“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১২

ফিরে দেখা...



             সংখ্য ছোটো ছোটো মশার প্রেকটিক্যাল চলছিল, লাশকাটা ঘরে একা আমি। পায়ের দিকে অস্বাভাবিক মনোযোগ আর ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথড লাশটাকে খাড়া করতে যথেষ্ট ছিল। আর তখনি ভুত কিংবা উলঙ্গ পাগল দেখলে দৌড়াদৌড়ি আর ঢিল মেরে খোঁচাবার আদিম প্রয়াসে মেতে উঠলো সারা তামিল মশারা। লক্ষণীয় যে এদের গানের সুর হুবহু আমাদের সিলেটী স্বজাতিদের মতই। আমি নৈরিতে ক্ষেপে গেলে ঈশান, অগ্নি, বায়ু থেকে ত্রিমুখী হামলা, আর বসলে মুখ ভেংচিয়ে অট্টহাসির সাথে মুখের তওয়াফ। মনে হল ওদের দলবদ্ধ আক্রমণের নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য নেই বা এখন ও আসেনি ওদের কাছে, তাই “যত পারো খেপিয়ে তোল শ্যালাকে” মন্ত্রে দীক্ষিত ওই তরুন হামলা বাজদের হামলায় করুন হয়ে বসে বসে ভাবছি সেহরির কথা।

নাম না জানা বাইং মাছের মত এক জাতিও তামিল মাছ দিয়ে ফরাশি বিচির ঝোল বানাবো বলে আড়াইটার অ্যালার্ম লাগিয়ে শুয়েছিলাম ক্লান্ত চোখে ঘুমের কুঁড়ি নিয়ে, কলি হয়ে ফুল ফুটার আগেই সব ছারখার। ঘুম পালিয়েছে জানলা দিয়ে। এখন ও প্রায় তিন ঘণ্টা বাকি সেহরি শেষ হতে। 

এখানে সেহরির জন্য মসজিদ থেকে কেউ ডাকে না বা ডাকলেও শুনা যায় না আর শুনলেও কিছু বুঝা যাবে না। তাই ওই ডাকের অপেক্ষা বেশ যুক্তি সঙ্গত নয়। সময়ের গলা চেপে হত্যা করা তো আমার নিত্যদিনের কাজ, তাই এই কাজ টা না হয় আজ আরেক দিন হল, কি ক্ষতি? এক খুনের যে সাজা, সাত খুনের ও সেই সাজা। আর সময় কে হত্যা কর আর কাজে লাগাও, কথা তো এক ই, সময় চলে যায়, বেঁধে রাখা যায় না। আমি কত ভালবেশেছি ওই সময়কে, কিন্তু কই সে তো আমায় পাত্তাই দিল না। আমাকে কখনও বলে ও নি যে ও চলে যাবে। নইলে সব শক্তি দিয়ে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতাম সেই সেহরি করার দিন গুলো কে। 

                শীতকালের রোজা, ভোর তিনটে থেকে আমার এক নানার মসজিদে মধুর সুরের গজল আর অতি সাহিত্যিক ভঙ্গীতে গ্রামবাসীকে ডাকার সেই মধুর স্মৃতি এখনও মন কে নাড়া দেয়। “বাজিলো কি রে ভোরের ও সানাই, নীদ মহলার আঁধার ও রাতে...” গান টা শুনলেই ওই নানার কথা মনে পড়ে। তখন রোজা রাখার খুব শখ ছিল, যদি ও ফর্য হয় নি তখন ও। সেহরিতে সবার সাথে উঠে ঠাণ্ডার মধ্যে সেহরি খাওয়ার মজা টাই ছিল অন্যরকম। বাড়ির সব ঘরে আলো জ্বলছে মধ্যরাতে, কুয়াশা আর ঝির ঝির বাতাসে টুং টাং বাসনের আওয়াজ, টুকটাক বার্তালাপ আর মসজিদ থেকে কখনও সেই নানা বা ইমাম সাহেবের মধুর সুরের গজলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইতাম। সেহরি শেষে ফজরের নামাজে আমার প্রিয় বন্ধুকে দেখে আরও উৎফুল্ল হতাম। নামাজ শেষে সবাই যখন ঘরমুখি, আমরা তখন ঠাণ্ডার মধ্যে দাড়িয়ে বা বসে গল্পে মেতে উঠতাম। কত যে গল্প হতো... তারাবিহির নামাজে মানুষের দলবদ্ধ যাত্রা তো সত্যিই কাব্যিক লাগতো আমার কাছে। ইফতার পর্ব শেষ করে আরও কিছু সময় পর ছাঁদে গিয়ে বসে থাকতাম গ্রামের লোকদের তারাবিহিতে আসা দেখতে। বয়স্ক আর কচি কাঁচার ছোটো ছোটো দল নানান গল্পে মেতে মেতে বাড়ির সামনে দিয়ে যেত। আমাদের ঘরের সামনেই এক উঠোন আর তারপর মসজিদে যাওয়ার পথ, আর তারপরেই পুকুর। পুকুরপাড়ে আরও কিছু গাছের সাথে একটা নারকেল গাছ আর ওই নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দূর আকাশে আমার এক প্রেয়সী পূর্ণিমার চাঁদ। যেন এক স্বপ্নিল যাত্রার লাইভ টেলিকাস্ট দেখতাম। বয়স্ক লোকেরা চাঁদর মুড়ি দিয়ে পান খেতে খেতে যেত আরা ছোটদের দল আগামীকালের ক্রিকেট ম্যাচের পরিকল্পনায় মশগুল থাকতো। আমাদের ওই সামনের উঠোন টা ও ছিল গ্রামের কয়েকটা মাঠের একটা। সবাই ঘুমিয়ে থাকতো বলে সকালে নাগাড়ে প্রায় চার/পাচ টা ম্যাচ হয়ে যেত। যাইহোক, ওই সব দেখে আমি যখন মসজিদে পৌঁছতাম তখন নামাজ প্রায় শুরু ই হয়ে যেত। আমরা ছোটো ছিলাম তাই পেছনের সারিতে থাকতাম। আমার বয়সি যদি ও আরও অনেক ছিল কিন্ত আমি সবার সাথে বেশ মিশতে পারতাম না, তাই আমি মনে মনে আমার সেই বন্ধুকে খুঁজতাম আর দেখা পেলে দুজনেই মুচকি হাসি দিয়ে জায়গা বদল করে একসাথে থাকতাম। সবচেয়ে বেশি মজা হতো ইমাম সাহেবদের টিফিন পেলে, খুলে দেখতাম কি কি আছে, আর সুবিধা হলে খুলে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করতাম, সে ছিল ইফতার শেষের বেঁচে যাওয়া জিলেপি, খেজুর আর ডালের বড়া। আমাদের থেকে ছোটো কেউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে চোখ রাঙাতাম আর তারপর ভদ্র ছেলের মত আবার নামজে যোগ দিতাম। নামাজ শেষে এক মায়াবি জোছনায় সারা মসজিদ প্রাঙ্গন এক অপরূপ রূপ নিত, দূর আকাশের ওই ছাঁদে দেখা চাঁদ এখানেও যেন আমার চোখাচোখির অপেক্ষায়। আমি উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে সবার মাথার উপর দিয়ে বাশ ঝাড় আর সুপারি গাছের ফাঁকে ফাঁকে সেই চাঁদের সাথে চোখ মেলাতাম আর চাঁদ টা ও যেন আমার চাহনিতে মুগ্ধ হয়ে আরও আলো ছড়াত চারিদিকে। চোখাচোখি পর্ব শেষে যখন নিচে ফিরতাম, দেখতাম ৫/৬ জনের ছোটো ছোটো বিভিন্ন বয়সি দল বিছিন্ন ভাবে আলাপ আলোচনায় মশগুল। গ্রামের সবার এক মিলনভুমিতে পরিণত হওয়া সেই মসজিদ প্রাঙ্গন, যেখানে একে অন্যের খবরাখবর নিচ্ছে আর শীতের রাতের এক বেহেশতই হিমেল হাওয়া সবাইকে যেন পবিত্র করে তুলছে। 

                          এখন সেই বয়স্কদের দলের প্রায় কেউ ই নেই, সবাই কবরবাসি, কচিকাচার দল গুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। আমি আমার সেই বন্ধুকে ফোনে প্রায় ই জিজ্ঞেস করি এখনকার রোজা, তেরাবিহির কথা। ও দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে, বলে “নেই রে, আগের মত কিছুই নেই, সব বদলে গেছে, এখন আর সেই দল বেঁধে মসজিদে আসা নেই, নেই সেই মিষ্টি কথোপকথন, সব্বাই ব্যস্ত এখন। কারুর ই সময় নেই, মানুষ গুলো সব কেমন যান্ত্রিক হয়ে গেছে, শুধু ওই চাঁদটা মাঝে মাঝে খুঁজে বেড়ায় কিছু চেনা মুখ আর না পেলে মেঘের আড়ালে মুখ লুকায়”। 

২৯ জুলাই, ২০১২

1 টি মন্তব্য:

গৌতম চৌধুরী বলেছেন...

লেখাটি সুন্দর ও আন্তরিক। পড়ে বেশ ভালো লাগল। লেখকের কাছে এমন লেখা আরও পড়তে চাই।
গৌতম চৌধুরী