।।সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।
ছিল ‘শুকতারা’, ছিল ‘নবকল্লোল’। ‘শুকতারা’ ‘ছোটোদের’ আর ‘নবকল্লোল’ ‘বড়দের’। ‘বড়দের’ সুতরাং নিষিদ্ধ। আর তাই অক্ষরজ্ঞান ছয় কেলাসে উঠতে না উঠতেই অবরে সবরে ‘নবকল্লোল’ পেলেই যতোটা সম্ভব গো গেরাসে গিলে নেওয়া। আমার বাড়িতে যেহেতু ‘নবকল্লোল’ আসতোনা তাই লোভটা ছিল আরো বেশী। শিলচরে বড় মাসীর বাড়িতে দিদিরা তখন কলেজে। কাজেই সেখানে ‘নবকল্লোল’ আসতো, আসতো ‘উlTল্টোরথ’ও। বড়মাসীর বাড়ি গেলেই উল্টে পাল্টে দুয়ের স্বাদই নিতাম যথাসম্ভব। - হলদে কাগজে সিনেমার সাদাকালো ছবি লাল কিংবা নীল টোনে ছাপা –যেন আনতো প্রকৃত নিষিদ্ধতার স্বাদ। দোকান বাজার থেকে বাড়িতে আসা কখনো ঠোঙ্গাও তখন অনেক সময়ই হতো ‘নবকল্লোল’, ‘উল্টোরথ’এর পাতায়। সেগুলিও নিস্তার পেতোনা আমার হাত থেকে। মনে আছে এমনি এক ঠোঙ্গার কাগজে একটি গল্প কিংবা উপন্যাসের একটি দৃশ্য পড়েছিলাম যেখানে ছেলের বিয়ের আলাপ নিয়ে মেয়ে দেখতে গিয়ে পাত্রের পিতা আবিষ্কার করছেন যে পাত্রীর মা তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা! হায়! তার পরে আর পড়া গেলোনা। ঠোঙ্গাটা এমন ভাবে বানানো যাতে কোন্ মাসের, কোন্ বছরের সংখ্যা তা ছিঁড়ে গেছে। অরূপ বলে একটি মেয়েলী ছেলে ছিল আমাদের ক্লাশে। সে একবার ‘নবকল্লোল’এর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে এনেছিল একটি ছবি যেখানে একটি পুরুষ একটি নারীকে চুম্বন করছে আর নীচে লেখা ‘এখানে... এখানে অন্ধকার, এখানে আমাকে পিষে ফেলো সমীর ...’ ঐ ছবির শিল্পী তুষার চ্যাটার্জী যিনি শুকতারায় ‘কালো বাঘের থাবা’ নামের গ্রাফিক-গল্প লিখতেন, আঁকতেন স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজের বই গুলির ছবি ... ফলে তাঁর রেখার ভঙ্গী, ছবির কিনারের দস্তখত তখন আমার চেনা। বাল্যের অবদমিত যৌনতা যে সবের স্পর্শে ক্রমে অবয়ব নিয়েছিল তাদের মধ্যে ইন্দ্রজাল কমিক্সের ডায়না পামার, নার্দা, বেলা’রা যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছে ‘নবকল্লোল’ আর ‘উল্টোরথ’ এর ঐসব ছবি আর ফটো ...
‘নবকল্লোল’ এর প্রকাশ ১৩৬৭ বাংলায় অর্থাৎ ১৯৬০ ইংরেজিতে। প্রকাশের সময় থেকেই এই পত্রিকা হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। এতে সুনীল ইত্যাদিও লিখেছিল। তথাপি সুনীল ইত্যাদি একটা সময় ফ্যাশান হয়ে উঠেছিল বলে সুনীলের অখাদ্য খাজা উপন্যাস গুলিকেও ‘পাব্লিক’ খাচ্ছিল ‘ইন্টেলেক্চুয়াল’ বলে আর বিমল মিত্র’র ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’হেন অনবদ্য রচনাকেও ‘বিয়ের উপহারের বই’ এই সংজ্ঞার তিলক পরতে হয়েছিল। এই ঘটনার গহনে প্রথমে বুদ্ধদেব বসু দ্বারা আমদানীকৃত ‘আধুনিকতা’র উৎকট সংজ্ঞা ও পরে ‘কৃত্তিবাস’মার্কা আধুনিকতার অবদান প্রবল। কিন্তু ঐ তিন চারজন মোদো-মাতালের হল্লাতে বাঙ্গালী ভুলে গিয়েছিল যে ঐ ভাঁড়দের স্বর্গ যে পাশ্চাত্য সেখানে কিন্তু এমন হয়না। সেখানে জর্জ সিমোনো তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পেয়েছেন। স্বয়ং আন্দ্রে জিদ ছিলেন তাঁর মুগ্ধ পাঠক। স্বয়ং এলিয়ট সাহেব সিমোনোর পক্ষে মাঠে নেমেছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। সিমোনোর প্রসঙ্গটি আসছে এই হেতু, যে, তাঁর সময়ে সিমোনোও মূলতঃ ছিলেন জনপ্রিয়তম লেখক। বিশেষ করে তাঁর গোয়েন্দা ইন্স্পেক্টার ‘ম্যাগ্রে’ ছিল প্রায় প্রতিজনপাঠ্য এক চরিত্র। কিন্তু তাবলে তাঁর একটি উপন্যাসও নয় অগভীর। আমার এবং আরো কয়েকজন সুধী পাঠকের মতে দস্তয়েভস্কির পরে মানবমনের অন্ধকারকে এইভাবে প্রকাশ করতে পারেননি আর কেউ। বাংলায় শরদিন্দু ঐ ঘরানায় অনেক অনবদ্য গল্প উপন্যাস লিখে গেছেন। কিন্তু ‘শিক্ষিত’, ‘বুদ্ধিমান’ বাঙ্গালী পাঠক তাঁকে ‘ওহ্ ডি-টে-ক্-টি-ভ্ লেখক’ থেকে বেশী কিছু বলে সম্মান দিতেই শেখেনি। বিদেশী গল্প উপন্যাসের ছায়ায় হলেও নারায়ণ সান্যালের ‘কাঁটা সিরিজ’, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্ণেলের গল্পগুলির প্রকৃত মূল্যায়ন অদ্যাবধি হয়েছে কি? বরং লোকে অদ্যাপি গাদা গদা ‘সন্তু কাকাবাবু’ কিনে নিয়ে যায় বাচ্চাদের জন্য যে সন্তু কাকাবাবুর পাতে দেওয়ার মতো লেখা মাত্র আড়াইটে –‘ভয়ংকর সুন্দর’ আর ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’! পক্ষান্তরে ‘দারোগার দপ্তর’, ‘নীলবসানা সুন্দরী’ এসব অদ্যাপি ব্রাত্য প্রায়। -বিদেশে কিন্তু কোনান ডয়েল বা আগাথা ক্রিস্টি ব্রাত্য নন।
প্রকৃত প্রস্তাবে ‘পপুলার’ আর ‘ইন্টেলেক্চুয়াল’ সাহিত্য বলে ব্যাপারগুলো তখন ক্রমে আমদানী হচ্ছিল বাজারে। তথাকথিত ‘শিক্ষিত’দের মধ্যে ‘দেশ’ ঢুকে পরছিল তখনি। কিন্তু সেই আমলের ‘দেশ’ যেহেতু বাণিজ্য ও সাহিত্যের স্তর দুটোকেই রক্ষা করার কায়দাটা জানতো ফলে এই ‘দেশ’এই প্রকাশিত হয় শংকরের ‘কত অজানারে’, বিমল মিত্রের ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ হেন আরো অসংখ্য অনবদ্য উপন্যাস। আবার সেই ‘দেশ’এই প্রকাশিত সমরেশ বসু’র ‘বিবর’! হায়! বাঙ্গালী পাঠক, তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পাঠক, যেহেতু তাতে পেলো কামু’র ‘আউট্সাইডার’ এর বিকৃত ছায়া, পেলো যৌনতা – যা সব ছিল বুদ্ধদেব বসু’র ‘আধুনিক’ হওয়ার প্রেস্ক্রিপ্শানে। ফলে তারা হামলে পরলো সুনীলে, সমরেশে –যেখানে মূলতঃ ‘ভঙ্গী’ দিয়েই ‘সাহিত্যের খ্যাতি’ চুরির হৈ হৈ। আজ বিমল মিত্র’র ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ এর পাশাপাশি সুনীলের ‘সেই সময়’ – যেহেতু উভয়েরি আবহ ইতিহাস –নিয়ে বসে টের পাই ‘সেই সময়’ এর ব্যর্থতা। এখান থেকে ওথান থেকে কুড়িয়ে আনা তথ্য কে অমনোযোগে পাশাপাশি বসিয়ে সুনীল যা করেছে তা হলো কালী সিংগি’ থেকে বিদ্যাসাগর – সবারি লেম্পুন। মূলতঃ সংবাদ পত্রের রিপোর্টিং এর ভাষাকে ‘সাহিত্য’ বলে চালিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা সেই সময়ে যথেষ্ট সফল হয়েছিল বলেই মনেহয়। পাশাপাশি ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ পাঠককে নিয়ে যায় ভাসিয়ে। হাজির করে সিরাজের হারেমে। প্রকৃত। কল্পনার ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ পায় রক্ত মাংসের অবয়ব। এতদ্ব্যতিত ‘সেই সময়’ ঠিক যতোটা গাব্দা, ঠিক ততোটা গাব্দা আকৃতির চিঠিও আসেনা পত্রিকা দপ্তরে – লেখকের নানা রকমের ভ্রান্তির উল্লেখ করে।
আসলে ‘আধুনিক’ হওয়ার বাসনায় একদল বাঙ্গালী পাঠক এই সত্য ভুলে গিয়েছিল, যে, গল্প হোক্, উপন্যাস হোক্, তাকে আগে ‘গল্প’ বলে যেতে হবে সফল ভাবে – যে সফলতা বঙ্কিমে, বিভূতিতে, রবি ঠাকুরের ছোটোগল্পে বা বিদেশী নাম না নিলে যদি ‘গুনাহ্’ হয় তবে বলছি চার্লস ডিকেন্স্, বালজাক্, রমা রঁলা থেকে হালের উম্বের্তো একো । ঐ মূর্খামি হেতু ‘উল্টোরথ’ বা ‘নবকল্লোল’ ক্রমে হয়ে গেলো ‘মেয়েদের পত্রিকা’, ‘গৃহবধূদের কাগজ’, এমন কি বিমল মিত্র, নারায়ণ সান্যালের মতন লেখকরা হয়ে গেলেন ‘বিয়ের যৌতুক’! এই ‘আধুনিক’ ও ‘শিক্ষিত’ হওয়ার ধারনার বশবর্তী ‘দাদা’দের নকল না করলে ‘ইন্টেলেক্চুয়াল’ হওয়া যায়না তাই দাড়ি গোঁফ গজানোর আমলে আমিও ঐ সমস্ত মতামতের প্রচারক হয়ে কাটিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন শংকরের ‘কত অজানারে’ আর ‘চৌরঙ্গী’ পড়লাম টের পেলাম ঐ সব ‘দাদা’দের মতামতের অন্তঃশ্বাস শূন্যতা। শংকরের গল্প সংকলন ‘এক ব্যাগ শংকর’ এইতো সেদিনো পড়েছি মুগ্ধ হয়ে। নারায়ণ সান্যালের ‘কাঁটা সিরিজ’ তো অনন্য, জানিনা তাঁর ইতিহাস ভিত্তিক রচনাগুলি কতোজন পড়েছেন – এই মুহুর্তে মনে আসছে তাঁর ‘ দান্তে ও বিয়াত্রিচে’ গ্রন্থটির কথা। সেই ‘দাদা’রা কি শচীন ভৌমিকের লেখা পড়ে দেখেছেন কোনোদিন? অন্ততঃ তাঁর ‘অন্লী ফর এডাল্ট্স্’ নামের বইটি? জানিনা। তবে সেই ‘দাদা’রা যে রাজনারায়ন বসু বা সতীনাথ ভাদুড়ি’ও পড়ে দেখেননি ভালোকরে আর আজো না পড়েই বোলচাল চালান সে আমি নিশ্চিত। এতোকথা বলার হেতু এই’ যে, এক ‘শংকর’ বাদে একটা সময় ‘নবকল্লোল’, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ এর লেখক তালিকা আর ‘দেশ’ এর লেখক তালিকা হয়ে পরেছিল ভিন্ন। কিন্তু শুরুতে তেমন ছিলোনা। বিমল কর, সুবোধ ঘোষ, বনফুল – তৎকালের সব নামী লেখকরা লিখেছেন ‘নবকল্লোল’, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ এ। স্বয়ং তারাশঙ্করের একাধিক লেখা বেরিয়েছে ‘নবকল্লোল’এ। পয়সার আর নামের লোভে সুনীলেরাও লিখেছে বৈ’কি। তবে এই ‘বুদ্ধিজীবি সাজা’ খেলায় ইন্ধন জুগিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলিও। ‘বড়দের’ কাগজের মধ্যে যেমন ‘নবকল্লোল’, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ হয়ে পড়লো কোনঠাসা, জাঁকিয়ে বসতে লাগলো ‘দেশ’, ‘আনন্দলোক’, ক্রমে ‘সানন্দা’ তেমনি ‘ছোটোদের’ কাগজের মধ্যে ‘শুকতারা’, ‘পক্ষীরাজ’, ‘কিশোর ভারতী’ র জায়গায় চলে এলো ‘আনন্দমেলা’। ‘শুকতারা’, ‘পক্ষীরাজ’, ‘কিশোর ভারতী’ র সঙ্গে ‘আনন্দমেলা’র চরিত্র নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে যা এই লেখায় আমি করবোনা তবে এটা তো এক কথায় বলে দেওয়া যায় যে মান হিসাবে ‘নবকল্লোল’, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ থেকে , ‘আনন্দলোক’ ও ‘সানন্দা’ স্রেফ নিকৃষ্ট মানের। আশির দশক থেকে ‘দেশ’ পত্রিকাটিও তা’ই।
‘নবকল্লোল’ এর আরেক আকর্ষণ ছিল যে তাতে লেখকদের ফটো ছাপা হতো। ‘আনন্দমেলা’ ধারাবাহিক ভাবে বেরোনো ‘কে?’ পড়ে তখন স্তম্ভিত হয়ে আছি । খুব ইচ্ছে করে জানতে ‘বিমল মিত্র’ মানুষটি কেমন দেখতে ... ঠিক যেমন শুকতারা’য় ‘পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া’ পড়ে ডঃ বিশ্বনাথ রায়’কে বা ‘মুখ দেখে কি মানুষ চেনে’র ‘স্বপনবুড়ো, ‘সিসের আংটি’র বিমল কর ... সে-ই সবার সাদা কালো ফটো প্রথম দেখি ‘নবকল্লোল’ এর পাতায়। সে’ও আরেক রকমের উত্তেজনা।
আজ এতো বছর পরে হঠাৎ দেখলাম ‘নবকল্লোল’ এর ৫০ বছরের নির্বাচিত গল্প প্রকাশিত হয়েছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ( হায়, তিনিওতো আজ বিস্মৃতপ্রায়) নিজেই সম্পাদনা করেছেন এই সংগ্রহের। প্রকাশিত হয়েছে সেই ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ থেকেই যে ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ এর কৃপায় আমরা বাল্যকালে সুধীন্দ্রনাথ রাহা আর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রথম পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলাম বিশ্ব সাহিত্যের সমুদ্রে, চিনেছিলাম প্রিন্স্ মিশ্কিন্কে, অলিভার টুইষ্ট, জাঁ ভালজা’কে। ‘নবকল্লোল’ এ সুধীন্দ্রনাথ রাহা’র অনুবাদে পড়েছি বিদেশী ‘বড়দের’ গল্প। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, দৃষ্টিহীন, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ... আহ্ ... দুই খন্ডে প্রকাশিত ‘নবকল্লোল ৫০ বছরের গল্প সংগ্রহ’ হাতে নিয়ে আমি তাই দিশাহারা বোধ করতে থাকি। একদিকে স্মৃতি, নস্টালজিয়া অন্যদিকে লেখকের তালিকা ... হ্যাঁ, প্রমথনাথ বিশী,গজা মিত্তির, মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসু বা সুনীল আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় না পড়লেও সম্পাদনার গুনে এদেরো যে লেখাগুলি এই সংকলনে রয়েছে সেগুলি তুলনামূলক ভাবে এদের ‘ভালো’ লেখা। তাছাড়া কতোযুগ পরে হাতে পেলাম সুধীন্দ্রনাথ রাহাকে, অখিল নিয়োগীকে, ডঃ বিশ্বনাথ রায় কে ... এই ডঃ বিশ্বনাথ রায় ‘শুকতারা’য় লিখেছিলেন ‘পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া’। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু’র জীবন অবলম্বনে উপন্যাস। মনেপড়ে সেই উপন্যাসের একেকটি পর্বের আশায় ‘শুকতারা’র জন্য প্রতিমাসে পথ চাওয়া... পেলাম অরুন দে’র লেখা, দীপক চন্দ্র’র লেখা ...
নামের তালিকা দীর্ঘ করার অর্থ হয়না। উৎসাহি পাঠককে বলবো বই দুটি সংগ্রহ করে নিতে। যে মূল কথাটি বলতে চাই তাহলো এই সংকলনের গল্প গুলির চরিত্র খাঁটি। এই সমস্ত গল্পের শরীরে তত্ত্ব বা তথ্য ভেসে ওঠেনা চামড়ায় পাঁচরা বা দাদের মত, এই সমস্ত গল্পের বলার মুন্সীয়ানা মনে করায় যেন সেই অবলুপ্ত কথকদের যাঁরা শুধু বলার টানে জাদু করে নিতেন অসংখ্য শ্রোতাকে। এই সমস্ত গল্প মনেপড়ায় রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তিগুলিকেঃ
সুস্থ স্বাভাবিক জগবন্ধুর হঠাৎ পাগলামির সঙ্গে কোনো এক আর্ট গ্যালারীতে রাখা মাটির মুর্তি গুলির ঠিক কি যোগ? লাল প্রাসাদের পুকুরের তলায় সুড়ুং কি সত্যিই গেছে গঙ্গা অবধি? – এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানতে জানতে আমরা কি জেনে নিই না সমাজ-সভ্যতাকেও? না’কি সমাজ সভ্যতা সেই চর্মরোগ যা দিয়ে গাদিয়ে দিতে হয় কাহিনীর অক্ষরকে? শব্দকে? বিবমিষা উদ্রেককারী ভাষায় করতে হয় ‘ন্যারেশান’? – পাঠক, বইগুলি পুরো পড়ার আগেই, শুধু উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আমি যেন ভিজতে থাকি নিজ জীবনের শুধু নয়, একটি ভাষার, সাহিত্যের জীবনের সেই বিস্মৃতি বৃষ্টিতে যখন মানুষ পারতো সত্যিই গল্প বলতে ...
ক-তো কাল পরে রাত জেগে পড়ে ফেলার মতো দুটি বাংলা বই যে পাওয়া গেলো ...
‘নবকল্লোল’ এর আরেক আকর্ষণ ছিল যে তাতে লেখকদের ফটো ছাপা হতো। ‘আনন্দমেলা’ ধারাবাহিক ভাবে বেরোনো ‘কে?’ পড়ে তখন স্তম্ভিত হয়ে আছি । খুব ইচ্ছে করে জানতে ‘বিমল মিত্র’ মানুষটি কেমন দেখতে ... ঠিক যেমন শুকতারা’য় ‘পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া’ পড়ে ডঃ বিশ্বনাথ রায়’কে বা ‘মুখ দেখে কি মানুষ চেনে’র ‘স্বপনবুড়ো, ‘সিসের আংটি’র বিমল কর ... সে-ই সবার সাদা কালো ফটো প্রথম দেখি ‘নবকল্লোল’ এর পাতায়। সে’ও আরেক রকমের উত্তেজনা।
আজ এতো বছর পরে হঠাৎ দেখলাম ‘নবকল্লোল’ এর ৫০ বছরের নির্বাচিত গল্প প্রকাশিত হয়েছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ( হায়, তিনিওতো আজ বিস্মৃতপ্রায়) নিজেই সম্পাদনা করেছেন এই সংগ্রহের। প্রকাশিত হয়েছে সেই ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ থেকেই যে ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ এর কৃপায় আমরা বাল্যকালে সুধীন্দ্রনাথ রাহা আর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রথম পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলাম বিশ্ব সাহিত্যের সমুদ্রে, চিনেছিলাম প্রিন্স্ মিশ্কিন্কে, অলিভার টুইষ্ট, জাঁ ভালজা’কে। ‘নবকল্লোল’ এ সুধীন্দ্রনাথ রাহা’র অনুবাদে পড়েছি বিদেশী ‘বড়দের’ গল্প। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, দৃষ্টিহীন, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ... আহ্ ... দুই খন্ডে প্রকাশিত ‘নবকল্লোল ৫০ বছরের গল্প সংগ্রহ’ হাতে নিয়ে আমি তাই দিশাহারা বোধ করতে থাকি। একদিকে স্মৃতি, নস্টালজিয়া অন্যদিকে লেখকের তালিকা ... হ্যাঁ, প্রমথনাথ বিশী,গজা মিত্তির, মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসু বা সুনীল আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় না পড়লেও সম্পাদনার গুনে এদেরো যে লেখাগুলি এই সংকলনে রয়েছে সেগুলি তুলনামূলক ভাবে এদের ‘ভালো’ লেখা। তাছাড়া কতোযুগ পরে হাতে পেলাম সুধীন্দ্রনাথ রাহাকে, অখিল নিয়োগীকে, ডঃ বিশ্বনাথ রায় কে ... এই ডঃ বিশ্বনাথ রায় ‘শুকতারা’য় লিখেছিলেন ‘পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া’। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু’র জীবন অবলম্বনে উপন্যাস। মনেপড়ে সেই উপন্যাসের একেকটি পর্বের আশায় ‘শুকতারা’র জন্য প্রতিমাসে পথ চাওয়া... পেলাম অরুন দে’র লেখা, দীপক চন্দ্র’র লেখা ...
নামের তালিকা দীর্ঘ করার অর্থ হয়না। উৎসাহি পাঠককে বলবো বই দুটি সংগ্রহ করে নিতে। যে মূল কথাটি বলতে চাই তাহলো এই সংকলনের গল্প গুলির চরিত্র খাঁটি। এই সমস্ত গল্পের শরীরে তত্ত্ব বা তথ্য ভেসে ওঠেনা চামড়ায় পাঁচরা বা দাদের মত, এই সমস্ত গল্পের বলার মুন্সীয়ানা মনে করায় যেন সেই অবলুপ্ত কথকদের যাঁরা শুধু বলার টানে জাদু করে নিতেন অসংখ্য শ্রোতাকে। এই সমস্ত গল্প মনেপড়ায় রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তিগুলিকেঃ
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল—
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝরঝর বরষার মতো—
ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তার শুনি অবিরত।
সেই-সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারি দিকে করি স্তূপাকার,
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণনিশার ’
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল—
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝরঝর বরষার মতো—
ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তার শুনি অবিরত।
সেই-সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারি দিকে করি স্তূপাকার,
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণনিশার ’
সুস্থ স্বাভাবিক জগবন্ধুর হঠাৎ পাগলামির সঙ্গে কোনো এক আর্ট গ্যালারীতে রাখা মাটির মুর্তি গুলির ঠিক কি যোগ? লাল প্রাসাদের পুকুরের তলায় সুড়ুং কি সত্যিই গেছে গঙ্গা অবধি? – এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানতে জানতে আমরা কি জেনে নিই না সমাজ-সভ্যতাকেও? না’কি সমাজ সভ্যতা সেই চর্মরোগ যা দিয়ে গাদিয়ে দিতে হয় কাহিনীর অক্ষরকে? শব্দকে? বিবমিষা উদ্রেককারী ভাষায় করতে হয় ‘ন্যারেশান’? – পাঠক, বইগুলি পুরো পড়ার আগেই, শুধু উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আমি যেন ভিজতে থাকি নিজ জীবনের শুধু নয়, একটি ভাষার, সাহিত্যের জীবনের সেই বিস্মৃতি বৃষ্টিতে যখন মানুষ পারতো সত্যিই গল্প বলতে ...
ক-তো কাল পরে রাত জেগে পড়ে ফেলার মতো দুটি বাংলা বই যে পাওয়া গেলো ...
1 টি মন্তব্য:
পড়লাম ভালো লাগলো।নবকল্লোলের পিছিয়ে পড়ার ,যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন,সেগুলির সাথে একমত।নবকল্লোলের সব পুরানো সংখ্যাগুলিকে নবকল্লোল অফিসে সংরক্ষিত আছে?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন