জীবন নিয়ে খাঁচার ভিতর অচিন পাখি জড়িয়ে রাত-প্রভাতের মত কর্মব্যস্ততার অবধারিত ঘুর্ণনে জীবন চিত্রের বদল ঘটে হরেক দিন, এটাই মানব জীবন। চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের প্রাক্পর্ব পর্যন্তও স্বাভাবিক থাকে জীবনাচরণ কোনো কোনো সময় মানুষের, জীব-জন্তু বা পশু- পাখির। চৈত্রের কালবৈশাখী, আষাঢ়ের বাধভাঙা জলেচ্ছ্বাস যেমন ছিন্নভিন্ন করে দেয় প্রকৃতির সাজানো সংসার, তেমনি মানবসভ্যতা ও সতর্কতার তরীকে জীবন নদীস্রোতের বিপরীতে নিয়ে এড়িয়ে চলে বিপদের লাল-সঙ্কেত কাটানো প্রহর।
প্রকৃতিই কখনও আপন খেয়ালে নিজের উল্লাসে মেতে ওঠে, ঝড় হয়ে দেখা দেয় প্রাণধারীর আয়ুতে, আবার প্রকৃতিই কখনও চোখের জলে ভাসিয়ে দেয় স্থল— চরভূমি জলের গভীরতা বাড়াতে। অর্থাৎ প্রকৃতিই প্রকৃতির ওপর— নিজের মনে ও শরীরে চালায় শাসন। অধিকার, হুকুম বা কখনও চূড়ান্ত ঘোষণা; যার ফলে প্রকৃতির সন্তানেরা প্রকৃতিরই লীলায় জীবনের সিসিফাসের ভূমিকায় নানান অবস্থাবৈচিত্র্যের পাথর ঠেলে যায়।কালের আপন খেয়ালে এভাবেই তো মহাবিশ্ব তার গতিব্যস্ততা নিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করে।
উত্তর পূর্ব ভারতের বাংলা কবিতার জগতে কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই, আমার সে দুঃসাহসও নেই। আমি একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে তার কবিতার প্রতি আমার ভালোবাসা ব্যক্ত করছি মাত্র। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে লিখতে এসেছিলেন প্রবুদ্ধসুন্দর কর। তার কবিতায় দেখা যায় মনের গভীরতম স্তরে সুখ, শান্তি ও স্থিতির উপরে অন্য কিছুকে মূল্য দিয়ে থাকে।আমরা যেখানে চাই কোনো-এক পরম ও নামহীন সুখ, কোনো-এক চরম নামহীন দুঃখ; এবং যা আমরা জীবনে পাই না, কিংবা যা চাইবার সাহস হয় না আমাদের সেইসব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাই জীবনের বাইরে খুঁজে বেড়াই। তাঁর জীবন ছিলো একজন বিশুদ্ধ কবির জীবন; যিনি সাহিত্যকে একধরনের ব্রত হিসেবে, নিজের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিতার মধ্যে দিয়েই তিনি নিজের আত্মসচেতনতার বোধকে নিরন্তর খুঁজে চলেছিলেন - এটাই প্রবুদ্ধসুন্দর করের স্বধর্ম।
কবি তাঁর কবিতায় বলেছেন - গানের ভেতর তোমার প্রশ্বাস স্পষ্ট শোনা যায়/মৃদু, তবু তীব্র এই শ্বাস ছাড়া যেন/সমূহ অন্তরা আজ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তিনি সেইসঙ্গে এইটিও বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিজের চৈতন্যের দ্বারা সবসময় নিজেকে পরিচালনা করা— মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কবির ভাঁড় কবিতায় 'জন্মনিরোধক আর বেবিফুড কিনে বাড়ী ফেরে/সেইসব সংখ্যালঘু অর্দ্ধদগ্ধ ভাঁড়/তাদের গোপন আড্ডা থেকে আমাকেও চিঠি দেয়/তীব্র হাহাকার আর গোঙানি মেশানো -- জীবনকে কবিতার সঙ্গে, কবিতাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কোনো কিছুকেই বিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং সমগ্রতার মধ্য দিয়ে সামঞ্জস্য নির্মাণের চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি।
একজন কবিকে প্রতিকূল পরিবেশে যা সবসময় সহায়তা করে, সেইটি হচ্ছে তার নিজস্ব একাকিত্বের বোধ। রিলকে গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন যে শিল্প সবসময়ই এই অন্তহীন এককিত্বের ফসল। একমাত্র ভালোবাসা, আন্তরিকতাই পারে তাকে কোনো-নাকোনোভাবে স্পর্শ করতে। এই বিশ্বাস থেকেই রিলকের মতো কবি বলতে পারেন,জঙ্গলের ভেতর কোথাও এক পরিত্যক্ত রেডিও স্টেশন/কোনো একদিন খুঁজে পেলে জেনো, স্তব্ধতাই এর সিগনেচার টিউন'।
কবি প্রধানত নতুন সমাজের একজন অভিনব প্রেক্ষক।নিজের নিজের জীবনের অনুভূত প্রকৃতিকেও সমাজের মতোই কবিতার বাঁধনে ঢেলে পরিবেশন করেন। প্রতি কবির সৌন্দর্যবোধ আলাদা। কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের যে সৌন্দর্যচেতনা কবিতায় উদ্ভিন্ন তা-ই বাস্তবের বিশিষ্ট সন্ধান। কবির ভাষায়— “ প্রেমিক ও তোমার মাঝখানে নড়বড়ে সাঁকো পার হতে গিয়ে বুঝেছিল কবি,কাকে বলে ছায়াপ্রতারণা। স্থির জলে প্রেমিকের ছায়া, মুখে মাংসখন্ড, দেখে কবি কেঁপে উঠেছিল। লোকমুখে শোনা যায় নিজের ছায়াকে তার, প্রেমিকের ছায়া ভেবে ভ্রম হয়েছিল।”
গত পঁচিশ বছরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাতটি কবিতার বই। উত্তরপূর্বের তরুণ কবিদের নিয়ে সম্পাদনা করেছেন শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতার সংকলন। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন উত্তরপূর্বের কবিতা।'বাংলাকবিতা'-র ১০টি সংখ্যার ছিলেন যৌথ সম্পাদকও। অনুবাদ করেছেন ভারতবর্ষের প্রাদেশিক অন্যান্য ভাষার সমকালীন কবিতা। কবি ও তাঁর কবিতার বিশ্লেষণের আর শেষ নাই।পরতে পরতে খুলে যায় তার বিভিন্ন দিক। তবে 'পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে পাথরের ফলকের গায়ে স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তির মতো ইঙ্গিতবহ এ আর্তি' -- এর বুকের ব্যাথাটুকু যে আমাদের প্রতিনিয়ত বিষণ্ণ ও শঙ্কিত করে তুলবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন