।। অভিজিৎ চক্রবর্তী ।।
কী কারণে সে
বেঁচে আছে। হ্যাঁ ঠিক এই কথাটিই ইদানীং মনে হচ্ছে বিমলের। কলেজ-জীবনে
নকশাল করত। হুরুয়া থেকে তরণি এসে গোপনে লিখনগুলি দিয়ে যেত। রাতারাতি
আলতায় চুবিয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে ফেলাই ছিল তার কাজ। সেটা ষাট-সত্তরের
দশক নয়। আশি। পুলিশি দাপটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সব। তবুও গোপনে কোথাও কোথাও চলছে বিক্ষিপ্ত কর্মসূচী। প্রশাসনও পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ সেই আগের তেজ আর নেই। যদিও সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন তখনো ফিকে হয়নি। ফের যেন বিপ্লবের উত্থান হবে। আসলে কলেজ লাইফটাই এমন। বিমল ভাবে, সমাজের জন্য
কিছু করা, মানুষের জন্য কিছু করা, নতুন কিছু
করার স্বপ্ন এই সময় অনেকটা নেশার মত। চোখের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আহা।
হবে না কেন! হতেই হবে। হাতে হাতে চে’র ডায়েরি, মায়কোভস্কির
কবিতা। কিউবার আন্দোলনের ঘটনা উত্তেজিত করে তুলছে। সোভিয়েত থেকে আসছে নানা
পত্রিকা। বাংলা ম্যাগাজিন। রাদুগা প্রকাশন। সস্তায় ঢাউস ঢাউস বই। তলস্তয়, গোর্কি।
মাঝেমাঝে প্রজেক্টারে সোভিয়েত সিনেমা। নানা কর্মকাণ্ড। গোপনে
লিফলেট বিলি। এখন হাসি ওঠে। কী না করেছে। সে এক
উত্তেজনার সময় ছিল। এসব নিয়ে এখন আর কোনো আকর্ষণ নেই তার। সেই বন্ধুবান্ধবও নেই। বেশিরভাগই বিভিন্ন কোর্পোরেট কোম্পানিতে আছে। মোটা মাইনে। বিশাল বাড়ি, দামি গাড়ি। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের লন। চাকর- বাকর সব আছে। সে এক অন্য দুনিয়া। কে যে কোন পক্ষে চলে গেছে বুঝতে পারেনা বিমল। নিজেই বা কোনদিকে। হা হা হা। যে আমেরিকার বিরুদ্ধে কলেজ জীবনে এতো উষ্মা ছিল, এখন ফেসবুক না খুললে ঘুম আসে না। এখন তার মনে হয়, মানুষ আসলে
স্বভাবতই ধনতন্ত্রবিশ্বাসী, অর্থলোভী। সেজন্য সমাজতন্ত্র তাকে
লড়াই করে আনতে হয়। অর্থাৎ প্রবৃত্তিগতভাবে মানুষ সুবিধাভোগী।
কিন্তু মৃত্যুর
ইচ্ছাটা শুধু স্বপ্নের মোহভঙ্গের জন্য নয়। ইদানীং খালি মনে হচ্ছে সব অর্থহীন। নিজেই হতবাক হয়। নিজেকে যেন আর চেনে না। এ কীরকম ভাবনা তার। মারা যেতে পারে এমন কারণ অজস্র । যেমন বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। বাবা চলে গেছে শৈশবেই। মা ছিল। মা-ও গেল গত বছর। যাকে ভালোবাসতো, সেই মেয়েটি
এখন এক এন আর আই বিয়ে করে কানাডাবাসী। মাঝে মাঝে ফেসবুকে ছবি
পোস্ট করে। নায়গ্রা ফলস আইফেল টাওয়ার, উপত্যকা, সমুদ্র, বিভিন্ন
রিসর্টের ছবি দেয়। একেবারে ঝাঁ চকচকে জীবন। ভালোই। তার সেই একঘেয়ে
সেন্টিমেন্ট থেকে দূরে সে এক অন্যরকম দুনিয়া। বিমল কল্পনাও করতে পারে
না।
তবু এখনো কেন সে বেঁচে আছে! নাকি সে মরে গেছে অনেক আগেই। এখন আসলে সে আর নেই। কবে কোন শীতের রাতে একাকী ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো সৈনিকের মত ঠাণ্ডায় খাদ্য আশ্রয়হীনভাবে সে মরে গেছে। অথবা কোনো মরুভূমিতে যেতে যেতে যেতে জলের তৃষ্ণায় মরীচিকায় বিভ্রান্ত সে মারা গেছে। অথবা কোনো কানা গলির ভেতর গুম করা হয়েছে তাকে। কেউ তাকে জীবিত পায়নি। মাছি ভন ভন করা তার লাশ পচে ভেসে উঠেছে সংসারে।
বিমল যেন এই সময়ের কেউ নয়। দশ বছরে চারপাশের মানুষগুলোর এতো অভূতপূর্ব পরিবর্তন! তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। নিজেকে মনে হয় গেল শতাব্দীর ভূত। তার আমলের যেন কেউ কোথাও নেই। রাস্তায় বেরোলে চারপাশে আকাশছোঁয়া বাড়ি, বহুতল ফ্ল্যাট, দোকান, মল।
ছেলেমেয়েরাও পাল্টে গেছে। চলা ফেরা থেকে শুরু করে ড্রেস, চুলের
কাটিং। ভাষাও যেন বুঝে না আজকাল। হাঁটতে হাঁটতে একটি ঝলমলে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে
পড়ে সে। ভেতরে অজস্র লোক। তীব্র আলোর ফোয়ারার ভেতর পুরুষ রমণীরা
মন্ত্রমুগ্ধ যেন ঘুরে বেড়ায়। বিমলের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। বাইরে থেকে
বিমল তাদের কোনো কথা শোনে না। তাকাতে তাকাতে এক সময় বিমলের মনে
হয় গা ঝলসানো এই আলোর ভেতর এই লোকগুলো যেন অ্যাকুরিয়ামের কোনো
প্রাণী। আটকা পড়ে গেছে। অথবা বেরোনোর কোনো ইচ্ছা নেই। হয়তো কোনোদিন ছিল। এখন নিঃস্পৃহ
ভেসে বেড়াচ্ছে। এক সময় মনে হয় এ যেন দুই সময়। দুই যুগ।
অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে চলে গেছে একটা জগৎ। আর একটা ভেতরে ঢুকতে
না পেরে হারতে হারতে হারিয়ে গেছে। বিমলের মাথা ঝিমঝিম করে। ভেতরেও কী
ওদের মাথা ঝিমঝিম করছে না। বিমলের খালি মনে হয়, এই কাচের ঘরের ভেতরে গ্যাস চেম্বারে দমবন্ধ হয়ে ওরা মারা গেছে কবে। অথবা ওদের মেরে ফেলা হয়েছে। ওরা আসলে সবাই মৃত।
রোজ সে নিয়ম করে একবার সমস্ত শহর
তন্ন তন্ন করে খোঁজে।হারতে হারতে তার তো হারাবার কিছু নেই। মনে মনে ভাবে, সে কি মনের অতলে সুদীপার অপেক্ষা করে নাকি ? খুব গভীরে!
কোথাও তার প্রতি বিশ্বাস এখনো আছে ? নাকি সব
মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট! সুদীপাও হয়তো এই গ্রহের কোনো অ্যাকুরিয়ামে আটকে
আছে। বেরোতে চাইছে। পারছে না। ইদানীং তার সবকিছু গুলিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান
নিয়ে যাদের মাথাব্যথা ছিল, তারাই প্রতিষ্ঠিত। সুদীপাও কী এই
চেয়েছিল! হয়তো তাই। হয়তো নয়। এ তার কীসের লড়াই! যখন সবাই
ভুলে গেছে তাকে, তখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এ তার কেমন ওঠাপড়া! অস্বস্তি লাগে।
বিমলের মনে হয়, রাজনৈতিক
আদর্শের বাইরে আরো কিছু একটা থাকে। সেটা মন। এবং তার মতিগতি স্থির
সুতোয় ধরা যায় না। নইলে যতবার সুইসাইডের এটেম্প্ট নিয়েছিল সে, ততবারই সে
পারেনি। না, ভয় নয়। মনে হয়েছে, বেঁচে থাকবে
সে। সে মরতে পারে না। স্মৃতির মত থেকে যাবে সে। কোনো
আদর্শের জন্য নয়। কোনো উত্থান বা ষড়যন্ত্রের জন্যও নয়। এমনকি সুদীপার জন্যও নয়। সেল ফোনের এই সংখ্যাহীনতার যুগে কারো কারো বাড়িতে যেমন রয়ে যায় সংযোগহীন মৃত সেলফোন। ঠিক সেই রকম। অতি সাধারণ। সে ভাবে, এই কাচের
ঘরের লোকগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একেক
সময় সে চিৎকার করে। ‘আমার দিকে তাকাও, এই যে আমি এখানে। আমাকে দেখো। আমি
কিছু বলতে চাই’। ভয় হতে থাকে। চারদিকে উপরে মাঝে লক্ষ
লক্ষ সি সি টি ভি ক্যামেরা। তার মনে হয় প্রতিনিয়ত কেউ তাকে লক্ষ করে চলছে।
সে কী করে, কোথায় যায়, কী বলে। যেকোনো সময় চালান হয়ে যেতে পারে অন্ধ কুঠুরিতে। ধীর পায়ে সে সরে পড়ে। তার মনে হয় চারদিকে কোটি কোটি সেলফোন কিন্তু সংযোগহীন। কেউ কখনো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। একেক জন থেকে একেক জন কত কত দূর। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সবাই যেমন আলাদা আলাদা। একা। একলা। এক একটা সংখ্যা। সেলফোনের নম্বরের মত। ফেসবুক খুললে কত কত বন্ধু। বিপ্লব তবু দীর্ঘজীবী নয়। বিমল জানে। সবাই বলছে। কেউ কিছু শুনছে না। বুঝছে না। তার গুলিয়ে যায়। সব যেমন নেটওয়ার্ক ক্ষেত্র থেকে বাইরে চলে গেছে। সেও কবে হারিয়ে গেছে কোথায়। এই শহরের ভিড়ে সে যেন
ভাসতে ভাসতে হাবুডুবু খাচ্ছে। যখনই সে ফোন
করে, যখনই কথা বলতে চায়, শুনতে পায় ইস রুট কি সভি লাইন ব্যস্ত হে। কৃপয়া
থোরি দের বাদ ডায়াল করে।