কিছুক্ষণের মধ্যেই পটলচেরা চোখ ভয়ঙ্কর। কালো তুলসী চোখে গুঁজে শেষ যাত্রা।
সীতার অভিশাপে সংসারে নিষিদ্ধ ছিল তুলসীর প্রবেশ। ফল্গুর বুক আজও খালি। এতো নিষ্ঠুর হতে পারেন সীতা! রাম রাজত্বেও ছিল আত্মহত্যায় প্ররোচনা।
মানুষ অসম্ভব সুখী থাকলেই বেছে নেয় স্বপ্ন মৃত্যুকে। শুধু মাত্র সুখেই ব্যাথা পায়। নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে শান্ত হয়, সুখ পায়। অথবা স্বপ্ন সম্ভব কোন প্রেম বা ঈশ্বর দেখে ভেবে নেয় নিজের মুক্তির পথ। আশ্রয় চায় সৃষ্টির কাছে, সুখের কাছে।
মানুষ জানেনা আত্মহত্যার প্রথম এবং শেষ কারণ। কোন বিষে শরীরের মৃত্যু হলেও, আত্মা আশ্রয় চায় সুখের কাছেই। যেমন ভালবাসে মানুষ। প্রত্যাখাত হয়। আবার ভালবাসে।
আত্মহত্যার পর নিহত শরীরের বুক চিরে লাশ কাটা ঘরে অনুসন্ধিৎসু চোখে হয়ত পেলেও পাওয়া যেতে পারে কোন সুখের কণা। আঁশটে পিঞ্জল বিষের গন্ধ অথবা বিষক্রিয়ার কারণ ঐ একটাই, সুখ। কিন্তু মনের নিহত হওয়ার কোন কারণ বা কোন হদিশ কেউ পায়নি কোনদিনই। প্রতিদিন কতবার যে মানুষ আত্মহত্যা করে!
পোস্টমর্টেম শেষে বর্ণালীর ভিসেরা টেস্টে পাওয়া যায় করবী ফলের কষ। কালো চুলে ছড়িয়ে ছিল হলুদ করবী ফুল। হৃদয় ছিল অক্ষত। এখনও লজ্জাবনত বুক নুইয়ে পড়েনি, আক্রোশে জমাট বেধেছে নীল শিরা উপশিরা। পাহাড়ের ভালবাসা আর বব ডিলানের বৃন্দগানের কলিতে এখনও নেচে ওঠে সমুদ্র। মেঘে ঢাকা যোনি পথ তেমনি নরম, কোমল আর অসম্ভব ঠান্ডা। ফল্গু নদীর মতো গভীর। নিহত শরীর এখনও উসকে দেয় অভিশাপগ্রস্ত ইন্দ্রের সহস্র চোখ। কাঁচা হলুদ গায়ের রঙে গড়িয়ে পড়েছে অলস দুপুরের রোদ। ঠোঁটে সেই সিন্ধু সভ্যতার খনন।
আত্মহত্যার ঠিক আগে যেমনটা ছিল পৃথিবী এখনও ঠিক তেমনটাই আছে। শুধু চাঁদ আর সূর্যের অদল বদল হয়েছে।
পাড়াতুতো তপন'দা কোমরে গামছা বেঁধে আড়চোখে দেখে গেছে হলুদ শরীর। এরপর গামছাটা খুলে আবার ঠিকঠাক পরে নিয়েছে। এতেও কি মানে পৌরুষ! উচু হয়ে থাকে বিদ্ধস্ত বৌদ্ধ ঢিবি। ব্রাহ্মণ তেল মাখাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার চাপ দিয়েছে নরম স্তনে। অন্য হাতে ছ্যাঁকা লাগে মোহন বিড়ির। তাতে কি! মাসি খুলে নিয়ে গেছে সোনার কানের দূল। প্রিয় নাকছাবিটা কিছুতেই ছাড়তে চায়না শরীর। মরার সাথে সোনা লাগে। তাই থেকেই গেল পরকালের জন্য। বোকা আকাশ অনেকদূরে বসে। পিঁপড়েদের খাওয়ার সন্ধান করে যাচ্ছে এখনও। একবারের জন্যও এমুখো হয়নি। পিঁপড়ের সারি পথ ধরেছে মধু তেলের সন্ধানে। আকাশ আজও দেখল না একবারের জন্যও বর্ণালীর নিটোল ঐশ্বর্যের চাবিকাঠি। সেই একইরকম নির্লিপ্ত চাহনি তার। অহং!
আমগাছের কাঠ, একশ গ্রাম চন্দন, আড়াইশ গ্রাম ধূপ আর টাল থেকে কেনা দেড়শ টাকার একটা সুতির কাপড়। কেউ হয়তো কাপড়টা মায়ের পুজায় ঘটের উপর দিয়েছিল। অন্তর্জলী যাত্রায় শেষ উপহার প্রিয় মানুষদের কাছে। কাঠ আর পাটশলা নিয়ে সাকুল্যে পাঁচশ কুড়ি টাকা। কাল রাতেও সাতশ টাকার বন্ধু পানীয় আকন্ঠ ঢেলে ঘুমিয়েছিল রাজা সেন। এতদিন একসাথে ঘর করেও তার স্বামী বুঝল না এই ক্যাটক্যাটে লাল রঙটা তার পছন্দ নয়! একটা গোলাপি শাড়ী আজ পেতেই পারতো বর্ণালী।
ধারে কাছে কোথাও মা নেই। জানেই না কিছু। সক্কাল থেকে কাঁচা দুধ নেই বলে রাগারাগি করছে। শিবপুজায় দুধ চাই প্রতিদিন। অম্বুবাচীর তিনদিন উপোস থাকবে জেদ ধরে হাসপাতাল বাড়ি করেছে সাত দিন। বাবা চলে যাওয়ার পর মা আজকাল কিচ্ছু বুঝতে চায়না।
বর্ণালীর এই আত্মহত্যা এই পৃথিবীতে কোন সতী পীঠের নির্মাণ করবেনা কোনদিনই। কোন বিশেষ প্রহরে কোন নদীর শরীরে বয়ে যাবে না কোন শরীর খারাপের স্রোত।
তবে আগুন জ্বলবে এবার আকাশে। সেই আগুন ছুঁয়ে যাবে মেঘেদের। কালো তুলসী পুড়ে ছাই হবে। ওলটপালট হবে সিন্ধু নদীর সভ্যতা। বর্ণহীন কোন আদুরে মেয়ে এবার কাছে গিয়ে বসবে ফল্গু নদীর। কথা হবে দুজনার। বর্ণালির পিন্ড দেবে দাশরথী। রাজা সেন এবার ফল্গু নদীতে উদোম হবে। মায়ের জেদ কমে যাবে, কাঁচা দুধের জন্য আর বায়না করবে না কোনদিন। মায়ের বেঁচে থাকার সব সম্বল ফুরিয়ে গেল। সুখের কাছে যাওয়ার সব চাবিকাঠি আজ পথ ভুলেছে। সব নিয়েছে মানুষ, শুধু থেকে গেছে ঐ নাকছাবিটা। আকাশের দেয়া একমাত্র উপহার। মৃত মানুষের শরীরে হীরেও চমকায় না।
বর্ণালির পোড়া শরীরের ছাইয়ে উর্বর হবে এবার মাটি, জন্ম নেবে লক্ষ লক্ষ উদ্ভিদ আর প্রাণীকুল। তারা ভালোবাসবে। প্রজনন করবে। মাটির কাছেই মাটির সুখ। সুখেই থাকে মানুষ আত্মহত্যার প্রহর গুনতে গুনতে। চোখের সামনে শুধু খেলা করে অজস্র ঈশ্বর কণা। একসময় সব মিলিয়ে যায়। চোখে নেমে আসে কালো তুলসীর শিরা উপশিরা।
শুধু মন ভালো নেই আমার। আমার উঠোনে চাই একটা সবুজ তুলসীর চারা। আমার দুচোখ যাকে দেখবে আমার সুখ যাত্রায়, চিনতে পারবে পরিচিত সেই সবুজ তুলসীর গন্ধ। আর বর্ণালীর সুখমৃত্যু। নীরবেই থেকে গেলে। আকাশে এবার মেঘেদের বাড়াবাড়ি। আকাশ প্রদীপ নিভে গেছে সেই কোন কালে, হদিশ রাখেনা কেউই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন