।। মাসকুরা বেগম ।।
আমার নাম এতিমা । এতিমা নামটি আমাকে এমনি এমনি দেওয়া হয়নি । কারণ আছে এ নাম রাখার পিছনে । আমার জন্মের এক মাস আগে আমার বাবার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ! বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে মা সাংঘাতিকভাবে মানসিক আঘাত প্রাপ্ত হন । বোবা পুতুলের মত হয়ে যান ! হায়রে নিয়তি ! তারপর যা ঘটেছিল তা আরও হৃদয় বিদারক ! একটি শিশুর জন্ম একটি পরিবারে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে । কিন্তু আমার জন্ম দুঃখের বোঝা নিয়ে এসেছিল ! হায় ! আমার মা ...! হ্যাঁ ! আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েই চিরতরে ইহলোক ত্যাগ করেছেন! হারিয়ে ফেলেছি মাকে ! আর ফিরে এল না মা ! কোনদিন এল না ! আমি মা-বাবার মুখই দেখতে পেলাম না ! কেমন ছিল আমার মা ! কেমন ছিল আমার বাবা ! দাদিমার ভারাক্রান্ত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল আমার নাম - ‘এতিমা’ ! দাদিমার প্রাণের স্পন্দন আমি - এতিমা ।
দাদিমার কাছে শুনেছি আমার জন্মের পর বড় চাচি বলেছিলেন, - " আমি পারবো না পরের বোঝা টানতে । আমার তিনটি বাচ্চাকেই বড় করব কীভাবে ! তার উপর এই অলক্ষ্মী অপয়া !’ আরও বলেছিলেন, - " গ্রামের সরকারি স্কুলে আমার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা হবে না । শহরে ভালো স্কুলে পড়াতে হবে । আমরা শহরে চলে যেতে চাই।’
বড় চাচাও বলেছিলেন, - ‘আমার এখান থেকে শিলচর অফিসে যেতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায় আর শরীরেও সয় না তাই স্থায়ীভাবে ওখানে যাওয়াই ভালো হবে।’
চাচা-চাচি বাচ্চাদের নিয়ে পরিবার থেকে আলগা হয়ে শহরে চলে গেলেন । তারপর কোনও সময় ছুটি কাটানোর জন্য একটু বেড়াতে আসেন মাত্র । তারা এখন শহরে ভিটে মাটি নিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা । দাদিমা বলেন, আসলে নিজের বাচ্চাদের তিনটি কাপড় কিনলে আমার জন্য যে একটি কিনতে হবে, তিন গ্লাস দুধের উপর আরেক গ্লাস যে বাড়তি দুধ লাগবে আমার জন্য, তিনটি চকলেটের জায়গায় চারটি কিনতে হবে - এসব চিন্তা করেই বড় চাচি কেটে পড়েছিলেন নিজের সংসার নিয়ে !
দুই পিসি তাদের সংসার-স্বামী-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত । আমার দায়িত্ব তাঁরা নিতে পারবেন না স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন । গত বৎসর বড় ফুফু এসেছিলেন তাঁর ছেলের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে দাদিমাকে বলতে শুনলাম – ‘কক্ষনোই এ সম্পর্ক হতে পারে না ! তুই না তখন বলেছিলি ‘মাই, এতিমাকে দত্তক দিয়ে দাও । এ বয়সে তোমার এই বাচ্চাটাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ার কী দরকার ! এই মেয়েটিকে আমি যখন বড় করতে পেরেছি, বিয়ে দিতেও পারব । তবে তোর মত নির্দয়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবো না।’ সেদিন যে রাগ করে বড় ফুফু চলে গিয়েছিলেন তারপর আমার বিয়েতেও পর্যন্ত আসেন নি ।
ছোট চাচি আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন । তখন চাচির নিজের বাচ্চা ছিল না । আমার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ছোট চাচা-চাচি নিজেরা বাচ্চাই নিলেন না । তারপর তাঁদের কোল আলো করে আমার ভাই এসেছে । আরও তিন বছর পর আমার বোন এসেছে । আমি যতটুকু পারি ছোট চাচি আম্মার সহায়তা করি ভালোবেসে । ‘আম্মা’ – ‘আব্বা' ডাকি ছোট চাচা - চাচিকে । ভাই - বোন দুটোকে দেখে-শুনে রাখি হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে।
দাদিমা আমার কোলে মাথাটা রেখে শুয়ে আছেন । খুশি মনে গুড়ো করা পান-সুপারি দিয়ে পান চিবোতে চিবোতে কত গল্প করছেন ! ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন গল্প করতে করতে । সারাদিন রোজা রেখে ইফতার করেছেন যে। বয়স তো কম হয়নি ! আশি বছর পার করেছেন জীবনের! কোনও দিন রোজা রাখা বন্ধ করেননি ! অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন আমার মাই মানে দাদিমা। আমি ‘মাই’ ডাকি তাঁকে ।
সারাদিন কাঠফাটা রোদ আর উৎকট গরমে পিপাসায় প্রায় সব রোজাদারেরা ছটফট করছিল । সূর্যের আলোর ফাঁকে ফাঁকে আকাশে কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ দেখা যাচ্ছিল । লোকজন চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে এক পশলা বৃষ্টির আশায়। ইফতারের এক ঘণ্টা আগে এক ঝাপটা কাল বৈশাখী ঝড় প্রকৃতিকে ঠাণ্ডা করার সাথে সাথে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে রোজাদারদের প্রাণ । বৈশাখ মাসের বৃষ্টি এক ঝটকায় আসে আবার চলে যায় । বৃষ্টি চলে গেলেও আমেজটা যায় নি। টিনের চালে আম গাছের পাতা থেকে জল পড়ার শব্দ বাজছে সুর তুলে টপটপ-টপটপ। বাইরে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকছে আর অফুরন্ত ভালোলাগার ছোঁয়া লাগছে গায়ে ! এই মুহূর্তে প্রকৃতির ফুরফুরে হাওয়া যেমন ভালোলাগার ছোঁয়া দিচ্ছে গায়ে তেমনি আমাদের দাদি-নাতনির মনও খুশিতে ফুরফুর করছে !
আজ দাদিমার খুশির কারণ আমি । আমার বিয়ে হয়েছে তিন মাস হল । বিয়ের পর এবছরের রমজানের মাসের প্রথম রোজা আজ। এসেছি দাদিমার সঙ্গে ইফতার করতে ! অবাক লাগছে, না ? আজ তো আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকার কথা আর বাবার বাড়ি থেকে ঘটা করে ইফতারি দেওয়ার কথা । এটাই তো বরাক উপত্যকার সমাজের নিয়ম ।
আজ সকালে তিনজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন আমার শাশুড়ির কাছে । আমার চাচি শাশুড়ি, তিনি নাকি খুবই সম্পদশালী বাবার মেয়ে ! পাশের বাড়ির রুমা পিসি শাশুড়ি, তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে চার দিন পর চলে এসেছিলেন আর কোনদিন ফিরে যাননি কিন্তু কেউ শ্বশুর বাড়িতে কীভাবে চলবে সে বিষয়ে উপদেশ দিতে তিনি পাকা জ্ঞানী ! ওবাড়ির অলির দাদি, তাঁর চার ছেলে থাকতে তাঁর চুলা আলাদা ! ছেলেদের বউদের সঙ্গে তাঁর বনিবনার অভাব ।
তিন জনেরই মুখ পানসে হয়ে আছে ! বেশি সাড়া শব্দ নেই ! অন্যান্য দিন হলে পান চিবোতে চিবোতে হৈহৈ করে বাড়িতে ঢুকেন ! এমনিতে তাঁদের পানের পিকে রাঙা ঠোঁটের সামনে লিপস্টিকের রংও যেন হার মানায় !
অলির দাদি শুরু করলেন, - ‘খানো গো, শাহিদের মা ! তোমার বউর ফয়লা ইসতারির গন্ধ বাস ফাইলাম না ।'
- ‘আমরারে তইআ খাইলে ফেট ফুলবো গো ভাবি ।' চাচি শাশুড়ি বললেন ।
- ‘হুনো ভাবি ! বউর বাড়ির কুনতা আইলে সবরে আগে তাকি খইতে লাগে ! ফয়লা ইসতারির মোছা এখলা কুলইন না । ইতা তুমি জানোনা নি ভাবি ?' ফুফু শাশুড়ি বললেন ।
আমার শাশুড়ি তাঁর ঘরে তাঁদের বসতে দিয়ে চুপচাপ বসে শুনছেন ! আমি আঁটোসাটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি শাশুড়ির পুরনো কাঠের আলমারিতে গা ঘেঁষে ।
- ‘গতবার হবাড়ির ফখর মাস্টারর বউর ফয়লা দিনকুর ইসতারি সারা গাঁও-এ খাইয়া শেষ করতে ফারছইন না !' দাদি বললেন ।
- ‘আমার ফয়লা দিনকুর ইসতারির খতা মনো নাইনি চাচি ! বাটতে বাটতে শেষ অইছে না, বাদে গরু ছাগলে খাইছইন !' চাচি শাশুড়ি বললেন।
- ‘ওয় ওয় ! তোমার বাড়ির মোছা ইতা ফাউরিমুনি বেটি ! তুমি অইলায় বড়লোক বাফর ফুড়ি । তোমার বাফর কলিজার লাখান কয়জনর কলিজা আছে ।'
- ‘ভাবি তোমার বউর বাড়িত হুনাইয়া রাখছনি । ইলা না আইলে যে তোমার মান সম্মান থাকতো নায় ।' ফুফু শাশুড়ি বললেন ।
‘মামনি !' আমার শাশুড়ি হাঁক পাড়লেন । তিনি আমাকে 'এতিমা' ডাকেন না । ‘মামনি' বলে ডাকেন । আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম – ‘জি আম্মা !'
- ‘মামনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও ! শাহিদ স্কুল থেকে ফিরে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে ! তোমার দাদিমার সাথে ইফতার করবে না! তোমাকে ছাড়া আজ প্রথমদিন তাঁর ইফতার মুখে উঠবে কী করে ? বিশটি বছর এক লোকমা কি তোমাকে ছেড়ে মুখে তুলেছেন ? কেমন নাতনি তুমি একবারও বললে না দাদির কাছে গিয়ে ইফতার করার কথা ! আমার অবাক লাগছে !' আমার স্বামী শাহিদ বাজারের লাগোয়া জনকল্যাণ হাইস্কুলের শিক্ষক ।
আমি হতবাক ! হতবাক আগন্তুকরা ! দাদি, চাচি ও ফুফুর তিন জনেরই পানসে মুখের যেটুকু ঝলক ছিল নিভে গিয়ে বৈশাখ মাসের আকাশে উড়ে বেড়ানো কালো মেঘের মতো হয়ে গেল !
মা তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন - ‘আপনারা শুনুন ! আমি আগে থেকেই আমার মামনির দাদিকে জানিয়ে দিয়েছি এসব ফালতু কষ্ট যেন আমাদের জন্য না করেন । মা বাবা হারানো এতটুকু দুধের শিশু মেয়েটিকে এত বছর দাদি, চাচা-চাচি লালন-পালন করলেন, শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষ করলেন । বিয়ে দিলেন । এখন আবার স্বামীর বাড়িতে ভিক্ষা দেবেন কোন দুঃখে ? আমি আপনি কি খাচ্ছি না ? আর কোনদিন আমার বাড়িতে আমার মামনির সামনে দয়া করে এধরনের নিকৃষ্ট কথা-বার্তা বলবেন না ।' তিন জন আগন্তুকই মেঘলা মুখগুলো পেঁচার মত করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন ।
স্বামীসহ আমাকে দেখে তো দাদিমা, চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন সবাই অবাক ! দাদিমা আমাকে কতক্ষণ যে জড়িয়ে ধরে ছিলেন টেরই পায়নি ! ভাই বোন দুটো যখন আমার কাপড় ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে টান দিল তখন আমার হুস এল । বুঝতে পারলাম দাদিমা আজ আমাকে কতটুকু মিস করছিলেন আর আমিও কত শান্তি পাচ্ছিলাম তাঁর বুকে। আমার স্বামী এখানে ইফতার করে ফিরে গেছেন বাড়িতে । মা একা আছেন । যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন, - ‘যতদিন ইচ্ছে করে তুমি থাকো । যেদিন মন চাইবে চলে এসো ।'
মাস ছয়েক আগে আমি সবার সঙ্গে ছোট চাচির বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম । সেখানে আমার শাশুড়ি আমাকে দেখেছিলেন আর পছন্দ করে ফেললেন ছেলের বউ করার জন্য । কী দেখে যে তাঁর আমাকে পছন্দ হয়েছে আমি ভেবেই পাই না ! আমি তো আর আহামরি কোনও সুন্দরীও না ! সাধারণ চেহারা, সাধারণ গড়ন, সাধারণ রং আমার । স্বামীও বলে প্রথম দিনেই সে নাকি আমার প্রেমে পড়ে গেছে। আমার ডিগ্রি কোর্সটা এখনও শেষ হয়নি । সমস্যা নেই । মা বলেছেন, -‘তোমার যত ইচ্ছে পড়।'
দাদিমা বলছেন, - ‘কালকেই ফিরে যা তুই । এত ভালো শাশুড়িকে একা ছেড়ে থাকিস না । খুব যত্ন করবি । তোর সুখ শান্তিতে ভরা সংসার দেখছি । এখন নিশ্চিন্তে দুচোখ মুজতে পারব।'
সবাই খুব খুশি আমার শাশুড়ি মায়ের ব্যবহারে । চাচা ইফতার করেই ছুটেছেন বাজারে বেয়াইনের জন্য শাড়ি কিনতে ! চাচি টিফিনে কী কী দেবেন পরিকল্পনা করছেন ! দাদিমা নাকি ক্ষীর বানিয়ে দেবেন !
আমি বলছি – ‘এসব নিয়ে গেলে মা যদি কিছু বলেন ?'
চাচা অভিমানের সুরে বলে উঠলেন, - ‘কেন কিছু বলবেন ? আমরা তাঁর উপর খুশি হয়ে কি কিছু উপহার দিতে পারি না ?'
আমার ভীষণ ভালো লাগছে । সবকিছু যেন একেবারে অন্যরকম ! নেই কোনও খরচা পাতির চিন্তা, নেই কোনও জাঁকজমক, নেই কোনও উদ্বেগ, নেই কোনও মনোমালিন্য ! সবাই খুশি আজ । ভীষণ খুশি !!!
( এই ‘অন্যরকম' গল্পটি নববার্তা প্রসঙ্গে ১৮/০৭/২০২১ প্রকাশিত হয়েছিল )