ ফিরে পেলো সে ।

 

       " কী নুরী, মহান নয় কি?"

       "হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার! তাকে কোথায় পেলেন নাভিদ স্যার ?" জিজ্ঞেস করে নুরী।

       "সে যখন ছোট তখন মা ওকে রাস্তায় একা কাঁদছে দেখে ঘরে নিয়ে আসেন। আমাদের গরিবের কুটিরেই বড় হয়ে উঠেছে সে। পড়াশোনায় খুব ভালো। আইন বিভাগে পড়ার ইচ্ছে.....।"  নাভিদ জবাব দিলো।

         "একী শুনছি ! বাস্তব সত্য না কোনো কল্প কাহিনী !" নুরী অবাক হয়ে বললো।

 

         তারপর আরো কয়েক মাস কেটে গেলো। নুরীর ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ। আজ নুরী তার বিচারপতি হওয়ার স্বপ্নটা প্রকাশ করেছিল মায়ের কাছে।

 

        মা বললেন, "মেয়ে মানুষ যতটুকু পড়াশোনা করেছ, যথেষ্ট হয়েছে। আর না।"

 

        দিদিকে বললে তিনি বললেন, "তোকে কোনো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেব, বড় ঘরের বউ হবে, আর কী দরকার এতো নিজে কিছু করার। বিয়ের পর পড়াশোনা হউক  আর চাকুরী কোনোটাই করা সহজ নয় রে। সবার মন যুগিয়ে যে চলতে হয়। তাই মেয়েদের কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখা বেমানান !"

 

        কিন্তু নুরীর স্বপ্ন নুরীকে শান্তিতে ঘুমাতে দেয় না । মা দিদি যখন পাত্তা দিলেন না তখন রাত্রে খাবার টেবিলে নিজেই সাহস করে দাদাদের সামনে  বলে উঠলো, 

      

      " আমি হাই কোর্টের জাস্টিস হতে চাই। তাই আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই।"

        গর্জে উঠলেন বড়দা, "এতো সাহস তোমার........" অনেক কথা বলে দেন।

       ছোড়দা চুপচাপ বসে আছেন। বৌদিরা চুপিচুপি হাসছেন। মা কটমট করে তাকিয়ে আছেন। আর বিচারপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখা নুরী যেন আজ নিজেই আসামির কাঠগড়ায় !

 

          তারপর নুরী করিডোর দিয়ে যেতে যেতে ছোটবৌদিকে বলতে শুনে, "ঐ ক্যান্টিনে যে ছেলের সাথে দেখা গিয়েছিল তার সাথে কিছু আছে মনে হয় । কতো মেয়ে আবার সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রেমিকের সঙ্গে  সম্পর্ক শেষ বলে, আর ডুবে ডুবে জল খায় ।......." পরিবারের বাকি সদস্যবৃন্দও কথাটা ফেলে দেবার নয় বলে মেনে নিলেন। নুরীর মনে মনে হাসি পেলো, যে ছেলেটি সেদিন ওদের বুঝানোর পর আর কোনোদিন তাকে বিরক্ত করেনি - তাকে নিয়ে  এখনও জল্পনা কল্পনা চলছে ! বাহ্ ! কী মানসিকতা ! 

 

 

        শান্তি ভবনের তিনতলার বারান্দায় বসে নুরীর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু আর বাবার কথা ভাবছে । ব্যস্ত শহরে আধুনিক কারুকার্য খচিত বাংলো বাড়িটিতে সর্বত্র আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। নুরী হচ্ছে এই বাড়িটির একটি প্রাণী। সে তো ছিল বাবার রাজকন্যা। বাবার কাছে ছিলো তার প্রচুর স্বাধীনতা। বাবা ছিলেন তার বন্ধু। আজ বাবা আর নেই এই পৃথিবীতে। চলে গেছেন ওপারের ডাকে সাড়া দিয়ে। কিন্তু বাবার বলা কথা গুলো তার কানে বাজতে থাকে। বাবা বলতেন, " জেনে রাখ নুরী মা আমার, আমরা দেখি যে সূর্য অস্ত যায় । ভাবি সূর্য জ্বলতে জ্বলতে ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে নিবে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই ? না মুঠেই না। সূর্য আপন তেজে জ্বলতেই আছে। আমরা সরে আসি অন্ধকারের দিকে। আমাদের সহ্য হয় না সূর্যের এমন উজ্জ্বল রূপ, এতো আলোর ঝলকানি। সূর্য কিন্তু আপন আলোয় আলোকিত করতে থাকে এদিক থেকে ওদিক। সূর্য অক্লান্ত, সূর্য অস্ত যায় না, সূর্য ডুবে ও না । এতো আমাদের চোখের দেখা। চোখের দেখা আর বাস্তব সত্য কি এক ? চোখ আমাদের ধোঁকা দেয়। জীবনে যে যাই ভাবুক সঠিক পথে চলতে থাকবে। ক্লান্তিহীন আলো জ্বালিয়ে যাবে। নিজেকে নিবে যেতে দেবে না। হারিয়ে যাবে না যতই বাঁধা বিপত্তি  আসুক....." ভাবতে ভাবতে দুচোখ মুছে ফেলে নুরী ! কী এক অদৃশ্য শক্তির বলে সাহস সঞ্চার হতে থাকে ! বাবার বলা কথাগুলো সাহস যোগাতে থাকে মনে। নিজের অধিকার ভোগ করতে দোষ কোথায় ! নাহলে সে যে হারিয়ে যাবে । নিবে যাবে । রুখে না দাঁড়ালে সূর্যের মত  জ্বলবে কেমন করে ! এ ঘরে থেকে চন্দ্রের ন্যায় অপরের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকতে হবে।

 

       চোখের জল মুছে ছোটকাকুকে ফোন করে, ".......কাকু তুমি কাল সকালে একবার আমার সাথে দেখা করতে আসবে?"

     "হ্যাঁ নিশ্চয়ই আসব মা। তোমার কী হয়েছে। কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন.....।"

   " কিছু না। রাখছি কাকু। কাল এসো বলবো।"

 

          পরদিন সকালে ছোটকাকুকে তার সব পরিকল্পনা খুলে বললো, " কাকু আমার  খুব ভয় করছে । পরিবারের লোকজনেরা আমাকে কোন বড়লোক বাবার বড়লোক অমানুষ ছেলের সঙ্গে না বিয়ে দিয়ে দেয়, আমার জীবনটাকে না নরক বানিয়ে দেয়। আমি এক স্বাধীন নীড়ের সন্ধান পেয়েছি। সেখানে কি আমার একটু জায়গা হবে তার খবর তোমাকে নিতে হবে। নাভিদ নামের একটি ছেলের কাছে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে। ভট্টাচার্য স্যারের অফিসে গেলে বাকি খবর পেয়ে যাবে ...।"

 

       কাকুও সায় দিয়ে সে মতে কাজে লেগে গেলেন। উপস্থিত হলেন গিয়ে ভট্টাচার্য স্যারের অফিসে। জানালেন সব পরিকল্পনা। শুনে স্যার খুশি হয়ে বললেন, " কাজটি যদিও খুব কঠিন তবুও করতে হবে। সফল হতে পারলে আমার থেকে খুশি আর কে হবে। দুইজনই আমার যে খুব প্রিয় ।"

 

 

        নুরীকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে এই মেয়ের হৃদয়ে কতো অভিমান, কষ্ট জমে আছে। এতোটা স্বাভাবিকভাবে সে  চলাফেরা করে বরাবরের মত। কিন্তু এটাও সহ্য হচ্ছে না অনেকের !

 

        সন্ধ্যার পর ভট্টাচার্য স্যার আসলেন শান্তি ভবনে । আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন পানাহারাদি পরিবেশন করা হলো। তারপর একে একে সবাই কিছুটা আশ্বর্যান্বিত হয়ে লিভিং রুমে জোড়া হলেন ! হঠাৎ এই অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির আগমনের কারণটা জানতে। স্যার নাভিদের সম্বন্ধে বলে  তিনি যে নাভিদের জন্য নুরীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন তা বললেন।

 

        "কী এক স্কুল মাস্টার ছেলের এতো বড় স্বপ্ন ! এ পরিবারের জামাই হবে। হা হা হা ! আমাদের বাড়ির ড্রাইভারের সমান মাইনে ও কি পায় ঐ মাষ্টার মশাই ছেলে ? তার মাইনে থেকে কি আমাদের নুরীর একজোড়া ড্রেসের দাম বেরুবে ? কতো দামি দামি ব্র্যান্ডেড ড্রেস আর গয়না ঘাঁটিতে অভ্যস্ত নুরী। বামুন হয়ে চাঁদে হাত। হা হা হা।"

 

         স্যার কোনো জবাব দিলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলেন। চলে যেতে উদ্যত হলে হঠাৎ করে "প্লিজ দাঁড়ান স্যার" শুনে পিছনে ঘুরে দাঁড়াতে দেখেন নুরী এগিয়ে আসছে। ওর সহ্য হয়নি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরকে অপমান আর একটি ছেলের সম্বন্ধে এতো অপমান জনক কথা। বললো, " নমস্কার স্যার ! আমি ঐ ছেলের মহৎ কাজ দেখে  বিয়ে করতে আগ্রহী। নাভিদ কি রাজি হবে? জেনে নেবেন স্যার। " 

          মা-দাদাদের উদ্দেশ্য করে বলে, " সরি মা, সরি বড়দা, আমি নিজে ঠিক করেছি এই স্কুল মাস্টারকে বিয়ে করবো। তাই স্যারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। নাভিদের সাথে অবশ্য কোনো কথা হয়নি আমার।সবাই আমার বেআদবি মাফ করবেন। প্লিজ।"

 

        সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন । দিদি এগিয়ে গিয়ে বললেন, " ঠিক আছে আমরা দেখছি । আপনি এবার আসুন স্যার। ক্ষমা করবেন।" তারপর নুরীর উপর শুরু হলো সবার বঞ্চনা আর তিরস্কার ! কিন্তু নুরী আজ নির্ভীক । কারো কথার কোনো জবাব দেয় না কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড়, অটল ! 

 

       বড়দা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না এই প্রস্তাবটায় । ছোড়দা হ্যাঁ বা না - কিছুই বলেন না। মা, দিদি অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। পাত্র যাচাই করতে ব্যস্ত 'ব্র্যান্ডেড প্রডাক্ট' এর মতো। মনে করে এখনও হাঁসি পায় নুরীর। কিন্তু নুরীর সেই দিনগুলো মুটেই সুখের ছিল না। অনেক ঝড় বয়েছিল তার উপর দিয়ে কারণ ও নিয়ম ভাঙার অপরাধে অপরাধী ! বিয়ের পাত্র পছন্দ করার অধিকার তো তার নেই এ পরিবারে !  

 

         ছোটকাকুকে নুরী নীরব থাকতে বলেছিল। কিন্তু ছোটকাকু যখন দেখলেন ও খুব একা হয়ে পড়েছে তখন আর পারলেন না।  অপমানিত হবেন জেনেও তিনি কথা বললেন নুরীর হয়ে । অনেক বাকবিতণ্ডা হল নুরীর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। তিনি যুক্তি দেখালেন, " নুরীর পাত্র পছন্দ করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে । ইতিহাস সাক্ষী  হজরত খাদিজা (র:) নিজে থেকে প্রস্তাব পাঠিয়ে বিয়ে করেছিলেন হজরত মুহাম্মদ (ছঃ) কে। তাই কোনো অবস্থায় নুরীর বিয়েতে বাঁধা দেওয়ার অধিকার তোমাদের নেই।............"

 

        অনেক বঞ্চনা গঞ্জনার পর শেষ পর্যন্ত নুরীর জয় হলো ! তার বিয়ের দিন ঠিক হল। যদিও পরিবারের লোকজন খুশি নন। পরিবারের কেউই ওর সঙ্গে ভালো করে কথাই বললেন না। নাভিদের সঙ্গেও না। বিয়ের দিন পরিবারের বাকি সদস্যরা পাঁচ লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য করেছেন । নুরী কাজী সাহেবকে বলে দিল তার যেন দেনমোহরটা  হজরত মুহাম্মদ (ছঃ) এর কন্যা ফাতিমা (র:) এর সমপরিমাণ হয়। তাই হলো।

 

        বিয়ের পরের দিন তার পরিবারের কেউ তাকে দেখতে তার স্বামীর বাড়িতে গেলেন না । কিন্তু দুই ট্রাক বুঝাই আসবাবপত্র আর একটা চার চাকার গাড়ির চাবি পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে । নুরী ফেরত পাঠিয়ে দেয় সবকিছু। তার ছোটকাকু, কাকিমা আর তাদের ছেলে- মেয়ে দুটো তাকে ঠিক দেখতে গেলেন। তার শাশুড়িকে কাকু বললেন, " ও বেয়াইন ! আমাদের গ্রামের বাড়িতে আপনাদের নিমন্ত্রণ রইলো। কোন দিন যেতে পারবেন ?"

        শাশুড়ি মা বললেন, " যখনই বউমা ইচ্ছে করবে আমরা যাবো।"

 

       খুশিতে নেচে উঠে নুরীর মন ! মনে করতে থাকে শেষ কবে গিয়েছিল গ্রামের বাড়ি ! তার খুব ভালো লাগে গ্রামের তাজা হাওয়া, কাঁচা মাটির গন্ধ, সবুজ শস্য-শ্যামল মাঠ, মাঠে শিশুদের স্বাধীন বিচরণ, পশু-পাখির কলতান ! 

 

       নুরীর স্কুল মাস্টার স্বামী আজ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির প্রফেসর ড.নাভিদ আহমদ ! আর নুরী আজ হাইকোর্টের জাস্টিস নৌরিন আহমদ নুরী ! নুরীর খুব ভালো লাগে তার শাশুড়ি মায়ের তৈরি এই স্বাধীন নীড়, যেখানে সমাজে অবহেলিতদের অবাধ বিচরণ সারাক্ষণ !