✍️ মাসকুরা বেগম ।
মাহিরা চৌধুরীর জীবন কাহিনির কিয়দংশ যেন ওর লেখা প্রথম গল্প ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ আর কিয়দংশ যেন ওর লেখা একটি উপন্যাস ‘ ‘হারানো আত্মবিশ্বাস’ এর সাথে গুলিয়ে গেছে । কোনোটাই আসলে ওর জীবন কাহিনির অংশ নয় । এটাই তো সাহিত্যের গুণ । কোনও না কোনোভাবেই চরিত্রগুলো বাস্তবের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় - সেটি কল্প কাহিনি হোক কিংবা বাস্তব উপলব্ধি ! সাহিত্য হচ্ছে সত্যের মূল, বাস্তবের আয়না, কল্পনার শিল্প, হৃদয়ের কথা, বুদ্ধির বিশ্লেষণ।
ষোলো বছর বয়সী মাহিরার সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে । তাই ওর সময়টা কাটছে না কিছুতেই। কেমন যেন একা একা লাগছে । কী যেন মিস করছে ! কী যে করবে ! কী করবে ! কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। টিভি দেখতেও ভালো লাগে না । ওর শহুরে মামাতো বোন ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে ওর টিভি সিরিয়াল সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখে, - ‘কী গাঁইয়া মেয়েরে বাবা ! টিভি সিরিয়াল দেখে না !’
পাড়ায় এঘর - সে ঘর ঘুরতেও ভালো লাগে না মাহিরার । ওর মা
টিভি দেখা, এদিক
ওদিক ঘুরে বেড়ানো পছন্দ করতেন না । তাই ওকেও সেভাবে গড়ে তুলেছেন । গত কমাস ও
পড়াশোনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিল ভালো রিজাল্ট করবে বলে। বরাবরই ও পড়তে খুব ভালোবাসে
। এই অভ্যাসটা ওর মধ্যে গড়ে উঠেছে ওর মায়ের জন্য। সেই ছোটবেলাতে থেকেই বিভিন্ন
ধরনের বই পড়া আর ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা ওর হবি।
জন্ম থেকেই দেখে আসছে ঘরে সংবাদপত্র, আর মাসিক ম্যাগাজিন আসাটা বাধ্যতামূলক। ওর শিক্ষিত মায়ের প্রতিদিন সংবাদপত্র চাই। ওর নানা মানে মায়ের বাবা ছিলেন খুব নাম করা একজন গুণী শিক্ষক । তাই বোধহয় ওর মায়ের মধ্যে অনেক ভালো গুণ আছে আর তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলেন। মাহিরার ঘর আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে । সকালের চায়ের কাপের সাথে সংবাদপত্র পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। বাবা শহরে বিদ্যুৎ বিভাগের অফিসের কেরানি । সকাল আটটায় শহরে অফিসের জন্য বেরিয়ে যান আর বিকেল ছয়টা-সাতটায় ঘরে ফিরে আসেন । বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসেন সংবাদপত্র । মা-মেয়ে ভাগাভাগি করে পড়ে পাতাগুলো । মা একটি পাতা নেন তো মেয়ে আরেকটি পাতা নেয় । তারপর পাতা বদল। মেয়েরটা মা আর মায়েরটা মেয়ে নেয় । মাহিরার বিশেষ আকর্ষণ শনিবার ও রবিবারের পাতায়। নিয়মিতভাবে ও পড়ে ছোটদের পাতা, সাহিত্য সম্ভার, নারী জগৎ, সাজগোজ, রান্না-বান্না, ইত্যাদি । রবিবার ও শনিবারের পাতাগুলো আলাদাভাবে জমিয়ে রাখা ওর শখ ! পুরনো সংবাদ পত্রগুলো মা ‘পুরনো কাগজ চাই’ দাদার কাছে বিক্রি করে দেন । কিন্তু মাহিরার জমানো পাতাগুলোতে তিনি কোনোদিন হাত দেন না।
পরিক্ষার পরে এক রবিবারের পাতায় মাহিরা দেখল ‘বিষয়ভিত্তিক
গল্প প্রতিযোগিতা’ ! বিষয় - ‘ গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না ‘ । মনে মনে ভাবে, ‘লিখে ফেলি ! বুকের ভিতর অনেক
আবোল-তাবোল ভাবনার জ্বালা ! গাঁয়ের মানুষের কত শত চিত্র লেগেই আছে চোখে ! ওই
বাস্তব চিত্রগুলো দিয়ে লিখে ফেলি একটি গল্প ! হাতে তো ঢের সময় আছে এখন । ‘
একমাস পর রবিবারের পাতায় প্রকাশিত হয় ওর লেখা
ছোটগল্প ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ । গল্পটিতে গাঁয়ের ছেলে
ভবঘুরে মনুকে সবাই ঠাট্টা করে তার উঠতে বসতে গুনগুন করে গান গাওয়া নিয়ে ।
মা-বাবা বকাবকি, গালাগালি, চড় - থাপ্পড় কোনোটাই কম
করেননি । তবুও তার গানের নেশা ছাড়াতে পারেননি । কোনমতে মাধ্যমিক পাস করেছে ।
পড়াশোনা আর এগুতে পারবে বলে মা-বাবার কোনও আশা নেই তাই কলেজে ভর্তি করলেন
না । ছোটখাটো কিছু একটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করতে লাগলেন । একটি কাপড়ের দোকানে
বিক্রেতার কাজ পেল । সেখানেও গান গাওয়ার রোগ তাকে ছাড়ল না । দোকান মালিকের মেয়ে
শুধুমাত্র তার গান শুনেই তার প্রেমে পাগল ! সেই কারণে মনু চাকরি ও হারাল, মায়ের ঝাঁটার বাড়িও খেলো
আর বাবার লাথিও খেলো ! মনের দুঃখে সে পালিয়ে বেআইনি উপায়ে একদিন বাংলাদেশে গিয়ে
প্রবেশ করল । সেখানে গিয়ে সে কিভাবে একেবারে রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠল তার
গল্প এটি । মাহিরার এই গল্পটি প্রথম পুরস্কার- প্রাপ্ত গল্প হিসেবে নির্বাচিত হল ।
তারপর আরেকদিন লিখে ফেলল একটি কবিতা । পাঠিয়ে
দিল রবিবারের সাহিত্য সম্ভারের পাতায় । বেশ সাড়া পেয়েছিল কবিতাটিও । এরপর
নিয়মিত লিখতে থাকে মাহিরা । প্রকাশিত হতে থাকে ওর লেখা গল্প, কবিতা একের পর এক ।
মাধ্যমিক পরিক্ষায় খুব ভালো রিজাল্ট করল মাহিরা । বাংলায়
পেল ১০০/১০০ । বাকি বিষয়গুলোতে ও অনেক ভালো নম্বর পেল ।
কিন্তু মাহিরাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও কম করা হয়নি ! অনেকেই
বলল, ‘বাংলায়
১০০/১০০ ! সে আর কী বাহ্ বাহ্ কুড়ানোর ব্যাপার ! বিজ্ঞানে কিংবা গনিতে ১০০/১০০
পেলে না হয় কথা ছিল ।’
পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পর ছোট চাচি বললেন, ‘ সারাদিন বই এর সাথে ফেভিকলের
মত লেগে থাকলে কে না ভালো রেজাল্ট করতে পারবে ? আসলে মাহিরা কিন্তু এত
ট্যালেন্টেড নয় ! পড়ার জোরে যা ভালো রেজাল্ট আর কি !’
বাবা-মা ওর সাহিত্যে আগ্রহ আর পরিক্ষার নম্বর দেখে কলা
বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিলেন । উচ্চ মাধ্যমিকে ও বাংলা বিষয়ে রাজ্যে সর্বোচ্চ নম্বর
পেয়ে চমৎকার ফলাফল করে মাহিরা । তাই বাংলা অনার্স নিয়ে ডিগ্রিতে ভর্তি হয় ।
বিজ্ঞান পড়ুয়া বড় চাচাতো দিদি ঠাট্টা করে বলল, ‘ মেজ-চাচা আর চাচি কী সেকেলে
রে বাবা ! মাহিরা ও যে কী বুদ্ধু ! এতো ভালো রিজাল্ট করে আর্টসে এডমিশন হল তাও
আবার বাংলা বিষয় নিয়ে । আজকাল আর্টস চলে নাকি ! বাংলায় কোনও স্কোপ আছে নাকি !’
পিসিতুতো ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র তাচ্ছিল্য
করে বলল, ‘আচছা বলত
মাহিরা ! তুই এই গল্প - কবিতা লিখে সময়টা কেন নষ্ট করিস্ ? এসব
করে, আর্টস
এ বাংলা নিয়ে পড়ে তুই কেরিয়ার গড়বি কেমন করে ?’
সবার কথা শুনে একটু হীনমন্যতাবোধ হল মাহিরার ।
নিজের উপর যে বিশ্বাস ছিল তা দুর্বল হয়ে পড়ল । ‘সত্যি কি আমি মূল্যবান সময়
নষ্ট করছি ? ‘সত্যি কি ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি ?’ ‘আমি কি
আমার কেরিয়ার গড়তে পারব না ? আমার শখকে গুরুত্ব দিতে
গিয়ে কি আমি আমার জীবনে সফল হতে পারব না ?’
ওর মা ওকে বললেন, - ‘ আমি মনে করি তুমি একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ
মাহিরা । সফলতা আসে জন্মগত প্রতিভার বিকাশে । আমরা দেখেছি সাহিত্যে তোমার প্রতিভা
আছে । তাই সেই প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটাতে যে আলো- বাতাসের দরকার তা হচ্ছে তোমার ভাষা
ও সাহিত্য নিয়ে বিস্তর অধ্যয়ন । তুমি মানুষের কথায় দুর্বল হয়ে যেও না ।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখ । নিজ প্রতিভার বিকাশের জন্য সাধনা চালিয়ে যাও । সাফল্য
তোমায় সালাম জানাবে !’
মায়ের জ্ঞান গর্ব কথাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেল মাহিরার ।
একান্ত মনে লেগে গেল নিজের প্রতিভার বিকাশে । নিজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে
উচ্চারিত হওয়া কথাগুলো যেন স্পষ্ট শুনতে পেল - ‘ নিজের প্রতিভার বিকাশ যদি
চাও তবে প্রথমে নিজের প্রতিভাকে চেন, নিজের জন্য কাজ করে যাও, নেতিবাচক মানুষ থেকে দূরে থেকো, যারা তোমাকে সম্মান করে না
তাদের ধারে - কাছে যেও না । এতে যদি কেউ তোমার আত্মসম্মানবোধকে আত্মগরিমা ভেবে ভুল
বুঝে, বুঝুক
।’
মাহিরার জীবন কাহিনি নতুন মোড় নেয় ওর
পিসিতুতো ভাইয়ের বিয়েতে । সেখানে ওর সাথে দেখা হয় পিসিতুতো ভাইয়ের বন্ধু
ও.এন.জি.সি. -তে কর্মরত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জাভেদের । ফর্সা, ছিপছিপে গড়নের, লম্বাটে মাহিরাকে প্রথম
দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় জাভেদের । প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেন সঙ্গে সঙ্গে । বাংলা
সাহিত্যে পিএইচডি গবেষণারত মাহিরা ও সুঠামদেহী, সুন্দর চেহারার ইঞ্জিনিয়ার পুরুষ জাভেদের প্রস্তাব গ্রহণ
করতে সময় নষ্ট করেনি । তার ভদ্র, অমায়িক ব্যবহার দেখে কী এক আকর্ষণ অনুভব করে ও ! দুজনের
মধ্যে ফোনালাপের মাত্র একমাস পর বিয়ে হয়ে গেল । সবাই খুব খুশি হয়েছে ওদের
বিয়েতে । বলাবলি করেছে, ‘মাহিরা যোগ্য স্বামী পেয়েছে । কী নেই তার ! ডাক্তার বাবার একমাত্র সন্তান
জাভেদ । বাড়ি- গাড়ি-উচ্চপদস্থ চাকুরি । প্রচুর সম্পত্তি ! সাত পুরুষে বসে বসে
খেয়েও শেষ করতে পারবে না।’
একদিন সকালে মাহিরা সংবাদপত্র হাতে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে
এসে জাভেদকে বলল, -
‘ এই দেখ দেখ ! কলেজে সহকারী অধ্যাপকের খালি পদগুলোর পূরণের
জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে । আমার তো নেট কোয়ালিফাই করা আছে । এপ্লাই করি !’
- ‘ কেন ? তোমার
কিসের অভাব ? শুনি ! আমাদের এত সম্পত্তি থাকতে তোমার চাকুরি করার কি
দরকার ?’
খুব আশ্চর্য হয় মাহিরা ! মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুলো না ।
খুব দুঃখ পেল ! ব্যথায় বুকটা খুব ভারি হয়ে উঠল কিন্তু কাঁদতেও পারল না । পাল্টা
কোনও জবাবও দিতে পারল না প্রাণ-প্রিয় স্বামীকে । ও যে খুব ভালোবাসে জাভেদকে । ওর
প্রথম প্রেম জাভেদ ! তাই হজম করে নিল ওর প্রতি জাভেদের অবজ্ঞাকে, তার আত্ম-অহমিকাকে ।
মাহিরা নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করল জাভেদের
ইচ্ছা-অনিচ্ছার সাথে । ইচ্ছে করে ভুলিয়ে রাখল ওর স্বপ্নকে, আত্মসম্মানবোধকে । হৃদয়
উজাড় করে ভালোবাসল স্বামী-সংসারকে । যে ভদ্র - অমায়িক পুরুষ দেখে জাভেদের
প্রেমে পড়েছিল - বাস্তবে ঠিক বিপরীত রূপ দেখেছে মাহিরা । প্রায়ই জাভেদ ওর সঙ্গে
অবজ্ঞাসূচক ব্যবহার করে। ওদের পরিচয় পর্ব আর বিয়ের মাঝখানে একে অপরকে বুঝার জন্য
সময়ও ছিল মাত্র এক মাস ! আসলে প্রেম কি আসে ভালো-মানুষ কি মন্দ-মানুষ বিচার
বিবেচনা করে ? প্রেম তো এক দমকা হাওয়া । কখন যে কার সুগন্ধি হাওয়া, কার হৃদয় স্পর্শ করে !
প্রেম তো হৃদয়ের আকর্ষণ থেকে হয়, বিবেকের জায়গা কতটুকুই বা আছে এখানে ?
মাহিরার যোগ্যতা, প্রতিভা ও সৃজনশীল কাজকর্মের কোনও মূল্যই নেই জাভেদের কাছে
। ওর কাছে এসব মিছেমিছি সময় নষ্ট । পিএইচডি গবেষণার কাজে ও কোনও সহযোগিতা করে না
মাহিরাকে । ওই তো সেদিন ঘরে ঢুকে জাভেদ দেখল মাহিরা আনমনা হয়ে পড়ার টেবিলে কাগজ
কলম নিয়ে বসে আছে । জাভেদের মাথা গরম হয়ে গেল তখনই।
- ‘ ঘরে কোনও মানুষ ঢুকেছি না
ইঁদুর ঢুকেছি ? সারাদিন চেয়ারে বসে বসে শুধু মাথা চুলকাতে থাক । কী লাভ
হয় লেখালেখি করে ! শুনি ।’
- ‘ তোমার হয়েছেটা কী ? বল
তো ! এত চেঁচামেচি করছ কেন ? ইস্ ! আমার কানেকশনটা দিলে তো কেটে । একটার সঙ্গে আরেকটা
তার জোড়া লাগানোর পর আবার কানেকশনটা ঠিক করা কত মুশকিল । এখন তুমি চেঁচামেচি করে
দিলে তো ছিঁড়ে !’ হেসে
হেসেই বলল মাহিরা ।
-’ সংসারে দায়িত্বজ্ঞানহীন
হয়ে গল্পের প্লট আর চরিত্রের কানেকশন লাগালে চলবে ? আমার কোনও খেয়াল রাখ তুমি ? সারাদিন
পরিশ্রম করে ঘরে ফিরলাম । কোথায় একটু জল দেবে, খেতে দেবে ? তুমি ফিরে ও তাকালে না ।’
- ‘ ডাইনিং টেবিলে সব রেখে
দিয়েছি তো, তুমি
দেখনি ? তুমি কেন আমায় মিছেমিছি ভুল বুঝতেছো ? আমি
তোমার কথার অবাধ্য হয়েছি কখনও ! তাইতো যোগ্যতা থাকতেও চাকুরি করতে যাইনি । আমি
লিখতে ভালবাসি কিন্তু তাও অবসরে লিখছি । বিয়ের পর থেকে তো আগের মত এত লেখা
প্রকাশিতও করতে পারছি না । পিএইচডি রিসার্চ পেপারের ও কাজ করতে পারছি না তেমন করে।
তবুও তো দুঃখ করি না । আমি যদি তোমার খেয়াল না রাখতাম তবে কি তোমরা পছন্দের খাবার
টেবিলে সাজিয়ে রাখতাম ? কোন দায়িত্বটা আমি পালন করলাম না যে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে
গেলাম ?’ শান্ত অথচ স্পষ্ট-দৃঢ় কণ্ঠে মাহিরা বলল ।
- ‘ বাহ্ ! মুখের উপর কথা বলতে
শুরু করে দিয়েছ । খুব উন্নতি হয়েছে তোমার ! জাহিরা কোথায় ? ‘ গলা
তিনগুণ চড়িয়ে জাভেদ বলল ।
- ‘ আম্মার কাছে ।’
-’ কী ! মেয়েকে সারাদিন মায়ের
কাছে রেখে তুমি কাগজ কলম নিয়ে তোমার শখ পূরণ করছ ? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা !’ বলে জাভেদ নিমিষেই টেবিল
থেকে মাহিরার অর্ধেক লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি মেঝেতে ফেলে দিল ।
মাহিরা এলোমেলো উড়ে যাওয়া কাগজ গুলোর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে
হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল । বাইরে আকাশে মেঘেরা উড়ছিল - প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলা
বাতাসের ধমকে । গাছগুলো দুমড়েমুচড়ে যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। ধ্বংসাত্মক
তুফানের সাথে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছিল তারা বাঁচার জন্য । দুর্বল গাছগুলো হার মেনে
নিল । ভেঙ্গে পড়ে গেল । কিন্তু যারা শক্তিশালী তারা লড়ে যাচ্ছিল । তুফানকে
হারাতে হবেই । বন্ধ করতে হবে তুফানের তাণ্ডব লীলা । নিশ্চয়ই ঐ গাছগুলো আবার মাথা
উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াবে ।
জাভেদ ফিরল সিগারেট জ্বালানোর লাইটার নিয়ে । কাগজগুলো হাতে
নিয়ে যেই পুড়ানোর জন্য আগুন ধরাতে যাবে খপ করে হাতটি ধরে ফেলল মাহিরা ! জাভেদ
ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল মাহিরার গালে ! মেঘের মধ্যেও দ্রুত বেগে বিদ্যুৎ
চমকানোর সঙ্গে প্রকাণ্ড বজ্রপাত হল ।
-’ ব্যস ! অনেক হয়েছে । প্রচুর
পুরুষত্ব দেখিয়েছেন । আর নয় ! আমার জিনিস পত্রে হাত দেওয়া, ছুঁড়ে ফেলা, আগুনে পুড়ানোর অধিকার
আপনাকে কে দিয়েছে ? আপনার আমার যে সম্পর্ক ছিল তা আমি আজ ত্যাগ করলাম ।’
- ‘ আপনার - আমার এভাবে আলাদা
করছ কেন, তুমিই
তো বলতে যাকিছু তোমার - সবই আমার .........।’
- ‘' হ্যাঁ বলেছিলাম ! ওটা ছিল
আমার মানসিকতা । কিন্তু আপনিই তো আলাদা করে রেখেছেন আমাকে আপনার জগৎ থেকে । কোনদিন
আপনার সোশ্যাল মিডিয়া, চ্যাট
বক্স ইত্যাদি আমাকে লগিন করতে অনুমতি দেননা ! আপনার মোবাইল, ল্যাপটপ সবকিছুরই পাসওয়ার্ড
লুকিয়ে রেখেছেন । বলেছেন, এসব
আপনার ব্যক্তিগত ! যখন আমি একটি ফেসবুক একাউন্ট খুললাম - আমার লেখাগুলো পাঠকের
সামনে তুলে ধরার জন্য । তখন আপনার ঘোর আপত্তির জন্য ফেইসবুক একাউন্ট ব্লক করতে
বাধ্য হয়েছি । তবুও কিচ্ছু বলিনি । মেনে নিয়েছি আপনার যুক্তি, ‘ মেয়েদের ফেসবুকে - সোশাল
মিডিয়ায় বিচরণ শোভা পায় না ‘ । আমি জানি, আপনার ফ্রেন্ড লিস্ট কিন্তু সেই মেয়েমানুষের দ্বারাই
পরিপূর্ণ !’'
নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে, শাশুড়ির কোল থেকে মেয়ে জাহিরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল
মাহিরা । সার্কাসের পাখি যেন তিন বৎসর পর আজ শিকল ছিঁড়ে বেরিয়েছে । ব্যথিত-
ক্লান্ত পাখি যেন মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে একটু নিঃশ্বাস নিচ্ছে । অনুভব করছে কী
দমবন্ধ করা পরিবেশেই না ছিল এতদিন ! ঝড় - তুফানের পর প্রাকৃতিক পরিবেশটা বেশ
হালকা ঝরঝরে হয়ে উঠেছে । হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে । মাহিরার চোখে - মুখে এসে
ঝাপটা লাগছে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির জলের । ভীষণ হালকা লাগছে মাহিরার নিজেকে । একটি
ট্যাক্সি ডেকে মেয়েকে নিয়ে মাহিরা রওয়ানা দেয় বাবার বাড়ির দিকে । আর ফিরেনি
জাভেদের সংসারে। মা - বাবাও ওর ব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ করেননি । তাঁদের মেয়ের
উপর অগাধ বিশ্বাস আছে । তাই ওর সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন । মাহিরা মেয়েকে
আঁকড়ে ধরে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করে একটি সুস্থ - সুন্দর জীবন শুরু করল ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে মাহিরার প্রথম
উপন্যাস ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ । যে উপন্যাসটিতে একটি মেয়ে
কীভাবে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, কীভাবে সফলতার শিখরে পৌঁছেছে - তারই গল্প । মেয়েটিকে
প্রভাবিত করেছে একটি প্রবাদ বাক্য ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’। মেয়েটি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে তখন বাংলা
ব্যাকরণে পেয়েছে বাক্যটি । শিক্ষক যখন বাক্যটির সারমর্মকে ওদের সামনে তুলে ধরেন
ওর হৃদয় স্পর্শ করেছিল বাক্যটি । ওর বাবা তাঁর বিফলতার জন্য দায়ী করেন তাঁর
নিজের বাবাকে, ভাই
তার ফলাফল খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী করে সংসারের অভাব অনটনকে, মা রান্না খারাপ হলে দোষ দেন
সবজি কিংবা মশলার উপর । মেয়েটি অনুভব করল সবই আসলে ‘ নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’। সেই মেয়েটির কষ্টকর সফলতার গল্প কিছু হাস্য কৌতুকের
সংমিশ্রণে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটিতে । অত্যন্ত মনোগ্রাহী উপন্যাসটি প্রকাশিত
হওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি করল সাহিত্য জগতে। অভিনন্দন - সংবর্ধনা - পুরস্কার
ইত্যাদি ঘিরে ফেলল মাহিরার জীবন !
এরপর অবিরাম চলতে থাকে ওর লেখালেখি। অনর্গল
প্রকাশিত হতে থাকে ওর গল্প - উপন্যাস - কাব্যগ্রন্থ -গদ্য ইত্যাদি। সাফল্যের শিখরে
পৌঁছে যায় মাহিরা আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওকে । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে
পিএইচডি করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহিরা সাহিত্য
জগতে এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব । গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণা ধর্মী গদ্য ইত্যাদি লিখনিতে পরিচিত নাম ড. মাহিরা
চৌধুরী !!!
গুয়াহাটি । আসাম ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন