।। সুশান্ত কর ।।
(লেখাটি ২৪ জুলাই, ২০২২ -এ করিমগঞ্জ আসাম থেকে জাহিদ রুদ্র সম্পাদিত "মননভূমি' কাগজে প্রকাশিত।)
পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের সর্বত্র ‘ভাষা আইন' আছে। পশ্চিমবঙ্গে শুরুতে কেবল বাংলা ও ইংরাজিই স্বীকৃত সরকারি ভাষা হলেও এখন আরও এগারোটি সহযোগী সরকারি ভাষা রয়েছে। অসমের বরাকের তিন-জেলাতে যেমন বাংলা, পশ্চিম বাংলাতেও দার্জিলিঙের তিন জেলাতে নেপালি সহযোগী সরকারি ভাষা। এ ছাড়াও নানা জেলা এবং ব্লক স্তরেও যদি কোনও ভাষিক গোষ্ঠীর মানুষ ১০%-ও রয়েছেন—সারা রাজ্যে হয়তো ১%-ও নন—তেমন অনেক ভাষাও স্বীকৃত । যেমন উর্দু, হিন্দি, ওড়িয়া, সান্তালি, কুরুখ, তেলেগু, কুর্মালি, তেলেগু, কামতাপুরি, রাজবংশী এমন কি পাঞ্জাবিও। অর্থাৎ মোট চৌদ্দটি সরকারি ভাষা। কোথাও অসমিয়া জনসংখ্যা ১০% হলে অসমিয়াকেও সহযোগী সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিত। না দিলেও অসমিয়াতে ব্যানার লাগিয়ে অসমিয়া অনুষ্ঠান করলে সারা বাংলাতে কেউ বাধা দিতে যান না।পশ্চিম বাংলা বলেই না,দেশের সব রাজ্যেই অন্তত বড় বড় শহরে অসমিয়া অনুষ্ঠানাদি হয়—অসমিয়াতেই হয়—অসমিয়াতেই তার প্রচার হয়। তাই বলে কি কেউ তাতে বাংলা ভাষার বা তামিল তেলেগু ভাষার বা মারাঠি ভাষার বা হিন্দি ভাষার অবমাননা হল বলে হুমকি ধমকি দিয়ে থাকেন? যান না। এমন করবার কল্পনাও করেন না। আর সংবিধানও এর অনুমতি দিয়ে থাকে। সংবিধানের ২৯ এবং ৩০ অনুচ্ছেদে সমস্ত সংখ্যালঘু ভাষা চর্চার অধিকার সুরক্ষিত। সেই জন্যে অসমেও যখন বাঙালি বা অন্য-ভাষিক সম্প্রদায় অনুষ্ঠানাদি করেন সরকার এখানে এইসবে বাধা দিতে আসে না। অধিকাংশ অসমিয়া মানুষও এতে আপত্তি করবার কিছু দেখেন না —আসে যারা কোনও আইনের ধার ধারে না। অনেকটা সারা দেশে হিন্দু নামধারী কিছু সংগঠন যেমন করে—আইন তারা নিজের হাতেই নিয়ে নেয়। অসমে এখন লাচিত সেনা ও এমন কিছু সংগঠনও তাই করছে।
দেখা গেছে জাতীয়তাবাদীদের ভয়ে তটস্থ দক্ষিণ পন্থী দলগুলোও এই নিয়ে রা তো করেই না, কিছু বাম ব্যক্তি বা দল বা সংগঠনও মনে করেন লাচিত সেনার তরুণরা হচ্ছেন ‘সংগ্রামী বন্ধুসকল' আর প্রদীপ দত্তরায়ের বিডিএফ বা অন্যান্য বাঙালি সংগঠনগুলো ‘সাম্প্রদায়িক'। সে নাহয় তাঁরা বলুন। কিন্তু সেই প্রগতিশীল বা ‘বামে’রা যতক্ষণ লাচিত সেনাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলতে পারছেন না ততক্ষণ সাধারণ বাঙালিকে -- এমন কি ‘প্রগতিশীল’ যারা রয়েছেন বা হতে চাইছেন তাদেরকেও --- সঙ্গে পাওয়া কঠিন।একজন প্রগতিশীল বাঙালিও বাঙালি হবার ‘অপরাধে’ আক্রান্ত হবার ভয়ে থাকেন। ঠিক যেমন একজন প্রগতিশীল যেকোনও ভাষী মুসলমান হিন্দুত্ববাদীর ভয়ে থাকেন। বাঙালি সাম্প্রদায়িকেরা অসমিয়া প্রগতিশীলদেরও এভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আক্রমণ করেন না, সাহস করেন না। কা বিরোধী আন্দোলনের দিনে, মনে আছে কি, বিধায়ক শিলাদিত্য দেব—কিছু বাঙালি সংগঠনকে নিয়ে গুয়াহাটির খানাপাড়াতে একটি সমাবেশের আহ্বান দিয়ে পরে নাকখত দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। অসম সাহিত্য সভার সঙ্গে মিলে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের স্মরণ অনুষ্ঠান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। স্থিতি ঠাণ্ডা হতেই সব ভুলে গেছিলেন। এমন কি সাম্প্রতিক তিনসুকিয়ার ঘটনাতে দেখা গেছে বহু হিন্দুত্ববাদী যারা হিন্দু বলে বাঙালি ও অসমিয়া ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন --- তাঁরাও আতঙ্কিত। তবু হিন্দুত্ববাদীরা কখনও বা বাম-অসমিয়া তো বটেই আসুর মতো জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেন—যখন অসমিয়া নয়—আক্রমণের লক্ষ্যমুখ থাকেন মুসলমান। যতই নিজেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলুন—অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা ইসলাম বা মুসলমানের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে বা বললে—সাধারণত মুখ খুলেন না। এত এত ফেক এন্টাকাউন্টার নিয়ে কজনে কথা বললেন? কিন্তু নগাঁওতে আসুর সদস্য কীর্তিকমল বরা আক্রান্ত হলেই শুধু এরা এমনই সরব হলেন যে পুলিশ প্রধানকেও শহর ছেড়ে চলে যেতে হল।
সম্প্রতি তিনসুকিয়া সহ উজান এবং মধ্য অসমে একাধিক শহরে বাংলাতে লেখা ব্যানারে,দেওয়াল লেখাতে কালি মেখেছে লাচিত সেনা। যেন কালি মাখানো অভিযান শুরু করেছে। কিছু বাঙালি সংগঠন ভাটি অসম থেকে সমানে উগ্র ভিডিও ভাষণ দেওয়াতে দিন কয় ভিডিও যুদ্ধ হল। ২২ জুনের তিনসুকিয়ার ঘটনা এর জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সেখানে একটি সংগঠন ছিল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, আরটি ছিল বর্ণালি শিশু কল্যাণ সংস্থা। আরও একটি বিপদনাশিনী পুজোর ব্যানার ছিল। প্রথম দুটির জন্যেই লোক আতঙ্কিত হয়েছেন বেশি, ক্ষুব্ধও। যেখানে সেই ঘটনা হয়েছে -- সেই দুর্গাবাড়িতে একটি প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এটি। এখানে সব ভাষাতেই অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে। কিন্তু বাঙালির সংগঠনগুলো এখানেই সভাসমিতি ইত্যাদি করে থাকেন। অসম আন্দোলনের দিন থেকে কা-বিরোধী আন্দোলনের দিনেও এখানে বাংলা ব্যানার টানানো হয়েছে, তোরণ হয়েছে। অনুষ্ঠান হয়েছে। কেউ কখনও বাধা দেয় নি। কা-বিরোধী আন্দোলনের শুরুর দিনে ২০১৬-র ডিসেম্বরে এই প্রেক্ষাগৃহেই ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’র আহ্বানে উত্তর পূর্বভারত বাংলা ছোটো কাগজ সম্মেলন হয়েছিল। সারা শহরে বাংলা ব্যানার লেগেছিল—কেউ বিরোধিতা করেনি। আজ শুরু হয়েছে—যখন জাতীয়তাবাদ নিজেই হিন্দুত্বের চাপে বিপন্ন। অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে—তখন এই নতুন সংগঠনটি খালি ময়দানে নিজেদের চ্যাম্পিয়ন করতে নেমেছে। এরা কেবল ব্যানারেই কালি মাখে না—এখানে ওখানে বাঙালি ছোটো দোকানদারকেও নানা কারণে হেনস্তা করছে। এদেরই মতো একটি সংগঠন অসমিয়া যুবমঞ্চকে দেখা গেল ব্যানার প্রসঙ্গে যেভাবে ভিডিও হুমকি টুমকি দিল—দুদিন পরে লক্ষিমপুরে এক বাজারে মুসলমান মাছব্যাপারির তকি মাটিতে ফেলে অপমান করল। ওদের অন্ধ ধারণা যে অসমিয়া মুসলমান বাকি মুসলমানের মতো কিছুই করেন না না। এরা ‘প্রায় হিন্দু’। হিন্দু এরা বলবেন না, বলবেন ‘অসমিয়া’। ফলে বাংলা ব্যানার টানানো যেভাবে পাপ, মুসলমানের তকি লুঙ্গি দাড়ি রাখাও পাপ। আজ অব্দি শোনা যায় নি—শার্ট প্যান্ট পরা কোনও মুসলমানকে এই জাতীয়তাবাদীরা হেনস্তা করেছেন বলে।
দুর্গাবাড়িতে সেরকম বাংলা ব্যানার টানানো বা অনুষ্ঠান করা নতুন কোনও কথা নয়।তিনসুকিয়ার এক অগ্রণী বাম-সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন অশোক কর্মকার। লিবারেশন সিপি আই এম এল করতেন। আই পি এফে ছিলেন। জন-সাংস্কৃতিক পরিষদেও ছিলেন। যতদূর জানি—তিনি এই নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনেরও সদস্য ছিলেন, বর্ণালি শিশু কল্যাণ সংস্থারও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’র তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। প্রতিষ্ঠার দুবছর পরে তাঁর অকাল বিয়োগ ঘটে। কিন্তু তাঁর আদর্শ পরবর্তী পনেরো বছর পরেও এই একটিই সংগঠন ধরে রেখেছে। তিনি অসমিয়া বাংলা দুই ভাষাতেই লিখতেন। নাটক লিখতেন। প্রবন্ধ লিখতেন। নাটক করতেন। অগত্যা তাঁর দুই সমাজেই প্রতিষ্ঠা ছিল। কিন্তু সেই যে সন্ত কবিরকে নিয়ে গল্প আছে—তাঁর মৃত্যুর পরে হিন্দু শিষ্যরা চাইছিল শ্মশানে নিয়ে যাবে, মুসলমান শিষ্যরা চাইছিল কবর দেবে। শেষে শবের চাদর তুলে দেখা গেল দেহ নেই—কিছু ফুল পড়ে আছে। অশোক কর্মকারও এখন দ্বিখণ্ডিত। তাঁর স্মরণে ছবি শোভা পায় বিষ্ণু-জ্যোতি সাংস্কৃতিক সমাজে। তাঁর প্রয়াণ দিবসে স্মারক বক্তৃতাও হয় কখনও কখনও। সেটি মূলত অসমিয়াদের সংগঠন। আর ছবি নেই স্মারক বক্তৃতা নেই—তবু নানা ভাবে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত কাগজকে ধরে রেখেছে ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’। তিনি দেখে যান নি যে তাঁর কাগজ এখন গোটা পূর্বোত্তরে বা তার বাইরেও একটি পরিচিত নাম। এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবাদে শহরের অগ্রণী নাম। এমন একটি অসমিয়া কাগজও এই শহরে নেই। ডিগবয় থেকে নতুন সাহিত্য পরিষদের একটি পত্রিকা কখনও বেরিয়ে থাকে।
অশোক কর্মকারের সতীর্থ কিছু লিবারেশন কর্মী সমর্থকও উজানে ছিলেন, বা আছেন। অন্য বামদলের সমর্থকেরাও রয়েছেন। ডান দলেরও লোক আছেন। শাসক দলেরও সমর্থক এই গোষ্ঠীতে রয়েছেন। গুটি কয় মানুষ—সামাজিক দায়বোধ থেকে কাজ করেন—সেখানে ভাবাদর্শের গণ্ডি সংকীর্ণতারই নামান্তর হয়ে যায়। সেই ‘উজান’ বহু অনুষ্ঠান এই দুর্গাবাড়িতে করেছে। কখনও অসমিয়া ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি বিরোধী কোনও কাজ করেনি। যদিও নিজেদের বাংলা ব্যানারে বুক চেতিয়ে লিখে গেছে ‘আমার ভাষা আমার পরিচয়’। ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বহুভাষিক অনুষ্ঠান করেন বলেই সেখানে অসমিয়াতেও লিখে রাখেন ‘মোর ভাষা মোর পরিচয়’। এভাবে উজান চেষ্টা করে গেছে উভয় সম্প্রদায়ের ‘প্রগতিশীল’ লোকজনকে ভিড়িয়ে অনুষ্ঠানাদি করবার। এবারেও করেছে ২১শের অনুষ্ঠানে ‘ভাষার গান, দেশের গান, মানুষের গান’ । সেখানে চিনিয়েছে টিভির রিয়ালিটি শোয়ের বাইরেও গান রয়েছে। কেবল ভক্তি আর প্রেমের গানের বাইরেও গান রয়েছে। বলিউড সিনেমার বাইরেও বাংলা অসমিয়াতে উপভোগ্য দেশের গান রয়েছে। অসমিয়া শিল্পীরাও এসে ভিড় করে গান করে গেছেন। এই সব করতে করতে প্রবল কমিউনিস্ট এবং মুসলমান বিরোধী কেউ কেউ লাল পতাকা হাতে নিয়েও কখনও থানা চারিআলিতে গিয়ে দাঁড়াবার নজির আছে। কিন্তু লালপন্থীরা যদি এমন অদ্ভুত প্রচারে থাকেন যে দুর্গাবাড়ির সবাই শাসক বিজেপি বা কংগ্রেসের লোক—তাই বাংলা ব্যানার চাপান -- তবে এরাও ভয়ে কুঁচকে যাবেন। বরং এই আস্থা বেড়েই যাবে যে শাসকদলের ছত্রছায়াতেই তাঁদের ভাষিক অস্তিত্ব সম্পন্ন থাকবে। যদিও বাস্তব এই যে সাম্প্রতিক বাঙালি বিরোধী আক্রমণের পেছনে শাসকদলের ‘কা’ আইন এনে বাঙালি রক্ষার লোকদেখানো নাটকই মূলত দায়ী। অসমিয়া লোকে বলতেই বলে, কা না আসতেই এই। এলে পরে কী হবে?
জন সংস্কৃতি পরিষদ বা গণ নাট্য সঙ্ঘ এখন কই? অভিনেতা বিরিঞ্চি বরা সম্প্রতি গ্রেপ্তার হলে পশ্চিম বঙ্গ গণনাট্য থেকে প্রতিবাদের পোস্টার আমাদের হাতে এসেছে। অসমের গণনাট্য থেকে আসে নি। থাকলেও নজরে পড়ে নি। দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালি যদি নিজ ভাষাতে বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক চর্চার অধিকার না পায়—তবে আর অসমে এই সব আশা করে লাভ নেই। তিনসুকিয়াতে বিষ্ণু-জ্যোতি সাংস্কৃতিক সমাজ বলে একটি আছে। তার অনেকেই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের মানুষ। কিন্তু সেখানেও সেদিন এক কর্মকর্তাই বললেন, আমরা রা করব কী? আমাদের ভেতরেই এনকাউন্টার রাজ—বুলডোজার সমর্থক লোক আছেন। কল্পনা করুন— নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন তো বিষ্ণুপ্রসাদ -জ্যোতিপ্রসাদ বাদ দিন হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরও নাম নিতে ভয় পায়। শঙ্খ ঘোষের নাম নিতেই সংকোচ বোধ করে। অতুল প্রসাদ দ্বীজেন্দ্রলালের নিচে নামেই না। এই বিষ্ণু-জ্যোতি সাংস্কৃতিক সমাজের অনুষ্ঠানে আমরা গিয়ে থাকি—আমাদের ‘উজানে’র অনুষ্ঠানেও অনেকে আসেন। অতিথি করেও আমরা আমন্ত্রণ জানাই। কিন্তু লক্ষ করেছি, আমাদের অনুষ্ঠানে অসমীয়া নাচ গান কবিতার অনুষ্ঠান হলেও তাঁদের অনুষ্ঠানে কখনও বাংলা বা অন্যান্য অনুষ্ঠান হয় না। অন্য কিছু সংগঠনে যদি বা হল, তবে সেই সব সাধারণত পশ্চিম বঙ্গীয় হন। পশ্চিম বঙ্গীয় অতিথি ছাড়া গুয়াহাটি বইমেলা থেকে শুরু করে অসম সাহিত্য সভার কেন্দ্রীয় অধিবেশনও সম্পন্ন হয় না কোনোদিনই। ফলে তলায় তলায় একটি দূরত্ব থাকাও সত্য।
যাই হোক, এত কথা টানবার উদ্দেশ্য একটাই-- কংগ্রেস বিজেপি করল বলেই বাংলাতে ব্যানার টানলে বা অনুষ্ঠান করলে তাদের আপনি অপরাধী সাজাতে পারেন না। আমরা নিশ্চিত নই, কোনও কমিউনিস্ট দল কি নিয়ম করেছে যে তাঁরা কোনোদিন উজান অসমে বাংলা ব্যানার লাগাবেন না? তবে যে তারা বাঙালি সমাজ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হবেন এটি নিশ্চিত। যদিও আমরা একাংশ বাম-ভাবাপন্নদের চিন্তাতে আঘাত করতেই এই কথাগুলো লিখছি, সবাইকে একই ছাদে ঢালবার বাসনা আমাদের নেই। অনেকেই সাধারণ বাঙালির মতোই এদের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খোলেন না। এমন কাজ তো ভারতীয় সংবিধান বিরোধী নয়। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার লেখা আছে “Any section of the citizens residing in the territory of India or any part thereof having a distinct language, script or culture of its own shall have the right to conserve the same”। বরঞ্চ লাচিত সেনার কাজগুলোই আইন হাতে নেবার মতো হয়েছে। এরা কেবল ব্যানারে কালি মাখায় না, এখানে ওখানে ছোটো দোকানিদেরও অপমান করে, তাড়াতে উদগ্রীব হয়। আর সম্প্রতি শৃঙ্খল চলিহার একটি সাক্ষাৎকার সামনে এসেছে যেখানে তিনি উজান অসমের সমস্ত বাঙালিকে বাংলাদেশি বলছেন। এরা ভাটি অসমের মুসলমান শ্রমিকদেরও বাংলাদেশি বলে প্রায়ই হেনস্তা করেন। দাড়ি লুঙি আর কানের নিচে ঘোমটা মহিলা শ্রমিক দেখলেই হল পথে ঘাটে। ভাগ্যিস আজকাল রিকশা- ঠেলার ব্যাবহার কমেছে। নইলে মুসলমান রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালাকে এরা এবং প্রায় সমস্ত ‘জাতীয়’ সংগঠনগুলো আর সংবাদ মাধ্যম এই সেদিন অব্দি ছেড়ে কথা বলতেন না। ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ বলেও এই সম্প্রদায়কে এরা আবিষ্কার করে রেখেছিলেন। আজকাল এই সব কম শোনা যায় । সম্ভবত তাড়াবার কৃতিত্বে সন্তুষ্ট আছেন। সেই সব কিছুই আইন হাতে নেওয়াই। সেই সব সম্পর্কেও বোর্জুয়াদলগুলোকে তো অবশ্যই, কমিউনিস্ট দলগুলোকেও এবং ‘প্রগতিশীলদের' সাধারণত চুপ থাকতেই দেখেছি। কেবল ডিব্রুগড়ে এক দশক আগে একটি সংগঠন ব্যাপক হারে মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি’ বলে তাড়ানো শুরু করলেই অসমিয়া মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে এর বিরোধিতাও সমানে হয়েছিল। কিন্তু ছোটোখাটো আক্রমণে কারই বা রা করবার সময় থাকে? কিন্তু এমন আক্রামকদের সংগ্রামী কিন্তু বিভ্রান্ত যুব-বন্ধু বলে উল্লেখ করছেন ‘প্রগতিশীল’রা এমন আশ্চর্য ঘটনাও দেখেছি । এরা এগিয়ে এসে শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে সংগঠিত করে সংগ্রাম করবে বলে অলীক স্বপ্নও কেউ কেউ দেখেন। বাস্তবে এরা কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন বা কমিউনিস্ট আন্দোলন সবল হলে কম্যুনিস্টদেরও ধরে আগেও পিটেছে, পরেও পিটবে। লাচিত সেনা এখন ভয় পাবার মতো সংখ্যাতে কম্যুনিস্ট দেখে না বলে।
এই সব কারণেই এখন আর ভূপেন হাজরিকাও নয় --খগেন মোহন্তও নয় --অসমীয়া সংস্কৃতির প্রধান পুরুষ এখন জুবিন গার্গ। যিনি গান করেন ‘পলিটিক্স নকরিবা বন্ধু!’ তিনি গান করেন না ‘মানুষ মানুষের জন্যে’। ‘গান করেন না ‘বুঢ়া লুইত তুমি...!’ তিনি বলেন,কা আইন বলবত হলে—আলফাতে যোগ দেবেন। পরে আর ভুলে গিয়ে যোগ দেওয়া হয়ে উঠে না। আর যখন বর্ষাশ্রী শদিয়াখোয়া বুঢ়াগোঁহাঞি বলে এক কিশোরি কবিতা লিখে হাজতে যখন যায়— দু-মাস আটকে থাকে-- প্রশাসন বলে, আলফাতে যেতে চাইছিল—লোকে টুইটারে ফেসবুকে প্রশ্ন করে—সে তো জুবিনও বলেছিলেন। তার বেলা?
অসমিয়াতে সাহিত্য চর্চা করা বাঙালি এখনও অসমে আছেন। কেউ তাদের নাম নিয়ে বলেন না কেন—তাদেরই মতো সব বাঙালিকে হওয়া দরকার? তাতেই প্রমাণ -- এই সব বাহানা মাত্র। ঊষা রঞ্জন ভট্টাচার্য আছেন, অমলেন্দু চক্রবর্তী আছেন। তাঁরা কম্যুনিস্ট নন বলে কি তাদের কোনও সম্মান থাকতে নেই? এমন কমিউনিস্টরা আজকের দিনে বাঙালি হিন্দু বা মুসলমান কাউকেই নিরাপত্তা দিতে পারেন না। মাঝে এই মজার কথাও বলে দিই—হেমাঙ্গ বিশ্বাস হবার পরামর্শ আবার প্রগতিশীলেরা কেবল বাঙালি হিন্দুদেরই দিয়ে থাকেন। এমনিতে তাঁরা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা এক্কেবারেই করেন না। মুসলমান তো তাঁদের বিশ্বাস অসমিয়া হয়েই আছেন। কেবল মুসলমানে বদরুদ্দিন আজমলকে আদর্শ করে নিয়েছেন—এটাই সমস্যা। আজান ফকিরকে অনুসরণ করলেই আর সমস্যা নেই। হজরত শাহজালালের সাড়ে তিনশ আউলিয়াকে তো কেউ চেনেনই না। চিনবার দরকারও নেই। কোন গাছের ‘গুটি’ থেকে যে এই সব তত্ত্ব জন্মায়। তা, কথা হচ্ছিল নিরাপত্তা নিয়ে-- কংগ্রেস বিজেপি অল্প হলেও ভোটের স্বার্থে দেবে । সেই জন্যেই এই সমাজটি শাসক দলের সঙ্গে থাকেন।
আমি নিজে একাধিক অসমিয়া বই বাংলাতে অনুবাদ করেছি, আরও অনেক করব। আন্তর্জালে অসমিয়া প্রচারে প্রসারে গত দশকে শুরুর দিনগুলোতে আমার ভূমিকা উল্লেখ থাকবে একটি প্রকাশিতব্য অসমিয়া প্রবন্ধ সংকলনে। তবু মনে করি না এমন জাতীয়তাবাদী পরিবেশে এই অসমে কোনও একজনও বাঙালি অপমানিত না হয়ে থাকবেন। দীর্ঘদিন আমার কলেজ থেকে ‘প্রজ্ঞান’ নামে একটি বহুভাষিক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছি, যার বেশিটাই থাকত অসমিয়াতে। অসমিয়া ছাত্রদের নিয়ে একটি লেখকগোষ্ঠীও গড়ে উঠেছিল। ত্রৈমাসিক ছিল কাগজটি। সাধারণত কোনও কলেজ থেকেই এমন কাগজ বেরোয় না। দেশে বিদেশে এর খ্যাতি পৌঁছে দিয়েছিলেন অসমিয়া অনুরাগীরাই। এর পরেও একাধিকবার এই শহরে আমি অসমিয়ার শত্রু বুলে আক্রান্ত এবং অপমানিতও হয়েছি। কিছু ঈর্ষান্বিত সহকর্মী আমাকে কাজটির থেকে তাড়ান অসমিয়া-বাঙালি করেই। এখন পত্রিকাটি অনিয়মিত। আগামী বছর থেকে সরকারি নীতির জন্যেই একেবারে বন্ধ হবারই সম্ভাবনা।পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ ছিলেন অসম সাহিত্য সভা এবং কামরূপ অনুসন্ধান পরিষদ প্রতিষ্ঠার পেছনে এক প্রধান ব্যক্তি। তিনি অভিমান করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে সিলেটের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ নিতান্ত কর্মভূমি থেকে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া ছিল না। যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য অসম থেকে কয়েক হাজার প্রাচীন পুথি অনুসন্ধান করে সংগ্রহ করেছিলেন। সব কিছু নিয়ে তিনি কলকাতা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন যতীন্দ্র মোহন সংগ্রহশালা আছে কলকাতাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এইসবই লাভ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস অমলেন্দু গুহের মতো মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীকে কজনই সাধারণ অসমিয়া বাঙালি মানুষ চেনেন? শ্রমজীবী মানুষ,ছোট দোকানদারেরা কি চেনেন? সমস্ত বাঙালিকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে অনুসরণ করবার উপদেশ মধ্যবিত্ত উপদেশ। অকমিউনিস্ট উপদেশ! এটাই বা কেন বলা হয় না যে এই সব শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির বৌদ্ধিক নেতৃত্বকে অসমের সমস্ত ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষেরই উচিত অনুসরণ করা? কেন কেবল বাঙালি হিন্দু? এখানেই দ্বিচারিতা। এমন কথা যত বেশি বলা হবে এই সব মহান শিল্পী লেখক ঐতিহাসিকদের অহেতুক লোকে ঘৃণা করবেন। ভাববেন এরা মনে হয় অসমিয়া জাতীয়তাবাদেরই প্রতিভূ ছিলেন। বাঙালির শত্রু। হেমাঙ্গ বিশ্বাস সমস্ত বাঙালির আদর্শ হতেই পারেন না। এই সামান্য কথা বোঝেন না যে সমস্ত ‘প্রগতিশীল’ অসমিয়া মধ্যবিত্ত—তাঁরা প্রমাণ করেন যে তাঁরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদী’। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আদর্শ যদি চান এরা সব বাঙালি স্বীকার করুন, গ্রহণ করুন—তবে বাংলা ভাষাতে এই গান গাইবার স্বাধীনতা স্বীকার করুন ----ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন!
অসমীয়া মাধ্যমের বিদ্যালয় ইংরাজি মাধ্যমে রূপান্তরিত হবার উদাহরণ নেই, যদিও বিশ্বায়নের জন্যে সমস্ত সরকারি বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন। বাংলা স্কুল বেশি বিপন্ন। অসমিয়া কম, কেননা অনসমিয়া ছাত্রছাত্রীরা এসে বাঁচিয়ে রাখছেন। ইংরাজি মাধ্যমে যে অভিভাবক ছেলেমেয়ে পাঠাতে পারছেন না, তারা ভাবছেন অসমে চাকরি পাবার জন্যে অসমিয়াই সই। কিন্তু স্কুলগুলো ভাবছে অন্যরকম। লাচিত সেনার ধরণের ধমকি হুমকির জন্যে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে সমগ্র উজান অসমে ইংরাজি মাধ্যমে যেতে শুরু করেছেন। তবু অসমিয়াতে যাচ্ছেন না। ইংরাজিতে গেলে জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো বিরোধিতা করবার যুক্তি খোঁজে পায় না। এদের কৌশল বুদ্ধি এর বেশি কাজ করতে পারে না। এ একধরণের নঞর্থক প্রতিরোধ। তুমি আমাকে অপমান করে যাও বলে, আমরা ছাত্র পাই না বলে অসমিয়াতে যাচ্ছি না, দরকারে ইংরাজিতে যাব। ভাষা- মাধ্যমে জাতিকে রক্ষা করতে পারে বা করবে—এই তত্ত্ব এখন বাস্তবের জমিতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০-এর আগে থেকে এহেন তত্ত্ব প্রচার করে আসছিলেন যে মধ্যবিত্ত—তাঁরা নিজেরাই সন্তানদের এখন বেসরকারি মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। সেখানে সন্তানেরা বাঙালি বিহারি নেপালি সবার সঙ্গে পড়ছে। সেখানে জাতীয়তাবাদী বা কোনও ধরণের সংগ্রামী ছাত্র সংগঠনও করা যাচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অন্যকোনও প্রশ্ন তুলবার থাকলেও ছাত্ররা শিক্ষকদেরই মতো সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকছেন। বিশ্বায়নের অনুগামী জাতীয়তাবাদীদের এর জন্যে লজ্জা পাওয়া দরকার। এখন দরিদ্র বাঙালিও পড়বে ইংরাজি মাধ্যমে।
অসমিয়াদের যেমন আছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বাঙালিদের তেমনি— নেতাজি সুভাষ। তিনি বুঝি অসমকে পাকিস্তানে যাবার থেকে আটকেছেন। এহেন বাঙালি আরও এককাঠি সরেস। মনে মনে এদের নেতাজি নিন্দিত হিন্দুত্ববাদও রয়েছে পূর্ণমাত্রাতে। তাঁরা ভুলেই থাকেন— কেবল গ্রুপ সি-র বিরোধিতা করেন নি অসমিয়া মধ্যবিত্ত সমাজ। সিলেটটাকেও পূর্ব-পাকিস্তানে ঠেলে পাঠাতে চাইছিলেন। গোয়ালপাড়াকে অসমে ধরে রাখতে চাইলেও বীর চিলারায়ের ‘কামতাপুর’ নিয়ে এরা বিশেষ আগ্রহ দেখান নি। তাদের কাছে সেটি ছিল পাকিস্তান নয়—পূর্ব বাংলা। খেয়াল করুন—ভাষা আন্দোলন যেমন দেশভাগের পরের দশকের ঘটনা —অসম আন্দোলনও মুক্তি যুদ্ধের পরের দশকের ঘটনা। আর এখন তো ‘কা’ আইন আর আন্দোলোনের যুগ। তখন নেতাজি সুভাষ ছিলেন না। এখনও তো নেইই। যে দুর্গাবাড়ির কথা বললাম, সেখানেই তিনসুকিয়াতে নেতাজি জয়ন্তী হয়। যারা পালন করেন—তাঁরা একটি ব্যানার টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। মামলা ঠুকবার সাহস জোটাতে পারেন নি। এভাবেই বাঙালি মনে বেঁচে আছেন নেতাজি। এদের বহু মানুষের ঘোর বিশ্বাস শৌলমারির সেই আত্মগোপনকারী সাধুটিই নেতাজি। সেই পূর্ববাংলার প্রচুর মানুষ দেশভাগ আর মুক্তি যুদ্ধের পরে অসমে উঠে এলেন বলেই বহু অসমিয়া মধ্যবিত্ত মনে সুগভীর অন্ধ বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে অসমের বাঙালি মাত্রেই ‘বহিরাগত’। অসমিয়া ভাষা এরা গ্রহণ করে না নিলে এদের থেকে বিপদ প্রচুর। তাইই তাঁদের আখ্যানের নায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অমলেন্দু গুহ, পুলক ব্যানার্জি প্রমুখ। এই আখ্যানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার ক্ষমতা নেতাজি সুভাষের নেই—সে তিনি যত বড় বীরই হোন। আমাদের নতুন নায়ক সন্ধান করতে হবে। অসমের জনগণমন অধিনায়ক। না কেবল বাঙালির, না কেবল অসমিয়ার। সে অধিনায়ক অসমের জনতার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন