“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৩

হীরুদার লাঙল এবং জমি-জিরেতের কথা...



(লেখাটি প্যাপিরাস ই-পত্রিকার , ২০১৩র শারদ সংখ্যা এবং তিনসুকিয়ার ছোট কাগজ 'উজানে' প্রকাশ পেয়েছে। --সুশান্ত  কর)
                     “তুই আমার মাটি কেটে চলে যাওয়া অবাধ লাঙল,
                      নেহাই চিকন লোহার ফাল”
এ সেই খ্যাতনামা কবির কবিতা যিনি লিখেছিলেন,
                  “মৃত্যুও তো এক শিল্প
                  জীবনের কঠিন পাথরে কাটা নির্লোভ ভাস্কর্য”

  
দ্বিতীয়টি বহুবার শুনেছেন অসমের মানুষ যারা কবিতা পড়েন তাঁরাও। যারা পড়েন না তাঁরাও। কেননা তাঁর কবিতা দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে বহুবার বহুভাবে। অবশ্যই অসমিয়া ভাষাতে। তিনি হীরেন ভট্টাচার্য। কিছুতেই ভাববেন না কবিতা দু’টো আমরা অনুবাদ করলাম বলে। প্রথমটি কবির নিজের লেখা, আর দ্বিতীয়টি রমানাথ ভট্টাচার্যের অনুবাদ। রমানাথ ভট্টাচার্য অসমের সেই প্রবাদপ্রতীম শিক্ষক-গবেষক পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের ভাইপোর দিকের পৌত্র, অসমের বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি । ১৯৯২তে ‘আধুনিক অসমীয়া কবিতা’ নামে একটি অনুবাদ সংকলন বের করেছিলেন। বিশ শতকের শেষার্দ্ধের সমস্ত অসমিয়া কবিদের বাংলা ভাষার পাঠকদের সঙ্গে বোধকরি এক সুপরিকল্পিত উপায়ে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ইনি । এর আগেও এঁরা অপরিচিত ছিলেন তা নয়। নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ভাবে। এমন একত্র উপস্থাপন এর আগে হয়েছিল বলে আমরা জানি না। সেই সংকলনে হীরেন ভট্টাচার্যেরও একাধিক বিখ্যাত কবিতা ঠাঁই পেয়েছিল । তার মধ্যে ‘জোনাকি মনে’র এই কবিতাও ছিল। রমানাথ এখন মুম্বাই প্রবাসী । সেখানে তাঁর  স্থাপিত রমানাথ ভট্টাচাৰ্য ফাউণ্ডেশন ২০০১তে হীরেন ভট্টাচার্যের জীবৎকালেই ‘পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে’ তাঁকে সম্মানিত করেছিল। সেই সংকলনে রমানাথ বেশ কিছু কথা লিখেছিলেন কবির সম্পর্কে। তারমধ্যে এই কথাটি আসলেই হীরেন ভট্টাচার্যের কবিতার পরিচয় সার, “ তাঁর কবিতা সঙ্গীত ধর্মী, চিত্রপ্রধান; গদ্যভঙ্গীমায় তিনি কথা বলেন, সুন্দর চিত্রকল্প তিনি ব্যবহার করেন।” যে পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে এই বাক্য লেখা সেগুলো ইউরোকেন্দ্রিক আধুনিকতার যুগে খুব চলত। বাংলা কবিতা আলোচনাতে এই সব পরিভাষা এখন স্কুলবই ছাড়া আর তেমন বিশেষ কোথাও চলে না। বিশেষ করে ‘চিত্রকল্প’ শব্দটি—ইউরোপের ইমেজিস্ট কাব্য আন্দোলন থেকে আমদানি। বুঝে না বুঝে এককালে সমালোচকেরা খুব ব্যবহার করতেন। অথচ  যদিও সমার্থক নয় ‘চিত্রকাব্য’, কথাটি ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রে অপরিচিত ছিলনা কোনদিনই। সে যাক, দেখা যাবে সত্যি এই ছবি আর গানের প্রতি এক আশ্চর্য আকর্ষণ আছে হীরেন ভট্টাচার্যের। উপরের দ্বিতীয় কবিতাতে সে ইঙ্গিত স্পষ্টই আছে। তার একটি অসমিয়া কবিতাতে আছে,
             “কবিতা এটা আরম্ভ করা টান।
             পোনপটীয়াকৈ একোয়েই উজু বাটেরে
            মোর কলমলৈ নাহে।
          সুরে মোক আগতেই ধরা দিয়ে।...” ( র’দত তিরেবিরাই)
 
প্যাপিরাসে চলে আসুন
কবিতাটির শুরুতেই একটি অতিবাক্য আছে তৃতীয় বন্ধনীতে-- [মই এতিয়াও গান শুনি ৰৈ যাওঁ।] গান তিনি গুনগুনাতেন। গান লিখতেনও। অসমীয়াতে বেশ কিছু গানের সংকলন আছে, আকাশবাণীতে শিল্পীরা সেই ১৯৬৯ থেকেই তাঁর গান গেয়ে আসছেন। বাংলাতে তাঁর তৃতীয় বইটি গানের। একুশটি গান, আশা করেছেন কেউ সুর দেবেন আর গাইবেন। নাম ‘বৃষ্টি পড়ে অঝোরে’। এই বইয়ের প্রতিটি গানের ( আমাদের মতে কবিতাই) সঙ্গে রবীন বর এঁকে দিয়েছেন আশ্চর্য সব  জল রঙের সাদাকালো ছবি—এতেই বোঝা যায় ছবির প্রতি যে তাঁর প্রবল আকর্ষণ। । তিনি নিজেই রঙে রেখাতে আঁকতে পারতেন। জানেন তিনি আঁকা। হয়তো বিনয়বশত নিজে সেটি করেন নি। কিন্তু করেছেন শব্দের সেই একই কাজ শব্দের পরে শব্দ জুড়ে । এই যেমন শেষ কবিতাটিঃ
              গান সেধেছি
             জলে বাতাসে, পাল গুটিয়ে, হাল থামিয়ে
             সারাটা দিন, সারাটা রাত।
             বুকে কান্না, মুখে হাসি---
             থামেনা আমার হাতের মুঠোর কাঁচা বাঁশের বাঁশি
             বুকের ভেতর দিচ্ছে দোলা, শব্দমালার জমি-জিরেত
            আসুক ঝড়-বৃষ্টি—
           বুক চিতিয়ে আড়ে বহরে দিচ্ছি পাড়ি
           আড়া-খাঁড়া একরোখা নদী
           ঝমঝম যেন চলে দেমাকে রাতের রেলগাড়ি।
           নৌকা আমার এগুই-পিছোই
           গান সেধেছি বুক নিংড়ে
           সুর বেঁধেছি আঁচা-আঁচি কথার একবজ্ঞা একাবলি।
           গান যে আমার গাঁ –গঞ্জের এগারো ভাটির ভাটিয়ালি...।
বহু অসমিয়া –বাঙালি কবিকে নিশ্চয়ই মনে পড়বে এই কবিতা পড়ে। কিন্তু এমন ছবি আঁকাটি তাদের কবিতার সাধারণ ধর্ম নয়। তারচেয়েও বড় কথা এগুলো ঠিক স্থিরচিত্র নয়। যখন রবীন বরের আঁকা স্থির ছবিটি দেখছিলাম, তখনই মনে হলো এই কবিতার গতিময়তাকে স্থির ছবিতে ধরা কঠিন। যদিও ভালো স্থির ছবিমাত্রেরই একটি গতি আছে, সে দ্রষ্টা মনকে দুলিয়ে ছাড়ে ‘রাতের রেলগাড়ি’র মতো। অতএব রবীন বরের ছবিতেও আছে, কিন্তু এগুলো বলে অন্য কথা। নিয়ে যায় অন্যদিকে। এগুলো বাড়তি প্রাপ্তি। কবিতার পাশে অলঙ্করণ হিসেবেও মন্দ নয়, কিন্তু কবিতাকে ধরিয়ে দেয় না বড়ো। বা সম্প্রসারিতও করে না। এই কবিতাটির সঙ্গেই যে ছবি আছে, মনে হয় যেন ঝড়ে বিধ্বস্ত জাগাজ ঘাটার ছবি সে। বাঁশি যদি বা বাজেও তবে সে বিপদ সংকেত। অথচ কবিতাতে ঝড়ের কথা থাকলেও ভাবটি বিপরীত। আর যেটি লিখছিলাম, এর সবটাকে ধরা কঠিন স্থির ছবিতে। সেটি চলচ্চিত্রে সম্ভব। পাশাপাশি দু’টো ছবি ‘বুক চিতিয়ে আড়ে বহরে দিচ্ছি পাড়ি’ কেমন সে পাড়ি? না, ‘ঝমঝম যেন চলে দেমাকে রাতের রেলগাড়ি’ এসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা অন্য কবিদের কবিতাতেও দুর্লভ তেমনও নয়। কিন্তু সে আস্ত কবিতাজুড়ে নয়, এই যেমন হীরেন গোঁহাঞির একটি কবিতার টুকরোতেই বোঝা যাবে , উৎপ্রেক্ষা আছে, কিন্তু ছবি নেই,
        “ হঠাৎ অচেনা লাগে ঘুর্ণিজলের ধ্বনিঃ ভালো খাওয়া হয়েছে দাসের বিয়েতে
        আবার সাহা কিনেছে কি মাটি সস্তায়
        তোষামোদের
       কতনা নতুন অজুহাত!” (উত্তর রবীন্দ্র; আধুনিক অসমীয়া কবিতা; পৃঃ৮৮) ।
 
হীরেন ভট্টাচার্যের কবিতা এই দাস-সাহাদের উল্লেখ না করেই নিজের কথা ব্যক্ত করে। এক দু’টি কবিতাজুড়ে ছবি আঁকার প্রয়াস হয়তো অনেকের কবিতাতেই মিলবেও কিন্তু তাঁর সমগ্র কাব্যদুনিয়াটিই এই। প্রথম জীবনে তিনি একটি কাগজ করতেন ‘চিত্রবন’ নামে, পরে এই নামে একটি ছাপাখানাও চালিয়েছিলেন নিজের বাড়িতেই।

             আর কবিতার সেই ছবির বিষয়ের সন্ধানে নাগরিক কবি হয়েও গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন খুব। বৃদ্ধ বয়সেও মৃত্যুর আগে অব্দি এই স্বভাব ছিল তাঁর অটুট। লোকে তাই তাঁকে ‘হীরুদা’ বললে চেনে বেশি, মূল নামে অচেনা ঠেকে অনেক সময়---এমন কপাল আর কোন কবির হয়েছে বলে জানি না। তাঁর এই ‘মোর দেশ’ কবিতাতে ঠিকই লিখেছিলেন তিনি,
            “ দেশে-দেশে মোর বন্ধু আছে। এনে বহু দেশর অরঙে-দরঙে
              মই ঘুরিছো। বহু বন্ধুর সতে হাতে হাতে হাত ধরি ফুরিছোঁ
             কেতিয়াবা সাগর পারত, কেতিয়াবা খেজুর তলত, নতুবা
             পাহারতলিত খন্তেক জিরাইছোঁ। বন্ধুর সতে প্রাণ খুলি প্রাণর
          কথা পাতিছোঁ। তার পিছত আকৌ আরম্ভ করিছোঁ নতুন যাত্রা।” (পৃঃ১৭; হীরেন ভট্টাচার্যর কবিতা) বাংলাতে তিনি লিখেছেন,
           “ আমার ছেলেবেলার খেলা আমার সঙ্গ ছাড়েনি
          ভরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আরেকবার জলের তল ছুঁয়ে আসতে চায়...” ( ১৩ নং কবিতা, জোনাকি 
    
পংক্তিমালা, শিকড় থেকে পাতা অব্দি, পৃঃ৫৭) , তো এই নদী, জল, নৌকা, দোতারা, আকাশ, প্রজাপতি, মেঘ, রৌদ্র, শরৎ , শ্রাবণ, ঘাস, গাছ, পাখি, ধান, লাঙল এগুলো ছাড়া তাঁর কবিতাই নেই। সম্ভবত তাই, তাঁর কবিতার পাঠক তাঁকে ‘সুগন্ধী পখিলা’র কবি নামে চেনে, চেনে ‘প্রেম’ কিম্বা ‘রোদালী’র কবি বলে। ১৯৬৮-তে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতা বইয়ের নাম ‘রৌদ্ৰ কামনা’ আর ১৯৭২এ প্রকাশিত দ্বিতীয় বইটির নাম ‘মোর দেশ মোর প্ৰেমর কবিতা’। ‘সুগন্ধী পখিলা’ নামে সবচাইতে খ্যাতনামা বইটি আসলে চতুর্থ প্রকাশনা। বেরিয়েছিল ১৯৮১তে। বাকি বইগুলোর নাম দেখুন, বিভিন্ন দিনর কবিতা (১৯৭৪),শইচর পথার মানুহ (১৯৯১), ভালপোয়ার বোকা-মাটি (১৯৯৫), ভালপোয়ার দিকচৌ বাটেরে (২০০০)। সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন,বাংলা বই এর নামগুলো ‘জোনাকি মন ও অন্যান্য’, ‘শস্যের মাঠ মানুষ’। আমাদের এখনো সে দুটো পড়বার সুযোগ ঘটেনি, অনুমান করতে পারি সেখানে ২০০১সনের আগেকার লেখা অসমিয়া কবিতার বাংলা রূপান্তর রয়েছে। আমরা যে শেষ দুটো বই তুলে নিয়েছি, তার একটির কথাতো লিখলামই, অন্যটি কবিতার বই। বলেছেন,নিজের কবিতার নিজে অনুবাদ করেছেন। কবি যখন করেন, তখন কি আর অনুবাদ থাকে? আমরা এই প্রশ্নের মীমাংসা করব পরে। কাজটি তিনি করেছিলেন আগেই, কিন্তু প্রকাশ করেছেন গানের বইটির পরে ২০১১তে। নাম ‘শিকড় থেকে পাতা অব্দি। গানের বইটির বিষয় সেই বৃষ্টিই। বাঁশের ঝাড়ে, গাঁ –গঞ্জে, নদীর পাড়ে, কচি ঘাসে ‘গান যে আমার গাঁ –গঞ্জের এগারো ভাটির ভাটিয়ালি...।’ সেদিক থেকে বৈচিত্র আছে কবিতা বইটির। আমরা সেটিকে বরং খানিক নিবিড় পাঠে বুঝে নেবার চেষ্টা করব। কিন্তু যেহেতু কবি মানুষটিকে বুঝে নিতে হবে, তাই অন্যান্য অসমিয়া কবিতার আশ্রয়ও কিছু নিতে হবে। ২০০১এ অসম উপত্যকা পুরস্কার নিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কবিতার বাহিরে কবির আন চিনাকি নাই। কবির জীবন-পঞ্জী পাঠকর বাবে অর্থহীন।” কথাটি মিথ্যে নয়। আমরাও তাই করব, কবিতা দিয়েই বুঝে নেব তাঁকে। কিন্তু সমালোচকের কাজ চলেনা, জীবনকে একেবারে না ছুঁলে।

            
১৯৩২এ যোরহাটে জন্মেছিলেন তিনি । ফলে চল্লিশের দশকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভাদের নেতৃত্বে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের যে ডামাডোল শুরু হয়, তিনি তার থেকে দূরে ছিলেন না মোটেও। এদের দেখেছেন, শুনেছেন, এক সঙ্গে কাজও করেছেন। ষাটের দশকে প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের অসম শাখার তিনি উপসভাপতিও হয়েছিলেন। তার মানে তখনকার বহু কবি সাহিত্যিক শিল্পীর মতো শিল্পী জীবনের শুরুতেই তিনি সাম্যবাদী আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। পরে যদিও তিনিও এই সঙ্ঘগুলোর সংস্পর্শ তখনকার অন্য অনেকের মতো ছেড়েছিলেন, নাগরিক প্রতিষ্ঠানের অলিতে গলিতে তাঁকে দেখা যায় নি তেমন। গেলেও সে হাঁসের জলে সাঁতার কাটার মতোন, তাঁর “অন্তর্জলি কান্নার জলে/ সাঁতার কাটছে এক ঝাঁক বুনো হাঁস/ তাদের ডানায়-পাখায় ঝলমলে রোদ। স্মৃতি নাড়া দিলে ঝরে পড়ে তরতাজা শব্দ--” (বৃষ্টি পড়ে অঝোরে; পৃঃ২১) তাঁর বিপরীত রাজনৈতিক বিশ্বাসের লোকেরা , বিশেষ করে উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা অনেকেই তাঁর কবিতাতে দেয়াল লিখেছে, পোষ্টার সেঁটেছে। সেগুলোও তিনি ভালো নজরে নেন নি , কোনদিন। নাগরিক জীবনের কালো ধোঁয়ার কথা লিখেছেন তাঁর কবিতায়, কিন্তু সে শুরুর দিকে যেমন কিছু কবিতাতে মেলে, জীবন যত এগিয়েছে মেলেনা আর। এই যেমন ১৯৬১তে লেখা ‘নাগরিক’ কবিতাতে তাঁর উচ্চারণ ,
                “ কলঘরর ক’লা ধোঁয়াই
               এদিন আকাশত বিজুলি জ্বলাব,
               রাস্তার কাষর এইজাক ল’রাই
              জীবনর বাটে-বাটে ফুল ফুলাব,
              ব্যাধিগ্রস্ত এই নগরে এদিন
             আকাশলৈ মুর তুলি ক’বঃ বতাহ ইমান কোমল।” (পৃঃ ১৬) সেই বহল আকাশ, কোমল বাতাসে তাঁর আজন্ম মোহ। ‘আহিনের লেণ্ডস্কেপ’ কবিতাতে ( ১৯৬৫)
               ‘শেষ হৈ গ’ল
             লুব্ধ আকাশর হিংস্র উৎসব...’
 এর কয়েক পংক্তি পরে যখন লেখেন
            ‘র’দালির ভাঁজে ভাঁজে
             অপার বিস্ময়।
            আবেগত ভাগি পরে
           শব্দের তন্ময়।’ (পৃঃ ২৮ ঐ) –তখন স্পষ্ট বোঝা যায়, এই কবিতা কেবল আশ্বিনের কবিতা নয়, আরো বেশি কিছু। আর তাঁর প্রতিটি শব্দের উৎসভূমির ইঙ্গিততো বটেই। ‘মোর এই শব্দবোর’ কবিতাতে তিনি আরো স্পষ্ট করে লিখছেন
        “...মোর কোন নিজস্ব আবিষ্কার নাই,
        মোর ভিতরত এটা যেন খেতিয়ক, মই শব্দবোর জিভাত দি চাঁও,
        কার কি সোয়াদ, হাতর তলুয়াত লৈ চাও,
        কিমান তপত,
        মই জানো শব্দ মানুহর মহৎ সৃষ্টির তেজঃদীপ্ত সন্তান,
        মই সাধারণ কবি,
        কান্ধ সলনি করি বৈ অনা মোর এই শব্দবোরত
     

মানুহর নিদারুণ অভিজ্ঞতা, বুরঞ্জীর নিঠুর আঁচোর।.” এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়ুন আমাদের আগে উদ্ধৃত গানের পংক্তি “বুকের ভেতর দিচ্ছে দোলা, শব্দমালার জমি-জিরেত” –তার সঙ্গে মেলান একেবারে শুরুর দু’লাইনের কবিতাটি। একটি সংযোগ সূত্র মিলবে যেগুলো নিতান্তই কবি হীরেন ভট্টচার্যকে চেনায় আর কাউকে নয়। ‘খেতিয়ক’ শব্দটির নানান মানে হতেই পারে। এক, তিনি মাটির খুব কাছাকাছি গ্রামীণ জীবনের কবি। কিন্তু এহ বাহ্য। এখানে তিনি সঙ্গে করে এও জানিয়ে দিচ্ছেন ‘মই সাধারণ কবি’ এই সবিনয় উচ্চারণের পরেও, চাষার মতোই কী অসাধারণ যত্নে তিনি শব্দগুলোকে তুলে আনেন। আর যখন কাঁধে ফসল নিয়ে ফেরেন, তখন চাষার ফসল নিয়ে ফেরার কথা যেমন মনে পড়ে, গোটা বর্ষা ঝড় জল তুফানের সঙ্গে তার অন্যন্য সংগ্রামের কথাও মনে পড়ে। একই সঙ্গে মনে পড়ে অসমিয়া কবিতার উত্তরাধিকার তাঁর নিজের কাঁধে আসা অব্দি কত ‘বুরঞ্জীর নিঠুর আঁচোর’ সেই কবিতাগুলোকে সইতে হয়েছে , অথবা তাঁর কোন একক কবিতার পেছনে আছে শব্দ নিয়ে কাটাকুটি যন্ত্রণার কত গোপন ইতিবৃত্ত। এই যে , যা লেখা হলো, তার বাইরে পাঠক মনে নানা অর্থের দোলা দিয়ে যাওয়া ---এই ব্যাপারটি আমাদের কবিরা জানতেন। ক্যামেরা যেমন ছবি তোলে, এমন বিশদবিবরণ সহ (ডিটেলিং) ‘চিত্রকাব্য’ তাঁরা ধর্মসাহিত্যের যুগেও খুব একটা লিখতেন না। মীরা যখন গান করেন ‘মেরেতো গিরিধারি গোপাল দোসরা না কোই’—তখনো এটা সত্য। কিম্বা চর্যার এই কবিতাটাই দেখুন,
             “...ছুটন্ত সেই হরিণের আর যায় না দেখা খুর–
    ভুসুকুর এই তত্ত্ব মূঢ়ের বুঝতে অনেক দূর।” ( অনুবাদঃ সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)-- একটা তত্ত্ব আছে কবিতাটিতে, আমরা সবাই জানি সে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু যারা সে তত্ত্ব বুঝতে যাবে তাদের মূঢ় বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন কবি ভুসুকু। আমাদের মতে ভালোই করেছেন , তাতে কবিতার স্বাদ নিতে আমাদের সুবিধেই হয়েছে। বিশেষ করে হরিণের সেই না দেখা খুরের কথাটার ব্যঞ্জনা অনুভব করবার চেষ্টা করুন— অতুলনীয়! অথচ আমরা যে ছেলেবেলা পড়েছিলাম,
           “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
           কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”—এগুলো বরং আমাদের কাব্য পরম্পরাতে বিলেতি দান। বিশেষ করে টেনিসন-ব্রাউনিঙ-ম্যাথু আর্নল্ড শাসিত ভিক্টোরীয় যুগের ইংরেজি কবিতার । কবিতা হিসেবে আহামরি কিছু নয়। এগুলো নতুন যুগের নীতি কথা। কথা হিসেবে ভালো, কিন্তু কবিতা হিসেবে মোটেও নয়। যারা লিখেছিলেন, পশ্চিমা শিক্ষার ফলে তাঁরাও তারা বিশ্বাস করতেন , আমাদের সমস্ত প্রাচীন সাহিত্য ধর্মীয় নীতিকথাতে পরিপূর্ণ, এখন কবিতাকে দেশীয় জাতীয়তাবোধের কথাতে পরিপূর্ণ হতে হবে। আদর্শ নাগরিক গড়ে তুলতে হবে, পাঠককে চরিত্রবান করে তুলবার দায় কবিকে নিতে হবে। অথচ, এটা ঘটনা ছিল যে যেগুলোকে আমাদের ধর্মীয় নীতিকথার বালাই বলে মনে করা হতো সেগুলোর অনেকটিতেই পরস্ত্রী লুলোপ শিব ঠাকুরকে বৌ পার্বতীর মারের চোটে অনেক সময় কাপড় ছেড়েও পালাতে হতো। তারমানে ইচ্ছে করলে, আপনি ‘নারীবাদ’ও সেখানে পেতে পারেন। কিন্তু সে কথা গুরুত্ব্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো সেগুলো সাহিত্য রসে এবং গুণে পরিপূর্ণ ছিল। বরং নজরুল যখন শ্যামাসঙ্গীত লিখলেন, সেগুলোতে অনেক নীতিকথা ছিল। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেও সেই পরম্পরারই ছাপ মিলবে। তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ কবি আখ্যা দেয়ার মধ্যেও কিন্তু এই কবিতা বহির্ভূত ভাবনাটিই ঠাই পেয়েছিল। ঠিক তেমনি তখন বাংলাতে অনেক ‘দুঃখবাদী’, ‘দেহবাদী’ ইত্যাদি কবিও দেখা দিয়েছিলেন। অথচ, এই অভিধাগুলো আসলেই এইসব কবিদের ছেটে ছোটো করেছিল। তাদের পরিচয়ের সবটা এতে ধরা পড়ত না। ব্যাপারটি অসমিয়া কবিতাতেও মিলবে। কেননা, বাংলা কবিতার পরম্পরার সঙ্গে তাঁরা পরিচিত ছিলেন খুব । আর না থাকলেও পশ্চিমী চিন্তার প্রভাবটিতো আছেই। কবিতার সেই একই ভাবনাস্রোত বহু ‘বামপন্থী-প্রগতিশীল’ কবিকেও কবি হতে দেয় নি। তাঁরা নিজেরা দেশ ,সমাজ নিয়ে যেমন যেমন ভেবেছেন, আশা করেছেন তাদের পাঠকও ঠিকঠাক তেমন তেমন ভাববেন—এবং তাঁদের চেতনার উত্তরণ হবে। রাবীন্দ্রিক পরিভাষা ধরে বলতে পারি, রূপের তথ্যটাকেই সব ভেবে নিতেন, ‘অরূপে’র সত্য অব্দি পৌঁছুতেন না। হীরেন ভট্টাচার্য সেই আবহাওয়াতেই শুরু করেছিলেন। সুতরাং তাঁর মধ্যে সেরকম ভাবনা ছিল না নয়, কিন্তু কেমন বেরিয়ে এসছিলেন, তার নজির ‘সাংকেতিক ধ্বনি’ কবিতাটি,
                “চহরীয়া বাহবার কী মূল্য গাঁয়ে –ভূঁয়ে যদি নোতোলে গির্জনি?
                নিপুণ কবির স্বাক্ষরবাহী কবিতা যেতিয়া
                 নষ্ট শস্যর মনোজ্ঞ বিজ্ঞাপন,
                নিষ্ঠাবান বিব্রত হোয়াটো স্বাভাবিক,
                মোর শরীরর তন্নতন্নত বিয়োগ গ্লানি,
                নিয়তি মই নেমানো, আতংকিত তেজ মোর
                একো- একো রাতি সমুদ্রর দরে গর্জি উঠে, ধ্যানকেন্দ্রী মুহূর্তর
                ক’ত সেই সাংকেতিক ধ্বনি?” (পৃঃ১০২, হীরেন ভট্টাচার্যর কবিতা)

   
যে ভাবনাবৃত্তের কথা বলছিলাম তার বাইরে গিয়ে সেই পশ্চিমেও বিশ শতকের শুরুতে শুরু হয়েছিল ‘সিম্বলিস্ট’, ‘ইমেজিস্ট’ , ইত্যাদি কাব্য আন্দোলন—আমাদের কবিরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাংলা কবিতাতে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটি আলাদা। তিনি দেশীয় কবিতার পরম্পরাকে খুব ভালো জানতেন, বুঝতেন। ফলে বিদেশী পরম্পরার সঙ্গে পরিচিত হলেও সেই ঝড়ে স্বয়ং উড়ে যান নি। কিন্তু অন্য অনেকে গেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বেশি বয়সে যারা নিজেদের আধুনিক বলে ঘোষণা করছিলেন তারা তো বটেই। তাদের থেকে সরে দাঁড়ালেন আবার জীবনানন্দ। সম্ভবত তাই জীবনানন্দকে এসে লিখতে হয়েছিল, “সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি” । রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষমাত্রেই শিল্পী’ কথাটির বিপরীত উচ্চারণ-- এই কথাটি অবশ্যি বাংলা তথা ভারতীয় পরম্পরাতে এক বিপরীত আভিজাত্যবোধের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু কবিতার স্বরূপ নিয়ে ভাবতে সবাইকে বাধ্যও করেছে। আমরা যেগুলোকে কবিতা বলে চিনি, অধিকাংশই আসলে ‘নষ্ট শস্যর মনোজ্ঞ বিজ্ঞাপন’— এই সত্যটি অনেকেই উপলব্ধি করতে শুরু করেন। কবি জীবনানন্দের এবং তাঁর সমকালীনদের সঙ্গে অসমিয়া কবিদের পরিচয় ঘটেছিল অচিরেই। সুতরাং হীরেন ভট্টাচার্য অপরিচিত ছিলেন এমন নয়। অনেক সমালোচক লিখেও দিতে পারেন তাঁর কবিতা পড়ে যে তিনি ‘ইমেজিস্ট বা সিম্বলিস্ট বা পরাবাস্তববাদী’ কাব্য আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমরা সেরকম বলতে চাইনা। তিনি আড্ডা দিতে ভালোবাসলেও বক্তৃতাতে খুব কম কথা বলতেন, এবং আমরা যেগুলো পড়েছি সেগুলোতে এই সব পশ্চিমা ‘আধুনিক কবিতা’র পরিভাষা খুব পাইনি। মনে হয়, গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বিহু সহ আমজনতার কাব্য পরম্পরার সঙ্গে তাঁর যে পরিচয় ঘটেছিল তাতে তিনি সেই সব পোষাকী পরিভাষার দরকারও বিশেষ বোধ করেন নি। সম্ভবত তাই তাঁর সুবিখ্যাত উচ্চারণ,
             “ গুণগুণনিতে
             কঁপে গছর ছাঁ, পাতর আগর র’দ
             একেটা ফুটতে
             মোর বুকুত উবুরি খায়
             অবোধ দিন
            এতিয়াও যার পোষাকী নাম দিয়া হোয়া নাই!
           ...কবিতা মূলত স্বাধীন, স্মৃতি তার সুগন্ধি পখিলা!” ২০০১এ অসম উপত্যকা সাহিত্য পুরস্কার নিতে গিয়ে তিনি বলছেনও, “ সকলো সৃষ্টির উৎস হৈছে লোকজীবন। লোক-জীবনর অভিজ্ঞতাই কবিতাক প্রাণবন্ত করে। ঐতিহ্য আমার কেবল অতীততেই নহয়। বর্তমানরো আধার।ঐতিহ্যর রূপ আরু রূপান্তরেই হৈছে কবিতার আধার...” ১৯৮৬তে অসম সাহিত্য সভার ৫২তম অধিবেশনে কবি সম্মেলনের সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি যখন বলছেন, “কবিতার শব্দ কেবল শব্দই নহয়, ই ধ্বনিও।” তখন সোজা আমাদের মনে পড়ে পুরোনো ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রের ধ্বনিবাদের কথা। তিনি আরো বলছেন, “কবিকণ্ঠর এটা শব্দ যেতিয়া প্রতিধ্বনি হৈ আমার কাষলৈ উভতি আহে সি জানো সেই পুরণি অবয়বেই ? শব্দর এই বাঢ়ি অহা কারণেই হৈছে কবির নিপুণতার চিনাকি। কিন্তু শব্দই জানো কবিতা? শব্দর অর্থই জানো কবিতা? শব্দর আভিধানিক অর্থই যদি কবিতার অভ্যন্তর প্রবেশর সঁচার-কাঠি হ’লহেঁতেন, তেনেহ’লে আজির কবিতার দুরুহতার বহু অভিযোগর অবকাশ নেথাকিলহেঁতেন। কবিয়ে জীবন পাত করে তেনে শব্দ সন্ধানত যার আবাহনী ক্রিয়াই আনি দিব পারে নতুন মাত্রা। ‘
           কবিতা জীবনর অন্য বিষয় কুশল, অন্য প্রত্যাশা
           শব্দ সংঘ ভাঙি তিরবির বন তুলসীর
       উজারি লুকুয়া সুগন্ধি দীঘল উপত্যকা।’” এর পরেই তিনি লিখছেন মোক্ষম কথাগুলো যা একজন নীতিবাগীশ থেকে কবিকে আলাদা করে, “ ...রোমাণ্টিক যুগতো কবিক কোয়া হৈছিল দ্রষ্টা-শিক্ষক। কবিতা আছিল কবির বাণী। সময় সলনি হোয়ার সতে কবি সম্পর্কে অভিধাও সলনি হৈছে। কবিও আন দহজনর দরে দোষে-গুণে মানুহ। আবেগ অনুভূতি একমাত্র কবিরেই আছে এই কথা জানো ন-দি ক’ব পারি? কবির আটাইতকৈ ডাঙর গুনটো হৈছে নিজর সৃজনশীল, মননশীল বিচিত্র ভাবনার বাহন স্বরূপে শব্দ ব্যবহার করার ক্ষমতা। এই প্রখর শব্দবোধেই কবিক আন মানুহর পরা পৃথক করিছে। কবিতা কবির শ্রাব্য কল্পনা। পাঠেই কবিতার জীবন। শব্দর শিল্প কবিতা ছপার আখরতেও আবদ্ধ নহয়। ই যে কণ্ঠরো শিল্প!...কবির পাঠে বর্ণক উন্মোচন করে শব্দলৈ, শব্দক ধ্বনিলৈ, আরু ধ্বনির অনুরণনে কবিতাক লৈ যায় জীবনর বোধি-মূললৈ।” বোঝা যাচ্ছে তিনি যদিও ধ্বনি বলতে শব্দের কানের শোনার দিককে বোঝাচ্ছেন, আসলে শব্দের আভিধানিক অর্থকে ছাড়িয়ে গিয়ে যে নতুন মাত্রা, নতুন ব্যাঞ্জনার্থের দিকে ইঙ্গিত করে কবিতা –তিনি সেদিকেও আমাদের বোধকে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। অর্থাৎ অনুরণনটি শুধু শব্দ ধ্বনির নয়, অর্থেরও হয়ে থাকে। সেজন্যেই একটি কবিতাতে তিনি লিখেছিলেন,
           “...শব্দও কবিতার কাষলৈ আহোঁতে
          খুলি থৈ আহে
          তার পোছাকী কাপোর” ( সাহিত্য উৎসবর তিনিদিন; হীরেন ভট্টাচার্যর কবিতা; পৃঃ১৭১) ‘ধ্বনি’ বলতে সেই অর্থের অনুরণনকেই বোঝাতেন আমাদের প্রাচীন সাহিত্যশাস্ত্রীরা। তাঁরা বলতেন, ‘কাব্যস্যাত্মা ধ্বনি’ । ধ্বনিই কাব্যের আত্মা। এই ধ্বনি আছে বলেই এই কথাও সত্য, ‘পাঠেই কবিতার জীবন।’ ছবি সম্পর্কে এই রবীন্দ্রোক্তি সত্য ‘চোখের ছবিতে মন আপনার ছবি জুড়িয়া দেয় তবেই সে ছবি মানুষের কাছে সম্পূর্ণ হইয়া ওঠে ।’ (ছবির অঙ্গ, পরিচয়, রবীন্দ্ররচনাবলী) এবং গান সম্পর্কে সত্য তাঁর এই উচ্চারণ, “একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে —/গাহিবে একজন খুলিয়া গলা , আরেক জন গাবে মনে” (গানভঙ্গ,কাহিনী, রবীন্দ্ররচনাবলী)

         এবারে আমাদের মনে হচ্ছে আমরা হীরেন ভট্টাচার্যের বাংলা কবিতার যেগুলো আমাদের হাতে আছে সেগুলো বুঝবার কিছু সূত্র হাতে পেয়ে গেলাম। আমরা এই কবিতাটি দিয়েই শুরু করি।
                “ মাথা নত করে ছুঁয়ে এসো মানুষ-মাটি
                  স্পর্শ করো প্রতিজন সৎ কবির কবিতা, অকুতোভয় ভালোবাসা
                  গ্রহণ করো মানুষ সম্পর্কীয় সুগভীর পাঠ, মাতৃভাষার দীপ্ত বর্ণমালা
                 পরিণত ভালোবাসার গানে ভরিয়ে দে শব্দ প্রতিমার ঘর
          প্রদক্ষিণ করো মানুষ মাটি।” (প্রদক্ষিণ করো মানুষ মাটি, শেকড় থেকে পাতা অব্দি, পৃঃ৮৭) একেবারেই সহজ কথা, সহজ বক্তব্য। বামপন্থী প্রগতিশীলেরা যেমন ভাবতেন, সেই কথাগুলোই আছে। তারপরেও দেখুন তিনি কেমন নামঘর বা মন্দির পরিক্রমা করা ভক্তদলের একটা ছবি এঁকে ফেলছেন। ছবি যে ‘ধ্বনি’টি তোলে তার গুনে কেউ ভাবতেই পারেন, বোধকরি চেনা ‘ভকতে’র ‘ভক্তি’কে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। আর দল ভাবতেই পারেন , কবির ভক্তির বিষয়কে পালটে দিয়েছে এই কবিতা। সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছে কবিতা নির্মাণের ব্যাকরণ। একেই বলে লোক উৎস থেকে পাওয়া ঐতিহ্যের নবনির্মাণ। এমন আরো আছে, গাছের বড়ো হয়ে উঠা আর পাখির কলকাকলি শুনুন,
               “ শিকড়টা আড়ালে আড়ালে অনেক দূর গিয়ে পৌঁছোল। পাথুরে মাটিও
               সহজে পেরিয়ে গেল। কিংবদন্তির দরজায় কড়ানাড়া দিয়ে এখন আমার বুকে
               ছটফটিয়ে আছে স্মৃতি।আমার গায়ে গা রেখে মেলে দিয়েছে ঝিমোনো ডানা।
               নদী- দহ আন্দোলিত প্রকৃতি শব্দমালার কোনো নির্জন বিছানায় হারানো শব্দ খুঁজে
               আড়াআড়ি শুয়ে আছে আমার ভিতরে বয়ে চলা ভাষার দ্রাঘিমা;
                ভালোবাসার দেশ-দেশান্তর...” (কবিতার অভিঘাত, পৃঃ৪৩)

তেমনি আছে,

           “... আমি কাগজ-কলম হাতে নিয়ে বসলাম, যদি একটিও কুড়োতে পারি;
           মানুষের বুকে এতো ঢেউ, এতো সর্বজনীন মানুষের বুক---
          শব্দবান মাটির দিকে চেয়ে আমি মাথা নিচু করে রইলাম। ( মানুষের বুকের ঢেউ; অংশ; পৃঃ ৪৫) এই শব্দবান মাটির দিকে তাকানোর কথাই আরেকটি কবিতাতে আছে এরকম,
         “ আমি এক দৃষ্টে ভাষার শেকড়টায় তাকিয়ে ছিলাম। কেউ আমাকে
        সুঠাম গাছটা আঙুল তুলে দেখালো।” (ভাষাবন্ধন, পৃঃ৬৭) স্মরণ করুন বইটির নাম ‘শেকড় থেকে পাতা’। একটা কবিতার আরম্ভ কেমন করে হয়?
        “ একটা দীর্ঘ কবিতার আবেগময় আরম্ভ যেন--
         আমার রক্তে সজীব হয়ে উঠেছে একটা শুকনো মাঠ--
        তার চারদিকে গজিয়ে উঠছে নলখাগরার চারা
        আমি তোর কোলে মাথা রেখে স্বপ্ন দেখছি
        আমার উঠনটার চিকন ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে
        কোনো আমলকী বনের
        একজোড়া চিতল হরিণ
        আর হাসি-খুশি রোদের সরষেখেতটাতে
        গুনগুনিয়ে আছে আঁঠালো একঝাঁক জিরোনো মৌ। ...( একটা দীর্ঘ কবিতার আরম্ভ; পৃঃ ৩১) কখনো বা সেই কবিতা লেখা হয়েও উঠে না,
         “ আমার শরীর জুড়ে ব্যাকুলতা, গাছগাছালির সবুজ
         বীজের চারা জন্যে রাখা ধানমুঠো হাতেই ভিজে উঠেছে
        ছিটিয়ে দিলেই শেকড় ধরবে
        মাঠে নতুন জল আসার শব্দ শুনছি , ঢল ভেঙ্গে আসছে
        জল ভেঙ্গে আসছে শস্যমুখর দিন
        আমার রক্তে কান্নাজলের আলতো গন্ধ
        হেলে পড়েছে ধানের চারা...( ঢল ভেঙে আসছে, পৃঃ ৪০) এবারে এই কবিতাকে ইচ্ছে করলেই যে কেউ কবি, কবিতার সঙ্গে অসম্পর্কিত করে পড়তে পারেন। কেউ এতে ফী-বছরের বানের যন্ত্রণার সন্ধানও করতে পারেন, বা অন্যকিছু। আমরা আসলে তাঁর কবি সত্ত্বার স্বরূপ ধরতে গিয়ে এভাবে পড়ছি। সঙ্গে যে কথাটি অবশ্যই বলে দিতে চাই, কবিতা তার লেখাতে অবশ্যই কখনো ধান, কখনো সরষে, কখনো বা অগুল্ম বৃক্ষ, কখনো বাঁশঝাড়, আর বুকের ভেতরেই তিনি লালন করেন সেইসব ফসলের জমি-জিরেত , অথবা যেমন দাবি করেন বাস্তব জমিজিরেত থেকেই সংগ্রহ করেন ‘শব্দমালা’ যেখানে ‘স্মৃতি’ হয়ে বেড়ায় কখনো সুগন্ধি পখিলা, কখনো বা গুনগুন করে মৌ, কখনো আলোর শিশির ছড়ায় জোনাকিরা। এরা যেমন বীজ ছড়ায়, ফসল ফলায়, সবুজ করে মাটি। ‘মাটির মাতৃভাষা সবুজ’ একটি কবিতার প্রথম সারি (মাটির মাতৃভাষা, পৃঃ ৭৬)। কবি নিজেকে অধিকাংশ সময়ে ‘খেতিয়ক’ বা চাষা বলে কল্পনা করছেন, সে বলুন বা নাই বলুন বোঝাই যায়, কখনোবা ইচ্ছে করেন লাঙল হয়ে উঠবার। একেবারে শুরুতে উদ্ধৃত কবিতার মর্ম কথাটিতো এই। একটি কবিতার নামেই তো ইচ্ছে জানালেন, ‘আমাকে লাঙলের ফলা করে গড়ে নে’ (পৃঃ৩৪) এমনকি শিল্পী প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়াকে নিয়ে যখন লিখছেন, কী লিখছেন?
               “ তুই গান গুটিয়ে চলে গেলি”
গান নয়তো যেন ধান! এরপরে লিখছেন,
              “ তোর দোতারাখানা সেভাবেই
                অগোছালো হয়ে পড়ে আছে
                উঠোনটাতে”
দোতারা নয়তো যেন লাঙল।
              “ছেঁড়া তার দুটো দুধারা চোখের জল”
 আশ্চর্য সুন্দর পংক্তি। কিন্তু এখানে থামলে চলবে কেন! শেষ পংক্তিটি,
              “ উজিয়ে বয়ে চলেছে মাটির সুরে” ।

স্মরণ করুন , রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরি’ কবিতাটি। মনে পড়বেই। কিন্তু কিছুতেই দুটো কবিতা এক নয়। প্রতিমা পাণ্ডের গান এখনো বাজে, সেই গান পড়ে থাকা দোতারার চোখের জল। তাও আবার ‘উজিয়ে’ চলেছে! তার মনে সে চলেছে আরেক নতুন সৃষ্টিমুখের দিকে। বাঙালি আঁকিয়ে সুশীল সাহা ঘোড়া আঁকবার জন্যে বিখ্যাত। চিত্রশিল্পী তিনি । কিন্তু যা বলবার বলেন এই ‘ঘোড়া’তেই । যারা বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে হিরণ মিত্রের আঁকা দেখেছেন ভালো করে , জানেন কীভাবে তাঁকে চেনা যায়। বক্ররেখার বিচিত্র গতির ভেতরে বা বাইরে কোথাও একটা অমসৃণ চতুর্ভুজ থাকবেই। কবি হীরেন ভট্টাচার্যকে চিনতে গেলে আপনি ধান –লাঙল-জমিজিরেতের কথা পাবেনই পাবেন। এরপরে সে আপনার ইচ্ছে আপনি এসবের কীই বা অর্থ করবেন। কিন্তু কোন এক বা দু’টি শব্দের অর্থ করে নেবার আগে আমাদের অনুরোধ থাকবে, সমগ্র কবিতাটি যে ছবি রচনা করে সেটি একবার দেখে নিতে। ভুল করলে কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলবার সমূহ সম্ভাবনা।

            সেই ছবি রচনাতে তিনি প্রায় ভুল করেনই না। ছবির যে সৌষম্যের জোরে রবীন্দ্রকথিত ‘রূপের মধ্যে অরূপে’র প্রকাশ ঘটে, যাকে আমরা আগে ‘ধ্বনি’ বলেছি, সেই সৌষম্যগুণটি তাঁর আয়ত্বে বলেই তাঁর ‘জোনাকি পংক্তিমালা’র খুদে কবিতাগুলোও পাঠক পেয়েছে বিশাল। অসম উপত্যকা পুরস্কার নিতে গিয়ে তিনি হিন্দি কবি অরুণ কমলের একটি আশ্চর্য পংক্তি উদ্ধার করেছিলেন, ‘সারা লোহা উন লোগোঁকা, অপনি কেবল ধার’ । কথাটা একই --‘ধার’ আর ‘সুষমা’। একটি কবিতাতে তিনি কেন যে লিখেছেন, ‘মোর অক্ষরবৃত্ত চাকত গঢ়া শব্দ-গাঁঠনি’ ( শব্দরূপ; হীরেন ভট্টাচার্যর কবিতা, পৃঃ২৩৪) –এ আমাদের কাছে এক প্রশ্ন। ‘অক্ষরবৃত্ত’ একটি ছন্দের নাম। তিনি সেই ছন্দে লেখেননি, এখানে শব্দটির অন্য মানে। লিখেছেন তিনি গদ্যে, কবিতাতেই তার স্বাক্ষর আছে, “ক’তো গদ্যর উজ্জ্বলতা নাই/ বর ফিকা হৈ গৈছে মোর কবিতা।” ( বীজ; ঐ; পৃঃ১৮৮) এমনকি আমরা যে বাংলা গানের বইটির কথা লিখলাম এবং একটি গান তুলেও দিলাম, সেখানেও দেখুন পনেরোটি পংক্তির মধ্যে অন্ত্যমিল আছে শুধু তিনজোড়া। সবগুলোই এরকম। ফলে যিনি শিল্পী নন, গানের মাস্টর মাত্র—তিনি সাহসই করবেন না এইসব গানে সুর বসাতে। হ্যা, কিছু কিছু জায়গাতে অসমিয়া শব্দগঠন থেকে গেছে বাংলাতে । এই যেমন ‘গর্জেথাকা শ্রাবণের আকাশখানা’ ( শ্রাবণের খেতজমিতে একদিন), বা ‘পাতল জিভে নুনের মহার্ঘ স্বাদ দিয়েছিস’ ( ধান যখন গা-ভারী হয়), ‘পাতল মেঘের আড়ালে ঢু মেরেছে চাঁদ’ (অন্য এক গান) ‘স্পর্শ করো প্রতিজন সৎ কবির কবিতা’ ( প্রদক্ষিণ করো মানুষ-মাটি) । এই নিয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। ভূমিকাতে ‘অনুবাদে মাতৃভাষার গন্ধ খানিকটা লেগে থাকতে পারে’ লিখে মার্জনাও চেয়ে রেখেছেন, যদিও অরুণ সেন সেই কবিতাগুলো দেখেও দিয়েছেন। দুই- একটি কবিতাতেতো এমন ভুল এক নতুন মানেই এনে দিয়েছে ।যেমন আমাদের উদ্ধৃত গানটিতে, ‘নৌকা আমার এগুই-পিছোই” । ক্রিয়াপদ দু’টিতে অসমিয়া প্রথম পুরুষে জায়গাতে বাংলাতে জুড়ে গেছে উত্তমপুরুষের বিভক্তি। হওয়া উচিত ছিল—এগোয়, পিছোয়।  কিম্বা  ‘ভাষাই শুশ্রূষা করে মানুষের মন’ বাংলাতে কর্তৃকারকের ‘ভাষা’ এখানে শূন্য বিভক্তি  হবার কথা, অসমিয়াতেও ‘এ’ বা ‘ই’ বিভক্তি যুক্ত হয়। কিন্তু এখানে ই যুক্ত হয়ে বাংলাতে নিশ্চিতির অর্থ এনে দিয়েছে। তার মানে ভাষা ছাড়া আর কেউ করেনা মানুষের মনের শুশ্রূষা।  আমাদের যাদের অমলেন্দু গুহ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঊর্ধ্বেন্দু দাশ, রবীন্দ্র সরকার  হয়ে হালের সঞ্জয় চক্রবর্তী, অভিজিৎ চক্রবর্তীদের কবিতা পড়বার অভ্যেস আছে আমরা জানি এখানকার বাংলাতে এমন অনেক শব্দ বা বাক্যগঠনরীতি আমরা মেনে নিয়েছি। ভাষাকে এমন গ্রহণ সমৃদ্ধ করে, যে ভাষা করতে পারে না সে দুর্বল। তবে কিনা, যেকোন ভাষার শক্তিশালী কবিরা এই গ্রহণ বর্জনের কাজটি করেন সচেতনভাবে, ভাষার ধর্ম জেনে এবং মেনে।  দুর্বলেরা করেন অচেতনভাবে— সংশয় দেখা দেয়  তিনি ধর্মটিকে চেনেন কি না। হীরেন ভট্টাচার্য বাঙালি কবি নন, তিনি দুর্বল কবিও নন---তাঁর ক্ষেত্রে এই সূত্র খাটবে না। বস্তুত ধর্তব্যের মধ্যে নেবার বিষয়ই নয় তাঁর এই ব্যাকরণের ত্রুটি। আমরা চোখ উপর দিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারি। যা পাওয়া গেল তার তুলনাতে এগুলো নিতান্তই তুচ্ছ। বরং আমাদের বিস্মিত করেছে একজন অসমিয়া কবি বাংলা কবিতা লিখতে বসে, ফলবানের সঙ্গে মিল রেখে  ‘শব্দবান’ বলে একটি নতুন শব্দ সত্যি তৈরি করে জুড়ে দিলেন বাংলা ভাষাতে! পংক্তিটি পড়ে এসছি আমরা,  ‘শব্দবান মাটির দিকে চেয়ে আমি মাথা নিচু করে রইলাম।’ এর আগে আমরা যদি  শব্দটি পেয়েছি, তবে ‘বন্যা’র সঙ্গে তুলনাতে রূপক হিসেবে। অথবা পেয়েছি তীর অর্থে শব্দবাণ। এ আমাদের অবাক না করে পারে না।

             আমরা যে বাংলা কবিতা-বইকে ধরিয়ে দিলাম, সেটি তিনি  লিখেছেন  জীবনের একেবারে শেষ ভাগে ২০০১ থেকে ১০ এই দশ বছরে। দুই একটি বাদে সবগুলো কবিতারই মূল অসমিয়া রূপ রয়েছে ‘হীরেন ভট্টাচার্যের কবিতাঃ ১৯৫৭-২০১০’ সংগ্রহে।    ‘বৃষ্টি পড়ে অঝোরের’র একুশটি গান সে বইতে পাইনি। এগুলো স্বাধীন রচনা। নিচে কোন সন তারিখের উল্লেখ করেন নি, তবে ভূমিকাতে জানিয়েছেন এগুলো অনুবাদগুলো সারবার  পরে লেখা।  আমরা আশা করব কোন সুরশিল্পী  সুর দেবেন আর দেখতে পাবো কোনদিন এই গানগুলো  “ উজিয়ে বয়ে চলেছে মাটির সুরে” ।







কোন মন্তব্য নেই: