“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৩

কবির স্বদেশ

             ।। দেবাশিস তরফদার।।
           (লেখাটা বেরিয়েছিল, মিহির মজুমদার, সঞ্জয় চক্রবর্তী, অভিজিৎ লাহিড়ী সম্পাদিত গুয়াহাটির ‘মহাবাহু’কাগজের  বর্ষা , ১৪১৭ সংখ্যাতে। লেখাটিকে আমাদের ঈশান ভারতের লেখককুলের প্রাথমিক ইস্তাহার বলা যেতেই পারে। যদিও ইতিমধ্যে আরো অনেকেই এই নিয়ে লিখেছেন। আমাদের ঈশানের পুঞ্জমেঘের প্রয়াসেরও এই লেখাটি একটি দিগদর্শক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। ভাল হতো আমাদের এই অন্যতম প্রিয় কবি গদ্য শিল্পী দেবাশিস তরফদা নিজেই যদি লেখাটি এখানে তুলতেন। কিন্তু তিনি একান্তে থাকতে ভালো বাসেন। আন্তর্জালে থাকলেও নিজের লেখা নিজে কিছুতেই পড়ান না। আমরা তাই নিজেরাই লেখাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভেবে খানিক শ্রম স্বীকার করে নিলাম। --সুশান্ত কর।)

থাটা বস্তাপচা শোনাতে পারে, তবু এক কথা না বলে পারি না যে সত্য এবং সুন্দর—দুটোই আমাদের চাই। আমদের জীবনে দুটি তৃষ্ণাই আছে।
       সত্যের ক্ষেত্রে চরাচর এবং অনাদি অনন্তকাল। সত্যের আঞ্চলিকতা বা আধুনিকতা হয় না। কিন্তু সুন্দরের সত্যটি দেশকালে বাঁধা। বৈচিত্রই তার অস্তিত্বের শর্ত। তাই, আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তা, শত প্রভাব মেনে নিয়েও একটি দেশকে আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে।
    নিজের সাংস্কৃতিক সত্তা নিয়ে যখন ভাবি, দেখতে পাই তার উপাদান একাধিক। বাঙালি? অবশ্যই। বিশেষ অর্থে , হিন্দুও। কিন্তু আরো একটি বড় উপাদান আমি  অস্বীকার করতে পারি না—আমি উত্তর পূর্বের সন্তান। আমার মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যা আমাকে শুধু শিলচরের বাঙালি বা যোরহাটের অসমীয়ার সঙ্গে নয়, একজন খাসি, মিজো, মিতেই বা নাগার সঙ্গেও আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধতে চায়।
        সেই জিনিসটা কী? উত্তরপূর্ব ভারত বহু বর্ণ, এখানে কত যে ভাষা, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান তিনটি ধর্মেরই লোক প্রচুর, সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে এর তুলনা পৃথিবীর খুব কম ভূখণ্ডেই আছে। কোন্ সে সূত্র, যাতে এই নানা রঙের মণিগুলি মালাবদ্ধ হয়ে আছে?
          এর উত্তর, আমার বিশ্বাস , ভূগোলে নিহিত। ঘন শ্যামল ভূমি, মাঝে মাঝেই পাহাড়, দীর্ঘ বর্ষা, তীক্ষন শীত, জীবনের মন্থর ছন্দ, রঙিন বনভূমি এবং মুখর এক নৈঃশব্দ। ঠিক এরকমটি আর কোথাও নেই। অতল খাদের গা ঘেঁষে মন্থর সর্পিল গতিতে উঠে যাওয়া বাস, পাহাড় ও অরণ্যের মধ্য দিয়ে ধীর ছন্দে চলা রেলগাড়ি, বাসস্টপে চায়ের উনুনের পাশে নীরব ও হাস্যমুখ উলের টুপি পরা ছেলে, অদূরে বাঁশগাছ, কখনো বা সুপুরি গাছে শোভিত লাল টিনের চালের ‘আসাম টাইপ’ বাড়ি, রোদে মেলে দেওয়া উজ্জ্বল রঙিন চাদর, কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে বা মেঘমেদুর দুপুরে টিনের চালের হোটেলে সাদা জুঁইফুলের মতো আতপ চালের ভাত, পথের পাশে ঝরনা বা ‘ছড়া’, সিঁড়ি নেমে গেছে পাতালে, সেখানে লাল টিনের ছাদ, কোথাও বা বাঁক ফিরতেই দু’পাশে চায়ের বাগান, কোথাও বা লাল চাদর পরা দুটি যুবতী তুচ্ছ কথায় ফেটে পড়ছে হাসিতে। আর ক্ষণে ক্ষণেই ফিরে আসছে নৈঃশব্দ্য। তারপর আবার সুপারিগাছ। আবার কলাগাছ। লাল নরম মাটির পাহাড়, ধান ক্ষেত। কোথাও পাথর গড়িয়ে পড়ে রাস্তা  বন্ধ। আর বিকেল হতেই সন্ধ্যা নেমে এল।
            এই ছবিগুলি কোথায়? হারাঙ্গাজাও না আমবাসা-তে? কাকচিং-এর পথে, নাকি নংপো-র পথে? একি শিলচরের রাঙিরখাড়ির সন্ধ্যা, নাকি ইমফলে থোয়থং-এর সন্ধ্যা? চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি, না হাফলঙের? বলা যাবে না। সব মিলে মিশে গেছে। এ একটা ভূগোল।
          ধর্মীয়, ভাষিক বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কথা আমরা শুনতে পাই, ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ কি হয় না? জানি না। কিন্তু আমি যখন উত্তরপূর্ব ভারতকে একটি সত্তা হিসেবে দেখি, একটি সত্যি হিসেবে দেখি, এবং নিজেকে তার অংশ হিসেবে ভেবে আনন্দিত হই, তখন হয়তো এই ভৌগলিক অনন্যতা অবচেতনে কাজ করে।
           আমরা , এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা, বাঙালি হয়েও যেন অন্য একটি জাতি, যেমন আমেরিকানরা ইংরাজিভাষী এবং ইংরেজ সংস্কৃতির হয়েও ইংরেজ নয়। এর প্রধান কারণ ভূগোল।
           এবং, অবশ্যই, নতুন ইতিহাস। আমাদেরও , যারা সাতবোনের মহাদেশে থাকি, বা বড় হয়েছি, আমাদেরও একটা নতুন ইতিহাস আছে। তার রঙটি বহুবর্ণতার। হ্যাঁ, এই মহাদেশে অনেক সংঘাত, দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে যা বড় হয়ে ওঠে, তা এই রঙের অসীমতা। ঠিক যেন এই ভূখণ্ডেরই কোন বনভূমির মতো।
         গত ডিসেম্বরের এক সকালে গুয়াহাটি হ’তে ডিফু ডিমাপুর হয়ে যোরহাটগামী একটি ট্রেনের কামরাতে বসেছিলাম। সহসা অনুভব করলাম, চারপাশে বিচিত্র স্বর, দেখতে পেলাম বিচিত্র মুখচ্ছবি, কেউ বা অসমীয়া, কেউ বাঙালি, কেউ মিকির, কেউ মিসিং, কেউ মিজো, কেউ নাগা ( কোন্ নাগা? আংগামী, আও, সেমা, টাংখুল?) । কেউ বা হয়তো মাড়! কোন খ্রিস্টান মেয়ে বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে, তার পাশে বোরখা পরা মহিলা। লালকালো চাদর পরা লালটুকটুকে নাগা মহিলার পাশে ঘনকৃষ্ণ চা-বাগান-জনগোষ্ঠীর মহিলা। একটা অনির্বচনীয় আবেগে  ভরে উঠল আমার মন। একটা মহাদেশকে যেন দেখতে পেলাম।
         এই ছবিটা উত্তরপূর্ব ভারতের অন্য কোন জায়াগায় হয়তো দেখতে পেতাম, হয়তো একটি বাসে। অন্য কোনো ট্রেনে। একটি যাত্রীবাহী ভাড়াটে জীপে। কোন এক ইস্টিশনের ভাতের হোটেলে। এই বাসগুলি, ট্রেনের কামরাগুলি, ইস্টিশনগুলি যেন এই বর্ণময় মহাদেশের ক্যালেণ্ডার। যেমন বড় বড় বিমানবন্দরগুলি আধুনিক বিশ্বের ক্যালেণ্ডার।
         এই অতীব নীল আকাশ, এই অতীব উজ্জ্বল রৌদ্র, এই হিম বাতাস, এই চরাচরবিপ্লাবিনী বৃষ্টি, এই নিঃশব্দ অরণ্য, নানা রঙের ফুলের মতো নানা রঙের মানুষ, তাদের সৃষ্টিকে এই বৌগলিক সত্য প্রভাবিত করে কি? আমার অন্তঃসাক্ষ্য বলে যে তা সত্য, যদিও এই প্রভাবের প্রকাশ সাংবাদিকের প্রকাশ নয়।
        আমার বিশ্বাস , আমরা কলকাতা বা তার উপগ্রহের বাঙালিদের চেয়ে স্বভাবত আলাদা। আমরা যেন আরেকটু খোলামেলা, আরেকটু সুখী, আরেকটু ইন্দ্রিয়প্রবণ। এর প্রকাশ কি কোথাও ঘটছে না?
অনেক সময় নানা ছোট কাগজের অনামী লেখক লেখিকার ‘কাঁচা’ লেখাতে এই স্বভাবের প্রকাশ দেখেছি। দেখে, আক্ষেপ হয়েছে মনে , ওই গুণগুলি হারিয়ে ফেলার জন্যে। কিন্তু সব কি হারায়? এই আলো-হাওয়া-রৌদ্র কোথাও কি সূক্ষ্মভাবে মিশে নেই? কে জানে!
           আমাদের বিশিষ্ট প্রকৃতির প্রকাশ হয়তো সব সময় আমাদের লেখায় ঘটেনি। তার দুটো সম্ভাব্য কারণ—অতিরিক্ত পাঠ , এবং অতিরিক্ত কলিকাতা মুখিনতা। এ ছাড়া, এ যুগের ‘উন্নয়নকামী’ দেশগুলির মধ্যে সতত একটি উদ্বেগ কাজ করে। একে চলতি বাংলাতে বলা যেতে পারে—‘লেটেস্ট’ হ’তে চাওয়া, এবং ‘উহাদের মতো হতে চাওয়া। এই উদ্বেগ থেকে দেখেছি কারো মুক্তি নেই, আমাদের এই প্রিয় মহাদেশের কোন জাতিরই নেই।
           বাংলার সভ্যতা এক সময় বৃহৎ ভারত এবং বৃহৎ বিশ্ব থেকে পুষ্টির উপাদান আহরণ করেছিল, একই সঙ্গে নিজের লোক সংস্কৃতি থেকে রস শোষন সে করেছে। গত কয়েক দশক থেকে তার আহরণের ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে এসছে। তার আত্মপরিচয় এখন কলকাতা+ ইয়োরোপ+ দুই আমেরিকা। কলকাতা এবং ইয়োরোপের মাঝখানে আর কিছু নেই, একটি বন্দর নেই।
          উত্তর পূর্বের বাঙালি কি একই ভুল করবে? আমাদের রস আহরণের একটি ক্ষেত্রে –এই সাত বহিনীর মহাদেশের দিকে আরো মনোযোগ, আরো দরদ দিয়ে কি আমরা তাকাব না?     
       
           ইংরাজি ভাষাটা আমরা মোটামুটি জানি, আর অসমীয়া ভাষা একটু আগ্রহ করলেই জানতে পারি, এবং এই দুটি ভাষার সাহায্যে উত্তরপূর্ব ভারতের বহুবর্ণ সংস্কৃতির স্বাদ আমরা পেতে পারি। যদি শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের সৃষ্ট অনুপম আধ্যাত্ম-সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হই, যদি জ্যোতিপ্রসাদের মধুময় সংগীতের স্পর্শ পাই, বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যের এপিক উপন্যাস পড়ার সুযোগ পাই, খাসিয়া কবি সো সো থামের কবিতায় সাবেকি চিনা কবিতার স্বাদ পাই, নাগা লেখিকা টেমসুলা আও-র গল্প ‘সোয়াবা’ পড়ে দ্রবীভূত হউ, মণিপুরের অভিরাম শ্যাম শর্মার ‘ইমাগী নিংথেম’ ছবিটি দেখে বাক্যহারা হই, তবে আমরা যে ধনে ধনী হব, তার কণামাত্র ল্যাটিন আমেরিকা নিয়ে কচলালে আমরা পাব না।
         তখন দেখতে পাবো, শুধু মাতৃভাষা নয়, মাতৃভূমিও ‘পূর্ণ মণিজালে’। স্বভাষার উত্তরাধিকার এবং স্বদেশের সম্পদ—এই দুটো মেলাতে পারলে হয়তো আমরা নবজন্ম লাভ করব। তখন আমাদের সাহিত্যকে আলাদা করে চেনা যাবে, যেমন আমেরিকান কবিদের—রবার্ট ফ্রস্ট, এডউইন আর্লিংটন, রবিনসন, এডনা সেণ্ট ভিনসেন্ট মিলে,এমিলি ডিকিনসনদের আমরা ইংরেজ কবিদের থেকে আলাদা করে চিনতে পারি।
এবং তখনই আমরা বাংলা সাহিত্যকে নতুন রস যোগাতে পারব।

কোন মন্তব্য নেই: