“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

জীবনরেখা চাতলা




পিংকী পুরকায়স্থ চন্দ্রানী, গবেষিকা
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়।
(লেখাটি নতুন কাগজ 'প্রতাপে'র প্রম স্যাতে বেরিয়েছে) 
 সামের মোট জলাভূমির ১৪ শতাংশই বরাক উপত্যকায়। শিলচর শহরের অদূরে অবস্থিত এমনই একটি জলাভুমি হল চাতলা হাওর। হাওর শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না থাকলেও এইটুকু বলা যায় যে বাঙলা এবং আসামের বেশ কিছু জায়গায় গোলাকৃতি বিশালাকার জলাভূমিগুলোকে স্থানীয় ভাষায় হাওর বলা হয়ে থাকে। হাওরগুলো বর্ষায় জলে টুঁইটুম্বুর আবার শীতে খিটখিটে শুকনো, টুকরো টুকরো জলাশয়ের রূপ নেয় । বর্ষায় চাতলার বিস্তৃতি ১৭৫০ হেক্টরের চেয়ে ও বেশী হয় এবং গভীরতা ১০ মিটারকেও ছাপিয়ে যায়। নীল নয়না চাতলার সাথে গাঢ় সই সম্পর্ক বরাকের চঞ্চলা কিশোরী উপনদী ঘাঘরার । চাতলা তার আশেপাশের সমস্ত জলধারাকে নিজের মধ্যে সঞ্চিত করে রাখে এবং পরিমিত অনুপাতে ঘাঘরার স্রোতে নিজেকে রিক্ত করে জলের উচ্চতা বজায় রাখে। যেহেতু প্রকৃতির সব কিছুতেই রয়েছে পরিমিতি অপরিমিতির হিসেব, তাই চাতলা কখনো সম্পূর্ণ ভাবে শুকিয়ে যায় না, শীতের নিস্তব্ধ দুপুরে রাজহাঁসের দল রাজকীয় ভঙ্গিমায় সাঁতার কেটে অথবা গরমের দীর্ঘ রাতগুলোতে নির্ঘুম চাঁদ জলের আরশিতে নিজের মুখ দেখে অবহেলায় কাটিয়ে দিতে পারে। ছবির মতন সাজানো চাতলাকে ঘিরে রয়েছে গ্রাম বরাকের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকাচার , জীবন যাত্রা। ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে আসা ভাটিয়ালির সুর, নাম না জানা অচিন মাঝির গলায় ব্যক্ত জগদীশ্বরের উদ্দেশ্যে আকুল প্রার্থনা , “বন্ধু, অকূলে ভাসাইয়া আমায়, কই রইল্যা রে../নহর ও দরিয়ার বুকে রইল্যাম সাঁতরাইয়া, /কি দুঃখ বুঝিবে বন্ধুরে কিনারে দাঁড়াইয়া /বন্ধু , কই রইল্যা রে...ও”। চাতলার কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকগুলো গ্রাম আজও ইলেকট্রিসিটির জাদু কাঠি থেকে বঞ্চিত, বিশুদ্ধ পানীয় জল মরীচিকার মতো, রাস্তা ঘাটের অবস্থাও তথৈবচ। তবু দারিদ্র, চরম অবহেলা, এই সব কিছুর মধ্যেই এলাকার অধিবাসীরা যারা মূলতঃ মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের, তারা আগলে রেখেছেন নিজের একান্ত আপন অকপট আন্তরিক সুখ, তৃপ্তি ,আনন্দকে। হাজার রিক্ততা, প্রতিকুলতা ও বঞ্চনার বর্ণহীনতা , আশার রঙ স্বপ্নের তুলি দিয়ে বর্ণময় করে তোলে তারা সাজিয়ে নেন আপন স্বপ্নের ভুবন। তাই তো হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যার আবছা আলোয় মেতে উঠতে পারেন মনসা মঙ্গল , তিন নাথের সেবা, হরিনাম সংকীর্তনে। লোকগীতির সুরে সুরে যশোদার বাৎসল্য, গোপালের শিশু সুলভ চপলতা–আনন্দ-দুঃখ–অভিমান হয়ে উঠে তাদের আপন পরিবারের গল্প, চাওয়া পাওয়া বা নাপাওয়ার ব্যক্ত অব্যক্ত ইতিহাস।সাপের মতন এঁকে বেঁকে চলা রাস্তার দুপাশে, মাটিতে নিকানো ছন বাঁশের ঘর, উঠোনের মধ্যমণি মমতা ঢালা তুলসি বেদী, বারান্দার কোনে দুপুরের পড়ন্ত রোদে ঘুম ঘুম চোখে কর্তব্যরত কুকুর, সদ্য চান করে ফিরে আসা হাঁসের দল, পালকের যত্নে উন্মুখ পায়রার গম্ভীর বাকবাকুম, বাঁশের বেড়ার উপর মেলে রাখা জাল, উঠোনের কোনে মাছ ধরার ডরি, চেপা, কোচা, দুপুরের রোদে মাছ শুকানোর কাজে ব্যস্ত নববধূ, চাতলার বুকে মাছ ধরায় তন্ময় সন্ন্যাসীর মতন দৃপ্ত সুঠাম বলিস্টদেহী যুবকেরা, হিজল ছায়াবীথিতে গরু চরানো রাখাল বালকের দল, ছাগ শিশু কোলে ঝুঁটি বাঁধা কিশোরী, ঘাটে জল নিতে আসা মেয়েদের সুখ দুঃখের কথোপকথন, হাসির অনুরণন সব কিছুই যেন প্রকৃতির মতন অকৃপণ, সৌম্য, শান্ত, বাহুল্য বর্জিত ।
         
              আমাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় , আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ডঃ সুস্মিতা গুপ্তের তত্বাবধানে এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগের (ইউজিসি) আর্থিক সাকুল্যে চাতলার জলের গুণগত মান, উৎপাদন ক্ষমতা এবং মৎস্যজীবীদের আর্থ সামাজিক অবস্থান নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কিত প্রজেক্ট হাতে তোলে নেওয়া হয়। তিন বছরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর চাতলার যে ছবি আমাদের সামনে উঠে এসেছে সেটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে আশার প্রদীপ। চাতলার জলের গুণগত মান, উৎপাদন ক্ষমতা এবং মৎস্যজীবীদের আর্থ সামাজিক অবস্থান নিয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কিত প্রজেক্ট রিপোর্ট অনুযায়ী চাতলার জলের গুণগত মান মোটামোট ভালোই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদিও জলে লোহার (আয়রন) পরিমাণ বেশী পাওয়া গেছে তা সত্বেও জলে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে শুরু করে অম্ল/ক্ষারকতা এবং অন্যান্য তত্ত্বগুলো মৎস্য উৎপাদনের উপযোগী পরিমাপ নির্দেশ করছে। তবে কোন কোন জায়গায় ধান খেত এবং সব্জি খেত থেকে জলের স্রোতে ভেসে আসা সার এবং বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক বৃষ্টির পর পরই দেখিয়েছে মারন চিহ্ন, জন্ম দিয়েছে ভীতির। চাতলার জল উৎপাদনক্ষম এবং এই জল যাতে কীট নাশকের সংস্পর্শে বিষিয়ে না যায়, সেই দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের লোক সংস্কৃতি এবং পরম্পরাগত লোকধারায় থরে থরে সাজানো রয়েছে সব সমস্যার সমাধান। প্রাকৃতিক সার এবং কীট নাশে পারম্পরিক পদ্ধতির প্রয়োগই মুক্ত করতে পারে প্রকৃতিকে বিষের করাল গ্রাস থেকে। মৎস্যজীবিদের মতে বর্তমানে চাতলায় মাছের সংখ্যা

এবং প্রজাতি দুটোই তলানির দিকে । তাছাড়া মৎস্যচাষের জন্যে প্রয়োজনীয় খরচপাতির অভাবেও মৎস্যজীবিরা উৎপাদনবৃদ্ধি করতে পারছেন না । এই ব্যাপারে যে তথ্যগুলো রিপোর্টে উঠে এসেছে তার অন্যতম একটি হল মাছ ধরার জন্যে নির্বিচারে মশারী জালের ব্যবহার। মশারীজাল বংশবিস্তারযোগ্য বয়েসের আগেই কেড়ে নেয় মাছেদের জীবন । দ্বিতীয়তঃ যখন চাতলার অন্তর্গত ফিসারীগুলো জলে একাকার হয়ে যায় তখন চাতলা সম্পূর্ণ রূপে সার্বজনীন সম্পত্তি হয়ে পড়ে, আবার শীতকালে যখন জল কমে আসে তখন ছোট ছোট ফিসারীগুলো মৎস্যজীবিদের নিজস্ব পারিবারিক সম্পত্তির আওতায় এসে পড়ে। ব্যবস্থাটি নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু এর সাথে যদি কোন কো-অপারিটিভ অর্থাৎ সমবায় গড়ে তুলতে পারতেন এলাকার মৎস্যজীবিরা সেই ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় টাকার পয়সার ব্যবস্থা, মশারীজাল নিষিদ্ধ করণ, ভালো চারা সংগ্রহ, উপযুক্ত মৎস্যখাদ্য শনাক্ত করন এবং প্রয়োগ, উপযুক্ত বাজারের সংস্থান অনেকাংশে সহজ হয়ে উঠতো, ঠিক যেমনটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে। চাতলা আমাদের সম্পদ, গ্রাম বরাকের জীবনরেখা। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সবার। আসুন আমারা জীবনীশক্তিতে উদ্বেল করে রাখি আমাদের প্রিয় চাতলাকে।

কোন মন্তব্য নেই: