“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১২

রক্তস্নাত একুশে জুলাই


         ২১শে জুলাই, ১৯৮৬ সকালে বাবা আর আমি খেতে বসেছি । মেনু – কাঁচকলা আর আলু সেদ্ধ ভাতবাবার খুব তাড়া, সার্কিট হাউসে যেতে হবে । কারণ জিজ্ঞাসা করতেই  বাবা গম্ভীর হয়ে একটি কথাই বললেন – “ভাষা আন্দোলন” হঠাৎ বাবার বিষম উঠলো । ভালো করে খাওয়া হয়ে উঠলোনাএর স্বল্পক্ষণ পর কয়েকবার গুলিচালনার শব্দ শুনতে পেলাম ।  বাবাকে বলতেই ব্যাপারটা তিনি পাশ কাটিয়ে বললেন যে পটকার শব্দ হতে পারে । বাবা আঁচ করতে পেরেছিলেন যে হয়তো কিছু ঘটতে চলেছে । তাড়াহুড়োর মধ্যেই তিনি বেরিয়ে গেলেন তারপর দু’ দু’টো রাত কেটে গেল, বাবার কোন খবর নেই ।


     ক্লাস ফাইভের ছাত্র হিসেবে করিমগঞ্জের নীলমনি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সদ্য ইংরেজী শিখতে শুরু করেছিবাংলা ভাষার পাশাপাশি আরো দু’টি ভাষা হিন্দি আর ইংরেজী শিখতে পারবো বলে কত আনন্দ । বাবার মুখেই শুনতাম বিদেশে যেতে হলে অনেক ভাষা জানতে হয় । কারণ ভাষা শেখার বিকল্প নেই । “ভাষা আন্দোলন” শব্দটা আমার কাছে কেমন জানি বাঁধো ঠেকলো ! ভাষার জন্য আবার আন্দোলন করতে হয় না কি ? এখানে  তো সবাই দিব্যি বাংলা বলছে২১শে জুলাই-এর রাতে মা এর মুখেই শুনতে পেলাম বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই আন্দোলনে দু’দুটো তাজা প্রাণ শহিদ হয়েছে, আর আহতের সংখ্যা অগনিত । কার্ফ্যু হয়ে যাওয়ায় পর বাবার কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিলনা । বাবাও কি তবে ...আমরা কেউ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই পারছিলাম না । পরদিনও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় কাটলো । একদিকে সেনার ফ্ল্যাগ মার্চ আর অপরদিকে পুলিশের ঘন ঘন টহল, পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছিল । ২৩ শে জুলাই সকাল বেলা খবর পেলাম যে বাবা সিভিল হাসপাতালে রয়েছেন । এক ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু উঠার পর তড়িঘড়ি মা আর দিদি হাসপাতালে বাবাকে আহত অবস্থায় দেখে এলেন
     ভাষা আন্দোলনের অতীত যে অনেক পুরানো তা পরে জেনেছিলাম ১৯৬০ সালে আসাম রাজ্যভাষা আইন চালু হওয়ার পর থেকেই বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীদের উপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে সামিল হয় মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহার সরকার । এর ফলস্বরূপ ১৯৬১ এর ১৯শে মে-এর  ভাষা আন্দোলনে শিলচরে পুলিশের গুলিতে এগারো শহিদের রক্তে রাঙ্গা হয়ে উঠে শিলচর রেলস্টেশন চত্বর । চালিহা সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়কিন্তু চক্রান্ত চলতেই থাকে । ১৯৭২ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি চরম সিদ্ধান্ত নেন যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে একমাত্র অসমীয়া ভাষাতদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শরৎচন্দ্র সিংহ ও ঝোপ বোঝে কোপ মারলেন । উনার মন্ত্রীসভাও ১৯৭২ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে মাধ্যমিক পর্যায়ে অনসমীয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা হবে ।  এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে বরাকে আবার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো অবশেষে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়, আর অনির্দিষ্ট কালের জন্য গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র মাধ্যম করার প্রস্তাবটি স্তগিত রাখা হয় এবং সঙ্গে ভাষা সার্কুলারটিও । ১৯৮৫ এর ডিসেম্বর মাসে প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ক্ষমতায় বসেই ভাষা সার্কুলারের “মাইন” আবার নুতন করে পুঁতবার প্রস্তুতি শুরু করলেন । দিসপুর থেকে বরাক উপত্যকায় নির্দেশ আসলো অসমীয়া ভাষা এখন থেকে বাধ্যতামূলক হবেআবারও গর্জে উঠার পালা এই উপত্যকার অবহেলিত মানুষদের । ১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর করিমগঞ্জ সফরে ভাষা সার্কুলারের বিরূদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার জন্য শতশত মানুষ সামিল হলেন ভাষা আন্দোলনে ।
২১শে জুলাই, ১৯৮৬ সকাল ন’টা । তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্তের হেলিকপ্টার করিমগঞ্জ শহরের অদূরে মাইজডিহিতে অবস্থিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হ্যালিপেডে এসে নামলো । সার্কিট হাউসের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় আসার পর দেখা গেল কালো পতাকা নিয়ে অগনিত মানুষের জটলা । জেলা প্রশাসনের মদতে জনতার ভিড় ঠেলে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় সার্কিট হাউসের দিকে চলে গেল । ততক্ষণে আন্দোলনকারীদের  পালে হাওয়া লেগেছে । ‘অগপ সরকার মূর্দাবাদ’, ‘প্রফুল্ল কুমার মহন্ত মূর্দাবাদ’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো সার্কিট হাউসের আশপাশ । উত্তপ্ত হয়ে উঠলো আন্দোলনের পরিবেশ । এরই মধ্যে পুলিশের কাজ শুরু হয়ে গেল । ‘কেলা বঙালি’ বলেই আন্দোলনকারীদের উপর লাঠি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো আসাম পুলিশের বর্বর ব্যাটেলিয়ান । সার্কিট হাউসের বারান্দায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মহন্ত পর্যবেক্ষণ করে গেলেন তার সরকারী বাহিনীর দাপট । এদিকে পুলিশের লাঠিচার্জে বিক্ষোভকারীরা বেসামাল হয়ে পি ডবলিউ ডি অফিসের সামনে জমায়েত হতে লাগলেন । এর অল্পকিছুক্ষণ পর মুখ্যমন্ত্রী মহন্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে আন্দোলনকারীদের পাত্তা না দিয়ে নিমিষে বেরিয়ে যান পরবর্তী গন্থব্যস্থল ফকিরাবাজারের দিকে । নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়তে শুরু করে । ব্যস – তারপর অগ্নিশর্মা পুলিশের দল গুলি চালনা শুরু করে দেয় । সময় তখন সকাল ন’টা পঞ্চান্ন । বুলেটের ছোবলে জগন্ময় দেব (জগন) আর দিব্যেন্দু দাস (যীশু) লুটিয়ে পড়লেন পি ডবলিউ ডি অফিসের সামনে । শহিদের রক্তে করিমগঞ্জের মাটি পবিত্র হয়ে উঠলো । আহত মানুষদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো । 
‘প্রতিক্ষণ’ ম্যাগাজিনের (১৭ আগষ্ট, ১৯৮৬) রিপোর্টের একটি অংশ ।

“ঘর থেকে বের হবার পর আমি খবর পেলাম পুলিশের লাঠি চার্জ আর ফায়ারিং-এ শহরের পরিস্থিতি থমথমে রেডক্রস আর সরকারি হাসপাতালে আহতদের ভিড় । তাই হাসপাতালে ছুটে গেলাম আহত আন্দোলনকারীদের সাহায্যে সুপারিন্টেনডেন্টের ঘরে যখন আহত মানুষদের খবর নিচ্ছি তখন হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করলেন করিমগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মহন্ত । এসেই তিনি আমাকে দেখে বললেন ‘দুলাদা আপনাকে আমি গ্রেফতার করলাম । চলুন গাড়িতে ।’ হাসপাতালের সীমানা থেকে বের হবার আগেই মহন্তের সেনাবাহিনী আমার দিকে ছুটে আসলো, আর এলোপাথারি লাঠির আঘাত করতে লাগলো হাত দিয়ে আটকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গাড়িতে উঠার পর সেটা যেন বেড়ে গেল । বুটের লাথি আর লাঠির আঘাতে জর্জরিত এক বৃদ্ধকে ক্ষমা দেখাবার ন্যূনতম সৌজন্যবোধ দেখালো না আসাম পুলিশের বর্বর দল । পুলিশের গাড়িতে অন্যান্য আন্দোলনকারীদেরও একই অবস্থা । অবশেষে থানায় এনে আমাদের বস্তার মত ফেলে দেওয়া হল । অনেক অনুরোধের পর আমাদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হল । ডান হাতটা ভীষণ ব্যথা করছিল । ভাবতেই পারিনি যে হাত ভেঙ্গে গেছে । হাসপাতালে আসার পর চশমা না থাকায় খুব অসুবিধে হচ্ছিল । চশমার কথা জনৈক অসমীয়া পুলিশকে বলতেই অশ্লীল গালি আমার দিকে ধেয়ে আসলো যাই হোক এক বাঙালি পুলিশ কর্মীর বদান্যতায় অবশেষে চশমাটি পেলাম ।” বক্তা আমার বাবা হিমাংশু শেখর দাস (দুলা)এই ঘটনার রোমন্থন অনেকবারই তিনি করেছেন । প্রতিবারই আমার মনে হতো নুতন ঘটনা শুনছি । কারফিউ উঠার পর রোজ হাসপাতালে বাবার ওখানে যেতাম আর শুনতাম নানা গল্প । পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের গল্প তখন ঘরে ঘরে মা বোনদের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল । অনেক নেতারাও বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন । এদের মধ্যে রথিন সেন, রণেন্দ্রমোহন দাস (দুলুবাবু), নৃপতি চৌধুরী, সুজিৎ চৌধুরী, লোপামুদ্রা চৌধুরী প্রমুখ । বর্তমান কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সেসময় করিমগঞ্জ সফর করেন আর বাবার সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয় । কলকাতার পাক্ষিক পত্রিকা “প্রতিক্ষণ” বিস্তারে ২১শে জুলাই এর ঘটনা নিয়ে ১৭ আগস্ট, ১৯৮৬ সালে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে । সেই সংখ্যার ম্যাগাজিনে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবার একটি সচিত্র (চিত্রঃ ১) রিপোর্ট বের হয় যা বাবা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একখানি কপি আগলে রেখে ছিলেন । বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী । বৃটিশের বিরূদ্ধে আন্দোলনের অনেক কথাই উনার মুখে শুনেছি । বাবা কখনো আক্ষেপ করে বলতেন যে স্বাধীন ভারতে এখন স্বদেশী ভাইদের বিরূদ্ধে ভাষার অধিকার নিয়েই লড়াই করতে হচ্ছে । বাবার অবশ্য এক আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল প্রথম জীবনে তিনি জনসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । পরে যখন জনসঙ্ঘ বিভক্ত হয়ে ‘জনতা পার্টি’ আর ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ হয় তখন বাবা জনতা পার্টিতে যোগ দেন । দীর্ঘকাল তিনি জনতা পার্টি (পরে জনতা দল) এর সম্পাদক আর সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন । বাবা করিমগঞ্জ থানার ও সি মহন্ত এন্ড কোম্পানীর বিরূদ্ধে মামলাও করে ছিলেন । মহন্ত এবং আর এক পুলিশ অফিসার বদরুল হক লস্কর আমাদের বাড়িতে প্রায়ই এসে বাবাকে কেস তুলে নেবার জন্য কাতর অনুরোধ করতো । কিন্তু বাবা তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি ।  অনেকদিন সেই মামলা চলার পর দেখা গেল শেষে সাক্ষী দেবার লোক নেই । মহন্তের চোখ রাঙ্গানিতে ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল । কেসের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল । সাক্ষী হিসেবে বাবা উনার সেদিনের পরিহিত রক্তরাঙ্গা কাপড়ও রেখেছিলেন । কিন্তু ২১শে জুলাইয়ের ভিলেনদের কোন বিচার হলনা !  সেই আক্ষেপ বাবা বাকী জীবন বয়ে গিয়েছিলেন         
২১শে জুলাই এর ঘটনা বাংলা ভাষার প্রতি আমার এক আলাদা তাগিদ সৃষ্টি করে । ১৯৬১ এর ভাষা আন্দোলনেও বাবা একজন সৈনিক ছিলেন । সেসময় করিমগঞ্জ রেলষ্টেশন চত্বরে পুলিশের লাঠির আঘাতে বাবার পা ভেঙ্গে যায় । “যুগান্তর” পত্রিকায় বাবার একখানি ফটো আর উনাকে নিয়ে একটি রিপোর্টও বেরিয়ে ছিল । পত্রিকার কাটিং রাখার এক বিচিত্র শখ ছিল বাবার । প্রচারবিমুখ বাবা উনার ফাইলে ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক দুর্লভ কাটিং সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ সেই সব আমার কাছে কিছুই নেইএই উপত্যকার প্রতিটি মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি এক তাগিদ আসলে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা । প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে বরাকের সর্বস্তরের মানুষই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল । তাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে যখন কোন আলোচনা হয় তখন প্রচারবিমুখ বাবার অবদানের জন্য  নিজেকে বড় গর্বিত মনে হয় ।

1 টি মন্তব্য:

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বলেছেন...

বিশ্বের যেকোন প্রান্তের বাঙালি - জার নিজ মাতৃভাষার প্রতি কিছুমাত্র মমত্ববোধ আছে গর্বিত করে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন । সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই সেই রক্তঝরা দিনের একটা খন্ড বৃত্তান্ত জানার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ।