“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৪ জুলাই, ২০১২

কুশীলব



সে প্রায় পনেরো কুঁড়ি বছর আগের কথা। আমরা তিন ভাই বোন, আমি, পপি আর তপু। বিনোদন বলতে বড় চাচার ঘরের টিভি তে বাংলা নাটক আর মাঝে মাঝে সিনেমা। বেশি ঝোঁক টা ছিল নাটকের প্রতি। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি, টিভি বলতে “বিটিভি” বাংলাদেশ টেলিভিশন। যেহেতু তখন এপারে “ডি ডি ওয়ান” ছাড়া আর কিছুই ছিল না তখন আর অপারে “বিটিভি”, আর আমাদের বাড়িটা ও একদম কুশিয়ারার কাছাকাছি, তাই টিভি খুললেই বিটিভির পর্দা টা আসতো সুন্দর ঝকঝকে, “ডি ডি ওয়ান” টা ছিল একটু ঝাপসা। আর সেই হেতু আমাদের প্রথম টিভি ই ছিল বিটিভি। 

“এক সাগর ও রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না...” গানটার সুরে যখন “রাত আট টার বাংলা সংবাদ” শুরু হতো তখন সবার ই অপেক্ষা থাকতো কবে খবর শেষ হবে আর আমদের প্রিয় নাটক শুরু হবে। ততক্ষনে যার যার পছন্দের জায়গা বেছে নিয়ে আমরা বসে আছি। দর্শক বলতে আমরা তিনজন, বড় চাচার তিন মেয়ে, খালাম্মা আর মাঝে মাঝে আমদের আব্বা ও মা। খবরের মাঝখানে আমরা টিভির বিজ্ঞাপন গুলো নিয়ে আলচনা করতাম, কার কোন টা ভালো লাগে। “বউরানি প্রিন্ট শাড়ির” ঘরের খবর পরে জানলো কেমনে, এই যে এমনে, কিংবা “রূপসা রূপসা রূপসা, নরম নরম হাওয়াই চপ্পল রূপসা” আবার কখন ও “মাছের রাজা ইলিশ আর বাত্তির রাজা ফিলিপ্স” চিৎকারে যখন ঘর টা তুলে ধরতাম তখনি হটাত খালাম্মা বলে উঠতেন ঐ দেখ “পানি এ কিতা করসে” আর আমরা হা করে তাকিয়ে দেখতাম বন্যার জলে টাইটুম্বুর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেই নাম গুলো এখন ও আমার কানে বাজে, গাজিপুর, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চাপাই নবাবগঞ্জ, মীরপুর, মাদারিপুর, ফেনী, ভোলা, কিশরগঞ্জ, ময়মনশিঙ এর অনেক গ্রাম জলে প্লাবিত। লোকগুলো কাঁথা, বালিশ, কলসি, আর বেতের তৈরি ঝুড়ি তে মোরগ ছানা ইত্যাদি নিয়ে ভেলায় চেপে যাচ্ছে, করুন মুখ হা করে তাকিয়ে আছে কেমেরার পানে। বন্যায় ওদের দুর্গতি আমার একটু ও খারাপ লাগতো না, আমার খুব ই ভালো লাগতো, আমি ও হা করে তাকিয়ে থাকতাম টিভির পানে। কলকল বেয়ে চলত নৌকো, আর আমি ও ডুব দিতাম স্বপ্নে, ইশ আমি ও যদি এরকম নৌকোয় থাকতাম। 

ত্রান বণ্টন এর খবর সহ আরও কিছু খবরের পর যখন দেখতাম আবাহনী আর ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং এর গোলের খবর দিতে দিতে “আগামি চব্বিশ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাষ” শুরু হয়ে গেছে, তখন বসা টাকে আরেক টু যুত করে নিতাম আর খেয়াল রাখতাম যাতে বাকিদের স্বর টা একটু নিচে নেমে আসে। কারুর জল তেষ্টা বা অন্য কিছু পেলে এক দৌড়ে গিয়ে সেরে আসতাম। খবর শেষ হওয়ার পর দু একটা বিজ্ঞাপনের পর ই এক হাস্যজ্জল রমণী ঘোষণা দিতেন একটু পরেই দেখবেন ধারাবাহিক নাটক...কিংবা ইদ উপলক্ষে বিশেষ নাটক...। বোনেরা ঐ রমনীর সাজগোজ নিয়ে একটু আধটু আলোচনা সেরে নিত ঐ ফাঁকে, যেখানে আমার আর তপুর একটু ও কনট্রিবিউশন থাকতো না। মনে মনে ভাবতাম ঐ মহিলা বোধ হয় শুধু আমাদেরকেই নাটক দেখার মিষ্টি নিমন্ত্রন টা দিয়ে গেলেন। 

এবার শুরু, সব চুপচাপ বসে আছি। এক এক করে অভিনেতা-নেত্রিদের নাম দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা গড় গড় করে সব নাম পড়ে যাচ্ছি। ওরা যেন আমাদের চির পরিচিত আপনজন। আবুল হায়াতের নাম আসতেই সবাই বলে উঠতাম “কাশেম আলি”, ওই নাম দিয়েই যে আমাদের কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এক বিশাল নাট্য শিল্পীর, নাট্যকার হুমায়ুন আহমদ। তারপর একে একে বাকি নাম গুলো আসতো...আসাদুজ্জামান নুর (আনিস ভাই/ বাকের ভাই), হুমায়ুন ফরিদি (কান কাটা রমজান), জাহিদ হাসান, আজিজুল হাকিম, টনি ডায়েস, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়...ফেরদৌসি মজুমদার (হুরমতি),সুবর্ণা মোস্তফা, শমি কায়সার, বিপাশা হায়াত, তারানা হালিম, বিজরী বকতুল্লাহ, আরও অনেক। সব্বার সাথে যেন আমাদের রক্তের পরিচয়। আমাদের পরিচিত সব শিল্পীদের দেখে আমাদের ও খুশির সীমা নাই, সবার ই মুখে মুচকি হাসি। কিন্তু একটা নাম আমাদের কারুর ই জানা ছিল না, প্রতিটা নাটকের প্রথমেই আসতো নামটা, কুশীলব। আমারা নিজের নিজের মত করে খুঁজে বেড়াতাম, কার নামটা হতে পারে কুশীলব? এক এক করে প্রায় সব্বাইকে ই তো চিনি, তবে এই কুশীলব টা কে? উত্তর আমরা কেউ ই পেতাম না, আর ভাবতাম হতে পারে কেউ একজন কুশীলব, যিনি প্রায় সব নাটকেই অভিনয় করেন। তারপর একদিন আব্বা কথাটা শুনতে পেরে বললেন, কুশীলব হচ্ছে, যারা যারা আভিনয়ে আছেন তাদেরকে কুশীলব বলা হয়। আর এক মহা উল্লাসে বোকার মত আমারা সবাই সেই অজানা চরিত্রটাকে চিরদিনের জন্য বিদায় দিলাম। 

এরকমই হাসির স্রোতেই কেটে গেল জীবনের সেই সোনালি দিনগুলো। কত নাটক দেখা হল, অয়ময়, সংসপ্তক, বহুব্রীহি, কথাও কেউ নেই, স্বপ্নের শহর, আজ রবিবার, আরও কত নাটক, ইদ উপলক্ষে বিশেষ নাটক।। নাটকগুলোর ডায়লগ ও মনে থাকতো অনেক কাল, এখন ও আছে কিছু কিছু। “সে এক বিরাট ইতিহাস”, কিংবা “আমি হইলাম নেত্রকোনার পোলা, থুথু রে কই ছেপ” এবং এমন অনেক যা এখন ও ভীষণ ভাবে মনে পড়ে। 
এই তো সেদিন, ২০১০ এর প্রথম দিকে যখন ল্যাপটপ টা কিনলাম, ইউ টিউব এ গিয়েই সেই নাটক গুলোর নাম স্মরণ করে করে খুঁজতাম, দেখে আনন্দ হতো, বাড়িতে ফোন করে বলতাম, মা বলতেন তোর এখন ও মনে আছে? তারপর বোনের সাথে শেয়ার করতাম নাটক গুলোর টুকরো টুকরো ঘটনা...

আজ আমার সেই বোন টি ও নেই। আর ওই অবিস্মরণীয় নাটক গুলোর রচয়িতা সেই হুমায়ুন আহমদ ও নেই।

২৩ জুলাই, ২০১২;              (C) Picture:ছবি

২টি মন্তব্য:

অপরাজিতা বলেছেন...

আসলে স্বার্থক লেখক বলতে যা বোঝায়, এক কথায়, হুমায়ুন আহমেদ তাই। আপনার লেখাটি পড়ে কত কথা, কত স্মৃতি যে মনে পড়ছে সব। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখার ভেতর দিয়ে মানুষের আবেগকে এতটা সম্মান আজ পর্যন্ত আর কোন লেখকের লেখনীতে ফুঁটে ওঠেনি আমার কাছে। আপনাকে শুভেচ্ছা...

miftah বলেছেন...

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!! আমি জানতাম না যে লেখাটা এতো ভালো হবে বলে ! কথা গুলো জাস্ট মন থেকে লিখেছি, হয়তো তাই সবার হৃদয় ছুঁতে পেরেছে। দোয়া করবেন যাতে এর ভালো লিখতে পারি।