।। সুদীপ নাথ ।।
ভাষা দিবসে ভাষা নিয়ে কত কিছু কথা হয়, কত অনুষ্ঠান হয়। তুলে ধরা হয় যার যার নিজস্ব ভাষার উৎকর্ষতার প্রমাণ। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের পিছনের ইতিহাস কম-বেশি সকল বাঙালিরই জানা আছে, অন্তত যারা এসব নিয়ে চর্চা করেন। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত আকার নেয়। এই ঘটনার ৪৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর জাতিসত্তাগুলোর অধিকারে রূপান্তরিত হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশে কিনা জানা নেই, তবে অনেক দেশেই ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আজ একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, বাঙালি জাতির জীবনে এমন গৌরবোজ্জ্বল অর্জন আর কখনো ঘটেনি। ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা এখন আমাদের অহংকার। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষা নিয়ে নতুন সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠতে পারে এই দিবসটি, এমনি প্রত্যাশা ছিল আমাদের।
প্রথমেই ভাষা শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নেয়া যেতে পারে। কথোপকথনে আমরা যে ভাষাই ব্যবহার করিনা কেন, তা কিন্তু কোন না কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টির ভাষা। ভাষা হঠাৎ একদিন গড়ে উঠে না। কোনও জনগোষ্ঠীতে ধাপে ধাপে নয়, ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের ভাষা গড়ে উঠলেও তা কখনো স্থায়ী রূপ নিয়ে থেমে থাকেনা। এখানেই রয়েছে ভাষা সম্পর্কে একটা ভ্রান্তি। ভাষা গঠনের জন্যে কোন ব্যাকরণ আগে ঠিক করে নিয়ে, কোন জনসমষ্টি মিলেমিশে বসে ভাষা বানায় না। আগে ভাষা তৈরি হতে থাকে, পরে যার মধ্যে ব্যাকরণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ভাষা একটা চলমান প্রক্রিয়া, তা ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েই এগোতে থাকে। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এখন যে ভাষায় আমরা কথা বলি, তা যেমন অতীতে এখনকার মত ছিলনা, ভবিষ্যতেও তা ঠিক এখনকার মত থাকবেনা।
নির্দিষ্ট জনসমষ্টি বলতে তা ট্রাইবও হতে পারে আবার একটা জাতিও হতে পারে। এখানে ট্রাইবের বা জাতির, ভাষায় কিভাবে উত্তরণ ঘটে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ঠিক তেমনি, ভাষার উদ্ভব নিয়েও ধারণাকে একটু পরিমার্জিত করে নেয়া যেতে পারে।
প্রথমেই যে প্রশ্নটা আমাদের মনে উদয় হয়, তা হচ্ছে, মানুষের মুখে ভাষা ফুটলো কী করে। ভাষা বলতে যদি গলা দিয়ে নির্দিষ্ট আওয়াজ তথা ধ্বনি (সাউন্ড) সৃষ্টি করে কিছু শব্দ (ওয়ার্ড) বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে নিজের ধারণাকে অন্যের ধারণার সাথে যুক্ত করা বুঝায়, অর্থাৎ কথা বলা বুঝায়, তাহলে তা এমন কিছু শব্দ হতে হবে, যেসবের অর্থ কথক ও শ্রোতার কাছে এক হতেই হবে। ব্যবহৃত শব্দগুলো খাপছাড়া হলেও চলবে না। এই পর্বে পৌছাতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সুদীর্ঘ সময় পেড়িয়ে আসতে হয়েছে। আবারো বলছি ভাষা কেনো, মানুষের মানুষ হয়ে উঠার ঐতিহাসিক পর্বগুলোও, কোন দিন বা কোন সময়ে স্থাণু নয়, হতে পারেনা। প্রকৃতির গতিশীলতা থেকে কোন কিছুই মুক্ত নয়, হতে পারেনা এবং আমরাও বারংবার ভুলে যাই যে আমরাও প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ। আর এখান থেকেই উৎপত্তি হয় যত সব ভ্রান্ত ধারণার।
যাইহোক, মানুষের মস্তিষ্কের অসাধারণ উন্নতি তো আছেই, যা অন্য সমস্ত জীবকুল থেকে আমাদের অনেকাংশেই পৃথক করে দিয়েছে। আর ঐ গতিশীলতার হাত ধরেই আমাদের স্বরযন্ত্রও হয়ে উঠেছে তদনুরূপেই উন্নত, যার ধারে কাছেও অন্য সব প্রাণী পৌছাতে পারেনি। স্বরযন্ত্রকে বাক্যন্ত্রও বলা হয়ে থাকে। অন্য প্রাণীদের সাথে মূল তফাৎ কিন্তু এই স্বরযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্য প্রাণীদের সাথে মৌলিক তফাৎ হচ্ছে আমাদের স্বরতন্ত্র। স্বরযন্ত্র/বাক্যন্ত্র আর স্বরতন্ত্রের পার্থক্য অনেক। মস্তিষ্ককে কেন্দ্র করে, প্রথম সাঙ্কেতিক তন্ত্র আর স্বরযন্ত্রের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই অতি উন্নত দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র যা মননক্রিয়া পরিচালনা করে। তাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে স্বরতন্ত্র। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র আমাদের ভাষা সৃষ্টির সাথে সঙ্গতি রেখে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে। বিপরীতে, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ক্রমান্বয় উন্নতিতে, ভাষাও দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে। অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই কাজ করে চলেছে।
এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ভাষার সৃষ্টি কিন্তু চিন্তা থেকে হয়নি, অর্থাৎ আগে ভাষা পরে চিন্তা। ভাষার উন্নতির সাথে সাথে কথা বলার শক্তি আয়ত্ত করার পর, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের সাহায্যে পরাবর্ত গঠন করার শক্তি অর্জনের পরেই মানুষ চিন্তা শক্তির অধিকারী হয়েছে। এই ভাষা এবং ধারণা থেকে গড়ে উঠা চিন্তার বিষয়টি, আমাদের জীবন প্রক্রিয়ায়, সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায়, জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে। পড়াশুনা, জ্ঞানার্জন, ভাব বিনিময়, আচার আচরণের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উৎকর্ষতা নির্ভর করে ভাষা এবং চিন্তা, প্রত্যক্ষণ ও ধারণা এসবের সম্মিলিত উৎকর্ষতার উপর। ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভব নয়। মানুষের বাক্শক্তিগত ভাষিক দক্ষতা, মানুষকে এনে দিয়েছে বিমূর্তভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা।
এইভাবে মানুষ এই নূতন তন্ত্রের অধিকারী হয়ে অর্থবাহি শব্দের পরাবর্ত তৈরি করে নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, এক বিশিষ্ট ক্ষমতা অর্জন করেছে। ফলে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র তথা ভাষা, ভাব বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। গুণীজনেরা বলেন, ভাষা হচ্ছে, বিশিষ্ট বস্তু ও ঘটনার সামান্যীকৃত ও বিমূর্ত রূপ বা প্রতীক। এ হচ্ছে মূর্ত ও বাস্তবের সাধারণীকরণ এবং বিমূর্তায়ন।
ভাষা হচ্ছে ধারণার বাহক। মানুষ যখন মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তখনই দলবদ্ধ জীবনে মনের ভাব আদান প্রদানের জন্যে নানারকম স্বরবর্ণের ধ্বনি দিয়েই ভাষার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিলো। আর তা থেমে থাকেনি। জীবন যাত্রায় অগ্রগতির কারণে, এক অক্ষরের তথা সরল স্বরধ্বনি যখন ভাব বিনিময়ে কুলিয়ে উঠছিলো না, যখন নূতন নূতন দ্বি-আক্ষরিক ধ্বনি দিয়েই সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিলো। আর সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে, অনুশীলনের বাস্তবতায়, স্বরবর্ণের সাথে ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার থেকে কালক্রমে, বহু অক্ষরের ব্যবহার, একাধিক শব্দ সহযোগে বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি আয়ত্ত করার অধিকারী হতে থাকল মানুষ।
এটা সর্বজনবিদিত যে, ভাষা সৃষ্টির পেছনে প্রতিটি জনসমষ্টির মধ্যে অবস্থানকারী সকলের সম্মিলিত প্রয়াস কার্যকরী থাকে। আর সুদূর অতীতে, বেঁচে থাকার এবং জীবনযাত্রা আরো উন্নত করার সামাজিক তাগিদ তথা প্রয়োজনীয়তা থেকেই ভাষার উদ্ভব হয়েছে, একথা বলে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। উৎপাদন ব্যবস্থার যৌথ প্রয়াস মানুষকে ভাব বিনিময়ে বাধ্য করেছে। আর সেই প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি হচ্ছে সেই সেই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা। এমনও দেখা গেছে, এক একটা পরিবারে তাদের নিজস্ব ভাষা প্রচলিত ছিলো। একটা পরিবার নিয়েই সেখানে একটা গ্রাম গড়ে উঠত। তারা যৌথ চাষ আবাদ করত। এসবের চিহ্ন এখনো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমন যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিটি জনগোষ্ঠীতেই কোন না কোন সময়ে বিদ্যমান ছিল। তারপর এক বা একাধিক গ্রাম একটা গোত্রে অঙ্গীভূত হতে থাকলো। এই গোত্র বলতে যা বুঝায়, তাকে কিন্তু ইংরাজ সাহেবরা ট্রাইব বলেই চিহ্নিত করে। আর আইরিশদের গোত্রকে ওরা বলে ক্ল্যান। আমরা বলি জনজাতি। যাই হোক, এই গোত্র বা ট্রাইবগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার অগ্রগতিতে তাদের নিজেদের ভাষায় অনেক অনেক শব্দের সংযোজন ঘটায়। তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন আর প্রয়োজনীয় সামাজিক আচার আচরণ তথা নিয়মাবলী আর ভাষা একে অপরের পরিপূরক হয়ে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু আগের সেই যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থা একসময় আর রইলো না। তখন এসে গেলো যার যার জমিতে যার যার আলাদা উৎপাদন ব্যবস্থা। গড়ে উঠতে থাকল তাদের নিজস্ব ভাষা, যদিও তা অন্যান্য সবকিছুর মতই, সব সময়েই চলমান। এটা মনে রাখতে হবে যে, সব স্থানেই কিন্তু একসময়ে এই গোত্র বা ট্রাইবগুলো গড়ে উঠেনি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক তথা ভৌগোলিক তারতম্যের কারণে, বিভিন্ন সময়ে এসবের আলাদা আলাদা অগ্রগতি ঘটেছে। আবার স্থানান্তরও ঘটেছে। ফলে এখনো বিভিন্ন গোত্র বা ট্রাইবগুলোর মধ্যে বিচার করে দেখলে, তাদের অগ্রগতির ধারার পার্থক্য দেখা যায়।
ভাষা দিবসে ভাষা নিয়ে কত কিছু কথা হয়, কত অনুষ্ঠান হয়। তুলে ধরা হয় যার যার নিজস্ব ভাষার উৎকর্ষতার প্রমাণ। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের পিছনের ইতিহাস কম-বেশি সকল বাঙালিরই জানা আছে, অন্তত যারা এসব নিয়ে চর্চা করেন। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত আকার নেয়। এই ঘটনার ৪৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর জাতিসত্তাগুলোর অধিকারে রূপান্তরিত হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশে কিনা জানা নেই, তবে অনেক দেশেই ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আজ একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, বাঙালি জাতির জীবনে এমন গৌরবোজ্জ্বল অর্জন আর কখনো ঘটেনি। ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা এখন আমাদের অহংকার। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষা নিয়ে নতুন সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠতে পারে এই দিবসটি, এমনি প্রত্যাশা ছিল আমাদের।
প্রথমেই ভাষা শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নেয়া যেতে পারে। কথোপকথনে আমরা যে ভাষাই ব্যবহার করিনা কেন, তা কিন্তু কোন না কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টির ভাষা। ভাষা হঠাৎ একদিন গড়ে উঠে না। কোনও জনগোষ্ঠীতে ধাপে ধাপে নয়, ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের ভাষা গড়ে উঠলেও তা কখনো স্থায়ী রূপ নিয়ে থেমে থাকেনা। এখানেই রয়েছে ভাষা সম্পর্কে একটা ভ্রান্তি। ভাষা গঠনের জন্যে কোন ব্যাকরণ আগে ঠিক করে নিয়ে, কোন জনসমষ্টি মিলেমিশে বসে ভাষা বানায় না। আগে ভাষা তৈরি হতে থাকে, পরে যার মধ্যে ব্যাকরণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ভাষা একটা চলমান প্রক্রিয়া, তা ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েই এগোতে থাকে। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এখন যে ভাষায় আমরা কথা বলি, তা যেমন অতীতে এখনকার মত ছিলনা, ভবিষ্যতেও তা ঠিক এখনকার মত থাকবেনা।
নির্দিষ্ট জনসমষ্টি বলতে তা ট্রাইবও হতে পারে আবার একটা জাতিও হতে পারে। এখানে ট্রাইবের বা জাতির, ভাষায় কিভাবে উত্তরণ ঘটে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ঠিক তেমনি, ভাষার উদ্ভব নিয়েও ধারণাকে একটু পরিমার্জিত করে নেয়া যেতে পারে।
প্রথমেই যে প্রশ্নটা আমাদের মনে উদয় হয়, তা হচ্ছে, মানুষের মুখে ভাষা ফুটলো কী করে। ভাষা বলতে যদি গলা দিয়ে নির্দিষ্ট আওয়াজ তথা ধ্বনি (সাউন্ড) সৃষ্টি করে কিছু শব্দ (ওয়ার্ড) বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে নিজের ধারণাকে অন্যের ধারণার সাথে যুক্ত করা বুঝায়, অর্থাৎ কথা বলা বুঝায়, তাহলে তা এমন কিছু শব্দ হতে হবে, যেসবের অর্থ কথক ও শ্রোতার কাছে এক হতেই হবে। ব্যবহৃত শব্দগুলো খাপছাড়া হলেও চলবে না। এই পর্বে পৌছাতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সুদীর্ঘ সময় পেড়িয়ে আসতে হয়েছে। আবারো বলছি ভাষা কেনো, মানুষের মানুষ হয়ে উঠার ঐতিহাসিক পর্বগুলোও, কোন দিন বা কোন সময়ে স্থাণু নয়, হতে পারেনা। প্রকৃতির গতিশীলতা থেকে কোন কিছুই মুক্ত নয়, হতে পারেনা এবং আমরাও বারংবার ভুলে যাই যে আমরাও প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ। আর এখান থেকেই উৎপত্তি হয় যত সব ভ্রান্ত ধারণার।
যাইহোক, মানুষের মস্তিষ্কের অসাধারণ উন্নতি তো আছেই, যা অন্য সমস্ত জীবকুল থেকে আমাদের অনেকাংশেই পৃথক করে দিয়েছে। আর ঐ গতিশীলতার হাত ধরেই আমাদের স্বরযন্ত্রও হয়ে উঠেছে তদনুরূপেই উন্নত, যার ধারে কাছেও অন্য সব প্রাণী পৌছাতে পারেনি। স্বরযন্ত্রকে বাক্যন্ত্রও বলা হয়ে থাকে। অন্য প্রাণীদের সাথে মূল তফাৎ কিন্তু এই স্বরযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্য প্রাণীদের সাথে মৌলিক তফাৎ হচ্ছে আমাদের স্বরতন্ত্র। স্বরযন্ত্র/বাক্যন্ত্র আর স্বরতন্ত্রের পার্থক্য অনেক। মস্তিষ্ককে কেন্দ্র করে, প্রথম সাঙ্কেতিক তন্ত্র আর স্বরযন্ত্রের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই অতি উন্নত দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র যা মননক্রিয়া পরিচালনা করে। তাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে স্বরতন্ত্র। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র আমাদের ভাষা সৃষ্টির সাথে সঙ্গতি রেখে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে। বিপরীতে, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ক্রমান্বয় উন্নতিতে, ভাষাও দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে। অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই কাজ করে চলেছে।
এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ভাষার সৃষ্টি কিন্তু চিন্তা থেকে হয়নি, অর্থাৎ আগে ভাষা পরে চিন্তা। ভাষার উন্নতির সাথে সাথে কথা বলার শক্তি আয়ত্ত করার পর, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের সাহায্যে পরাবর্ত গঠন করার শক্তি অর্জনের পরেই মানুষ চিন্তা শক্তির অধিকারী হয়েছে। এই ভাষা এবং ধারণা থেকে গড়ে উঠা চিন্তার বিষয়টি, আমাদের জীবন প্রক্রিয়ায়, সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায়, জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে। পড়াশুনা, জ্ঞানার্জন, ভাব বিনিময়, আচার আচরণের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উৎকর্ষতা নির্ভর করে ভাষা এবং চিন্তা, প্রত্যক্ষণ ও ধারণা এসবের সম্মিলিত উৎকর্ষতার উপর। ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভব নয়। মানুষের বাক্শক্তিগত ভাষিক দক্ষতা, মানুষকে এনে দিয়েছে বিমূর্তভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা।
এইভাবে মানুষ এই নূতন তন্ত্রের অধিকারী হয়ে অর্থবাহি শব্দের পরাবর্ত তৈরি করে নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, এক বিশিষ্ট ক্ষমতা অর্জন করেছে। ফলে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র তথা ভাষা, ভাব বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। গুণীজনেরা বলেন, ভাষা হচ্ছে, বিশিষ্ট বস্তু ও ঘটনার সামান্যীকৃত ও বিমূর্ত রূপ বা প্রতীক। এ হচ্ছে মূর্ত ও বাস্তবের সাধারণীকরণ এবং বিমূর্তায়ন।
ভাষা হচ্ছে ধারণার বাহক। মানুষ যখন মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তখনই দলবদ্ধ জীবনে মনের ভাব আদান প্রদানের জন্যে নানারকম স্বরবর্ণের ধ্বনি দিয়েই ভাষার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিলো। আর তা থেমে থাকেনি। জীবন যাত্রায় অগ্রগতির কারণে, এক অক্ষরের তথা সরল স্বরধ্বনি যখন ভাব বিনিময়ে কুলিয়ে উঠছিলো না, যখন নূতন নূতন দ্বি-আক্ষরিক ধ্বনি দিয়েই সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিলো। আর সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে, অনুশীলনের বাস্তবতায়, স্বরবর্ণের সাথে ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার থেকে কালক্রমে, বহু অক্ষরের ব্যবহার, একাধিক শব্দ সহযোগে বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি আয়ত্ত করার অধিকারী হতে থাকল মানুষ।
এটা সর্বজনবিদিত যে, ভাষা সৃষ্টির পেছনে প্রতিটি জনসমষ্টির মধ্যে অবস্থানকারী সকলের সম্মিলিত প্রয়াস কার্যকরী থাকে। আর সুদূর অতীতে, বেঁচে থাকার এবং জীবনযাত্রা আরো উন্নত করার সামাজিক তাগিদ তথা প্রয়োজনীয়তা থেকেই ভাষার উদ্ভব হয়েছে, একথা বলে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। উৎপাদন ব্যবস্থার যৌথ প্রয়াস মানুষকে ভাব বিনিময়ে বাধ্য করেছে। আর সেই প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি হচ্ছে সেই সেই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা। এমনও দেখা গেছে, এক একটা পরিবারে তাদের নিজস্ব ভাষা প্রচলিত ছিলো। একটা পরিবার নিয়েই সেখানে একটা গ্রাম গড়ে উঠত। তারা যৌথ চাষ আবাদ করত। এসবের চিহ্ন এখনো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমন যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিটি জনগোষ্ঠীতেই কোন না কোন সময়ে বিদ্যমান ছিল। তারপর এক বা একাধিক গ্রাম একটা গোত্রে অঙ্গীভূত হতে থাকলো। এই গোত্র বলতে যা বুঝায়, তাকে কিন্তু ইংরাজ সাহেবরা ট্রাইব বলেই চিহ্নিত করে। আর আইরিশদের গোত্রকে ওরা বলে ক্ল্যান। আমরা বলি জনজাতি। যাই হোক, এই গোত্র বা ট্রাইবগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার অগ্রগতিতে তাদের নিজেদের ভাষায় অনেক অনেক শব্দের সংযোজন ঘটায়। তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন আর প্রয়োজনীয় সামাজিক আচার আচরণ তথা নিয়মাবলী আর ভাষা একে অপরের পরিপূরক হয়ে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু আগের সেই যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থা একসময় আর রইলো না। তখন এসে গেলো যার যার জমিতে যার যার আলাদা উৎপাদন ব্যবস্থা। গড়ে উঠতে থাকল তাদের নিজস্ব ভাষা, যদিও তা অন্যান্য সবকিছুর মতই, সব সময়েই চলমান। এটা মনে রাখতে হবে যে, সব স্থানেই কিন্তু একসময়ে এই গোত্র বা ট্রাইবগুলো গড়ে উঠেনি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক তথা ভৌগোলিক তারতম্যের কারণে, বিভিন্ন সময়ে এসবের আলাদা আলাদা অগ্রগতি ঘটেছে। আবার স্থানান্তরও ঘটেছে। ফলে এখনো বিভিন্ন গোত্র বা ট্রাইবগুলোর মধ্যে বিচার করে দেখলে, তাদের অগ্রগতির ধারার পার্থক্য দেখা যায়।
গোত্র বা ট্রাইবগুলোতে তাদের ভাষায় নিজস্বতা চূড়ান্ত আকার নেয়। আর ঠিক তখনই উৎপাদনের অগ্রগতির কারণে, সামাজিক প্রয়োজনীয়তা তথা তাগিদ থেকে এক বা একাধিক গোত্র বা ট্রাইব জাতিতে উন্নীত হতে থাকে। সাহেবরা জাতিকে বলে রেইস। জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ক্ল্যানের ভাষাগুলো নিয়ে মিলেমিশে আরেকটা নূতন ভাষা তৈরি হয়। কিন্তু তখনও ট্রাইবের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সেই ট্রাইবেল ভাষায় ভাব বিনিময় করে, যখন তারা তাদের বাড়িতে, বা নিজস্ব কাজকর্মে মিলিত থাকে। কিন্তু হাটে বন্দরে, রাস্তাঘাটে তারা জাতীয় ভাষায়ই কথা বলা শুরু করে। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় উপর-নীচে দুটো ভাষাই চালু থাকে। এক ট্রাইবের সদস্যরা, অন্য ট্রাইব তথা গোত্র তথা ক্ল্যানের সাথে রাস্তা-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে বা অফিস-আদালতে যে ভাষায় কথা বলে, তাকে চলতি কথায় অনেকে বাজারী ভাষা বা বাজাইরা ভাষাও বলে। এই বাজারী ভাষাই সেই জাতির জাতীয় ভাষা। এই পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। ট্রাইবের ভাষা তখন উপভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়। কখনও ঘটে যায় আত্তীকরণ। কখনো কখনো দেখা যায়, একটা বা একাধিক জনজাতি যখন জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় আছে, ঠিক তখনই, রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতির চাপে, সেই জাতি গঠনের প্রক্রিয়া আর চূড়ান্ত আকার ধারণ করতে পারছে না। উদাহরণের জন্যে বেশি দূরে যাবার প্রয়োজন নেই। চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এখনো ট্রাইবেলই রয়ে গেছে। তাদের জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত আকার নিতে যাওয়ার আগেই, বিধ্বস্ত অবস্থায় চলে এসছে। অথচ, তাদের নিজস্ব ভাষার অগ্রগতি তথা উৎকর্ষতায়, তারা এতদূর এগিয়ে গিয়েছিল যে, চাকমা জনজাতি তাদের নিজস্ব লিপির পর্যন্ত উদ্ভাবন করে ফেলেছিল।
ট্রাইব তথা গোত্র তথা ক্ল্যানের যেমন কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে, তেমনই প্রতিটি জাতিরও কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। যেকোনো একটা জাতির বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস, নিজস্ব অর্থনৈতিক জীবন ধারা, নিজস্ব সাংস্কৃতিক জীবন আর নিজস্ব ভাষা। মানব গোষ্ঠীর উৎপাদন কাজকর্মের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাষাও বিকশিত হয়। ভাষা তার মূল শব্দ ভাণ্ডারকে বাড়িয়ে তোলে, ধীরে ধীরে তাকে পরিবর্তিত করে এবং ধীরে ধীরে তাদের ব্যাকরণকেও সংশোধিত করে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে যেমন বিভিন্ন ভাষার বিকাশ ঘটে, তেমনি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক যোগাযোগের সঙ্গেও স্ব স্ব ভাষার বিকাশ ঘটে। এইভাবে এক সাথে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন ভাষা বিভিন্ন পথে ছড়িয়ে পড়ে। পারস্পরিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে, এক ভাষা আরেক ভাষাকে বদলেও দেয় এবং পুরানো ভাষাগুলির সমন্বয়ে নূতন নূতন ভাষার সৃষ্টিও হয়। কোন জনগোষ্ঠী যখন অপর জনগোষ্ঠীকে নিপীড়ন করে, তখন নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাষার বিকাশ ব্যাহত হয়। আবার এক জনগোষ্ঠী যখন অপর জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে ফেলে, তখন তাদের ভাষাকেও ধ্বংস করে ফেলতে পারে।
এবার ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভাষার নিজস্বতা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের শৈশব কালটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছয় বছর বয়েসের মধ্যে অন্তত একটা ভাষা শিশুকে শিখে নিতেই হবে। নাহলে সারা সারা জীবন চেষ্টা করেও কোন ভাষা শেখা যায়না। আর ভাষা শিক্ষা না হলে মেধার বিকাশও ঘটে না। শিশুকে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়েই বেঁচে থাকতে হয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষের মগজে স্নায়ু সন্নিকর্ষ (সাইন্যাপ্স) যতগুলো থাকে তার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক স্নায়ু সন্নিকর্ষ থাকে দুই বছর বয়েসের একটি শিশুর মগজে। এইসব স্নায়ু সন্নিকর্ষগুলো ছয় বছর বয়েসে অনেক কমে যায়। মোটামুটি দেড় বছর বয়েস থেকে ছয় বছর বয়েস পর্যন্ত শিশু প্রতিদিন পাঁচ থেকে নয়টি শব্দ শিখে নিতে পারে। ছয় বছর বয়েসের পর তার এই ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। স্নায়ু সন্নিকর্ষের সংখ্যা কমে যাওয়াই এর কারণ। দশ বছর বয়েসের পর নাকি এই স্নায়ু সন্নিকর্ষ চিরতরেই হারিয়ে যায়, এমনটাই বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাই এই সময়ের মধ্যে যতগুলো ভাষা শোনার ও বলার সুযোগ হবে, শিশু ততগুলো ভাষাই ভালভাবে শিখে নিতে পারবে। মোটামুটি বার বছর বয়েসের পর, নূতন ভাবে কোন ভাষাই আর সাবলীল ভাবে শেখা যায়না। অল্প কয়েকজনের ব্যতিক্রমী ক্ষমতা দিয়ে সমগ্রকে বিচার করা যাবে না। এই হচ্ছে ব্যক্তি বিশেষের ভাষা শেখার মোদ্দা কথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাভাষা-পরিচয় শীর্ষক একটা প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যাতে এই উক্তিটি ছিলো -“কখনো কখনো শোনা গেছে, বনের জন্তু মানুষের শিশুকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে পালন করেছে। কিছুকাল পরে লোকালয়ে যখন তাকে ফিরে পাওয়া গেছে, তখন দেখা গেল জন্তুর মতোই তার ব্যবহার। অথচ সিংহের বাচ্চাকে জন্মকাল থেকে মানুষের কাছে রেখে পুষলে সে নরসিংহ হয় না”। হ্যাঁ, এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিকেরা বহু গবেষণা করেছেন। পশু পালিত মানব শিশু অনেক পাওয়া গেছে। এদের নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাষা ও চিন্তা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং তা সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, শ্রম সাধনা আর হাতিয়ার ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত। শুধুমাত্র ইউরোপেরই নানা স্থানে এই ধরণের প্রায় ৩০ টি মানব শিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা পশুর সাথে বড় হয়ে উঠেছিলো। এই ধরণের শিশুগুলো দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারত না। তাদের প্রথম সাঙ্কেতিক ব্যবস্থা ছিলো মানব সমাজ তথা মানব পরিবারে বেড়ে উঠা শিশুদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী। তারা চার পায়ে ভর দিয়েই সজোরে ছুটে বেড়াতে পারত, কেউ কেউ তাড়াতাড়ি গাছে চড়তে পারত।
মানব শিশুর উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা নূতন কিছু নয়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে মিশরের তৎকালীন সম্রাট দুটি শিশু নিয়ে পরীক্ষা করেন। তিনি একজনকে আদেশ দেন, শিশু দুটিকে এমনভাবে প্রতিপালন করতে হবে যাতে তাদের সামনে কোন কথা বলা না হয়। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল এটা জানা যে, সমাজে না থাকলে মানুষের প্রথম ভাষা কি হয় তা জানা। আর দ্বিতীয় আরেকটি পরীক্ষার চেষ্টা হয়েছিলো সম্রাট আকবরের সময়ে। সম্রাটের ইচ্ছায় ১২ টি শিশুকে বোবা কালাদের দিয়ে বারো বছর লালনপালন করিয়েছিলেন তিনি, যেখানে কেউ ঢুকতে পারেনি, ওদের সাথে কথা বলতে পারেনি। এই দুটি পরীক্ষার মধ্যে প্রথমটির ফলাফল জানা যায়নি। দ্বিতীয় পরীক্ষায় দেখা গেছে ওই শিশুদের কেউ কথা বলতে পারেনি, যখন ওদের সবার সাথে রাখা হলো ১২ বছর বয়েসের পর। তারপর কি হয়েছে, মানে তারা আদৌ কথা বলা শিখেছিলো কিনা, তা আর জানা যায়নি। তবে এটা জানা গেছে যে, এই শিশুগুলো, আকারে ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে আর ইশারায়, মনের ভাব বিনিময় করত, যখন তাদের সমাজে মিশতে দেয়া হয়েছিল।
এই ধরণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল ফ্রান্সে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। ফ্রান্সের অ্যাভেরাতে ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে তিনজন শিকারি গহন অরণ্যে একটা ছেলেকে দেখতে পায়। কিন্তু সে ধরা দিতে চায়নি। কিন্তু গাছে উঠতে গিয়ে শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে যায়। তাকে শহরে নিয়ে এসে লালন পালন করা হচ্ছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সে বনে পালিয়ে যায়। তার নাম রাখা হয়েছিলো ভিক্টর। তার পর ১৭৯৮ ও ১৭৯৯ সালে তাকে বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, কিন্তু ধরা যায়নি। অতঃপর ১৮০০ সালের ৮ জানুয়ারি ভিক্টর নিজেই লোকালয়ে এসে ধরা দেয়।
ভিক্টর যখন এলো তখন তার বয়েস অনুমিত হল প্রায় ১২ বছর। তার সারা গায়ে প্রচুর ক্ষতচিহ্ন ছিল। আর সে ছিলো উলঙ্গ। সে লোকজনকে কামড়ে আর খামচে দিত। চুপ হয়ে থাকত আর কিছু জিজ্ঞেস করলে নিরুত্তর হয়ে থাকত। সবাই মনে করেছিল সে বোবা ও কালা। তাকে প্রথমে একটি মূক-বধির স্কুলে ভর্তি করানো হল আর একজন ডাক্তার তার দেখাশোনার ভার নিলেন। দিনে দিনে তার অনেক পরিবর্তন হল। সে আস্তে আস্তে সামাজিকতা শিখে নিলো। সে আর জামাকাপড় পড়তে আপত্তি করেনা। হিংস্রতা কমে এলো। এভাবে সে চল্লিশ বছর বয়েস অব্দি বেঁচে রইল।
কিন্তু তাকে কোন কথা বলা শেখানো যায়নি। কিন্তু সে যে কালা নয়, তা ডাঃ ইটার্ড বুঝতে পারলেন। কারণ তাকে কোন নির্দেশ দিলে সে তা পালন করত। কিন্তু তার মুখে কোন কথা ফোটেনি। দুয়েকটা শব্দ সে উচ্চারণ করতে পারত, এইমাত্র। ভিক্টরকে ২৮ বছরের অনেক চেষ্টাতেও শেষ পর্যন্ত কথা বলা মানে ভাষার ব্যবহার শেখানো যায়নি।
এদিকে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত গবেষণা চলতেই লাগল। সুদীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণিত হল, ভাষা শেখার বয়েস হচ্ছে ছয় বছর। ছয় বছর বয়েসের মধ্যে অন্তত একটি ভাষা শিখে নিলেই, শিশু পরে আরও ভাষা শিখে নিতে পারে। আর একসাথেও এই বয়েসে অনেকগুলো ভাষা সহজেই শিখতে পারে।
এবার আসা যাক মাতৃভাষা প্রসঙ্গে। মাতৃভাষা বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়ে একটা সংশয় শিক্ষিত সমাজে বিদ্যমান। মাতৃভাষা কি আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের কথ্য ভাষা, নাকি আমাদের জাতীয় ভাষা অথবা যার যার ক্ল্যানের তথা গোত্রের ভাষা সেই প্রশ্ন এখনো পরিষ্কার নয়। একটি শিশুর পিতা যদি ফরাসী ও মা যদি বাঙালি হয়, আর দুজনে যদি দুটো ভাষাতেই সন্তানের সাথে কথা বলে তাহলে, সেই শিশু সন্তানটি দুটো ভাষাই শিখে নেবে অতি সহজেই। তখন তার মাতৃভাষা কোনটা হবে। আর যখন একটি শিশু মায়ের কাছে না থেকে, অন্য কোন প্রতিপালিকা বা প্রতিপালকের তত্ত্বাবধানে বা সান্নিধ্যে বেড়ে উঠে, তখন দেখা যাবে, শিশুটির মায়ের ভাষা যাই হোক না কেন, সে তার প্রতিপালক বা প্রতিপালিকার ভাষাই আত্মস্থ করে নিয়েছে। আবার, একজন বাঙালি মা, নিজের প্রদেশ থেকে বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গিয়ে, একমাত্র সেই স্থানের ভাষায় যদি নিজের শিশু সন্তানের সাথে কথা বলে, তখনও কিন্তু সেই শিশু সন্তানটি, সেই স্থানীয় ভাষাই শিখে যাবে। এমনটা কোলকাতায় হামেশাই দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে প্রদেশ থেকে উঠে আসা মা বাবা কোলকাতার স্থানীয় ভাষাতেই কথা বলতে দেখা যায়। অথচ মায়ের মাতৃভাষা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সেই প্রাদেশিক ভাষাই। আবার অন্য দিকে, ভাষা বলতে বোঝাতে পারে মাতৃভূমির ভাষা। আর মাতৃভূমি বলতে বোঝায় কোন জাতির ভৌগোলিক স্থান।
আসলে এই ধরণের বিভ্রান্তির কারণ কিন্তু শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ও মান্যতার সাথে জড়িত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা আর পারস্পরিক সামাজিক আদান প্রদানের দ্রুততা, প্রায়শই কোন কোন শব্দের দ্বারা কোন কোন বিষয়কে বোঝাতে অক্ষম হয়ে উঠে। জাতিতে জাতিতে ভাব বিনিময়ে তাই নূতন শব্দ প্রয়োগ করা অব্দি পুরানো শব্দের কার্যকারিতা চোখে পড়ার মত। এটা লক্ষ্য করলেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, পুরানো শব্দ বাতিলের প্রশ্নটা আসে, নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের সাথে হাত মিলিয়েই। অজস্র শব্দ আর মানুষের কাজে না এসে বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। অথবা, আবিষ্কারকের দেয় শব্দগুলোই, পরিষেবা গ্রহণ যারা করে তাদের ভাষায় স্থান করে নেয়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহারে এই বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখার মত। এই ভাবে এগোতে এগোতে মানব সমাজ দ্রুতলয়ে একটা আন্তর্জাতিক ভাষার দিকে এগিয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
তাই সব দিক বিচার করে মাতৃভাষা শব্দটির যথাযথ অর্থ বুঝে উঠা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এটাও ভাষা বিষয়ে শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন। কোন শব্দ সময়োপযোগী না হলে তার স্থানে সঠিক অর্থবহ একটি নূতন শব্দ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতেই পারে। আবার এমনও দেখা যায়, প্রয়োজন তথা পরিস্থিতির তাগিদে, নূতন নূতন শব্দ অনবরত সব ভাষাতেই স্থান করে নিচ্ছে আগের আলোচনায় যা বলা হয়েছে।
এই ধরণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল ফ্রান্সে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। ফ্রান্সের অ্যাভেরাতে ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে তিনজন শিকারি গহন অরণ্যে একটা ছেলেকে দেখতে পায়। কিন্তু সে ধরা দিতে চায়নি। কিন্তু গাছে উঠতে গিয়ে শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে যায়। তাকে শহরে নিয়ে এসে লালন পালন করা হচ্ছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সে বনে পালিয়ে যায়। তার নাম রাখা হয়েছিলো ভিক্টর। তার পর ১৭৯৮ ও ১৭৯৯ সালে তাকে বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, কিন্তু ধরা যায়নি। অতঃপর ১৮০০ সালের ৮ জানুয়ারি ভিক্টর নিজেই লোকালয়ে এসে ধরা দেয়।
ভিক্টর যখন এলো তখন তার বয়েস অনুমিত হল প্রায় ১২ বছর। তার সারা গায়ে প্রচুর ক্ষতচিহ্ন ছিল। আর সে ছিলো উলঙ্গ। সে লোকজনকে কামড়ে আর খামচে দিত। চুপ হয়ে থাকত আর কিছু জিজ্ঞেস করলে নিরুত্তর হয়ে থাকত। সবাই মনে করেছিল সে বোবা ও কালা। তাকে প্রথমে একটি মূক-বধির স্কুলে ভর্তি করানো হল আর একজন ডাক্তার তার দেখাশোনার ভার নিলেন। দিনে দিনে তার অনেক পরিবর্তন হল। সে আস্তে আস্তে সামাজিকতা শিখে নিলো। সে আর জামাকাপড় পড়তে আপত্তি করেনা। হিংস্রতা কমে এলো। এভাবে সে চল্লিশ বছর বয়েস অব্দি বেঁচে রইল।
কিন্তু তাকে কোন কথা বলা শেখানো যায়নি। কিন্তু সে যে কালা নয়, তা ডাঃ ইটার্ড বুঝতে পারলেন। কারণ তাকে কোন নির্দেশ দিলে সে তা পালন করত। কিন্তু তার মুখে কোন কথা ফোটেনি। দুয়েকটা শব্দ সে উচ্চারণ করতে পারত, এইমাত্র। ভিক্টরকে ২৮ বছরের অনেক চেষ্টাতেও শেষ পর্যন্ত কথা বলা মানে ভাষার ব্যবহার শেখানো যায়নি।
এদিকে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত গবেষণা চলতেই লাগল। সুদীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণিত হল, ভাষা শেখার বয়েস হচ্ছে ছয় বছর। ছয় বছর বয়েসের মধ্যে অন্তত একটি ভাষা শিখে নিলেই, শিশু পরে আরও ভাষা শিখে নিতে পারে। আর একসাথেও এই বয়েসে অনেকগুলো ভাষা সহজেই শিখতে পারে।
এবার আসা যাক মাতৃভাষা প্রসঙ্গে। মাতৃভাষা বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়ে একটা সংশয় শিক্ষিত সমাজে বিদ্যমান। মাতৃভাষা কি আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের কথ্য ভাষা, নাকি আমাদের জাতীয় ভাষা অথবা যার যার ক্ল্যানের তথা গোত্রের ভাষা সেই প্রশ্ন এখনো পরিষ্কার নয়। একটি শিশুর পিতা যদি ফরাসী ও মা যদি বাঙালি হয়, আর দুজনে যদি দুটো ভাষাতেই সন্তানের সাথে কথা বলে তাহলে, সেই শিশু সন্তানটি দুটো ভাষাই শিখে নেবে অতি সহজেই। তখন তার মাতৃভাষা কোনটা হবে। আর যখন একটি শিশু মায়ের কাছে না থেকে, অন্য কোন প্রতিপালিকা বা প্রতিপালকের তত্ত্বাবধানে বা সান্নিধ্যে বেড়ে উঠে, তখন দেখা যাবে, শিশুটির মায়ের ভাষা যাই হোক না কেন, সে তার প্রতিপালক বা প্রতিপালিকার ভাষাই আত্মস্থ করে নিয়েছে। আবার, একজন বাঙালি মা, নিজের প্রদেশ থেকে বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গিয়ে, একমাত্র সেই স্থানের ভাষায় যদি নিজের শিশু সন্তানের সাথে কথা বলে, তখনও কিন্তু সেই শিশু সন্তানটি, সেই স্থানীয় ভাষাই শিখে যাবে। এমনটা কোলকাতায় হামেশাই দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে প্রদেশ থেকে উঠে আসা মা বাবা কোলকাতার স্থানীয় ভাষাতেই কথা বলতে দেখা যায়। অথচ মায়ের মাতৃভাষা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সেই প্রাদেশিক ভাষাই। আবার অন্য দিকে, ভাষা বলতে বোঝাতে পারে মাতৃভূমির ভাষা। আর মাতৃভূমি বলতে বোঝায় কোন জাতির ভৌগোলিক স্থান।
আসলে এই ধরণের বিভ্রান্তির কারণ কিন্তু শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ও মান্যতার সাথে জড়িত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা আর পারস্পরিক সামাজিক আদান প্রদানের দ্রুততা, প্রায়শই কোন কোন শব্দের দ্বারা কোন কোন বিষয়কে বোঝাতে অক্ষম হয়ে উঠে। জাতিতে জাতিতে ভাব বিনিময়ে তাই নূতন শব্দ প্রয়োগ করা অব্দি পুরানো শব্দের কার্যকারিতা চোখে পড়ার মত। এটা লক্ষ্য করলেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, পুরানো শব্দ বাতিলের প্রশ্নটা আসে, নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের সাথে হাত মিলিয়েই। অজস্র শব্দ আর মানুষের কাজে না এসে বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। অথবা, আবিষ্কারকের দেয় শব্দগুলোই, পরিষেবা গ্রহণ যারা করে তাদের ভাষায় স্থান করে নেয়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহারে এই বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখার মত। এই ভাবে এগোতে এগোতে মানব সমাজ দ্রুতলয়ে একটা আন্তর্জাতিক ভাষার দিকে এগিয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
তাই সব দিক বিচার করে মাতৃভাষা শব্দটির যথাযথ অর্থ বুঝে উঠা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এটাও ভাষা বিষয়ে শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন। কোন শব্দ সময়োপযোগী না হলে তার স্থানে সঠিক অর্থবহ একটি নূতন শব্দ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতেই পারে। আবার এমনও দেখা যায়, প্রয়োজন তথা পরিস্থিতির তাগিদে, নূতন নূতন শব্দ অনবরত সব ভাষাতেই স্থান করে নিচ্ছে আগের আলোচনায় যা বলা হয়েছে।
তবে এটা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, অবদমিত জনগোষ্ঠীর ভাষায় অবদমনকারি জনগোষ্ঠীর ভাষা ঢুকে পড়ছে বেশি। ইংরেজরা আমাদের দেশে রাজত্ব করার সুবাদে, আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে তাদের ভাষা। ফলে জীবনযাত্রায় তাদের ভাষা না শিখে উপায় নেই। চলতে গিয়ে প্রয়োজন হচ্ছে ইংরাজি ভাষা শিখে নেয়ার। ইংরেজ, ফরাসি ও জার্মানেরা পৃথিবীর নানা দেশে দীর্ঘ দিন সাম্রাজ্য বিস্তার করে রাখার ফলে, পৃথিবীর সুবৃহৎ অঞ্চলেই এইসব ভাষা স্থায়ী ভাবে ঢুকে পড়েছে। স্পেন, বলিভিয়াতে তাদের বর্ণমালা চাপিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। এমন অনেক উদাহরণই রয়েছে। আবার পাশাপাশি অবস্থানে থাকা জাতিগুলির মধ্যেও, ভাষার অবদমন তথা আধিপত্য ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যেমন ভারতে হিন্দি ভাষা রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে। অথচ হিন্দি ভাষা শুধুমাত্র গো-বলয়ের ভাষা। গো বলয়ের জনগোষ্ঠী ভারতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকায়ই তা সম্ভব হচ্ছে। প্রচার যন্ত্রকে ঢালাও হারে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের ভাষাকে চাপিয়ে দিতে ও ছড়িয়ে দিতে।
একটা জাতির জাতীয় পরিচয়ে যেমন ভৌগোলিক স্থান একটা শর্ত, ঠিক তেমনি সেই জাতির নিজস্ব ভাষাও একটা শর্ত। তাই কোনও জাতির পরিচয়ের প্রশ্নে, ভাষাকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। নাহলে সেই জাতি ইতিহাসের বস্তু হিসেবেই স্থান করে নিতে বাধ্য হবে। হারিয়ে যাবে তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ। হারিয়ে যাবে সেই জাতি। এমন ঘটনা অবিরত ঘটে চলেছে, যদিও তা একটা দীর্ঘ কালীন প্রক্রিয়া।
এই প্রেক্ষাপটেই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেস্কো, জাতিসংঘ এমনকি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। তাহলেই এই মাতৃভাষা দিবস পালন হয়ে উঠতে পারে আক্ষরিক ভাবেই অর্থবহ। পৃথিবীর শত শত ভাষার মতো বাংলা ভাষাও আজ আসন্ন এক বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। *****