।।
শিবানী ভট্টাচার্য দে ।।
স্কুলের সংস্কৃত বইয়ে একটা শ্লোক পড়েছিলাম, যার বাংলা অর্থ হল--
‘জল, আগুন, বিষ, শস্ত্র, ক্ষুধা, ব্যাধি, পাহাড় (উঁচু জায়গা) থেকে
পড়া---- এসবের কোনো একটি নিমিত্ত পেয়ে দেহধারীদের মৃত্যু হয়ে থাকে।’
এই নিমিত্তগুলোর পরিধির ভেতরে যে আরো কত 'শাখাকারণ' আছে, যুগ যুগ ধরে আরো কত নতুন
নতুন নিমিত্তের উদ্ভব হয়েছে, পঞ্চতন্ত্রকারের তা হয়তো মাথায়ই আসেনি।
এখন আমরা দেখি এই নিমিত্তগুলোর মধ্যে আরও কত ‘শাখাকারণ’ লুকিয়ে থাকতে পারে।
১। জল : সাধারণ ভাবে, জলে ঝাঁপ দিলে সাঁতার-না-জানাদের মৃত্যু হতে পারে, জলে হাত-পা বেঁধে ফেলে
দিলে ডুবে মৃত্যু হতে পারে। খরা অঞ্চলে দিনের পর দিন খাবার জল না পেলেও হতে পারে, বন্যায় ভেসে গিয়ে মৃত্যু
হতে পারে।
প্রাচীন শ্লোক-লেখক ভাবেনও নি হয়তো, যে জল আরো কত ভাবে
মৃত্যুর নিমিত্ত হতে পারে। যেমন, আর্সেনিকদুষ্ট
জল বা কলিফর্ম যুক্ত জল খেলে সঙ্গে সঙ্গে না হোক, কিছুদিন ধরে রোগে ভুগে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
মাটির তলার জল বহুজাতিক জলব্যবসায়ীরা তুলে নিলে, বা সরকারি উদ্যোগেই বাঁধ দিয়ে নদীর একদিকে জল জমিয়ে
অন্যদিকে জলশূন্য করে ফেললে, জলা, পুকুর, নদী ভরাট করে ফেললে্, জলাভাবে মানুষসহ সব
প্রাণী ধুঁকতে ধুঁকতে জিভ বের করে শেষ শ্বাস নেবার রাস্তায় যেতে পারে।
২।আগুন : ঘরে আগুন লাগলে, দাবানলে ঘিরে ফেললে, বজ্রাঘাতে আগুন লাগলে
প্রাণীর মৃত্যু হতেই পারে, যুদ্ধের
আগুনেও মৃত্যু হতে পারে, এসব
পুরোনো কথা। জানা ছিল না যা, তা
আগুন আরো কত ভাবে লাগতে পারে। বাজারকে দাহ্যপদার্থের গুদামে
পরিণত করে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না রাখলে, এবং
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং
বিদ্যুৎসরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার না করার ফলে জতুগৃহ তৈরি হতে পারে, তাতে মানুষের দাহন হতে পারে।
পণের দাবি না মেটায় স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা
বউয়ের গায়ে আগুন দিলে, দলিতদের
বাড় বেড়েছে মনে করলে তাদের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলে, সংখ্যালঘুদের বাড়িতে বা ব্যাগে গোমাংস রাখার সন্দেহ হলে তাদের বাড়িতে, গাঁয়ে এবং গায়ে আগুন
ধরালে যে কিছু দেহীর প্রাণ খাঁচাছাড়া করার অন্যতম নিমিত্ত হতে পারে, তা সে আদ্যিকালের
শ্লোক-রচয়িতার ধারণায় বোধ হয় ছিল না।
৩।বিষ : আগেকার দিনে অপরাধীদের বিষপানে মৃত্যুর বিধান
ছিল। কেউ কেউ বা জীবন অসহ্য
হলে হাতের কাছে যা বিষ পেত খেয়ে মরত। পঞ্চতন্ত্রকার জানতেন না, এছাড়াও অনেক ভাবে অনেক
ধরণের বিষ প্রয়োগ করা যায়। খাবার জিনিষ চকচকে দেখাতে বিষরঙ দিয়ে চকচকে করা হয়, মাছে মাংসে ফর্মালিন, সব্জিতে পেস্টিসাইড, ফলে কার্বাইড, জলে আর্সেনিক--- বিষ
প্রয়োগে প্রাণীহত্যার
অনেক রাস্তা আছে। তা ছাড়া আছে প্লাস্টিক। পলিব্যাগ খেয়ে গরু মোষ, সাগরে ফেলা পলিব্যাগ ও
অন্যান্য প্ল্যাস্টিক খেয়ে তিমির মত জন্তুও বেশ মরছে, বিষে প্রাণী মরবার
উদাহরণ এখন জলেস্থলে। যানবাহনের ধোঁয়া, রাসায়নিক
কারখানার বিষবাষ্প ফুসফুসে ঢুকে যাওয়াও প্রাণীদের অক্কা পাওয়ার নিমিত্তের তালিকায় আজকাল ঢুকে
গেছে।
৪।শস্ত্র : অস্ত্রশস্ত্র তো মারার জন্যই। সে শত্রু
মানুষ হোক, আর
পশুপাখি শিকার করার জন্যই হোক। তবে এখন শস্ত্রের অনেক রকম হয়েছে, আগুন, বিষ, ব্যাধি অনেক কারণই শুধু
এক শস্ত্রে লুকোনো থাকতে পারে। শস্ত্র থেকে আগুন, শস্ত্র থেকে ব্যাধি, শস্ত্র থেকে বিষ উৎপাদন হতে পারে, আর অস্ত্রশস্ত্র একদেশ
থেকে অন্য দেশে, এক
রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে আকছার
চালান হচ্ছে, এসব
সেই একই নিমিত্তে।
৫। ক্ষুৎ(ক্ষুধা) : দীর্ঘসময় খাদ্য না পেয়ে মানুষ
মরতে পারেই, দুর্ভিক্ষ
অনাহার সব যুগেই
আছে, তাই
শ্লোকের মৃত্যু-কারণের তালিকায় ক্ষুধা আছে। কিন্তু শ্লোক-রচয়িতার যা জানা ছিল না, তা হল, ক্ষুধাতে খাবার না পেয়ে
কাঁচা লিচুর মত টক্সিক ফল
খাওয়া, আর
বছরবছর এন্সেফেলাইটিসে গোছাগোছা বাচ্চার টেঁসে যাওয়া। ক্ষুধার্ত গরীব মানুষকে সস্তায় গুদামের
পচা চাল রেশনে খাইয়ে, ভেজাল
খাবার খাইয়ে রোগ বাঁধিয়ে তাড়াতাড়ি পটল তুলতে যাবার রাস্তা করা। ধনী চাষির খামারে
উৎপাদিত কেমিক্যাল সার আর কীটনাশকে ভরপুর খাদ্যবস্তু পরীক্ষার জন্য সাধারণ মানুষই গিনিপিগ --- খিদে পেয়েছে, ব্যাটারা খা। খাবার না
থাকে তো আমের আটির শাঁস সেদ্ধ, তেঁতুলের
বিচির আটা খা। ইঁদুর খা, পোকা
খা, কচুঘেঁচু
তুলে খা, বাঁচিস
না বাঁচিস তাতে
কি। বাঁচার উলটো রাস্তাটা খোলাই আছে। ক্ষুধার নিমিত্ত মৃত্যুর শাখাকারণের তালিকায়
অন্যতম সংযোজন।
৬। ব্যাধি : রোগে মানুষ মরবে না তো কি? মানুষ কেন, পশু পাখি মাছ উভচর সবাই
রোগে মরে। রোগ ব্যাধি চিরন্তন। এর জন্য অত ভেবে লাভ নেই। হাসপাতাল হবে, ডাক্তার থাকবে, ওষুধ থাকবে সেবিকা থাকবে, পরিষেবা থাকবে, আর রোগ ভ্যানিস —এতো সব চাওয়াটা বড্ড
বেশি বেশি চাওয়া না? সব
কিছু থাকলে যমরাজ কি করবে? তাই
দুর্লভ ডাক্তার নার্স থাকলেও ভুল চিকিৎসা থাকতে পারেই, ক্যাপস্যুল থাকলে ভেতরে
ওষুধ না থাকতেও পারে, প্রেসক্রিপশনের
লেখা চার
রকমের ওষুধের মধ্যে দুরকম
হাসপাতালে নেই, সারা
বাজার ঢুঁড়েও পাওয়া না যেতে পারে, এ্যাম্বুলেন্স
মিছিলে ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে রুগী মরতে পারে। কাজেই ব্যাধিতে মৃত্যু তখন ছিল বটে, এখন তার সূত্রে আরো ঢের
কারণ বেরিয়েছে, অতোসব
আগেকার শ্লোক লেখার দিনে জানা ছিল না।
৭। পাহাড় থেকে পতন : পাহাড়ে কখনো সকনোই বেড়াতে যাওয়া
হয়, দুঃসাহসী
যারা অগম্য পর্বতে
আরোহণ করতে যায়, তাদের
দুচারজনের মৃত্যু হতে পারে। আগেকার দিনে অবশ্য পাহাড়ের উপর থেকে অপরাধীকে ফেলে
দিয়ে মেরে ফেলা একটা অন্যতম শাস্তি ছিল। আজকাল বহুতল থেকে
ঝাঁপ দিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, বহুতল
থেকে ফেলে দিয়ে কাউকে কাউকে হত্যা ও করা হয়। উড়ন্ত বিমানের যান্ত্রিক গোলযোগে
ভেঙ্গে পড়ে যাত্রীর মৃত্যুও আকছার। এসব ঘটনায় যন্ত্রের
বিকলতা, উচ্চস্থান, আগুন, কুয়াশা, এতগুলো ফ্যাক্টর একসঙ্গে
কাজ করে-- এতোসব প্রাচীনেরা জানতেন না।
তাঁদের দেওয়া নিমিত্তগুলোর বাইরে আরো কত বেরিয়েছে
আজকাল। সেগুলোর অনেক রকমফের, নিত্যনতুন নানারকম
বেরোচ্ছে, দেখতে
পাবেন চারদিকে তাকালে। কিছু প্রাইভেট, কিছু
পাবলিক। যেমন,
কোনো মেয়ে কোনো প্রেমিকের ডাকে সাড়া দিল না, ছুঁড়ে মারো অ্যাসিড, শেষ করে দাও মেয়েটিকে। জ্বলে
দগ্ধে মরুক সে।
বাচ্চাকে ধর্ষণ করে সে কঁকিয়ে উঠবার আগেই তার গলা
টিপে নালায় ফেলে দাও।
কোনো মেয়েকে নেতা ধর্ষণ করেছে, মেয়েটি
পুলিশে জানিয়েছে। মেয়েটির বাপকে জেলখানায় নিয়ে মারতে মারতে শেষ করে দাও, ট্রাকের নিচে ফেলে
মেয়েটিকে তার বাকি গুষ্ঠিসুদ্ধ পিষে দাও।
কোনো অজুহাতে, (বিশেষ
করে দেশদ্রোহের) কোনো প্রতিবাদীকে ধরে বিনা বিচারে জেলে ভরে রাখ দিনের পর দিন।
এমনিই রোগে, অর্ধাহারে
সে মরবে, গ্যারান্টি।
তবে এ পর্যন্ত সব চাইতে অমোঘ একটা নিমিত্ত আবিষ্কার
হয়েছে --- এন আর সি। আপাতত উত্তরপূর্বাঞ্চলে
কার্যকরী। পরে সারা দেশেই
কার্যকরী হবে বলে শোনা যাচ্ছে। একসঙ্গে অনেক মানুষকে শেষ রাস্তা দেখানোর ব্যাপারে মোক্ষম কার্যকর। যাদের
অনভিপ্রেত মনে কর, তাদের
বেশ কয়েক লাখ লোককে বিদেশি বলে দাগিয়ে দাও, তারা
হবে না ঘরকা, না
ঘাটকা। রাষ্ট্রহীন হবার ভয়ে, ডিটেনশন
ক্যাম্পে যাবার ভয়ে গলায় দড়ি দিয়ে গাছে নয়তো ঘরের কড়িতে ঝুলবে, নয় রেলের লাইনে গলা দেবে, নয় বিষ খাবে, নয়তো এমনিই ভয়ে হার্টফেল
হয়ে মরবে, আরো
কত কি করে মরতে পারে। যদি এ রাস্তা না নেয়, তাহলে
কনসেন্ট্রেশন, থুড়ি, ডিটেনশন ক্যাম্পের মধ্যে
চাঁদ সূর্যের চেহারা ভুলে, ঘর
পরিবারের মুখ ভুলে, নিজের
ও বাপের
নামধাম ভুলে গাদাগাদি করে দিন কাটাবে, মানে, বেশিদিন কাটবে না, কাটতে পারেনা, এমন মোক্ষম এই
নিমিত্তটি।
প্রাচীনেরা প্রাণ বের করবার এত সব নিমিত্তের সঙ্গে
পরিচিত ছিলেন না।