(লেখাটা গেল ২৮শে, জুলাই, ১২ দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত )
“ চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়,তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল ”----- রণদীপম বসু
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণেঃ
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”, শুধু গেরস্তালি সংসার নয়, তাবৎ জগৎসংসার। মেগা সিরিয়্যাল হোক কিংবা বলিউড সিনেমায় দৌর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার-মাফিয়ার আসরে মুজরোর আসর, সবখানেই সুখ সন্ধানে রমণী চাই। জাত্যাভিমান বজায় রাখা থেকে শুরু করে, মিইয়ে আসা পৌরুষ উদ্ধারে সফ্ট টার্গেট মেয়েমানুষ। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচেও নারী নির্যাতনের ফোড়ন না দিলে সংসদীয় রাজনীতির আসর জমে না। এসব আমরা ভালোই বুঝি, শুধু বলতে গেলেই খানিকটা দ্বিধাবোধ। গোছানো সোশ্যাল স্ট্যাটাস, মনোহরী কথোপকথনের ইয়ার দোস্তদের হারানোর ভয়। তাই সনি সরি ইস্যুতে মুখে কুলুপ আঁটতে হয়। পাঠ্যপুস্তকের সৌজন্যে পাওয়া দেশাত্মবোধ আর কলেজ রাজনীতির ‘শহিদ-শহিদ’ আস্ফালন সেই কবেই অম্বলের চোঁয়া ঢেঁকুর আর ইসবগুলের শরবতে ধুয়ে গেছে। ঝিঙ্গে-পটলের দৈনিক বাজারের চিন্তাওলা মগজে ‘সব বদলের’ উচ্চমার্গীয় দর্শনের ঠাঁই নেই। তাই জাতীয় স্তরে আলোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনায় আমরা মিনমিন করে প্রতিবাদ করি। ঘটনার বর্বরতা তেমন দাগ কাটে না বরং রসালো বিশেষণে পাকানো কাগুজে প্রতিবেদন উপভোগ করি। “আহা, ওই মহিলার চরিত্র, নিদেনপক্ষে পূর্ব ইতিহাস দেখতে হবে না নাকি? ” গোছের প্রতিক্রিয়া দিয়ে গোঁফটা চুমরে পুরুষত্ব ঝেড়ে নিই। একদল চরম অসভ্য মাস্তানদের ততোধিক অসভ্য মারধোর-শ্লীলতাহানির পরও আমাদের হাতে থাকে চারিত্রিক স্খলনের টেক্কা! দোষীদের জনতার কাতারে রেখে আমরা বলি “ এ হচ্ছে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ ”। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখতে মহান গণতন্ত্র চলে যায় ডিসেস্টার কন্ট্রোল মোডে। তারপরও আমরা মানুষ বৈকি। এই সুইডো-মনুষ্যত্ব দেখে ‘ধরণী দ্বিধা হও’ বলার মতো কেউ থাকেন না। আবার ঘটনা ঘটে, মোটা চোখে দুএকটা আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। অন্যথায় বিশ্ব জুড়ে আকচার ঘটেই চলেছে নারী নির্যাতন। মেয়েটি রাজপথে নির্যাতিত হল। সদ্য গোঁফ গজানো চ্যাংড়া যুবক, পুর্ন সাবালক, সব মিলিয়ে এক দঙ্গল তথাকথিত রাজপথের গার্জেনরা সমাজ সংস্কারের নমুনা পেশ করলেন। আধুনিক পোশাক-আশাক, বারে গিয়ে জন্মদিন পালন, ডিস্কোথেক ইত্যাদি বরদাস্ত করা হবে না! ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে পাপড়ি-মিতালি-সুইটি-রা চোখ রাঙ্গানিটা দেখে নিল। পুরুষতন্ত্রের গো-ধরা কাপুরুষ আর নিজেদের ভারতীয় সংস্কৃতির একমাত্র পরিবেষক-বিতরক-রক্ষক দাবি করা পিউরিটানরা ব্যাপক পুলকিত হলেন।
অনেক সময় দেখা যায় জননেতারাও আম-আদমিকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহ দিচ্ছেন, “ ভিন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করা ছেলে-মেয়েদের বাঁশ দিয়ে পেটান”, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে ইউপি, হরিয়ানার ‘অনার কিলিং’ আর এ হেন বিবৃতির মধ্যে গুনগত তফাৎ কোথায়? এই তো সদ্যই উত্তর প্রদেশের বাগপথ অঞ্চলে গ্রামীণ খাপ পঞ্চায়েত চল্লিশ বছরের নিচের মহিলাদের জন্য একগুচ্ছ তালিবানি নীতি-নিয়ম জারি করেছেন। মাথা অনাবৃত রাখা যাবেনা, মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ এবং সন্ধ্যের পর বাড়ির বাইরে বেরুনো বরদাস্ত করা হবেনা। এমনকি ‘লাভ ম্যারেজ’ করা ছেলে-মেয়েদের গাঁয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যতোই তালিবানি হোক, এও একধরণের সোশ্যাল গার্জেনশিপ। তাই ঘাঁটাঘাঁটি নৈব নৈব চ। স্থানীয় খাপ পঞ্চায়েতের তরফে বলা হয়েছে, ভালোবেসে বিয়ে করাটা হিন্দি সিনেমার কু-প্রভাব। এই নোংরা প্রেমজ বিবাহ বরদাস্ত করা হবে না। পঞ্চায়েতের আইন অমান্য করে বিয়ে করলে সমাজে স্থান দেওয়া হবে না। মোবাইলে ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করা নিয়ে যে যুক্তি পেশ করেছে পঞ্চায়েত তা এরকমঃ প্রেমজ বিয়ের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের ভূমিকা থাকে। এই ফোনের সাহায্য নিয়ে অপহরণের ঘটনাও সংগঠিত করা হয়। এই মোবাইল ফোন দিয়েই ছেলেরা মেয়েদের উত্যক্ত করে। কমবয়েসি মেয়েরা যদি মোবাইল ব্যাবহার বন্ধ করে দেয় তাহলে ওই ভাবে উত্যক্ত করা সম্ভব হবে না। তরুণীরা একা একা বাজারে-হাটে গেলেও উত্যক্ত করার ঘটনা ঘটে। সেজন্যই একা বেরনো নিষেধ। চল্লিশ বছরের নিচে সকল মহিলাকে তাই মাথামুখ ঢেকে বাইরে বেরতে হবে।
এভাবেই সমাজে সুস্থিরতা বজায় রাখতে শুধুমাত্র মেয়েদের ওপর চাপানো হয় কড়া আইন কানুন। এতে ফুটে উঠে পুরুষশাসিত সমাজের এক মালিকানাবোধ। শৈশব থেকে মেয়েরা দেখে যান যে তাদের ঘিরেই রয়েছে যতো সব নিয়ম কানুন। বলা না বলা, এক অদৃশ্য গণ্ডি। এটা বহাল থাকে স্কুলে, কলেজে, গেরস্তালিতে, কর্মক্ষেত্রে। সরাসরি না বলা হলেও মেয়েরা যেন ভোগ্যপণ্য। ভোগ করো এবং সুরক্ষা দাও। মালিকানা বিহীন স্বাধীন নারী আজ তাই নড়বড়ে পুরুষতন্ত্রের ত্রাস। সমান অধিকার চাইতে গেলেই আদর-অনুরাগ এবং ঘৃণার মধ্যে থাকা সরু লাইনটা উৎকটভাবে প্রকট হয়ে পড়ে।
স্যরি, বন্ধু হতে পারলাম নাঃ
“আছেন বাৎস্যায়ন আর খাজুরাহো / ভাদ্র মাসের বেয়াড়া উৎসাহ”, এমনসব বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে সময় কাটাতে ভালোবাসে—এমন একজনের সঙ্গে কথা হল। তার মতে, বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিমণ্ডলে বড় হওয়াতে সে মজে আছে “ঘেটো কমপ্লেক্সে”। উনিশকুড়ি-র এই যুবক খানিকটা মজার ছলে জানায়ঃ “ আমি বা আমরা ঠিক কী চাই, তা স্বয়ং খোদাতাল্লার বুঝে ওঠার জো নেই। খুব সামান্য ক’টা দিন হল ইন্টারনেটের সঙ্গে দোস্তি পাকিয়েছি । সেই সূত্রেই ফ্লার্ট করার স্থূল মানসিক চাহিদা প্রশ্রয় পেয়েছে। কারণ কি শুধুই পুঁজিবাদি-সাম্রাজ্যবাদি প্রলোভন? আসলে মেয়েদের সঙ্গে ভালো করে বন্ধুত্ব করার সুযোগ হয়না অনেকেরই,মেয়েরা থাকে সেই মেয়েদের মতোই,লজ্জার শামুকখোলের নিচে। সমাজের কুশিক্ষা পেয়ে মেয়েদের দেখেছি-শিখেছি মেয়েদের মতো করেই,মানুষ হিসেবে দেখিনি। চারপেয়ে প্রাণী যাঁরা। ওদের বিয়ে দিতে হয়,নিজেদের (আমাদের) একখানা যোগাড় করতে হয় এবং তা ওই বিয়ের মাধ্যমেই। বিয়ের আগে বন্ধুমহলে রোয়াব দেখাতে কিংবা মনের সুড়সুড়ি মেটাতে সাময়িকভাবে একখানা প্রেম যোগাড় করতে হয়---বাজারচলতি মানসিকতার শিক্ষা এই। তবে, বিধিসম্মত সতর্কীকরন। পালিয়ে বিয়ে করলে যৌতুক জোটে না!
আশেপাশে মেরিকম,জ্বওয়ালা গুট্টু, সানিয়া মির্জা,নিদেনপক্ষে ডবল্যু ডবল্যু ই-র রগচটা মেয়েদের দেখিনি আশেপাশের জীবনে। কলতলায় জল নিতে আসা ঝগড়ুটে মাধবী আর বিকেলবেলা এন্ডিং লটারি,তীর খেলার রেজাল্ট মেলাতে আসা কুলসুমের মা কে দেখেছি, যাদের মেয়েমানুষ বলে গণ্য করেন না আমার লেখাপড়া জানা মা-মাসিরা। তাই ধারনা হয়েছে মেয়েমানুষ মানে নিতান্তই একধরনের কোমল-মিহি জীববিশেষ,যাদের কাজ হচ্ছে যৌবনে যুবকদের মনোরঞ্জন করা আর পরবর্তীকালে মা-মাসি হয়ে হেঁসেল ঠেলা। কো-অ্যাডুকেশন না হওয়ার সাইড এফেক্টও রয়ে গেছে। ছোটবেলাই সব ধারনা গড়ে ওঠে কি না ! সাধেই কি লোকে স্বীকার করে যে নারীর মন বোঝা হল না ! আপনারা বলবেন বোন-দিদি ওরা গেল কই? আরে কন্যা সন্তান জন্মাবার পরেই মা-বাবার গবেষনা শুরু হয় মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে,মেয়ে কালো-না ফর্সা? বিয়ের টাকা জমানোর জন্য দু’তিনটে ইন্স্যুরেন্সের কিস্তি দেওয়া আরম্ভ। রাখঢাক না রাখা অভিবাবক আগেই শুনিয়ে রাখেন,এই মেয়ে ফর্সা,ভালোয় বিক্কিরি হবে! (খাঁদা নাক,কালো রঙ হলে সমস্যা আছে)। রান্নাবাটি আর পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে বালিকারাও জেনে যায় তাদের সাফসুতরো থাকতে হবে। লম্বা চুল রাখতে হবে,ঠোঁটে-নখে রঙ লাগাতে হবে। ছোটবেলার বান্ধবী হঠাত একদিন আর ফুটবল-ক্রিকেট খেলতে আসে না। জবরদস্তি রুটি বেলা,ভাতের ফ্যান গালা (মধ্যবিত্ত বাড়িতে) শেখানো হয়। উচ্চবিত্তের দিকে তাকিয়েও হতাশ। পি এইচ ডি করা ডঃ বেগম অমুক,হিজাব ধারন করেন ! শুকুর আলহামদুলিল্লাহ । তখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাবার কথা উঠলে বান্ধবীদের না বলেন আর মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দেন এই ভেবে যেঃ দুনিয়াবি আমোদ-আহ্লাদ ইহুদি-নাছারাদের জন্য,আমাদের জন্য আল্লাহ বেহেস্তে রেখেছেন বেশুমার বিনোদন। হ্যাঁ,তখন জোকার নায়ক মাথায় বাসা করেন বলে নিজেকে বিপ্লবী মনে হয়।
অজানা পুরুষ ধর্ষক-সম, তাই মেশামেশি নৈব নৈব চ। অতএব দুরত্ব বাড়ে। এই দূরত্ব থেকেই বোধহয় পুরুষদের পিশাচ মনে হয়। আর পুরুষরা ওদের খাদ্য হিসেবে দেখতে শুরু করে। ”
পরম্পরাগত নীতি-নিয়ম, মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে আজকের ‘আমেরিকান পাই’-ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির ঠোকাঠুকি শুরু হয়েছে। ঘাত প্রতিঘাতে বিদ্যমান থাকছে মহান হেগেলীয় দ্বন্দ।
‘ সাহায্য করুন নয়তো জীবনটা শেষ করে দিতে দিন ’
সোনালী মুখার্জির সরকারের প্রতি আবেদন মন খারাপ করে দিয়েছে। দোষীরা আজও সাজা পায়নি। বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। টিভিতে খবরটা দেখানোর পরই মেজাজটা বিগড়ে গেল। ভাবতে গেলে করিমগঞ্জ-গুয়াহাটি-বাগপথ সবই যেন একসূত্রে গাঁথা। এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে উপমহাদেশে অ্যাসিড ছোঁড়ার ঘৃণ্য প্রবণতার বিষয়টি, সোনালী এই বর্বরতার শিকার। বিতর্কিত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ‘ নো কান্ট্রি ফর উইম্যান ’ বা ‘ নারীর কোনও দেশ নেই ’ শীর্ষক ব্লগের সাম্প্রতিক পোস্টে লিখেছেন, “ আমাদের জখম করা বা চেহারা-ছবি বিকৃত করার উদ্দেশ্যে পুরুষরা আমাদের উপর অ্যাসিড ছোঁড়ে। তারা আমাদের গায়ে অ্যাসিড ফেলে, চোখ জ্বালিয়ে দেয়, নাক থ্যাঁতলে দেয়, চোখ গলিয়ে দেয়, এবং সুখি মানুষের মতো চলে যায়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়া এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশে এমন অ্যাসিড হামলার ঘটনা সচরাচর ঘটে। নির্যাতনের প্রতিবাদ করায়, যৌন হেনস্তায় সায় না দেওয়ায়, বিয়ের প্রস্তাব, যৌতুকের দাবিতে, স্কুলে যাওয়া নিয়ে, বোর্খা না পরায়, হিজাব না রাখায়, ভালো আচরণ না করায়, খুব বেশি আপন মনোভাব ব্যক্ত করায় কিংবা শুধুমাত্র নির্ভেজাল আনন্দের জন্য ক্ষিপ্ত পুরুষরা আমাদের উপর অ্যাসিড ছোঁড়ে।
ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে বছর আঠারোর কলেজ পড়ুয়ার ওপর তিনজন প্রতিবেশী দুবছরেরও বেশি সময় ধরে যৌন হয়রানি করে, এবং পরে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে। ওর মাথার খুলি, চেহারা, গলা, বুক এবং পিঠের চামড়া গলে গিয়েছিল। ধানবাদ উইম্যান্স কলেজের সোসিওলোজি অনার্সের প্রাক্তন ছাত্রী এবং এনসিসির সিনিয়র সার্জেন্ট সোনালী মুখার্জি, আজ সম্পূর্ন অন্ধ এবং আংশিকভাবে বধির। ওর বাবা লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন মেয়ের চিকিৎসায়। ওদের কাছে এখন আর টাকা নেই। হামলাকারীরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছে। ওই হামলার নয় বছর পরও সুবিচার মেলেনি। এবার তিনি সরকারের কাছে ‘ সাহায্য দেওয়া হোক, নয়তো তাকে মরে যেতে দেওয়া হোক ’—এমন অনুরোধ রেখেছেন। কম্বোডিয়াতে এক অ্যাসিড হামলায় সক্রেউন মিন পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। তার মুখমণ্ডল সহ শরীরের উর্ধাংশ বিকৃত হয়ে যায়। জার্মান সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার কার্স্টেন স্টর্মার জানান, “ অ্যাসিড আক্রান্তরা তাদের চেহারা-ছবি এবং দৃষ্টিশক্তি ছাড়াও অনেক কিছু হারিয়ে বসেন। পরিবার ভেঙ্গে যায়। স্বামীরা পত্নীদের ত্যাগ করে। শিশুরা তাদের মা-বাবার থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। রাতারাতি চাকরি চলে যায়, পেশাদাররা পরিণত হয় ভিখিরিতে। অনেক আক্রান্তদেরই ক্রমাগত অন্যের সাহায্য ছাড়া একটা দিনও গুজরান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যার দরুন তারা পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ান।... কাউকে সারাজীবনের জন্য কষ্ট-ভোগান্তি দেওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে ব্যাটারি অ্যাসিড । রাস্তার পাশে যে কোনও দোকানে এক ডলারে লিটারের সামান্য বেশি অ্যাসিড অনায়াসে মেলে। কদাচিৎ-ই দোষীদের শাস্তি হয়। ” নিজের স্বামীর হাতেই হামলার শিকার হন পাক মহিলা ফখরা ইউনুস। স্বামী বিলাল খার পঞ্জাব বিধানসভার প্রাক্তন সদস্য এবং পাকিস্তানি রাজনীতিক গোলাম মোস্তাফা খারের পুত্র। দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়ার পরই বিলাল স্ত্রীর মুখে অ্যাসিড ছোড়ে। ‘মাই ফিউডাল লর্ড’ বইয়ের লেখিকা এবং বিলালের এককালের সৎ মা তেহমিনা দুরানি ফাখরাকে সারিয়ে তোলার অনেক চেষ্টা করেন। ফাখরাকে সাহায্যের জন্য ইতালিতে পাঠানো হয়। উনচল্লিশটি পুনর্সংস্থাপনা মূলক সার্জারির পর ফাখরা আত্মহত্যা করেন।
গোটা পৃথিবী জুড়ে এমন ঘটনার অভাব নেই। পারিবারিক কলহ, যৌতুক, কন্যা সন্তানের প্রতি বিদ্বেষ, প্রেমে সাড়া না দেওয়া, ইভ টিজিং-এর প্রতিবাদ---প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে অ্যাসিড ছুঁড়ে। সামাজিক সুশিক্ষাই পারে এই বর্বরতার প্রাথমিক বিকাশকে রুখে দিতে। চাই কড়া আইন। নারী-পুরুষে সমানাধিকার, বিশ্বাস, সহানুভূতি এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার বন্ধুত্বের শক্ত বাঁধন।
সংবিধান প্রদত্ত সমানাধিকার স্থাপিত করতে, একে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সবাইকেই মুখ খুলতে হবে। লিঙ্গ বৈষম্যের সাপকে ফণা তোলার আগেই থ্যাঁতলে দিতে হবে। করিমগঞ্জের ঘটনায় বরাক উপত্যকা প্রতিবাদ-মুখর হয়েছে। জি এস রোডের সেই নির্মম রাতের পর গোটা দেশে বিরাট প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চর্চার বিষয় অনেক , ওই গুন্ডা-লোফারদের পশুও বলা যায় না। সুবিচার দিতেই হবে। বৈঠকখানার বিনোদনে ন্যায্য ভাগ বসিয়েছে ঘৃনা-প্রতিবাদ। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়েছেন সমাজকর্মীরা। “ উই ওয়ান্ট জাস্টিস ” শ্লোগানে রাজধানী কাঁপালেন কালো পোশাক পরা বিরাট সংখ্যক ফেসবুক ফ্রেন্ডরা। আমাদের মনুষ্যত্ব সত্যিই ন্যায়ের পথ খুলে দিয়ে সমানাধিকার স্থাপনের ক্ষমতা রাখে। তবে এখনো অনেক বন্ধুর পথ হাঁটার বাকি।
(সোমবার ১৬ জুলাই ২০১২)
(সোমবার ১৬ জুলাই ২০১২)