।। অভীককুমার দে।।
হঠাৎ,
জয়ের ফোন আসলো দিন পাঁচেক আগে। বিজনদার সাথেও কথা হয়েছিল।সৌমেন
হরিণা আসবে, শিলাগুহা যেতে চায়। আমাকেও যেতে বলেছেন। শিলাগুহার
কথা এর আগে অনেকবার শুনেছি। গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধনও এই গুহার কথা বলেছিলেন
আমাকে। সঙ্গী ও সুযোগের জন্য যাওয়া হয়নি এর আগে, তাই আমিও না
করিনি।
আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। ন'টার আগে যেতে বলেছিল জয়। আসলে যখন খুব
তাড়াতাড়ি, দরজাও আঁচল টেনে ধরে; তা
নাহলে চরকবাই থেকে হরিণা যেতে তিনবার গাড়ি বদলাতে হলো ! তবুও সময় মত গিয়ে
পৌঁছেছি। বিজনদার দোকানে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। জয় বাজারেই, কাছাকাছি কোথাও। সৌমেন আর সঞ্জীবদা এসে পৌঁছেছে। এগারোটা নাগাদ
মোটরসাইকেলে রওনা হলাম শিলাছড়ির উদ্দেশ্যে। হরিণা ও রূপাইছড়ির ঠিক মাঝামাঝি
জয়ের বাড়ি। আনুমানিক চার পাঁচ কিলোমিটার গেলে সোনাই বাজার। বাজার থেকে বনকুল
অভিমুখে সামান্য এগিয়ে গেলেই সঞ্জীবদার বাড়ি। এ পথে এখনও শহরের দূষণ লাগেনি।
পাহাড়, বন, গ্রাম একসাথে মিলেমিশে
আছে। পরপর গ্রামগুলোকে যুক্ত করে একটি পাথুরে রাস্তা জীবনের ছন্দ মেখে এগিয়ে গেছে।
আঁকাবাঁকা পথ উঁচুনিচু পাহাড়ের ঢালে
ঝুলছে।পাহাড়ের কাছে প্রকৃতির মায়ামেয়ে। পুরুষের মতো প্রহরী শরীর, নারীর মতো সবুজ মন। পায়ে লতানো গাছের
নূপুর। নূপুরে ঢেঁকিশাকের কারুকাজ। মাঝে মাঝে বনফুলের মুক্তো।
বাঁদরঝোলা রাস্তা কোথাও পাহাড়ের কোমর জড়িয়ে, কোথাও চুমু খায় পায়ে। এসব দেখে সূর্যটা হেসে উঠলে কুয়াশা চাদরে জড়িয়ে
নেয় শরীর এবং নীরবতার বাদ্যযন্ত্রে প্রকৃতির সুর নিজস্ব ধারায়। শুনতে শুনতে
এগিয়ে চলেছি আমরা পাঁচজন। পাহাড়ের বাড়ি এলে মনের খোকাবাবুর আবদারও বেড়ে যায়।
তা নাহলে একটু পরপরই ছবি তোলার নামে দাঁড়িয়ে পড়বে কেন ? কেনইবা
জয়ের মতো ধীরস্থির ছেলে পাহাড়ের ঢালে একটি ফুল দেখে অস্থির হয়ে উঠবে ? শৃঙ্খলা বাহিনীর মানুষ হয়েও সৌমেনইবা অন্য কেউ কেন ! যার গলা ছেড়ে
বেড়িয়ে আসছিল গানের কলি। আনন্দে আত্মহারা সঞ্জীবদার মুখেও পুনমের হাসি প্রজাপতির
মতো ভাসতে দেখেছি। অনবরত কথা ফুটতে শুনেছি বিজনদার মুখে। আসলে পাহাড়ের কাছে এলে মানুষের
ভেতর আর কোনও জড়তা থাকে না।
তোমাদের মতোই আমার প্রিয় বন্ধু পাহাড়, বন, নদী। মনের
সাথে তর্ক করে যখন আমি হেরে যেতে যেতে চুপ হয়ে যাই, তুমি
ঠিক বুঝতে পারো। কাছে আসো, সঙ্গ দাও। ভুলগুলো বেছে বেছে
সরিয়ে দিতে পারো মন থেকে। ঠিক তেমনই, পাহাড়ের কাছে গেলে ঘন
সবুজ বন আমার সব জড়তা সরিয়ে দেয়। খুশির ঝর্ণা ছলাৎ করে ওঠে। মনের ভেতর একটি
চঞ্চল নদী ঢেউ ছড়িয়ে বয়ে যায়। তৃপ্তির অভিমুখে অদ্ভুত স্বচ্ছতায় সাঁতার কাটি।
পাহাড়ি বন আমার অবয়বের দু'পিঠ দেখে হাসে।
হরিণা থেকে শিলাছড়ির দূরত্ব পঁয়তাল্লিশ
পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি হবে না। অথচ যখন শিলাছড়ি পৌঁছলাম তখন প্রায় পৌনে একটা।
মাথার উপর দুপুর ভাঙছে। খোঁজখবর নিয়ে আমরা শিলাগুহার পথে রওনা হয়েছি।
মোটরসাইকেলে আরও কিছুদূর যাওয়ার পর হাঁটা পথ। জলাশয়ের পাশে পাশে গুহাটা
সরু খাঁজে পা গলিয়ে পাহাড়ের দিকে হাঁটছি। গভীর জঙ্গলের ভেতর মুখ লুকিয়ে একটি
ছড়ি অজগরের মতো শুয়ে আছে। তিনবার ছড়িটির ছায়াশরীর আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করার পর
আকাশ ছোটো হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। জলের শব্দ বাড়ছে। এখান থেকে ছড়ির গা বেয়ে যেতে
হবে সামনের দিকে। এই জলপথ ছাড়া শিলা-গুহায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। যতই এগিয়ে যাচ্ছি
ছড়িটি ঝর্ণা হয়ে উঠছে। ঘুঙুর পায়ে তাল ঠুকছে পাথরে। পিচ্ছিল পাথরে গড়িয়ে নেচে
ওঠা ঝর্ণার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। যতই এগিয়ে যাচ্ছি, ছোটো হয়ে আসছে আকাশ। ছড়ির উপর
মুগলীলতা, পাশে কাঁটাঝোপ, উঁচু পাহাড়িঢাল।
অদ্ভুতুড়ে আলো আঁধারে পাহাড়কে ভয়াল করে তুলেছে।
আনুমানিক দুই কিলোমিটার হাঁটার পর সামান্য
একটু খোলা জায়গা। সামনেই পাহাড়ের গায়ে হা করে আছে একটি গুহা। ছড়িটি সামান্য
বেঁকে বাঁদিকে সরে গেছে। আমরা যখন গুহামুখে এসে পৌঁছেছি তখন ঘড়িতে দুটো। অথচ মনে
হচ্ছে, গুহামুখ দিয়ে ভেতর
থেকে কেউ অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছে সামনে। পাহাড়ের শরীর ভেদ করে সেই অন্ধকার মুছে
দেবার ক্ষমতা আকাশের আলোতে নেই।
একে একে সবাই মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে
ঢুকে পড়লাম গুহার ভেতর। ঢোকার সময় গুহামুখে মোমবাতি জ্বালিয়ে পাহাড়ি
প্রাণীগুলোকে আমাদের অস্তিত্বের কথা জানিয়ে গেলাম। বিজনদার খানিকটা ভয় হচ্ছিল
কিনা বুঝতে পারিনি। সৌমেনকে পথ দেখানোর জন্য সামনে যেতে বললেন। গুহামুখ থেকে তিন চার
হাত যেতেই পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার জমে এখানে চিররাত্রি। মোবাইলের আলোকে চেপে ধরছে
অন্ধকার। সীমাবদ্ধ গণ্ডির ভেতর বাঁধা পড়ে ছটফট করছে আলো।ভেতর দেয়ালে গুহামুখের
দরজাটি কবে কারা হেলান দিয়ে রেখেছে। দরজাটি ছুঁয়ে অনুভব করলাম, এমনই সব গুহায় ডাকাতরা রেখে যেতো
লুটের সম্পদ। এমনই কোনও গুহার সামনে এসে দরজা খোলার জন্য নাকি বলতে হতো 'খুল যা সিমসিম'। যদিও এই গুহা সেই গুহা নয়। এটি
সমশের গাজীর গুহা। এখন ভেতরে চামচিকা আর বাদুড়ের নিরাপদ বসবাস।
গুহার ভেতরের পথ অত্যন্ত সুকৌশলে তৈরি হয়েছে।
খুব তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ধৈর্যশীল
ও প্রচুর শ্রমশক্তি না থাকলে এমন একটি অসাধারণ সৃষ্টি অসম্ভব। কেননা, গুহার ভেতর চলতে চলতেই টের পাওয়া যায় বাহ্যিক চাপ, গতি
ও প্রভাব বিস্তারের কোনও সম্ভাবনা নেই। এখানে অবস্থানরত কাউকে আক্রমণ করা বা গুহাতে
বন্দী আছে এমন কাউকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। কোথাও কোথাও রাস্তা অত্যন্ত সরু।
হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা ঢোকার পর মাথা সোজা করার
জায়গা আছে। আবার বেঁকে গেছে পথ। একদম ভিতরে ঢুকলে ইগলুর মতোই প্রায় গোলাকার
জায়গা। পাশ দিয়ে পাহাড় ঘামানো জল নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা আছে। অনন্ত তৃষ্ণায়
বুক ফেটে মৃত্যু হবে না।
সমশের গাজীকে ছুঁয়ে দেখার এর থেকে ভালো কোনও জায়গা
হতে পারে কিনা আমার জানা নেই। এখানে না এলে ত্রিপুরার ইতিহাসের একটি বৃহৎ অধ্যায় অদেখাই
থেকে যাবে।