।। বৈশালী ঘোষ
।।
“দিদি, মেয়ে
আপনার ষোলআনা বিদেশ যাচ্ছে”।
মা – “কী
বলছেন ঠাকুর মশাই ? মেয়ে
কি তবে Higher studies
এর জন্যে যাবে?”
একটুক্ষণ সময় নিয়ে ঠাকুর মশাই আমার ডান হাত, বাঁ
হাত আর ঠিকুজি টা কে ভাল করে দেখে গম্ভীর ভাবে বললেন… “হ্যাঁ ,মনে
তো হচ্ছে পড়তেই যাচ্ছে”।
মা আমার দিকে তাকিয়ে,
চেঁচিয়ে লক্ষ্মীর মাকে ডেকে বললেন,
“কী
গো লক্ষ্মীর মা, ঠাকুর
মশাই এতক্ষণ ধরে বসে আছেন। কেন চা নিয়ে এলে না? চা টা নিয়ে এসো, সাথে
কাল আনা নলেনগুড়ের মিষ্টিটাও এনো”।
আমি ভাবছি,
মা আর ঠাকুর মশাই মিলে আমাকে বিদেশ নামের hostel টায় পাঠাবার ফন্দি
গড়ছে না তো? মা
কে অনেক দিন বলেছি,
আমি তোমায় ছেড়ে কখনো ওই hostel টায়
যাব না।
বিদেশে আমাকে যেতেই হচ্ছে । না
কোন Higer studies এর
জন্যে নয়। Study গুলো
সব আমি দেশেই শেষ করে নিয়েছি । বিদেশে যাওয়ার পুরো credit টাই
কিন্তু আমার Better Half এর। Better Half এই কারণে, Life এ
যত Better জিনিস
বিয়ে নামক সংক্রামক রোগের পর হয়েছে,
ওটা আমার other Half এর
জন্যেই। তাই Better Half word টা
আমার life এ
খুবই important ।
আমার আগেই অর্ক কে America তে Shift করতে
হল।আপনাদের
সাথে তো অর্কর পরিচয়টাই
করানো হল না। অর্ক আমার Better Half। বিয়ের
পাঁচ বছর আগে থেকেই আমরা একে অপরকে চিনি। অনেক স্বপ্ন দেখেছি
দুজনে। এবার সব স্বপ্নকে বাস্তবে বাঁধতে চলেছি আমরা। আর
কিছুদিন পরই আমি পাড়ি দেব America তে। Visa র কাগজপত্র সব রেডি, Ticket টাও confirm হয়ে
গেছে । বাবা
জিজ্ঞেস করলেন,
‘সত্যিই
কি তুই চলে যাচ্ছিস ?’ কাঁপা কাঁপা ঠোট গুলো শুধু নড়ে উঠল।বাবা কিছু শুনতে পেল
কিনা জানি না। শুধু, দুজনের চোখ থেকে জল গড়াচ্ছিল। মার
মনটা খারাপ। কিন্তু
ঠাকুর মশাই এর ভবিষ্যৎবাণীটা সঠিক প্রমাণিত হওয়ার জন্যে বেশ আনন্দিতও।
দেখতে দেখতে দিনটি চলে এল। আমি একাই পাড়ি দেব America তে। সবাই
আমায় Airport এ
ছাড়তে এলো। বাবা,মা বন্ধুরা এবং আরো
কিছু কাছের লোক। মা
কাঁদছে ,বাবার
চোখটাও ছলছল করছে। আমিও
নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। কিন্তু সময়তো আর
কারোর জন্যে আটকাবে না। তাই আমাকে সবাই কে ছেড়ে চেক্ ইন্
কাউন্টার এর
দিকে এগোতে হল।
এবার কান্নাকাটি ভুলে আমায় কাজে নামতে হবে। প্রথম
বার,
তারপর আবার America তে
যাওয়া। অর্ক
বারবার ফোন
করে Instruction দিচ্ছিল। Check in করে immigration এর form টা
শুধু fill করতে
বসেছি, তার
মধ্যেই announcement
- flight 2 hours late । মনটা এমনিই ভার লাগছিল। Late এর খবরটা শুনে
ভেঙ্গেই পড়ল। কী
আর করা! অপেক্ষা ছাড়া যে আর উপায় নেই। Security হোলো, Boarding এর
জন্যে বসে আছি। সকাল
সাড়ে পাঁচটায় flight ছাড়বে। 22 ঘণ্টা আমাকে একা বসে
যেতে হবে। Plane এ
উঠে seat no টা
দেখে বুঝলাম মন খারাপের পালাটা আমার পেছন ছাড়েনি। কারণ,আমি middle এর seat টা
পেয়েছি। এক
পাশে, এক
সর্দার uncle, যার
বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। আরেক পাশে, formal পরা
এক কমবয়সী ভদ্রলোক। হয়তো
অফিসের কাজে যাচ্ছেন। Excuse me, বলে
নিজের seatএ
বসতে গেলাম। কমবয়সী
ভদ্রলোক নিজেই ওনার window seat টা
আমায় offer করলেন। এ
যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি । আমি এক লাফে offer টা
লুফে নিলাম। মিষ্টি
হেসে Thank You বলে
seat এ
বসলাম।
কিছুক্ষণ এর মধ্যেই তন্বী air hostess আমাদের পাশে এসে কিছু
চাই কিনা জিজ্ঞেস করল। সর্দার uncle জল চাইলেন। আমি
আর মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ‘No Thanks’ জানিয়ে
নিজের কাজে busy হলাম। এবার
বই পড়ে, movie দেখে
ঘুমিয়ে আর নতুন জায়গার স্বপ্ন বুনতে বুনতে আমাকে এই ২২ ঘণ্টা
কাটাতে হবে।
একটা Magazine নিয়ে
পড়তে শুরু করলাম। ছাইপাশ
কিছুই মাথায় ঢুকছে না। পুরো Airbusটা আজ full । সামনে
পেছনে তাকালে লোকের মাথা ছাড়া কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। Mobile টাকে switch off করে
রাখলাম। অর্কর সাথে
কথা হয়েছে plane এ
ওঠার আগেই। আর
যোগাযোগ হবে Boston এ
পৌঁছে।
পাশের ভদ্রলোক নিজের laptop নিয়ে busy হয়ে
পড়েছেন। আর
সর্দার uncle এর
চোখটা বন্ধ আর ঠোঁটটা নড়ছে। হয়ত উপরওয়ালার নাম নিচ্ছেন। আমার
মত ওনারও এটা first journey মনে
হচ্ছে। চার
পাশে সবাই নিজেকে নিয়ে busy। পেছনের
দুটো seat পর
বসেছে একটা couple আর
তাদের একটা ছোট বাচ্চা। বাচ্চাটা খুব কাঁদছে আর ওর মা-বাবা ওকে শান্ত করার
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কান্না শুনে air-hostess ওদের
পাশে এসে দাঁড়াল। কিছু বলছে। সামনের বেশ কয়েকটা seat দখল
করে বসেছে বারো তেরো বছরের কিছু ছেলে মেয়ে, সাথে দু’জন teacher। ওরা
হয়ত কোন school trip এ
যাচ্ছে। পেছনের
ডান পাশে আরেক টা couple মেয়েটাকে
দেখে মনে হচ্ছে pregnant ।
Announcement হল, এবার
plane টা
take off করবে।দু’জন Airhostess দুদিকে
দাঁড়িয়ে instruction দিতে
শুরু করেছে ।Seat belt লাগিয়ে
ready ।মনে মনে
তিন বার দুগ্গা দুগ্গা করে নিলাম।অনেক স্বপ্ন, কত মাস পর অর্ককে
দেখব। কত স্বপ্ন আমরা
এক সাথে দেখেছি, এবার
একটা একটা করে সত্যি হওয়ার পালা । মা-বাবার কথা মনে পড়ছে, বাবার
সেই ছলছল চোখ
দুটো। Plane টা
চলছে runway এর
উপর দিয়ে।সব কিছু কে পেছনে ফেলে plane টা যাচ্ছে।
Plane টা
এখন মেঘের রাজত্বে। তুলোর পাহাড়গুলোর মধ্যে। আর কতক্ষণ।নানাকথা ভাবতে
ভাবতেই airhostess হাজির
হল সামনে – “Ma’am what
do you prefer ? Veg or non-veg?” ‘Non-veg’
খাওয়া দাওয়ার পর অনেকেই ঝিমোচ্ছে। আমি আবার বই এর পাতা
উল্টোচ্ছি, পাশের
ভদ্রলোক এখনও laptop এ
কীসব কাজ করেই চলেছেন।
সামনে বসা বাচ্চাগুলোর কথা শোনা
যাচ্ছে।পেছনের ছোট বাচ্চাটার কান্না শুনতে পাচ্ছি না, হয়ত
ঘুমিয়ে পড়েছে। সবার চোখে এখন নানা স্বপ্ন।আমি আমার ছোট্ট বাড়িটার কথা ভাবছি,যার সামনে একটা বাগান
আছে।যেখানে আমি আর
অর্ক গাছের নীচে বসে থাকব ঘণ্টার পর ঘণ্টা।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি।একটা চিৎকারে ঘুম টা ভাঙ্গল।
কিছুক্ষণ সময় লাগল কোথায় আছি বুঝতে।আমার
পাশের seat টা
ফাঁকা। কী
করছেন ভদ্রলোক ওখানে ? ওনার
হাতে কি ওটা! বন্দুক !
সবাই কে চুপ করে বসতে বলছে লোকটা
।সর্দার uncle এর
মুখটা লাল,খুব ভয় পেয়েছেন।দরদর
করে ঘামছেন।খুব ভয় লাগছে, লোকটা
কে দেখে তো একবার ও মনে হয়নি ও রকম কিছু করতে পারে।পেছনের বাচ্চাটা
খুব কাঁদছে।লোকটা ওদের দিকেই তো যাচ্ছে। চুপ করাতে বলছে বাচ্চাটা
কে না হলে মেরে ফেলবে।মা টা বাচ্চাটার মুখ টা চেপে ধরেছে।বাচ্চা টার
কান্না আর শোনা যাচ্ছে না।ও কি ঘুমিয়ে পড়েছে আবার? পেছন থেকে আরও দুটো
লোক উঠে দাঁড়িয়েছে।ওদের
হাতেও বন্দুক।ওরা সবাই একদলের। ওরা কি চায়, কি চায় ওরা? আমাদের
তো কোন দোষ
নেই।আমরা তো যে যার কাজে, যে
যার আপনজনের কাছে যাচ্ছি।
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আমাদের সরকার
ওই terrorists দের না
ছাড়লে ওরা এক এক করে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।হঠাৎ বাচ্চাটার মা চিৎকার করে উঠল, বাচ্চাটা
যে আর নড়ছেনা। কাঁদছে না কেন বাচ্চা টা ।“চুপ । আওয়াজ বন্ধ কর”, তারপর
একটা গুলির আওয়াজ, সবাই
চুপ।রক্ত!
জলের মত গড়াচ্ছে রক্ত।
আমার পাশে বসা লোকটি যাকে দেখে নিষ্পাপ
মনে হচ্ছিল, এখন
সে কি
হিংস্র।“তোমাদের
সরকার আমাদের কথা মানছে না”।
এবার কি target তবে
school trip এর বাচ্চা
গুলো।ও ঠাকুর আর কতো ,আর
কতো ?
এক ঘণ্টা…. দু ঘণ্টা জানি না কত ঘণ্টা!
এখন আর ঘড়ির কাঁটার হিসেব নেই আমার কাছে। মৃত্যুকে এতো কাছ
থেকে দেখব, কখন
ভাবিনি। মা-বাবা কি জানতে পারল আমার কথা। আর অর্ক ….অতো
আমার অপেক্ষা করছে।
বাচ্চাটার মাথায় বন্দুকটা ধরেছে, “তোমাদের
সরকার এখনো মানেনি আমাদের
কথা”।
Airhostess না
থাকতে পেরে No No, please বলতে
বলতে দৌড়ে আসছে। আবার সেই আওয়াজ । সব চুপ । শুধু রক্ত আর রক্ত ।Cockpit এ
ওদের লোক ঢুকে আছে। ভয় কাকে বলে আজ বুঝতে পারছি। কতো দুর্বল
আমরা। একএক করে অসহায় লোকগুলোকে ওরা মারছে, কিন্তু
আমরা ওদেরকে বাধা দিতে পারছি না। সময় গড়াচ্ছে, আর বেশিক্ষণ plane টা
আকাশে উড়তে পারবে না। কিন্তু আমাদের সরকার তো কিছুই জানাচ্ছেনা।
লোকটার আওয়াজ – “এক
ঘণ্টার মধ্যে তোমাদের সরকার না মানলে, সব শেষ হয়ে যাবে”।রক্ত চারদিকে রক্ত ।
তাজারক্তের গন্ধে ভরে গেছে চারদিক। ছোট বাচ্চাটার বাবা দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে
পড়লো লোকটার উপর। পেছনে থাকা দুটো লোক ছুটে আসছে।আবার সেই বিকট আওয়াজ।আর
পারছিনা । রক্তের নদী বইছে পায়ের নিচে।Pilot announce করল আর দশ মিনিটের
জ্বালানী আছে
plane এ।
সরকার কি মানবে না , আমার
আর অর্কর কি কখনই এক সাথে বাগানে বসা হবে না। আর মাত্র পাঁচ মিনিটের
জ্বালানী plane এ।Plane টা
খুব speed এ
নিচে নামছে। মা-বাবা
কে কি আমি কক্ষনো দেখতে পাবো না।আর মাত্র দু মিনিট । তারপর সব অন্ধকার ।
মা তোমার ঠাকুর মশাইর কথা তো সত্যি হল
না। মা আমার কি আর বিদেশে
যাওয়া হবে না ? মা,বাবা, অর্ক
- সবাই কেন দূরে চলে যাচ্ছে? মা আমি ..আমি বাঁচতে চাই
মা।
খুব জোরে একটা ঝাঁকুনি। দূর থেকে মায়ের
গলা শোনা যাচ্ছে ….
“দিয়া
এই দিয়া ওঠ ! Airport এ
যাবি না……………”