।।সপ্তর্ষি বিশ্বাস।।
[ উৎসর্গঃ মা’কে ... ]
এরা যে কোথায় থাকে কেউ জানেনা। জানবেও না। তবে গীর্জাটির আশে পাশে, ফুটপাথে,রাস্তায় ওরা আসে। ভিড় ভাট্টা দেখলে ঢুকে যায় গীর্জার অন্দরেও। তারপর আবার কোথায় যে যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে ...রাত বিরেতে ওদেরি কি দেখাযায় ব্যস্ত হয়ে উঠতে ডাস্টবিন থেকে পাঁউরুটির টুকরো খুঁজে নিতে? হয়তো এরাই। হয়তো ঠিক এরা নয়। অন্য কেউ। হয়তো। তাও যদি হয় তবে এরাও ওদেরি মতন... অথবা ওরাও এদেরি মতন – চুল, যথারীতি, রুক্ষ, লাল। উকুনে ভরা। দৃষ্টি, যথারীতি মোনালিসার চেয়েও ব্যঞ্জনাময়। এদের দেখামাত্র, যথারীতি, অন্ততঃ অবিনাশের, যে এখন গীর্জাটির অপর পারে দাঁড়িয়ে ধুমপানে ব্যস্ত,সন্দেহ জাগে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ভূমিকা নিয়ে ...
এদের সব চেয়ে বড়টির বয়স হবে পনেরো। অনাহারের দৌলতে মনেহয় বারো তেরো। সবচেয়ে ছোটোটি হবে পাঁচ। দেখে মনেহয় তিন... সে ঘুরে বেড়ায় দিদিদের কোলে কোলে... তিন দিদি, এক বোন... ঐ যে তারা এখন বসে আছে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার দখল করে, ঐ গীর্জার জঠরে ... ওই যে ওদের বিস্মিত চোখ গিলে খাচ্ছে মঞ্চে চলতে থাকা নাচগানরত ছোটো ছোটো শিশুদের ...
গীর্জাটি বেশ পেল্লায় আকারের হলেও আকৃতি এবং প্রকৃতি দুই’ই নয় অভিজাত। ‘গীর্জা’ শব্দটি যে সম্ভ্রম বহন করে তা এখানে নেই। বরং দূর থেকে দেখলে এটাকে হাসপাতাল বাড়ি বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ‘নির্ঘাৎ কন্ভার্সন্ওয়ালা কোনো দেশী পাদ্রীর কাজ’ – ভাবে অবিনাশ। গীর্জাটি পার হয়েই আরম্ভ মুসলমান পাড়ার। নির্ঘাৎ কন্ভার্সনের পুরো ফসলটা মোল্লা সাহেবেরাই শুধু কেটে নেচ্ছেন দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোনো করিৎকর্মা দেশী পাদ্রী ... তবে খুব বেশী দিনের যে নয় এই গীর্জা তা’ও বুঝে নেওয়া যায় এক ঝলকেই। একটা বড়সড় প্রার্থনা কক্ষ –বাবা যিশুর একটি মূর্ত্তি না থাকলে যাকে ‘প্রার্থনা’শব্দটির ধারে কাছেও কিছু ভাববার কোনো হেতু নেই ... আর তার পাশে একটা ‘কমিউনিটি হল্’। তার আকার প্রার্থনা কক্ষ থেকে বেশ খানিকটা বড়। একফালি বাঁধানো উঠান। সামনে। ঐ কমিউনিটি হল্ ভাড়া দেওয়া হয় উৎসবে অনুষ্ঠানে। তা’সে কারোর বিয়েই হোক্ আর হোক্ কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । সম্ভবতঃ গীর্জার আয়ের একটা বড় অংশ আসে ঐ ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা থেকে।
গীর্জার সামনের রাস্তাটা সরু। রাস্তার ওপারে সিগারেট-কেইক-চা-বিস্কুটের একটি দোকান। দোকানের পিছনে উঁচু পাঁচিল ঢাকা মুসলমান কবরখানা। কবরখানা বলেই সেখানে কিছু গাছ সুযোগ পেয়ে গেছে বড় হওয়ার। অহেতুক ডালপালা মেলে অদ্যাবধি টিঁকে থাকবার। এমনি একটি বৃক্ষের ছায়াতে,রাস্তার ঐ পারে দাঁড়িয়ে আছে অবিনাশ। সিগারেট খাচ্ছে। রাস্তার অন্য পারে, গীর্জার শরীরে রোদ, রোদে আসন্ন গ্রীষ্মের হলকা। বহুদিন বৃষ্টি হয়নি বলে গাছের পাতায় ধূলার আস্তরন। রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি দু’টি অটো রিক্সা। কার্। ধোঁয়ায়, ধুলায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে দশদিক ... যেন ঐ তিনটি-চেয়ার জুড়ে বসা চারটি অজ্ঞাতকূলশীল শিশুগুলির চুলের মতোই ...রাস্তাটির শেষ প্রান্তে কোথাও একটা কিছুর কারখানা রয়েছে যে কারখানার নামে এই রাস্তার নাম। সম্ভবতঃ ঐ কারখানা থেকেই উড়ে আসছে ধোঁয়া। মিশে যাচ্ছে বাতাসে। সব মিলিয়ে ‘হতশ্রী’ শব্দটি যেন শারিরীক হয়ে উঠেছে এখানে ...
এতোক্ষণ গীর্জার ভিতরে, ঐ, ‘কমিউনিটি হল্’এ’ই ছিল অবিনাশ। সোনি-হ্যান্ডিক্যামের লেন্সে চোখ লাগিয়ে তুলে নিচ্ছিল চলচ্ছবি এই অনুষ্ঠানের। এখন খোকার হাতে ক্যামেরাটি দিয়ে চলে এসেছে বাইরে। সিগারেট খেতে। বয়স দশ পেরোয়নি খোকার। তবে খোকা হ্যান্ডিক্যাম্ চালাতে পারে। পারে দাবা খেলতে। ছবি আঁকতে। পারে গুগুল্’এ সার্চ্চ করে হোম্টাস্কের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জেনে নিতে। তা’য় আবার এ তার বোনের ইস্কুলের ‘ফাংশান’। অতএব ‘দাদাগিরি’র এমন সুযোগ সে ছাড়ে? ... মঞ্চে উঠে আসছে একের পরে এক দল শিশু। ব্যাক্গ্রাউন্ডে বাজছে নানান ভাষার গান। তামিল-তেলেগু-কন্নড়-হিন্দি-ইংগ্রেজি। ঘোষক-ঘোষিকা বলে দিচ্ছেন ‘এটা পোঙ্গলের গান’, ‘এটা উগাদী’র...’ এখানে হাতে হাতে হ্যান্ডিক্যামের বদলে রয়েছে ভিডিও-রেকর্ডিং করার ক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল। তাতেই ধরা পরছে নিজ নিজ সন্ততির কৃতিত্ব। খোকার ইস্কুলে হলে দৃশ্যটা খুব একটা অন্য রকম হতোনা। সেখানে হাতে হাতে ভিডিও-রেকর্ডিং করার ক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল এর বদলে থাকতো নানা ব্র্যান্ডের হ্যান্ডিক্যাম্। আর হ্যাঁ, ঐ’তিনটি চেয়ার জুড়ে বসে থাকা চারটি লাল-চুল শিশু ওরা পারতোনা ঢুকতে, অবশ্যই। কেননা খোকাদের ইস্কুল ইন্টারনেশন্যাল্ হয়ে গেছে। তাই বিরাট তার প্রাচীর। সেই প্রাচীরের পেটের ভিতরে অডিটোরিয়াম ... ওই প্রাচীরের ভিতরে ঢুকতে, পিটিএম্ ছাড়া অন্য সময়ে পেল্লায় এসি গাড়িওলা ‘পেরেন্ট্স্’দেরো ‘পার্মিশান’ নিতে হয় ...
মনে মনে রঞ্জনা মিত্রের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনা অবিনাশ। বেশ গুছিয়ে তুলেছে সে ব্যাপারখানা ... বস্তিবাড়ির লাগোয়া গলিতে ইংরেজি ইস্কুল খুলবার দুঃসাহস সমারসেট্ মমের ভার্জারো দেখাতে পারতো কি’না সন্দেহ ... তবে রঞ্জনা মিত্র, এই মুহুর্তে দর্শকের আসনে যে বসে আছে প্রথম সাড়িতে, যার পিঠ কাটা ব্লাউজের কিনারায় উঁকি দিচ্ছে ‘ভিক্টোরিয়াজ সিক্রেট্’, যার চোখে চশমা, হাতে মোবাইল, পাশে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট বর দেবর্ষি মিত্র, তার দূর দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ যে ‘ভিশন্’এর মতো ধ্রা দিয়েছিল অনেক আগেই এ নিয়ে কারো যদি কিছুমাত্র সন্দেহ এখনো থেকে থাকে আগামী পাঁচ বছরে আর থাকবেনা ...
একটা সিগারেট শেষ হলে আরেকটা জ্বালিয়ে নেয় অবিনাশ। কি হবে ভিতরে গিয়ে? খুকি’র নাচ আপাততঃ শেষ। রঞ্জনা মিত্র বলেছে আরো দুটো নাচ আছে। আরো আধঘন্টা পরে একটা। তার আরো কিছুক্ষন পরে আরেকটা। অতএব এখানে দাঁড়িয়ে আরো একটা সিগারেট টানবার সিদ্ধান্তেই স্থির হয়ে অবিনাশ ভাবে একটু চা হলেও মন্দ হতোনা। দোকানীটিকে ‘চা’য়ে হোগা?’ বলতে বলতে তার চোখ পড়ে দোকানের পেছনের দিকে রাখা আয়নাতে। শস্তা আয়না। গরমে বেঁকে গিয়ে নিয়েছে অবতল আকৃতি। ফলে ছায়ার আকার হয়ে যায় বস্তুর আকারের চেয়ে ঢের বড়ো। নিজেকে, মানে নিজের মুখকে, এতো বড়ো করে, বাস্তবে দেখেনি অবিনাশ। তাই যেন একটু চমক লাগে তার। দোকানীটি ছোটো প্লাস্টিকের গেলাসে চা দেয়। কিন্তু সেদিকে মন যায়না অবিনাশের। সে যেন তন্ময় হয়ে যায় তার ঐ অবতল প্রতিবিম্বে ...
আচ্ছা মুখের বাঁদিকে এই রেখাটা গজালো কখন? না’কি ছিল আগেই? গলার ভাঁজটাও যেন বেশ গভীর বলেই মনেহচ্ছে... চোখের চাউনিতেও কি যোগবিয়োগ ঘটেগেছে কিছু?...নিজের দিকে তাকিয়ে একটু অস্বস্তিতেই পরেযায় অবিনাশ। হ্যাঁ, চশমা আগে ছিলোনা। বছর পাঁচ হলো লেগেছে। গালে, তলপেটে মাংসের মচ্ছবটাও এখানে আসার পরেই। কিন্তু ঠিক কবে থেকে সূত্রপাত হলো তার? বেঙ্গালোরের পথে পথে চাকরি খুঁজে বেড়ানোর দিন গুলিতে এমন ছিলনা ... কিন্তু বেঙ্গালোরে আসারও’ত হয়ে গেলো প্রায় এগারো বছর ... আশ্চর্য ... এক বছরের খোকা পেরিয়ে গেলো দশ ... যে খুকি’র নাম গন্ধও ছিলোনা কোথাও আজ সে’ই খুকি’ই যাচ্ছে ইস্কুলে ... যদিও ‘প্লে স্কুল’ তবুও স্কুল’ত বটেই ... খুকিকে কতো কি শিখিয়েছে এরা ... ‘এ’ ফর্ এপ্ল্, ‘বি ফর্ বেট্’ ... নেচে নেচে, চোখ মুখ ঘুড়িয়ে বলা ‘চাবি চিক্স্’, ‘টিংকল্ টিংকল্ ...’ চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে দেশবন্দনা ‘সারে যাঁহা সে আচ্ছা...’ ... অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হাত ধরে গোল হয়ে ঘরতে ঘুরতে ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোসেস্’ বলতে বলতে হঠাৎ ধপ্ ক’রে মাটিতে পরে যাওয়া ... আহা, খোকার কম্পিউটার প্রতিভা আর খুকির এইসব দেখে তাদের আসামের দেশবাড়ি থেকে সপরিবারে বেঙ্গালোর বেড়াতে আসা সমর পাল আর তার বউ’এর তো চোখই গিয়েছিল টাটিয়ে ...দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমর বলেছিল ‘সাউথে এডুকেশনের স্টেন্ডার’ই আলাদা ...’ মনে মনে হেসেছিল অবিনাশ, হুঁ হুঁ বাবা, এলেম আছে, রঞ্জনা মিত্র’র এলেম আছে ... এ’ও ঠিক, যে, প্লে স্কুল শেষ হয়েগেলে খুকিকে আর এখানে রাখবে না অবিনাশ, দিয়ে দেবে খোকা যে ইস্কুলে যায়, সেই ইন্টারনেশ্নেলেই, তবে রঞ্জনা মিত্র’র ‘কিড্-কিডিস্’এরও ইন্টারনেশনাল হতে খুব বেশী দেরী নেই ... হ্যাঁ, যদি সত্যি তেমনটা হয় তাহলে নিশ্চয় এই গলির ভিতরের বাড়িটাতে আর থাকবেনা এই স্কুল, ফাংশন্ও হবেনা এই বস্তির পাশের গীর্জার ‘কমিউনিটি হল্’এ আর তা যদি নাহয়, সত্যি যদি একটা পশ্ স্কুল হয়ে ওঠে এটা তখন কেজি ওয়ান বা টু’তে এখানে এনে খুকি’কে আবার ভর্তি করে দেওয়াই যায় ... হাজার হোক্ রঞ্জনা মিত্র’ত মাল্যশ্রী’রও বান্ধবী, দেবর্ষি মিত্র’র সঙ্গে অবিনাশেরোতো ভাবসাব আছেই ...
চা’য়ের গ্লাস্ হাতে নিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালায় অবিনাশ। সরে আসে ঐ অবতল আয়নার কাছ থেকে। সড়ে আসে তবু যায়না ঐ ভাবনা ... বেঙ্গালোরে আসার হয়ে গেলো এগারো বছর ... আশ্চর্য ... এক বছরের খোকা পেরিয়ে গেলো দশ ... যে খুকি’র নাম গন্ধও ছিলোনা কোথাও আজ সে’ই খুকি’ই যাচ্ছে ইস্কুলে ... যখন এসেছিল তখনো দেশগাঁয়ে জীবিত ছিল যতো চেনা মানুষ এখন তার অর্ধেক মরে হেজে গেছে ...এঁদের কয়েকজনের সঙ্গে শেষবার যে কবে দেখা হয়েছিল তা’ও আজ মনে পড়েনা ...তখন এ সব ছেলেরা পার্কে জটলা করে আড্ডা দিতো, হাত পাকাতো সিগারেট বা গাঁজা টানায় আজ তারা কেউ কেউ পাড়ার মাস্তান, কয়েকজন মাষ্টারি পেয়েছে আশে পাশের গ্রামের ইস্কুলে আর বাদ বাকীরা আদের কিছু হয়নি তারা বলে বেড়ায় ‘কন্ট্রাকটারি করছি ...’ এমনি একজন, সুজিত, অবিনাশের পরিচিত গিয়েছে পাগল হয়ে ... কালো, লম্বা মতন শঙ্কর, যার কোঁকড়ানো চুলের জন্য সবাই তাকে ডাকতো ‘জ্যাক্শন’ বলে, সে ঝুলে পরেছে গলায় দড়ি দিয়ে ... মা’বাবার মুখের রেখার জ্যামিতি হয়েছে জটিলতর। হাতে গোনা যে দু চারজন বন্ধু আছে তাদের সঙ্গেও কি গড়ে ওঠেনি কোনো দূরত্ব? ... এখানে, বেঙ্গালোরে এসেও যে সব জমি ওরা এসেও দেখেছিল সবুজ সেখানে এখন শপিং মল্, ফ্ল্যাটবাড়ি, বহুতল মাল্টিনেশনেল ... মনেপড়ে বেঙ্গালোরে আসার প্রথম দিনগুলি, মাসগুলি ... আকাশ ছোঁয়া ঐ বহুতল মাল্টিনেশনেল বাড়ি গুলির দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মাল্যশ্রী’র চোখের কাতরতার মর্মে মিশে থাকা প্রার্থনা ... চাকরীর ... সুস্থিতির ...স্বাভাবিক নিয়মেই মাল্যশ্রী চেয়েছিল ভাত-কাপড় আর ছাদের সুস্থিতি ... তা’ই চায়নি’কি অবিনাশও ...অন্ততঃ তখন? যদি না চাইতো তাহলে ভিটেবাড়ি, ঘরদোর ছেড়ে কেনই বা সে পাড়ি জমিয়েছিল এই শহরে যে শহর মূলতঃ ভূইফোঁড়? যে শহরের সঙ্গে তার আত্মার কোনো পরিচয় নেই, স্মৃতি নেই ... তবু সে চলে এসেছিল। চলে এসেছিল এই শহরেই। নৌকা পুড়িয়ে দিয়েই যেন প্রায় ... হঠাৎই তার মনে হলো, ঐ’যে রুক্ষ চুলের না খেতে পাওয়া শিশুগুলি ওরা কোন্খান্ থেকে এসেছে এই শহরে? এই ভূইফোঁড় শহরের সঙ্গে কি তাদের সংশ্রব?
“পাপা, তাড়াতাড়ি আয়্... পুগির নাচ আরম্ভ হয়ে যাচ্ছে...” খোকার উত্তেজিত ডাক ভেসে আসে গীর্জার ফটকের মতো খোলা মুখটার থেকে। খুব সুন্দর হয়েছে খোকা। ঠিক যেন ছোটো বেলার অপু ...ডাগর চোখে অপার বিস্ময় ...খুকির চোখে দুষ্টুমি ... শুধুই দুষ্টুমি ...রাস্তা পার হয়ে এসে ছেলের কাঁধে হাত রাখে অবিনাশ। হেঁটে হেঁটে চলেযায় ‘কমিউনিটি হল্’ এর ভিতরে ... স্টেইজে মাইক হাতে রঞ্জনা মিত্র ঘোষনা করছেন এখন হবে ‘হোলি’নাচ। বেক্ড্রপে ভিড় মিকিমাউস্, সিন্চেন ইত্যাদি কমিক চরিত্রদের। জোরালো আলো ফেলে ভিডিও তুলে ঘড়ে বেড়াচ্ছে এক ভাড়া করা ছোকরা। ঠিক খোকাদের ‘ইন্টারনেশনেল’ ইস্কুলের মতোই। ‘না, রঞ্জনা মিত্র’র হবে...বেশ দ্রুত উঠে যাচ্ছে সিঁড়ি ভেঙ্গে’...মনে মনে বলে অবিনাশ...আর তখনি স্টেইজের এক পাশে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুকি’কে ঠিক চিনেনিয়ে খোকার হাত থেকে হেন্ডিক্যামটা নেয় অবিনাশ। খোকা মৃদু আপত্তি তুল্লেও দিয়ে দেয় ক্যামেরাটা। আই পীসে চোখ রাখে অবিনাশ। মাইকে বেজেওঠে কি একটা গান... ক্যামেরায় উঠে আসে একটি একটি করে মুখ সঙ্গে সিনেমার মতন করে যেন চোখে ভেসে ওঠে পরিচয় লিপি গুলিও ...
মনীষাঃ বাবার কাটা কাপড়ের দোকান। তবে সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের মোবাইল ব্যবহার করে সে। কানে লাগানো থাকে ব্লু টুথ্। ফাংশনে এসেছে টাই পরে।
সাসনিঃ বাবার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া নিতে হলে তার কাছে যাও। সে বাড়ি খুঁজে দেবে। তুমি ওকে পয়সা দেবে বাড়ি খুঁজে দেওয়ার জন্য, বাড়ির মালিক দেবে ভাড়াটে খুঁজে দেওয়ার জন্য। তার গাড়ি টাড়ি সবই আছে। কিন্তু ইংরেজি বলতে পারেনা বলে অনেকেই তাকে হাতে নেয়না। এমন কি মেয়েকে কোন্ এক ইস্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাওয়ার পর তার ইংরেজির বহর দেখে মেয়ের এড্মিশান বাতিল হয়ে যায়।
নরহরিঃ বাবা’যে ঠিক করেন তা কারোরি জানা নেই। তিনি পটি করতে গেলেও শার্পের ল্যাপ্টপ্ সঙ্গে নিয়ে যান। বাড়িতে পার্টি হয় প্রায় রোজই। অনেক রাত পর্যন্ত। থুতনীতে ফ্রেঞ্চ্কাট্ আছে। নরহরি সমস্ত পার্টীর মধ্যভাগে দুলে দুলে শোনায়ঃ টিংকল্ টিংকল্’ ... বাবা সবাইকে বলেদেন ‘ও কানাড়া জানেইনা ... অল্ ডে ইংলিশ্’
পুগিঃ পুগির মা রঞ্জনা মিত্র’র বান্ধবী স্থানীয়। কাছাকাছি যে বাঙ্গালী এসোসিয়েশনটি দুর্গাপুজা করে সেখানে গিয়ে পরিচয়। ‘যদিও এদের সঙ্গে আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ডের গ্যাপ্ আছে, স্টীল্ , ইউ ক্যান্ গীভ্ আ ট্রাই... আফ্টার্ অল্ আমি’ত আছি’ ...
মাঝখানে কি করে ঢুকে পড়ে ঐ চারটি মুখ। রুক্ষ লাল চুল। চোখের কোনে পিচুটি। তিনজনে জড়সড় হয়ে বসে আছে দুইটি চেয়ারে। ভিতু ভিতু চোখে তাকাচ্ছে চারপাশে। সবচেয়ে ছোটোটি বসে আছে মাঝারিটির কোলে। হাতে হলুদ একটা বল। কেউ সামনে দিয়ে চলে গেলেই ভাবছে এই’না বলে ‘যাও, বেড়িয়ে যাও ... তোমরা এখানে কি করতে এসেছো? শিক্ষা-দীক্ষার কি বোঝো তোমরা? কি বোঝো নেশনেল ইন্টিগ্রাশনের ...” ... অবিনাশ, যেন নিজের অজান্তেই জুম্ করতে থাকে ঐ মুখগুলি, চোখগুলি ... জুম্ করতে করতে করতে করতে যেন ছুঁয়ে দিতে চায় তাদের অস্তিত্বকেই ... কিন্তু টেক্নোলজির নিয়মে তা হয়না। এক সময় আবছা হয়ে যায় মুখগুলি। পরিবর্তে ভেসে ওঠে অন্য নাম, অন্য মুখ, অন্য আবহ, অন্য পরিচয়লিপিঃ
‘ জিউস্ ইন্টারনেশন্যাল স্কুল’
‘প্রতিটি বড় শহরে শাখা আছে’
‘আমাদের ইস্কুলের অমুক-তমুক এবং অমুক ঐ বৎসর আমেরিকা গিয়েছিল’
‘আমাদের তমুক ছাত্রের সঙ্গে ওবামা’র ফটো ...’
‘আমাদের প্রতিষ্ঠাতা তমুক ইন্দিরা গান্ধী’কে মালা দিচ্ছেন...’
‘এখন আমরা হাজির বাঙ্গালোরেও... তবে এক লক্ষ টাকা ডোনেশান না দিতে পারলে আর মাসে মাসে কুড়ি হাজার ফী না জোগাতে পারলে এখানে এসোনা যেন..’
‘ঐ দেখো আমাদের কৃতী ছাত্ররা... ঐ দেখো তারা নাচছে ......
ঐ দেখো অর্বিন্দ, এসেছে কেরালা থেকে। তার বাবা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার। ওরা এখন আর কেরালা যায়না কেননা কেরালা’র যে গ্রামে ওদের বাড়ি ওখানেই কেউ ইংরেজি বলতে পারেনা। ট্রাই টু আন্ডারস্টেন্ড্ দ্য জেনুইন্ এফোর্ট্ হি ইজ্ পুটিং টু গীভ্ হিস্ চাইল্ড্ এ গুড্ এডুকেশান এন্ড্ এট্মোস্ফিয়ার... ঐ দেখো পিটার। তার বাবা একজন সফট্ওয়ার প্রোফেশন্যাল। ওরা কৃশ্চান। ওরা প্রতি সপ্তাহে চার্চ্চে যায়। ওদের ঠাকুমা-ঠাকুর্দ্দা থাকেন এই বেঙ্গালোরেই। একটা ওল্ড্ হোমে। মাসে বারো হাজার টাকা দিতে হয় ঐ হোমে। ঐ জন্য তাদের প্যানেল টিভি কেনা তিন মাস পিছিয়ে গেছে। -- আই এম্ শীওর ইউ কেন ভেলু দেয়ার সেক্রিফাইস্...এই যে ছট্ফটে মেয়েটি এর নাম দীপিকা। ওর মা একজন এনজিও’কর্মী। ওর মা’র সঙ্গে ওর বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে।ওর নতুন বাবা’কে ও বলে আংকল্। ইয়েস্, দিস্ ইজ্ কল্ড্ মেনার্স্ ...ঐ’যে সুদীপ, সুডীপ চাট্টোপাড্যায়, ওরা বেঙ্গলী। ওর বাবাও একজন আইটি প্রো। ওর মা খুব ভালো টেগোর-সং গাইতে পারেন। সান্ফ্রান্সিস্কো’তে তাঁর গান শুনে, নাচ দেখে ‘অরাক্ল্’ কোম্পানীর চেয়ারম্যান খুবই প্রশংসা করেছিলেন। ওর ঠাকুর্দ্দা নেই। ঠাকুমা থাকেন কলকাতায়। একটা নামী ওল্ড হোমে। সুডীপের বাবা তাঁর প্রবল ব্যস্ততা সত্ত্বেও দু বছরে একবার যান মা’কে দেখে আসতে...মিস্টার চাট্টোপাড্যায়’ সোয়ামি অরবিন্দের একজন ফলোয়ার ... ওহ্, হোয়াট্ এ কাল্চারেল হেরিটেইজ্ দে হেভ...ঐ’যে ছেলেটি, ওর নাম ভিনায়ক। ওর বাবা আইটি প্রো নন। কিন্তু তিনি চান ছেলে আইটি প্রো হোক্। তাই ছেলেকে তিনি আমাদের জিম্মায় দিয়েছেন সর্বতোমুখী তালিমের জন্য। ইয়েস্ দিস্ ইজ্ কল্ড্ ভিশন... ঐ যে ছেলেটি, সে’ও বঙ্গ্। নাম অবলীল চাক্রাভারটি। ওর বাবার নাম আনিমেষ চাক্রাভারটি। উনি আইটি প্রো এন্ড্ এ পোয়েট এস্ ওয়েল্। ওনার ওয়াইফ্ মিসেস্ মাল্যশ্রী আমাদের স্কুলেরি একজন টীচার। বাট্ যেহেতু তাঁরা চাননা যে তাদের অনুপস্থিতিতে বাচ্চা ডে-কেয়ার ইত্যাদিতে থাকুক তাই মিসেস্ চাক্রাভারটি’র পেরেন্ট্স্দেরকে তাঁরা এখানে এনে রেখেছেন তাঁদের ছোটো বাচ্চাটিকে দেখে রাখবার জন্য। ইন্ দ্যাট্ ওয়ে ওঁরাও ঐ অল্ড্ ফেলোস্’দের কেয়ার নিতে পারছেন... ইজ্ন্ট্ ইট্ এ ভেরী গুড্ এক্সাম্প্ল্? ... মিস্টার চাক্রাভারটি ইজ্ ভেরী লিবারেল্। মা’বাবার কষ্ট হবে বলে ওদেরকে উনি আসামেই রেখেছেন। মাঝে মাঝে ওঁদের এখানে আনিয়ে তিনি ট্রিট্মেন্ট্ করিয়ে আবার ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। তবে, বাই দ্য ওয়ে, মিস্টার চাক্রাভারটি’র মাথায় একটু ছিট আছে বলেই মনেহয় আমাদের কেননা উনি বলেন যে বাচ্চাদের না’কি ভার্নিকুলার মিডিয়ামেই পড়াশোনা করা উচিত। আমাদের ইস্কুলের সাইকোলজিস্ট বলেছেন যে এরকম জিনিস তারাই ভেবে থাকে যারা আসলে হাম্ব্ল্ অরিজিনের। যেহেতু এরা নিজেরা ব্রেন্ডেড্ স্কুল-কলেজে পড়েনি তাই বাচ্চাদের ব্রেন্ডেড এডুকেশান দিতে ওদের ভেতরে একটা ইন্ফিরিওরিটি কম্প্লেক্স্ কাজকরে ... মে বী মিস্টার চাক্রাভারটি ইস্ আইটি প্রো বাট্ হি ইস্ ফ্রম্ সাম্ অব্স্কীওর ভিলেইজ্ অফ্ আসাম ... আচ্ছা বাদ দিন ... এই যে মেয়েটি দেখছেন ...
বেশ তো চলছিল মুখের মিছিল আর পরিচিতি পর্ব্ব। হঠাৎ, আবার বাদ সাধলো ঐ রুক্ষ, লাল চুল ওয়ালা বাচ্চাগুলি। ওদেরোতো ইন্ট্রোডাক্শান দরকার। কিন্তু কী হবে ওদের ইন্ট্রোডাক্শান? শুধু অবিনাশ নয়, সমস্যায় পরে যায় মিসেস্ রঞ্জনা মিত্র, সেই রঞ্জনা মিত্র যে জানে ঠিক কি কি দাওয়াই দিলে বস্তির লোক ঝেঁটিয়ে আসবে তার স্কুলে কাচ্চা বাচ্চা ভর্তি করতে, যে মাল্যশ্রী’কে খুকি’কে আপাততঃ তার ইস্কুলে দিয়ে দেওয়ার ফ্রেন্ড্লী আইডিয়াটা দিয়েছে ... ‘একেতো কাছে প্লাস্ আমি ত’ আছিই। এন্ড্ দিস্ ইস্ নাথিং বাট্ এক্লেমেটাইজ্ হার উইথ্ দ্য কন্সেপ্ট্ অফ্ স্কুল ... কি বলো মালা, এম্ আই রাইট্?” ... সেই রঞ্জনা মিত্র’ও পারছেনা ক্যামেরায় ভেসে ওঠা ঐ মুখ গুলির, ঐ অনাদরে বেড়ে ওঠা রুক্ষ চুলগুলির, ঐ অদ্ভুত চাউনি ভরা চোখ গুলির কোনো ইন্ট্রোডাক্শান দিতে ... পারছেন না মিস্টার জেরী আর মিসেস্ জেরী... যাঁদের অনবদ্য দূরদৃষ্টির ফল এই জিউস্ ইন্টারনেশ্নেল ... পারছেনা আইটি প্রো কাম্ পোয়েট অবিনাশ চক্রবর্তী’ও ... পরিবর্তে তার ক্যমেরা ঘুরে যাচ্ছে অসহায় ফ্ল্যাশব্যাকে ...ক্যামেরায় ভেসে উঠ্ছে একটি সকাল। লাল পাড় শাদা শাড়ি পরনে এক মহিলা। একটি রিক্সায়। মহিলার কোলে একটি শিশু। কিনারে আরেকজন। রিক্সা চলেছে মফস্বলি পীচ্ রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশে পাশে বয়ে চলেছে একটা নদী। নদী নয়। খাল। পরে যদিও গিয়ে মিলেছে নদীতে। এই মফস্বলের প্রান্তেই। নদীও নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে মিশেছে সাগরে। কিন্তু কোথায় কেজানে ... রাস্তার ধারে ধারে বাড়ি। প্রায় সব বাড়ি থেকেই ভেসে আসছে পোড়োদের স্বর নয়তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের রেওয়াজ ... রিক্সা পার হচ্ছে মণীন্দ্র মহাজনের দোকান, জোড়া তেঁতুল গাছ, পার হচ্ছে রজনী শা’র বাগান ... সরকারি হাসপাতাল ... ইষ্টিশান রোড... যমজ বোনের মতো রাধা-দুর্গা সিনেমা হল্ ...মা’র সঙ্গে ‘সফেদ্ হাতী’ দেখেছে তারা এরি কোনো একটিতে ... দেখেছে ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘ফটিকচাঁদ’, ‘কিং-কং’ ... কতোবারই গিয়েছে ভিতরে ... তবু, প্রতিবার, আলো নিভে যাওয়া মাত্র কেমন ভয় ভয় করেছে ... করেছে গা ছম ছম ...পর্দায়, ক্রমে,ভেসে উঠছে অক্ষর, ছবি ...
‘ অক্ষরঃ মনিমুক্তা বিদ্যামন্দির
ছবিঃ বিরাট পাঁতিল তোলা ইস্কুল বাড়ি। ইউ’র মতো আকার। শাদা দেওয়াল। ফটক থেকে বাঁধানো, উঁচু পথ চলে গেছে প্রিন্সিপালের কোঠা অবধি। বারান্দা ঘিরে নীল নীল নাম না জানা ফুলের গাছ। গাছের ডাল ভাঙ্গা যায় সহজেই। ডাল ভাঙ্গলেই শাদা শাদা আঠালো রস আসে বার হয়ে। বারান্দা গুলো উঁচু হলেও মাঠটা নীচু। বৃষ্টি হলেই মাঠ জলে থৈ থৈ... পেছনে একটা পুকুর। শ্যাওলা ঢাকা ...।।
‘অক্ষর ( কোনো ছবি নেই, কালো পর্দায় শাদা অক্ষরের আবহে ঘোষকের কন্ঠ ...)নিজস্ব স্কুল বাড়ি হয়নি এখনো, ভিকম্চান্দ নামক মহিলা হাই-ইস্কুলে সকাল ছ’টা থেকে দশ’টা ইস্কুল হয়, আপাততঃ’
‘পালিত হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী, ২৩ শে জানুয়ারী, শহীদ ক্ষুদিরাম দিবস, বিশ্ব বাংলা ভাষা দিবস ইত্যাদি’
‘ সব বিষয়ই পড়ানো হয় বাংলায়, ইংরেজি আছে সাব্জেক্ট্ হিসেবে’
‘এই ইস্কুলটি একজন মহিলার একক প্রয়াস’
‘সবচেয়ে কম ফী’ নেওয়া হয় এই ইস্কুলে...’
‘ঐ দেখো ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা... ঐ দেখো তারা নাটক করছে .... ‘শারোদৎসব’, ঐ দেখো তারা কবিতা বলছে ‘ব্রাহ্মণ’, ‘শেষ শিক্ষা’, ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ ... এই যে তাদের পরিচয়লিপি, দেখো, ভেসে উঠছে পর্দ্দায়ঃ
কৃপাসিন্ধুঃ কালো। রোগা। সামনের দিকের দুটো দাঁত উঁচু। চুল কদমছাঁট। বাবার কাঠের জিনিস বানানোর দোকান। ইস্কুলের গলীর মোড়েই। ‘দিদিমণি আপনার হাতে ছেলেটাকে দিলাম ... একটু ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিন যাতে মানুষ হয় ... আমরা’ত লেখাপড়া করতে পারিনি ... তাই যতো কষ্ট করেই হোক্ ছেলেটাকে পড়াবো ...’ বলে প্রধান শিক্ষিকার কাছে ছেলেকে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ...
( কৃপাসিন্ধু আজ কোথায়? কৃপাসিন্ধুরা আজ কোথায়? কতোদূর লেখাপড়া হলো ওর? ওর বাবার দোকানটাও উঠে গেছে অনেকদিন ...)
সুজিতঃ ফর্সা। রোগা। দুরন্ত। ইস্টিশান রোডে বাবার দোকান। প্লাস্টিকের খেলনার। সুজিতের মা নেই। ইস্কুলে ওর বন্ধু বলতে বড় দিদিমণির ছেলে অনিমেষ। ওর বাবা এসে মাঝে মাঝে নালিশ দিয়ে যান বড় দিদিমণির কাছে। নালিশ দিতে দিতে কখনো নিজেই কেঁদে ফেলেন মানুষটি ... ‘ ঘরে দেখবার কেউ থাকলে এমনটা হতোনা দিদিমনি ... আমার ত দিন যায় দোকান সামলাতে সামলাতেই ...’
অবিনাশঃ বাবা কলেজে পড়ান। মা’ও পড়াতেন কলেজে। তবে অন্যত্র। বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন এখানে। ভাব ভালোবাসার বিয়ে। মা’র সহকর্মিনীরা মা’কে বল্লো হবু বরকে দেখতে চায়। বাবাকে যেতে হলো জোড়হাট। মা’র সহকর্মিনীরা তখন হবু বরকে বল্লেন ‘কি উপহার চাও বিয়েতে?’ – তা ব’লে যা’তা চাইলে চলবে না। হয় প্রেস্টীজ প্রেসার কুকার নয় বিভূতি রচনাবলী। দুটোই তখন সদ্য এসেছে আসামে ... বাবা রায় দিলো বিভূতি রচনাবলী’র পক্ষেই ..অনিমেষ ইস্কুলের সব চেয়ে দুরন্ত ছেলে। অমনোযোগি। ছবি আঁকে। ইস্কুলের বিরাট পাঁচিলের ফোকর গলে ইস্কুল পালায় ...
অন্বয়ঃ অবিনাশের ছোটো ভাই। তুলনামূলক ভাবে শান্ত। পড়ার থেকে খেলায় বেশী মন। ইনোভেটিভ্। ‘চিড়িয়াখানা’ শব্দ দিয়ে দিদিমনি বাক্য লিখিয়ে দিয়েছিলেন ‘চিড়িয়াখানায় পশুরা থাকে’, বাড়িতে বাবা বলেছিলেন দিদিমনি’র বাক্যের গঠনে নূতন বাক্য লিখতে। তাই, হাফ্ ইয়ার্লি পরীক্ষার খাতায় সে লিখেছিলঃ ‘চিড়িয়াখানায় অন্বয় থাকে...’
শাশ্বতীঃ ‘সুবোধ’ এই শব্দটির সংজ্ঞা হয়তো এই মেয়েটিকে দেখেই লিখিত হয়েছিল। কখনো। এমনই সুবোধ এই বালিকা যে সে লক্ষী দিদিমণির’ও পছন্দের ছাত্রী। গায়ের রঙ কালো। চোখের দৃষ্টি গভীর। তার বাবা ছবি আঁকেন। ছবি বলতে ক্যালেন্ডার দেখে ভালো নকল তৈরী করতে পারেন। কাজ করেন কি একটা সরকারী অফিসে। ইস্কুলে পার হয়ে লেভেল ক্রশিং। ক্রশিঙের ওপারেই শাশ্বতীদের দোতলা বাড়ি। সামনে ছোটো বাগান।
শাশ্বতী’র বাবার স্কুটার আছে।
সন্দীপঃ এরা জৈন। রাজস্থানের মানুষ। তবে তিন পুরুষের ব্যবসা এখানে। সন্দীপের বাবা সন্তোষ জৈন না মার্কস্ না বিবেকানন্দের দীক্ষিত। কিন্তু মানুষটি জানে, যে, ব্যক্তির উন্নতি আর সমষ্টির উন্নতি পরস্পরের পরিপূরক। অতএব যে সব কাজ ভদ্রলোকের সমষ্টির উন্নতি ঘটাবে বলে মনেহয় ভদ্রলোকের তাতেই তিনি এগিয়ে যান। বড় দিদিমনি’কে ডাকেন ‘দিদি’ বলে। সন্দীপ চঞ্চল। কিন্তু মুখচোরা।
ভাওনাঃ সন্দীপের দিদি। রাজস্থানের মরুভূমির পান্থপাদপের সঙ্গে আসামের বিস্রস্ত নীলিমায় গড়া মুখ, চোখ ... পরে ইউনিভার্সিটিতে কয়েকবারই গোল্ড মেডেল পেয়েছিল ...
হীরালালঃ হীরালাল শর্ম্মা। বাবা মারা গেছেন যখন সে একে বারেই শিশু। বাবার পেন্সনে দিন চালান মা। ফর্সা। রোগা। চঞ্চল। সুন্দর ছবি আঁকে...
( ... এখন কি করে হীরালাল? চাকরী? কন্ট্রাক্টারি? আদৌ করে কি কিছু? ...)
আরো মুখ, আরো ছবি, আরো পরিচয় লিপি ভেসে উঠবার আগেই খুকি’র দ্বিতীয় নাচও শেষ হয়ে যায়। এখন মঞ্চে ডাকা হয়েছে চার জোড়া পেরেন্ট্স্’কে। সাহসী চার জোড়া পেরেন্ট্স্ উঠেও গেছেন মঞ্চে। খোকার স্বভাবতঃই ইচ্ছা ছিল তার বাবাও যাক। কিন্তু অবিনাশ ততোটা সাহস করতে পারেনি। ছেলেকে বলেছে ‘খিদে পেয়েছে, কিছু খাবি?’ ‘কি খাবো? কোথায়?’ ‘ঐ’যে বাইরের দোকানে...’ ‘কি পাওয়া যায় ওখানে?’ ‘চল্ না গিয়ে দেখি ...’ ... খিদে সত্যি পেয়েছিল অনিমেষের। নিশ্চয় খোকারো পেয়েছে। খুকিরো। কিন্তু খুকি এখন ইস্কুলের সম্পত্তি। অন্ততঃ আরো একটা নাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। যদিও শাশুড়ি দিয়ে দিয়েছেন খুকির টিফিন তবু এখন খাওয়ানো যাবেনা ...
সামনের ছোটো রাস্তাটি পার হয় তারা। পার হতে হতে কানে আসে মাইকের দ্বারা প্রচারিত শব্দাবলীঃ... এই খেলার নিয়ম হচ্ছে প্রতিজন পুরুষকে দেওয়া হবে এক একটি প্রশ্নপত্র। এতে প্রশ্ন থাকতে তাঁর স্ত্রীর ভালোলাগা মন্দলাগা বিষয়ে। মহিলাদেরো দেওয়া হবে প্রশ্নপত্র। জানতে চাওয়া হবে তাঁদের স্বামীদের ভালোলাগা মন্দলাগা বিষয়ে। এরপরে মিলিয়ে দেখা হবে ঐগুলি। ... আজ যে আটজন পেরেন্ট্স্ এই খেলায় জয়েন করেছেন তাঁরা হচ্ছেন ...’
খোকা বলেঃ ‘পাপা, এরকম কি একটা টিভিতে কোন্ চ্যানেলে যেন দেখেছিলাম...”
অবিনাশ হাসে। বলেঃঠিক...
দোকানটিতে খাবার বলতে বিস্কুট আর কেক্। খোলা কেক্ না নিয়ে এক প্যাকেট্ ফ্রুট্ কেক নিলো অবিনাশ। নিয়ে আবার হাসলো নিজের মনেই। ‘ব্রেন্ডেড্ এডুকেশান... ব্রেন্ডেড্ কেইক’ ... খোকা বল্লো ‘পাপা, হাসছিস্ কেন? ...’ অবিনাশ বল্লো ‘ঠিক ...’ খোকা বল্লো ‘ ওরা কিন্তু আবোল তাবোলের গানও করতেই পারতো ...’ অবিনাশ বল্লোঃ ঠিক ... এবারে রেগে গেলো খোকাঃ কি খালি সব কথায় ‘ঠিক’, ‘ঠিক’ বলছিস্? পুগি’ত ‘পেঁচাকয় পেঁচানী’ নেচে নেচে গায় ... রঞ্জনাআন্টি’কে বললে ও এটাই এখানে করে দেখাতে পারতো...’ এবারো অবিনাশের মুখ দিয়ে ‘ঠিক’ কথাটা ছিট্কে আসছিল বেড়িয়ে। কিন্তু অব্যবহিত পূর্বে খোকার ধমকের সম্মানে এবারে সে আর ‘ঠিক’ বলেনা। বলেঃ হুঁ, আগে বললে তোর মা রঞ্জনা’কে বলে দিতে পারতো ...’
মাল্যশ্রী আজ আসতে পারেনি এই ফাংশনে। আজ তাদের ইস্কুলেও কি একটা ব্যাপার যেন। চাইলেও আজ ছুটি নেওয়া যাবেনা। অবিনাশের অফিস, যেহেতু কর্পোরেট, যেহেতু মাল্টিনেশনেল, ফলে শনি রবি ছুটি। আজ যদি শনিবার না হতো ছুটি নিতে হতো অনিনাশকে। ছুটি নিতে ভালোই লাগে অবিনাশের। গোটা তিন নামী দামী মাল্টি নেশনেলে কাজ করা সত্ত্বেও অফিস আর চাকরি এই দুটো জিনিসকেই তেমন সিরিয়াসভাবে নিতে পারেনি অবিনাশ। মাল্যশ্রী, যেহেতু সে অন্য সব বিষয়েই সিরিয়াস, তাই চাকরীটাও তার কাছে বেশ কিছুটা গুরুত্ব পায়। গুরুত্ব পায় মেয়েকে সময় দিতে না পারার দুঃখবোধও। অবিনাশ প্রথমটা উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু ক্রমে ভাঁটা পরছে এখন। ‘জিউস্ ইন্টারনেশনেল’ থেকে যখন তৃতীয়বার ডাক আসে তখন অবিনাশের মা’বাবা এসেছেন বেঙ্গালোরে। যেমন আসেন প্রতি বছর। নাতি-নাতনীর টানে। ডাক আসা মাত্র মা বল্লেনঃ না, ও যাক চাকরি’তে ... আমরা পুগি’কে দেখবো ... আবার কিছুদিন পরে’ত মালা’র মা’বাবাও আসছেন ... এতো পড়াশোনা করে, ডিগ্রী নিয়ে ঘরে বসে থেকে কি লাভ?’ – ঠিক। অবিনাশও ভাবে। আবার ভাবে শিক্ষা আর ডিগ্রীর কি একমাত্র প্রয়োগ ঐ চালকলা বাঁধা বিদ্যে? মনেপড়ে সর্বজয়া, মনেপড়ে হরিহর, মনেপড়ে অপু ... সর্বজয়া চাইত বাপের যজমানি’তেই ক্রমে থিতু হোক্ অপু ... কিন্তু হরিহর ... হরিহর যে কি চাইতো তা হরিহর নিজেই হয়তো জানতো না তবে এ টুকু জানতো সে ছেলেকে যজমানি ব্রাহ্মণ হতে দিতে চায়না ... কিন্তু অবিনাশও কি শেষ বিচারে ঐ চালকলা বাঁধা’র দরকারেই বিদ্যাকে প্রয়োগ করেনি? সে একটি পুরুষ মানুষ, এই চালকলা বাঁধার বিদ্যাকে সে কোনোদিনই দেখেনি ভালো চোখে ... তথাপি তাকেও জুতে যেয়ে হলো এই হালে ... সেখানে মাল্যশ্রী’ত একটি মেয়ে ... চাকরী ইত্যাদি নিয়ে ততোটা তলিয়ে ভাবেওনি কোনোদিন ... সে যদি মনেকরে ঐ চাকরিতেই তার বিদ্যার প্রকৃত ব্যবহার তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি? ...
সকালে উঠে নিজে রেডি হয় মাল্যশ্রী। ছেলেকে রেডি করে। অবিনাশের জলখাবার, অফিসে নিয়ে যাওয়ার টিফিন করে রেখে সে ছোটে, ছেলেকে নিয়ে, স্কুলবাস ধরতে ... হ্যাঁ, এটাও আরেকটা ব্যাপার, ঐ ইস্কুলেই’ত পড়ে খোকা। ফলে মাল্যশ্রীর চাকরিটার একটা অন্য মানেও রয়েযায় ... সকালে, মা’র সঙ্গে ইস্কুলে যাওয়া, এ’ওতো অবিনাশের নস্টালজিয়ার একটি অঙ্গই ... মাল্যশ্রী’র মা’ও ছিলেন ইস্কুল মাষ্টার ফলে সে’ও ক্লাস ফাইভ থেকে টেন্ ইস্কুলে গেছে মা’র সঙ্গেই। ফলে ঐ দৃশ্যের পুনরাভিনয়ের কোথাও যেন রয়েযায় এক পরাবাস্তবতা ...তথাপি খুকি প্রতিরাতে মা’কে বলে ‘কাল তুমি ইস্কুলে যাবেনা, তাইনা?” – “না সোনা, যাবোনা...” বলে ঘুম পাড়ানো হয় তাকে ... এখানে এসে সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় অবিনাশের। বিদ্যার প্রকৃত ব্যবহার, আমেরিকান ছাঁদে গৃহবধূদের নূতন সংজ্ঞা ‘হোম্ মেকার’, তার নিজের জীপন যাপন, কবিতা লেখার স্পৃহা’কে ঘিরে তার অন্তঃকরনের সাধ আহ্লাদ ... এমনিতেই অবিনাশের ঘুম আসেনা এতো তাড়াতাড়ি। সবাই ঘুমালে সে উঠে আসে। এসে দাঁড়ায় সামনের ব্যালকনীতে ... অধুনা এগারোশো স্কোয়ার ফুটের এই ফ্ল্যাটটির মালিক সে। তার ‘বিদ্যা’র সঠিক ‘ব্যবহারে’র মূল্যে।
তিন তলায় এই ফ্ল্যাট্। সেখান থেকে দেখা যায় নিঝ্ঝুম রাস্তা। দেখাযায় নানান উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো কুকুরেরা ... ভেসে আসে তাদের কোলাহল ... দেখাযায় রাস্তার অন্য পারে, সাইবার কাফে’র বারান্দায় ঘুমানোর চেষ্টা নেওয়া তিনটি মানুষ ... সম্ভবতঃ মা-বাবা আর ছেলে। গত তিন চার মাস ধরে এ’ই তাদের রাতের আস্তানা ... দিনের বেলা পুরুষ দুইজন থাকেনা ... মহিলাটি ভিক্ষা করে কেভি সান্দ্রা বাস স্টেন্ডের সামনে ... রাতের দিকে ফিরে আসে পুরুষ দুইজন ... এখন এরা ঘুমে নয়। একজন বসে আছে। বোঝাযায়। আরেকজন মাটিতে আধশোয়া হয়ে কিছু বলছে ... ওদেরকে দেখতে দেখতে সিগারেট জ্বালায় অনিমেষ... ভাবে হয়তো এ’ই তার নিয়তি ... এখানে, এই ব্যালকনীতে এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশ পাতাল কথা ভাবা আর সকাল হতেই সমস্ত ভাবনাকে জলাঞ্জলী দিয়ে অফিসের পথে ছুট লাগানো ... এর থেকে কারোরি মুক্তি নেই ... সবই যেন পূর্ব নির্ধারিত ... যদিও সোডিয়াম আলোতে আকাশের অবয়ব ধর্ষিত তথাপি একটি দু’টি তারা এখনো দেখা যায় ... দূরে, কেন্টন্মেন্ট্ স্টেশন থেকে ভেসে আসে রেল গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ ... অবিনাশের মনেপড়ে অনেক কাল আগে পড়া একটি কবিতার কিছু পংক্তিঃ
Surely, if the stars are lit
There is somebody who longs for them,
Somebody who wants them to shine a bit ...
অবিনাশের মনে হয় কে’সে যার চাওয়ার মূল্যে এই তারাগুলি জ্বলমান? সে’কি অবিনাশ চক্রবর্তী না’কি ফুটপাথের ঐ রাতজাগা মানুষগুলি? মনেহয় সবই যদি পূর্ব নির্ধারিত তবে ফুটপাথের ঐ রাতজাগা মানুষগুলি ... এই মুহুর্তে সংখ্যাতীত ফুটপাথে রাত জাগা এমন সংখ্যাতীত নারী-পুরুষ-শিশু তাদেরো কি এ’ই নিয়তি? নির্ধারিত? পাপীর নিয়তি পাপ? ধর্ষিতা’র নিয়তি ধর্ষিত হওয়া? ... আর সমগ্র মানব জাতির নিয়তি, এই ভাবে পুড়ে যাওয়া? মুক্তি বলতে পুড়ে যেতে যেতে জীবাত্মা’র সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের স্বপ্ন দেখা?? তাহলে রঞ্জনা মিত্র, অবিনাশ চক্রবর্তী, মিস্টার এন্ড্ মিসেস্ জেরী, ঐ রুক্ষ লাল চুলের বাচ্চারা কারোরি কিছু নেই করণীয়? সকলি সারথী-কৃষ্ণ করে রেখেছেন বহু আগে থেকে? সকলেই তাঁর মুখ বিবরে প্রবিষ্ট হচ্ছে... নির্গত হচ্ছে আবার? কোথায় সেই অর্জুন যে সারথী-কৃষ্ণ’র কথা মতোই কুরু বংশকে ধ্বংস করে মুক্ত করবে এদের? না’কি রঞ্জনা মিত্র, অবিনাশ চক্রবর্তী, মিস্টার এন্ড্ মিসেস্ জেরী, ঐ রুক্ষ লাল চুলের বাচ্চারা সকলেই কৌরব পক্ষীয়? ... রাস্তা পার হয়ে দৌড় দিতে যায় খোকা। অবিনাশের সম্বিৎ ফেরে যেন। ‘এই দেখে ... দেখে ... রাস্তার দু দিক দেখে ...’ ছোট্ট গলীর মতো হলেও হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পরে, গোঁ গোঁ শব্দে মারাত্মক মোটর বাইক কিংবা ব্রেইকের কথা ভুলে যাওয়া অটোরিক্সা ...
এদিক ওদিক দেখে নিয়ে আস্তে হলেও দৌড়ও দেয় খোকা। পার হয়ে যায় রাস্তা। এবার গীর্জার গেইটের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ বুঝতে পারে খোকা’র আচমকা দৌড়ের হেতুটি। কল্লোল ডাকছে তাকে। কল্লোল রঞ্জনা মিত্র’র ছেলে। খোকার চেয়ে বছর দুই’এর বড় হলেও খোকার সঙ্গে খুব ভাব। কল্লোল পড়ে সিক্সে। কোন্ আরেক ইন্টারনেশনেলে। আচ্ছা, এই কল্লোল কি পড়েছে তার মা’র ইস্কুলে কোনো দিনই? রঞ্জনা মিত্র’র মেয়েটি ঠিক খুকিরি বয়সী। সে আপাততঃ রঞ্জনা মিত্র’র ইস্কুলেরি ছাত্রী। তবে সামনের বছর থেকে তার জন্যও নির্ধারিত হয়ে গেছে একটি ইন্টারনেশনেল। ‘ মালা, ইউ কুড্ টেক্ ইয়োর ডিসিশান ফ্রম নেক্সট্ ইয়ার এবাউট পুগি ... আসলে কি জানো মা’র ইস্কুলে হ’লে বাচ্চারা স্কুলটাকে ঠিক স্কুলের মতো নেয়না ... দ্যাট্স্ হোয়াই আমি ঋতা’কে অন্য স্কুলে দিয়ে দিচ্ছি ...’ ঋতা’র জন্মদিনের পার্টি হচ্ছিল রঞ্জনা মিত্র’র বাড়িতে। সেখানেই প্রসঙ্গটা তুলেছিল রঞ্জনা মিত্র। ইতিমধ্যে দুই পেগ্ মতো হুইস্কী চালান হয়ে গিয়েছে অবিনাশের পেটে। ঐ হালকা নেশার ঘোরেও রঞ্জনা মিত্র’কে তারিফ করেছে সে। করতে বাধ্য হয়েছে। উফ্ কি সাট্লিটি। এ একদিন চ্যালেঞ্জ করবেই জিউস্ হেন আরো বহু ইন্টারনেশনেল্’কে ...
পার্টিতে আরো দুই পেগ্ হুইস্কী পেটে চালান করেছিল অবিনাশ। তারপর রাত্রে বসে বসে এই কথা গুলি লিখে রেখেছিল সেঃআজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সে যদি এক ভয়ংকর খাদ হয় তবে প্রশ্ন জাগে, মনে, মাঝে মাঝেই, যে, ঠিক কি করে এখানে এলাম? আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সে যদি এক ভয়ংকর খাদ হয়, তবে আমার মর্মে তার সংজ্ঞার সূত্রগুলি এই, যে, প্রথমতঃ যে দুশ্চিন্তা আমাকে তাড়িত করে, তা হলো আমার পুত্র কন্যা বেড়ে উঠছে এমন এক অঞ্চলে যেখানে বেড়ে উঠলে তারা বাঙ্গালী হয়ে উঠবেনা, প্রকৃত অর্থে, কোনোদিন। বাংলা ভাষা শিখেছে আমার ছেলে। হয়তো মেয়েও শিখবে, কিন্তু সে হবে কলকাতায় বসে ফরাসী শেখার মতোই। ওতে কেউ বাঙ্গালী হয়না। আমার স্ত্রী আমার এই বিরাট ভয়, হতাশা ঠিক কতোটা অন্তরঙ্গ ভাবে অনুভব করে আমি জানিনা। এতে হতাশা আরো বেড়ে যায় ... বাংলা ভাষা শিক্ষা, বাঙ্গালী হয়ে ওঠা এ গুলো আমার অব্সেশনের মতো। ঠিক যেমন অব্সেশন কোনো ছোট্টো মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা – সেই শহরের নদী, মাঠ, গাছপালা, পোড়োবাড়ি গুলিকে ভালবেসে – একদা, প্রেম পর্বে, সেই বয়সের ম্যাচিওরিটিতে যতোটা সম্ভব, চিঠি লিখে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম হবু বৌ’কে। কিন্তু এতাবৎ জীবনের সমস্ত চরাই-উৎরাই পেরিয়ে সে’ই চিঠি গুলির, গুলির ছায়া কতোটা বাস্তব হয়েছে আজকের এই যাপনে? আদৌ হয়েছে কি?
দ্বিতীয়তঃ, এখানে আমার ভালো, শুভানুধ্যায়ী বন্ধু দু’চার জন থাকলেও এরা মূলতঃ অন্য জগতের মানুষ। এরা অফিসের কাজ, প্রোমোশান ইত্যাদি নিয়ে বাস্তবিকই চিন্তিত হতে জানে। আমি যদি জানতাম ঐ প্রক্রিয়াটা তাহলে হয়তো ভালোই ছিল কিন্তু আমি নিজে ঐ জগতের মানুষ না হওয়ার জন্য, আমি অন্ততঃ, নিজমনে, জীবনের কাছে, জীবন দেবতার কাছে কৃতজ্ঞ। আসলে এই যে চাকরি, বেতন, বেঙ্গালোর – যাকে আমি বলি যাপন, সেটা আমার কাছে এখনো ততোটা বাস্তব হয়ে উঠলোনা যতোটা বাস্তব বই’এর অপু, ডিমিট্রি কার্মাজভ্ বা আনা কারেনিনা... ফলে একটা বই পড়ে বা সিনেমা দেখে তা নিয়ে শুধুই ফোনে আলোচনা, দূরে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে, তা আর কতো দূর অক্সিজেন পারে জোগাতে? বা একটি কবিতা লিখে, উত্তেজিত হয়ে শুধুমাত্র ফোনে বা বড়জোর ইন্টারনেটে তা প্রিয় মানুষদের সঙ্গে শেয়ার করা এ’ই বা কতোদূর তৃপ্তি দিতে পারে? এই ফোনে আলোচনা বা ফোনে লেখা পড়ে শোনানো, জোনাকের ভাষায়, নল লাগিয়ে অক্সিজেন নেওয়া ... আর তার ঐ কথার সূত্র ধরেই বলতে হয়, যে, নল লাগিয়ে অক্সিজেন নিয়ে যারা বেঁচে থাকে তারা কি সুস্থ ? ... আমি টেরপাই আমি অসুস্থ। মানসিক অবসাদ জমে জমে শারীরিক অসুখ... রক্তচাপ ইত্যাদি ... আর মাঝে মাঝে ফেটেপরা, অনিচ্ছায়, অজান্তে, বাড়িতে, আগ্নেয়গিরির মতো ...
এখানে এসে এ’ও প্রশ্ন জাগে, যে, কে চালায় এ জীবন? আমি না নিয়তি? না’কি ‘যথা হি একেন চক্রেন ন রথস্য গতির্ভবেৎ এবং পুরুষকার বীনা দৈবয়ং ন সিদ্ধয়তি’? আচ্ছা, যদি কম বয়সে মদ-গাঁজা খেতে না শিখতাম, যদি বারো ক্লাশের পরীক্ষায় পদার্থ বিদ্যায় ৭৭ না পেয়ে ৮৭ পেতাম তবে প্রেসিডেন্সি তে চান্সটা পেয়ে যেতাম বা অন্ততঃ যদি ইঞ্জিনীয়ারিং এ’র পাঠটা নিতাম ভালো ফল করার মতন করে তাহলে কি হতো? আজ যে আমার স্ত্রী সে’ই কী হতো আমার স্ত্রী, আজ যারা আমার পুত্র কন্যা তারা কি হতো আমার পুত্র কন্যা? যদি বলি নিয়তিই একমাত্র সত্য তাহলে হয়তো হতো আর যদি কার্য্য কারন সম্পর্কই হয় আমাদের চালিকা শক্তি অথবা আকস্মিকতা অথবা chaos তাহলে হতোনা। আমি হয়তো হতাম অন্য একজন মানুষ। লেখালেখি হয়তো করতাম কেননা না লিখে আমি বাঁচতে পারিনা সেই ক্লাশ ফাইভ্ সিক্স্ থেকেই। কিন্তু কি লিখতাম দশপদী না’কি Suitable Boy ... জানিনা ...... লিখতে লিখতে নিজের সংগ্রহ থেকে আরো পেগ দুই হুইস্কী চালান করে দিয়েছিল পেটে। ফলে ভাবনার খেই গিয়েছিল হারিয়ে। কলমও চলেনি আর। আজ, এখানে দাঁড়িয়ে যেন ঐ লেখাটার কাছে আবার যেতে চাইলো অবিনাশ ... ইচ্ছা হলো কাগজে কলমে লিখে রাখতে এই কথাগুলিঃ ... আমাদের দুই ভাইকে পাঠানো হয়েছিল ‘প্রান্তিক’ নামের এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ... কেননা ঐ স্কুলে বাবার কলেজের অধ্যাপক মাণিক বাবু’র ছেলেরা যায়, যায় হোমরা চোমরা বিনয় বাবুর দুই ছেলে ... অতএব আমাদেরো নিয়তি যে হবে ঐ স্কুল তাতে আর বিচিত্র কি? ইস্কুলের রিক্সা ভ্যানে করে যেতাম। প্রায়ই সেই যাওয়া হতো কাঁদতে কাঁদতে। ফিরতামও ঐ রিক্সা ভ্যানে। আমাদের পাড়ার আর কোনো বাচ্চা ঐ ইস্কুলে যেতোনা। ফলে অনেকটা পথ একা একা আসতে হতো ভ্যানে। ঐ একা আসার প্রতিটি মুহূর্ত্ত ছিল ভয়ের। যদি ড্রাইভার কাকু আজ বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে নিয়ে চলে যায় অন্য কোথাও ... যদি বিক্রি করে দেয় ... অবশেষে পাড়ার মোড়ের মসজিদ আর তার লাগোয়া কবরখানাটা দেখা মাত্র বুকে বয়ে যেতো এক আনন্দের শিহরণ! আহ্! বাড়ি আর দূরে নয় ... আহ্! ‘হোম্ সুইট্ হোম্’ ...
প্রতি সন্ধ্যায় ইস্কুলের খাতা গুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দেখতো মা। কি’যে দেখতো স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতাম না তখন। তবে মাঝে মাঝে ডাক পড়তো আমারো ...
‘লিট্ল্’ বানান এ ক’টা ‘টি’?’
‘দু’টো’
‘খাতায় তাহলে তিনটে লিখেছো কেন?’
কিংবা ‘নাইনের সঙ্গে সেভেন প্লাস্ করলে কতো হয়?’ ... আঙ্গুলে গুনে টুনে, অবশেষে বলি ‘সিক্সটিন্’ ... ‘ কিন্তু খাতায় ত লিখেছ ফিফ্টিন্ ... এই ম্যাথ্ গুলো রাফ্ খাতায় আবার করো বসে বসে ’ ... রাগ হতো। ভাবতাম ‘মিস্’ দেখে ‘কারেক্ট্’ দিয়ে দিয়েছে ... তা আবার দেখা কেন? অনিচ্ছা নিয়ে খুলে বসতাম বই খাতা ...
একদিন রীতিমতো ভীত হয়ে গেলাম মা যখন বল্লো ‘ কাল ইংলিশ্ আর ম্যাথ্ খাতা স্কুলে নিয়ে যেতে হবেনা ...’ ‘আরে মিস্ বক্বে যে ...’ ‘ আমি দুটো নতুন খাতা এনেছি তোমার জন্য, পুরোনো গুলো আমার কাছে থাক্...’ নতুন খাতা পাওয়ার আহ্লাদে মা কেন রেখেদিলো পুরোনো খাতাগুলো এই প্রশ্ন চাপা পরেগেলো ...
ইস্কুলের সামনের দিকটা গোল মতন। গেট্ খুলে ঢুকেই দুটো বড় বড় গাছ । এতে যে ফুল ফোটে তা দিয়ে লাটিম বানায় বাচ্চারা। আমাদের ক্লাস বসে এক তলায়। ইস্কুলের ফটক দিয়ে কেউ ঢুকলে দেখা যায়না তবে বারান্দায় উঠে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোঠার দিকে গেলে দেখাযায়। হঠাৎ দেখি মা! বারান্দা পার হয়ে চলেছে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোঠার দিকে! এক দৌড়ে ক্লাসঘর ছেড়ে সোজা মার কাছে। পেছনে পেছনে ‘মিস্’। মা বল্লো ‘আজ আর ভ্যানে যেতে হবে না, আমি বসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো ... এখন ক্লাশে যাও ... আমি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে আসি ...’ অগত্যা ফিরতে হলো ক্লাশ ঘরে। কিন্তু মন পড়ে রইলো কখন মা’র কথা শেষ হবে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে আর কখন মা’র সঙ্গে রিক্সায় চাপবো ...
একটু পরেই ক্লাশের দরজায় দেখা গেলো মেট্রন মাসীকে। এ’ও শুভলক্ষণ। মা’বাবা এসে বাচ্চাকে নিতে চাইলে ক্লাশ ঘরে এসে সে খবর জানিয়ে যাওয়ার কাজ মেট্রন মাসীর। নিশ্চয় মা ডাকছে !! হায়, কিন্তু মেট্রন মাসী এসে বল্লো প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ডাকছেন ক্লাসের ‘মিস্’ কে। মিসের ভ্রূ তখন কুঁচকে ছিল কি’না মনে নেই তবে মিনিট দশেক পরে যখন ফিরে এসেছিলেন তখনকার তাঁর জ্বলন্ত দৃষ্টি, বিশেষতঃ আমার দিকে, আমার চোখে ভাসে এখনো ...’অবিনাশ ইয়োর্ মম্ ইজ কলিং ইউ ...’ বই খাতা বাক্সে ভরে এক দৌড়ে চলে এলাম মা’র কাছে। রিক্সা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক গল্প হলো ... মা’কে প্রশ্ন করলাম ‘আজ ইস্কুলে এলে কেন?’ মা বল্লো ‘এইতো, তোকে নিয়ে যেতে ...’
পরদিন থেকে ক্লাশে মিসের ব্যবহারে দেখা গেলো বিশেষ পরিবর্তন। আগে যে সমস্ত অপরাধে ক্ষমা পেয়েছি অনায়াসে, যে সব অপরাধের জন্য জয়ন্ত, নবল কশোর সিং, মনোজ, সোনালী কেউ’ই পায়না শাস্তি, সে সবের জন্যও শাস্তি জুটতে লাগলো আমার। তা’য় বাড়ি যাওয়ার আগে, প্রতিদিন, সমস্ত খাতা প্রিন্সিপাল মিস্’কে দেখিয়ে যাওয়ার নিয়ম হলো আমার জন্য ... হ্যাঁ, সেই আরম্ভ, সে’ই মা’র মাথায় ঢুকলো একটা ইস্কুল করার চিন্তা যেখানে এভাবে তিনটে ‘টি’র ‘লিটিল্’ বানানে ‘কারেক্ট্’ দেওয়া হবেনা, যেখানে প্রতিমাসে বেতন বাড়বে না, যেখানে বাংলা ভাষায় পড়ানো হবে বাচ্চা দেরকে ...
তখনি প্রথম দেখি অরুনিমা মাসী আর ঝর্ণা মাসীকে। আমাদের বাড়িতে। এঁদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যেতো মা। কখনো ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো সন্ধ্যা। কোনো কোনোদিন বাবাকে দেখেছি রাগে ফেটে পড়তে। কোনো কোনোদিন মা উত্তর করেনি। কোনো কোনো দিন করেছে। বহুদিন ঘটনা গড়িয়েছে কেঁদে কেটে না খেয়েই মা’র ঘুমিয়ে পরা অবধি। আমরা দুই ভাই বাবার তত্ত্বাবধানে ভয়ে ভয়ে খেয়ে দেয়ে উঠে পড়েছি বিছানায় ... কোনো কোনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছি আবার কী সব কথা বার্তা চলছে মা আর বাবায় ... কথা বার্তার মাঝখান থেকে ‘ইস্কুল’ শব্দটি ছিট্কে লেগেছে কানে ...
কোনো কোনো দিন আমাদের রেখে যাওয়া যেতোনা। বায়না করতাম। তাই আমাদেরো সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে যেতো মা। এরকমই একদিন গিয়েছিলাম সন্তোষ জৈন’দের বাড়িতে। মনে আছে ‘দিদি’ ‘দিদি’ বলে মা’র সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রলোক। আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে ... একদিন গিয়েছিলাম মিলনশশী নামের এক রাগী বৃদ্ধার বাড়িতে। ইনি আমাদের এখানের একটি নামী মেয়ে ইস্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন ... মা’কে প্রশ্ন করেছিলাম ‘আমরা এদের বাড়িতে যাই কেন?’ মা বলেছিল ‘তোমাদের জন্য একটা নতুন ইস্কুল, নতুন রকমের ইস্কুল হচ্ছে ... তা’ই ...’ কথাটা ভালো করে না বুঝলেও ঐ ভ্যানে চড়ে ঐ ইস্কুলটিতে আর যেতে হবেনা এমন একটা সম্ভাবনায় আমি আর ভাই দুজনেই আনন্দিত হয়েছিলাম যার পরনাই ... জল্পনা কল্পনাও চলেছিল অনেক ...
একদিন মা বল্লো ‘কাল থেকে আর ইস্কুলে যেতে হবেনা’ ... আহা, এমন আনন্দ সংবাদ!! শুনে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মা বল্লো ‘দু সপ্তাহ বাড়িতেই পড়াশোনা করবে তারপর যাবে নতুন ইস্কুলে ...’ ... নতুন ইস্কুল? তার মানে সেই স্কুলটি হয়ে গেছে যার জন্য মা এতো দৌড়া দৌড়ি করতো? ...সে কোথায়? কি তার নাম? মা বল্লো ‘নতুন ইস্কুলের নাম মণিমুক্তা বিদ্যামন্দির, ঐ ইস্কুলে তোমাদের ক্লাসে পড়াবেন অরুনিমা মাসী ..., আমিও থাকবো ’ সে যে ঠিক কি রকমের উত্তেজনা, কি আনন্দ ... বাড়িতে আসতে লাগলো বড় বড় রঙ্গীন কাপড়, তাতে নানা রঙ্গে লিখা ‘মণি মুক্তা বিদ্যামন্দির’ ... আসতে লাগলো প্লাস্টিকের বল, ব্যাট্ ... বাবা-মা’র রাগারাগিও যেন কমে গেলো অনেক দূর ... এবারে আরম্ভ হলো রিহার্সেল, মা বল্লো ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাটক হবে ... শেষশিক্ষা, তুমি হবে গুরু গোবিন্দ সিংহ...’
আমাদের বাড়ির কাছেই বিপিনচন্দ্র পাল হাই স্কুল। বিকাল চারটার পরে সেখানে গিয়ে হাজির হতাম মা’র সঙ্গে। আসতো অরিনিমা মাসী, ঝর্ণা মাসী, লক্ষী দিদিমনি ... আসতো সন্দীপ, ভাওনা, শাশ্বতী, কৃপাসিন্ধু ... শিবা দিদি গান গাইতো ...কে কে যেন নাচতো ‘আমায় ক্ষম্ হে ক্ষম্ নমো হে নমো ...’ ... আবার সকাল হতে অরুণিমা মাসী না হলে ঝর্ণা মাসীর সঙ্গে বেড়িয়ে পরতো মা ...’
এতোদূর লিখে থেমে ছিল অবিনাশ। ভেবেছিল ইস্কুলের উদ্বোধনের দিনটির কথা, ক্রমে ঐ চারজন-ছ’জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ঐ ইস্কুলের সমুদ্রযাত্রার কথা সবই লিখে রাখবে। লিখে রাখবে সেই সকাল বেলার কথা যেদিন হয়েছিল ইস্কুলের উদ্বোধন ...ভোর ভোর বিছানা ছেড়ে দুই ভাই উঠেছিল মা’র ডাকে ... স্নানও করে নিতে হয়েছিল সেই সকাল সকাল ... সংক্রান্তি আর সরস্বতী পূজোর দিনগুলির মতো ...তারপর সেজে গুজে রিক্সায় উঠে বসা ... মনেপড়ে সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা ... ইস্কুল পাড়ার একটু বড় ছেলেরা ...স্বপনদা, মান্নাদা ততোক্ষনে এসে ইস্কুলের সামনে আরম্ভ করে দিয়েছে প্রস্তুতি – প্রভাতফেরীর সঙ্গে সঙ্গে যাবে দুটো রিক্সা, একটা মাইক নিয়ে, তাতে বাজবে গান ... অন্যটা ইস্কুলের নাম লেখা বড় একটা ফেস্টুন নিয়ে ... উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইল শুক্লাদি ...গাইলোঃ চল্ রে চল্ সবে ভারতসন্তান...মাতৃভূমি করে আহ্বান ...’ আরম্ভ হলো পথ চলা ... আমাদের ... আরম্ভ হলো পথচলা... একটি ইচ্ছার ... কুড়ি-পঁচিশজন কাচ্চা-বাচ্চার সঙ্গে পাঁচ-ছ’জন দিদিমণি, যোগ দিয়েছেন কিছু মা-বাবা’রাও ... মেঘলা সকালের ভিতর দিয়ে মাইকে বাজছে গানের পরে গান ... রিক্সায় বসে বসে গাইছে শুক্লাদি আরো একজন কে যেন ... এই কথাগুলি হয়নি লিখে রাখা, এখনো ... ইচ্ছার তোলপাড়ে মন প্রাণ কখনো পাখি হয়ে উঠলেও অতঃপর, যথারীতি, ঘুম থেকে উঠে অফিসে ছোটা আর রাত ন’টায় বাড়ি ফেরার রুটিনে, নিয়মে, ক্লান্তিতে এগোয়না লেখা। কোনো কোনো দিন অফিসের পার্টীতে বা বাড়িতে বসে হুইস্কী’তে চুমুক দিতে দিতে কেবল ভাবাই হয় ... শেষ করতে হবে লেখাটি... এই প্রতিজ্ঞাই হয় ... অন্ততঃ ঐ ইস্কুলের কথাগুলি রাখতেই হবে লিখে ... আর কোনো কারনে যদি না’ও হয় শুধু নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য লিখে রেখে যাওয়া প্রয়োজন ঐ তথ্যগুলি, যেমন, ‘মা’ নামক ঐ মহিলার দুর্দান্ত ইচ্ছা শক্তির কথা, ঐ মহিলার এক রকম আদর্শের কথা ... তাঁর চেষ্টার কথাও ... ক্লাস থ্রী ফোরে আসাম সরকারের যে বাংলা পাঠ্যবই তা পড়ায়নি মা। ইস্কুলে। ঐ বইগুলি, যেহেতু সরকারী, ফলে সরকারের মতনই অযোগ্য লোকের লেখায় ভরা ... ছিল, থাকবে ... বহু পরে টের পেয়েছে অবিনাশ ... মা আনলো ‘কিশলয়’ নামে একটা বই ... আহ্, ঐ বইটির কবিতা, গল্প আজো মনে পড়ে অবিনাশের ... ঐ বইতেই’ত সে প্রথম পড়েছিলঃ দ্বারের কাছে এইখানে বস্ ... এই হেথা চৌকাঠ... বল্ মা আমায় কোথায় আছে তেপান্তরের মাঠ ...’ পরে, যখন স্থির হলো যে ক্লাশ ফোরের ছাত্র-ছাত্রীরা দেবে সরকারের ‘বৃত্তি’ পরীক্ষা তখন জনৈক সুরেশ চক্রবর্তীর লেখা বইটিও পড়াতে হয়েছে তবে ‘কিশলয়’ থেকে গেছে র্যাপীড্ রীডার হয়ে ... লিখে রাখতে হবে সেই উদ্বোধনের দিনে, প্রভাতফেরীর শেষে ইস্কুলে ফিরে নাটক করার কথা ... কাঠের বেঞ্চি জোড়া দিয়ে বানানো স্টেইজে ... যেখানে আরো ছোটো বাচ্চারা নাচলো আর পেছনে বসে গাইলো শুক্লাদি... গাইলোঃ কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা ... মনে মনে ...’ আর ঐ গানের রেশ ধরেই যেন প্রথমবার টের পেলো অবিনাশ যে, অন্ততঃ মনে মনে হলেও, কোথাও নেই হারিয়ে যাওয়ার কোনো মানা ... আহা, সেই প্রথম প্রভাতফেরী, সেই প্রথম মঞ্চে অভিনয় ... সেই গানশোনা ... সে নিজে লিখে না রাখলে আর কে লিখে রাখবে তার মর্ম্ম নির্ঝরের এই স্বপ্নভঙ্গের কথা ... কে লিখে রাখবে যে তার মা’র এই চেষ্টা, নিরীক্ষা হয়তো রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনহেন বিরাট নিরীক্ষা নয়, তথাপি ঐ নিরীক্ষার মূল্যে,অবিনাশ টের পায়, এই মুহুর্ত্তে যেন আরো বেশী করে টের পায়, তার সন্ততিরা ঠিক কি হারাচ্ছে ... কি হারাচ্ছে পরের প্রজন্ম ... ‘বড় শহর’, ‘বড় শহর’, ‘বড় চাকরী’র অবান্তর আস্ফালনের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে small is beautiful এর সত্য ... ঠিক যেমন development এর সংজ্ঞার আবডালে পুড়ে যাচ্ছে অরণ্য ... খালি হয়ে যাচ্ছে পাহাড় ... পরিবর্তে আদিবাসী নৃত্যের সাবলীল নগ্নতা টু-পাইস্ এনে দিচ্ছে ট্রেভেল এজেন্ট্ আর ট্রেভেলীং এজেন্সীকে ... সরকার বাহবা দিচ্ছে development এগিয়ে চলেছে জোর কদমে ...
এই প্রজন্মের কোনো শিশু যদি শৈশবেই হয়ে থাকে খুনী তবে তাকে দোষ দেওয়া যায়না ... যদি তার নিজের ছেলেমেয়েরাও তার মনের মতন না হয়, যদি তার মর্মাকাশের সামান্যতম খণ্ডটিও হারিয়ে যায় তার সন্ততির অন্তর্গত শিরা উপশিরাবাহি শোণিতের থেকে তাহলেও কি’ই বা বলতে পারে সে? অবিনাশ? দোষ কার? না’কি সত্যই কারো কোনো দোষ নেই, দায় নেই? সকলই ডুবে মরছে নিজ নিজ স্বখাত সলিলে? ... এই’যে ভিড় করে ‘ফাংশান’ দেখতে আসা মা-বাবা’রা, এখানে, এরা চায় এদের ছেলেমেয়েরাও ‘জিউস্ ইন্টারনেশনেল’এ না হোক্ কোনো ইংরেজি ইস্কুলে ত পড়ুক্ ... এদেরো কি দোষ আছে কোনো? এরা লাখ টাকা ডোনেশান দিতে পারেনা, কিন্তু হাজার দশ’তো পারে! তা’ই নিয়েই রঞ্জনা সেন’ গড়ছে ক্যাপিটাল্, হয় সে কালে ‘জিউস্ টু’ নামাবে নয়তো কোনো বড় ব্রেন্ডের কেউ এসে ‘কারেক্ট্ অফার্’ দিলে ইস্কুল বেচে দিয়ে করবে এনজিও কিংবা ‘য়োম্যান্স্ লিব্’ ... তথাপি বোম্বে’র বীচে গিয়ে ব্রেসিয়ার পুড়িয়ে ‘য়োম্যান্স্ লিব্’ দেখানোর হিম্মৎ কি এদের হবে? এই রঞ্জনা মিত্র’দের? কিংবা তার নিজের? মাল্যশ্রীর? তারা পারবে কি এই যাপনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একদিন নেমে আসতে তাদের নিজ নিজ স্বপ্নের পথে ... যেপথে সেই প্রভাতফেরীর সকালে কোনোদিন হেঁটেছিল অবিনাশ? ...হঠাৎই তার মনেপড়ে যায় সেই কবিতাটিঃ
এক জানালা রাত্রি আমার কাটল কেমন করে
বৃষ্টি থামল, সাঁকোর তলায় এই পৃথিবী ক্রোড়ে
মা জননী বসে আছেন, চোখের সামনে খালি
শহরে কাজ নিতে পালায় বলাই বনমালি ...
পরের পংক্তিগুলি মনে পড়েনা ... পরিবর্তে কবিতার আবহে কয়েকবছর আছের একটি সন্ধ্যার কথা, সেই সন্ধ্যার অন্তর্গত ভাবনাগুলির কথা মনে আসে অবিনাশের ... সন্ধ্যা তখন নামিয়াছে সম্পূর্ণ। আকাশ মিলাইয়া গিয়াছে দিগন্তে। আকাশের অধুনা অন্ধকার শরীরে বাঁশঝাড়্গুলির স্যিলুয়েট। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আবডালে কখনো বিন্দু আলোর ইঙ্গিত। এখানেও তুমুল বৃষ্টি হইয়াছে গতকাল রাত্রে। কিছু কিছু বাড়িতে বিজলীবাতির ব্যবস্থা থাকিলেও গাছপালা পরিয়া,তার ছিঁড়িয়া সমস্ত জায়গাটিই অন্ধকারের রাজত্ব। মাঠ যেখেনে শেষ সেইখানে অন্ধকার গাঢ়। ঐখানে রেল রাস্তা। শব্দ বলিতে জলের শরীরে বাতাসের মৃদুশীতল স্পর্শের। কখনো শব্দ সাপের সাঁতারের আর শব্দ তাহার আপনার চলার। এই দৃশ্যের ভিতর দিয়া একা হাঁটিতে হাঁটিতে এক সময় অবিনাশের মনে হইল যেন এই বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যা, এই মেঠোপথ, এই নির্জনতা যেন সংখ্যাতীত কাল এইখানে, এইভাবেই প্রতীক্ষমান ছিল কেবল তাহারি নিমিত্ত। আজ সে আসিয়া পরায় যেন তাহাদের দায় ফুরাইল ... যেন একটি দায় কমিল তাহারো ... জীবনের বাঁকে বাঁকে জমিয়া থাকা বিস্ময়ের দায় ...
কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল দায় কি কমিল না’কি বাড়িল ... জীবনের কাছে ... জীবনের অন্তর্গত ঐ দেবতা বা শয়তানটির কাছে যে তাহাকে, এই অবিনাশকে, গড়িয়াছে এমন অদ্ভুত করিয়া, অসম্ভব করিয়া ... মাল্যশ্রীর দাদা সুমিত থাকে বাঙ্গালোর। বড় চাকরি করে। অবিনাশকেও বহুবার বলিয়াছে চলিয়া আসিতে বোম্বাই। আশ্বাস দিয়াছে কিছু একটা হইয়া যাইবে বলিয়া। নেহাৎ মূর্খ তো নহে অবিনাশ। নির্বোধও নহে। ফলে ইহা সে নিজেও অনুভব করে, যে, বোম্বাইহেন কোনো বড় শহরে গিয়া হাজির হইতে পারিলে চাকুরী একটি জুটিয়া যাইতেই পারে। তবু এতাবৎ যাওয়া হইল না অবিনাশের। যাওয়ার নামেই কি একটা ভীতি আসিয়া চাপিয়া ধরে তাহাকে। এই শহরগুলি, শিলচর...করিমগঞ্জ... ইহাদের পথগুলি...বাড়িঘর, রাস্তাঘাটগুলি... ঝোপঝাড়গুলি ... তাহাকে যেন যাদু করিয়া রাখে ... ইহাদেরকে তাহার মনেহয় দুঃখিনী দুয়োরাণী মায়ের মতন ... মনেহয় একবার ইহাদিগকে ছাড়িয়া গেলে সে আর কোনোদিনই, কিছুতেই সে ফিরিয়া আসিতে পারিবে না এইখানে ... ইহাদের নিকটে ... ভাঙ্গা,পাঁচগ্রাম,মহিষাশন,দুধপাতিল এই ছোটো ছোটো না-শহর-না-গ্রাম গুলির ছায়াতে ... যেন বোম্বাই, কলিকাতা, দিল্লী বা বাঙ্গালোরের মতন ভিড়ের আর ব্যস্ততার শহরগুলি গিলিয়া খাইবে তাহাকে ... তাহার মনেপড়ে কবেকার পঠিত সেই গল্প, সেই ছড়া – ‘মোতির ফুল মোতির ফুল সে বড় দূর ... তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর পুর ... হাটের সওদা ঢোল-ডগরে গাছের পাতে ফল ... তিন বুড়ির রাজ্য ছেড়ে রাঙ্গা নদীর জল ...’ – সেই রাঙ্গা নদীর জলে জাহাজ ভাসাইতে ভয় পায় অবিনাশ ... মনেহয় ঢোল-ডগরে হাটের সওদা করিতে গিয়া সে’যে কোথায় যাইবে হারাইয়া ... আর পথ পাইবেনা ফিরিয়া আসিবার ... এই নদীতীরে, এই সন্ধ্যায়, এই বর্ষণে ... ইহার চেয়ে এ’ই ভালো ...মনেহয় ... এই প্রদীপ পালের পাঁউরুটির কারখানায় ডাটা এন্ট্রি ... নীলমণির দোকানে সন্ধ্যাবেলার আড্ডা ...একমাত্র সাথী শেখরদা ... পথঘাট নির্জন হইলে ধীরপায়ে বাড়িফেরা ... রাত্রির ভিতর দিয়া ... সিগারেট টানিতে টানিতে ... কথা ভাবিতে ভাবিতে... তারপর খাইয়া দাইয়া ঘুমাইয়া থাকা খোকাকে জড়াইয়া ধরিয়া ...
হয়তো ভালো। ভালোই। কিন্তু উহার বিনিময়ে মাল্যশ্রীকেও চাকুরী করিতে হয়। সামান্য বেতনের ইস্কুল মাষ্টারী। প্রাইভেট ইস্কুলে,যেখানে, কেতার মোড়কে জড়াইয়া বিক্রি হয় অশিক্ষা, কুশিক্ষা ...
রাস্তার অন্য পার থেকে ভেসে আসে খোকার উত্তেজিত স্বরঃ ‘পাপা, আয়, এবার পুগিদের ক্লাসের প্রাইজ্ ডিস্ট্রিবিউশান ...’ সিগারেট ফেলে দিয়ে, ফেলে দেওয়া সিগারেটটাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে রাস্তা পার হয় অবিনাশ। খোকা ক্যামেরাটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। ভয় পায় অবিনাশ... আবার যদি ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখা মাত্র ক্যামেরা চলেচায় ঐ রুক্ষ-লালচুল বালিকা ও শিশুগুলির দিকে ...ভীত অবিনাশ মৃদু হাসে, খোকার মাথায় হাত দিয়ে বলেঃ ‘তুই তোল্তো দেখি এটা ... দেখবো কেমন হয় ...’ খোকা মহোৎসাহে ভিডিও ক্যামেরা ঝুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় যাতে ভালো করে তার ক্যামেরায় ধরা পরে সব ...
আবার মঞ্চে উঠে আসে নানা মুখের, নামের পোশাকের বাচ্চারা, আবার নাম ঘোষনা করে রঞ্জনা মিত্র, আবার হাততালিতে ফেটেপরে দর্শককূল ... অবিনাশের মনেহয় মাল্যশ্রী এলে খুশি হতো ... মনেহয় তার এই জীবন না’কি তার এই যাপন ঠিক কোথায়, কিভাবে নিলো সেই মোড়টি যেখানে মাল্যশ্রীকেও ঘিরে নিলো এমনি ব্যস্ততা যে খুকির ইস্কুলের অনুষ্ঠানেও তাকে থাকতে হলো গর হাজির? না’কি এ’ই হওয়াই, এরকম হওয়াই তাদের স্বাভাবিক যারা সিঁড়ি ভাঙ্গতে চায়? কিন্তু তেমন খুব উঁচু সিঁড়ি কি ভাঙ্গতে চায় সে? সে’ কি ডিঙ্গিয়েছি তেমন উঁচু কোনো সিঁড়ি যার মূল্যে কোম্পানীর মুখপাত্র হয়ে তাকে নিউজ্ চ্যানেলে বাণী দিতে হয় সুব্রাম নটরাজন বা ভি শঙ্করগোপালের মতো? ... মাল্যশ্রী’ই কি চায় মিসেস্ জেরী না হোক্ অন্ততঃ রঞ্জনা মিত্রের মতো হতে? ... অবিনাশ জানে সে চায়না, চায়না মাল্যশ্রীও ... তথাপি ... তথাপি এই ঘটনাগুলি যেন এসে পরে, পরবেই নিয়তির মতো ... এবার ‘নিয়তি’ এই শব্দটি ভাবিত করে অবিনাশকে ... কার নিয়তি? কোন্ নিয়তি? মা যদি ইস্কুলটা বিক্রি করে দিতো নমন্ আগরওয়াল নামের সেই ব্যবসায়ীটিকে যে প্রায় তিন বছর মা’র পেছনে ঘুর ঘুর করছিল ‘অফার্’ নিয়ে তাহলে কি তার আর পেটের ধান্দায় আসতে হতো এই বাঙ্গালোরে? ছেলে মেয়েকে পাঠাতে হতো এইসব মিসেস্ জেরী কিংবা রঞ্জনা মিত্রের কাছে, শিক্ষা নিতে ... তখন কি হতো তার নিয়তি? মাল্যশ্রীর নিয়তি? তাদের সন্তানদের নিয়তি? ... সমস্ত তালগোল পাকিয়ে যায় যেন ... যেন সেই তালগোল পাকানোর ভিতর থেকে শোনা যায় গান, সেই শুক্লাদি’র কন্ঠে ... ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয় ... খুলে যাবে এই দ্বার...’ দ্বার খুলে যাবে? কিভাবে খুলে যাবে? ...আবার মনেপড়ে কবিতা... মনেপড়ে ‘কাছে দূরে কেবলি গ্রাম পতনের শব্দ হয়’...মনেপড়ে যায় একটু আগে মনে না পড়া কবিতাটির পরের পংক্তি গুলি..
বলাই বনমালী সুবল শ্রীদাম সুদাম শেষে
রমেন নরেন পরেশ হল শহর ভালবেসে।
মধ্যমগ্রাম হালিশহর রামপ্রসাদী সোনা
চুরির ভয়ে আব্জে নিল চব্বিশ পরগণা ...
... মঞ্চে এখন জোর হাততালি। একটি বাচ্চাকে প্রশ্ন করা হয়েছে ‘হোয়াট্ ইজ্ ইয়োর নেম্?’ সদ্য বাজারে আসা একটি হিন্দি ছবির নায়কের কায়দায় সে বলেছে ‘খান্ , মাই নেম্ ইজ্ খান্’ ... ঐ হাততালির ভেতর দিয়ে অবিনাশের কাছে এসে স্থির হয় একটি মীমাংসা ... নিয়তি’র মীমাংসা ... বহুদিনের, বহুরাতের একটি প্রশ্নের উত্তর আজ সরল অবয়বে চলে আসে তার ধরা ছোঁয়ার ভিতরে...সে টের পায় মা যদি ইস্কুলটা তখন বেচে দিতো ঐ আগরওয়াল’কে তাহলে না তাকে, না মাল্যশ্রী’কে ভিটে বাড়ি ছেড়ে আসতে হতো এখানে ... পরবর্তে ঐ মফস্বলের মিস্টার এন্ড্ মিসেস্ জেরী হয়ে যেতো তারা ... অথবা মিস্টার এন্ড মিসেস্ মিত্র ... হ্যাঁ, এই মীমাংসায় এসে পৌঁছানোর জন্যও সে কৃতজ্ঞ ঐ রঞ্জনা মিত্র’র কাছেই ... রঙ্গীন পেন্সিলে পাঠ্য বইএর ইম্পর্টেন্ট লাইনগুলো দাগিয়ে দেওয়ার মতোই রঞ্জনা মিত্র দাগিয়ে দিয়েছে তার চেতনাকে ... একটু আগেই দোকানের অবতল আয়নায় দেখা তার নিজের মুখটি আবার মনে আসে তার ... আর সেই সঙ্গেই একটা প্রবল পরিচিত ইংরেজি শব্দও উঠে আসে তার ঠোঁটে ... সে বিড় বিড় করে বলে ... কাকে বলে? রঞ্জনা মিত্র’কে, মিসেস্ জেরী’কে, এই ফাংশনের দর্শককূলকে না’কি নিজেকে? ... না’কি সকলকেই? ...কেজানে ... তবু বলে, বিড় বিড় করে নিজের মনেই বলে ‘আপ্স্টার্ট ... আপ্স্টার্ট’ ... নিজের কানে এই শব্দই যেন প্রতিধ্বনিত হয় ‘বাস্টার্ড, বাস্টার্ড...’ ...
খুকির গলাতেও একটি মেডেল ঝুলিয়ে দিয়েছে রঞ্জনা মিত্র ... সোনালী মেডেলে ইস্কুলের নাম ঠিকানা, প্রতিষ্ঠা-বছর সবই লেখা ...খোকা কোলে করে মঞ্চ থেকে নিয়ে এসেছে বোনকে ... মেডেল গলায় দিয়ে খুকির সে’কি আনন্দ ... ঐ সরল আনন্দকে নিজের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চায় অবিনাশ ... এই মুহুর্ত্তে ... ঐ ঢালের আড়ালে থেকে সে আর দেখতে চায়না ঐ রুক্ষ-লাল-চুলের শিশু গুলিকে ... আর ভাবতে চায়না তাদের নিয়ে ... সে এবার বাড়ি ফিরতে চায় ... ফিরে যেতে চায় তার নিজস্ব দুর্গে, নিজস্ব ব-দ্বীপে ... খুকি’কে কোলে নিয়ে অবিনাশ ডাকে খোকাকেঃ ‘আয়্, চল্ দেখি একটা অটো’ ধরি ...’ ... খুকি’কে বলে ‘খিদে পেয়েছে? খাবে? দিদিয়া’ তোমার জন্য পরটা বানিয়ে দিয়েছেন ...’ খুকি বলেঃ ‘না, চিপ্স্ খাবো ... ঐ’যে চিপ্স্’ ... খুকির আঙ্গুল তখন রাস্তার অন্য পারের দোকানে ঝোলানো চিপ্সের প্যাকেট গুলিকে নির্দেশ করছে ...
#
দিন যায়। ঐ দিন। তার যায়। ঐ রাত। দিন যায়। অন্য দিন। রাত যায়। অন্য রাত। অবিনাশের গল্প ফুরোয় না। অবিনাশদের গল্প ফুরোয়না। কেবলি চলে আসে এক দিনের পরে অন্য দিন। এক রাতের পরে অন্য রাত। এই নিরেট যাপনের কোথাও কোনো গল্প দানা বাঁধেনা... ঘটে যায়না কিছুই ... তবু ফোন করলেই সমর পাল বলেঃ ‘ আরে কি’যে বলিস্, বেঙ্গালুরু ইজ্ এ হেপেনিং সিটি ... এ’তো আর আমাদের গাঁড় মারানি বরাক ভেলী নয় ...’
তবু একদিন,অফিসের বিরক্তি আর ক্লান্তি নিয়ে ঢোকামাত্র মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল অবিনাশের কারন সেদিন কারেন্ট্ চলে গিয়েছিল কোঠায় পা রাখা মাত্র ... আকাশে সুগোল চাঁদ, আবছা কুয়াশা ... অন্ধকার ঘরে রহস্যের আব্ছায়া ... আহ্, এক মুহুর্ত্তে ফিরে আসতে চাইছিল ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলি ...’
অমনি জ্বলে উঠলো বিজলীবাতি গুলি। মুছে গেলো গগন ঠাকুরের ছবির মতো সেই অন্ধকার ... মুছে গেলো ফ্ল্যাট্ বাড়ি থেকে তবু তা জড়িয়ে রইলো এই ফলাট্’এর মুখোমুখি ‘গরীব গুর্বো’দের ভিটে গুলোকে ... অর্থাৎ জেনারেটার চল্লো ফলাটে ... বাবু-বিবিরা নিশ্চিন্দি হলেন। এলসিডি পর্দায় ঝিকিয়ে উঠলেন ওবামা – হোম্ থিয়েটারে ‘কলা-বারি’ গেয়ে উঠলেন রজনীকান্থের জামাতা ... বৈদ্যুতিক লোম তোলা মেশিন চলতে লাগলো বিবিদের বগলে বগলে ... কার্টুন নেট্ওয়ার্কে শোনাগেলো শিন্চেন্’এর এক ঘেয়ে কন্ঠস্বর ... এক দল বাচ্চা ডুব দিলো তাতে আর আরেক দলকে গিলে খেলো ‘হোমটাস্ক্’ ... বাবুরা আয়েসে চুমুক দিলেন বীয়ারের, হুইস্কীর গেলাসে ... হায়, হারিয়ে গেলো রহস্য, শৈশব, চাঁদ, জ্যোৎস্না ... অবিনাশের মনে পড়লো ডেভিড্ ফিন্চারের ‘ফাইট ক্লাব্’ ছবির নায়ক’কে যে অবচেতনে এমনি বিধ্বস্ত হয়ে পরেছিল এই ফ্ল্যাট কেন্দ্রীক জীবনে যে একদিন, নিজের অজান্তেই তার ‘অল্টার ইগো’ গিয়ে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল ঐ জন-জঙ্গল, তারপর থাকতে চলে গিয়েছিল শহরের প্রান্তে এক পোড়ো বাড়িতে ...
তার মনেপড়ে বালকবেলার কথা ...কারেন্ট্ চলে যাওয়া মানেই ছুটি। পড়াশোনা নেই। মা বা বাবা হ্যারিকেন, মোমবাতি জোগাড় করে জ্বালিয়ে দিলেও পড়ানোর উদ্দীপনা যেন কমে যেতো ওদেরো। কখনো জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতো ঘর, বারান্দা ... কখনো বাদ্লার বাতাস এসে উড়িয়ে নিতো দরজার, জানালার পর্দ্দা ... কখনো, পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসতো অবিনাশ, খালের পাড়ে ... কখনো সামনের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতো কখন ঝন্ ঝনাৎ শব্দ তুলতে তুলতে চলে যাবে একটা দুটো রিক্সা, সাইকেল ...
বয়ঃসন্ধির থেকে কৈশোরের দিকে যেতে যেতে ঐ কারেন্ট চলে যাওয়া আত্মপ্রকাশ করলো আরেক অবয়বে ... ব্যাটারী চালিত রেডিও’র নব্ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে গান শোনা ... মনেপড়ে ঐ ভাবে, নব্ ঘোরাতে ঘোরাতেই সে একদিন শুনেছিল, অশোকতরু’র কন্ঠেঃ ‘যদি প্রেম দিলেনা প্রাণে ... কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে ... কেন তারার মালা গাঁথা, কেন ফুলের শয়ন পাতা... কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে ...’ কতোদিন এমন হয়েছে যে কারেন্ট নেই এই অছিলায় ফিরিয়ে দিয়েছে মাষ্টার মশাইকে ... কোনো কোনো দিন ঐ অছিলায় মাষ্টার মশাই নিজেই চলে গেছেন ...আর কারেন্ট না থাকার রাত্রিটি ডাল পালা মেলে ছড়িয়ে যেতে যেতে পার হয়ে গেছে ঘড়িতে ধরা বাঁধা সময়ের চক্রবাল ...
একদিন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের দিকে, নামলো বৃষ্টি, ছুটলো বাতাস ... যথারীতি চলে গেলো কারেন্ট ... বৃষ্টি হলো সারারাত ... টিনের চালে ঝরে গেলো বৃষ্টি, উড়ে আসা পাতা, ডালপালা ... ভরে উঠলো নদী, খাল, বিল ... সন্ধ্যায় ঘন্টা খানেকের জন্য কারেন্ট এসেই আবার নেই ... বৃষ্টি’র যমজ যে আলস্যে সেই আলস্যে সারাদিন অবিনাশ যায়নি কোথাও ... তখন ইস্কুলের শেষ দিক ... যাওয়া মানে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়া মফস্বল শহরের কেন্দ্রে, মফস্বলি পার্কে ...
সন্ধ্যা ক্রমে রাত্রি হয়ে গেলো। আবার বাতাস বইল। আবার বৃষ্টি নামলো। তবু তার বিছানার মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ করল না অবিনাশ ... জানালার বাইরে গোঁসাই দের বাগানের বড় বড় আশ্ শ্যাওড়া’র গাছ ... তার অন্ধকার পাতার আড়ালে অন্ধকার আকাশ ... দূরের বাতাসে সেই আশ্ শ্যাওড়া’র ডালপালা সড়ে যাচ্ছে, বেড়িয়ে পরছে আরেকটুকরো আকাশের অন্ধকার ... বাড়ির পেছনের খালও জলে ভরে গিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছে উঠোন, পেছনের বারান্দার সিঁড়ি ... সিঁড়িতে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিচ্ছে ঢেউ ... হায়, তার মনেহয়, ‘আমার সন্ততিরা বঞ্চিত মর্মের ঐ সব অলৌকিক অভিযান থেকে ... এরা ফলাট্’এ বেড়ে উঠছে ... হায়, ফলাটে বেড়ে উঠে মানুষ হওয়া যায় কি প্রকৃত? যেমন মানুষ অপু, দুর্গা, জাঁ ক্রিস্তফ্, প্রিন্স্ মিশ্কিন বা নিতান্ত ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশী ডাক্তার? ... জানিনা। জানতে চাইনা। আমি ভুলে যেতে চাই, ভুলে থাকতে চাই আমার এই ফলাট্ জীবন, এই আইটি বাস্তবতা ... আমি টের পাই আমি হেরে গেছি, টের পাই আমি চাই বা না চাই আমার যাপন হয়ে গেছে নাগরিক ... আমার দুঃখুগুলো, সত্যজিত রায়ের ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’র সৌমিত্র চাটুজ্জের দুঃখু ... সাঁওতাল পরগণার পরিবর্তে অফিসের পাট্টি’তে নাহয় উইক্-এন্ড টিরিপে গোয়া’য় গিয়ে নয়তো কোনো রিসর্ট’এ গিয়ে মাল খেয়ে উথ্লে ওঠে ... আর তখন ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকি ‘ হইতে ছিলাম গারিবলডি ... হইয়া গেলাম আইটি প্রো ...’ ... আর ঐ সময় আমার মুখটা যে ঠিক, টলষ্টয়ের ‘ইম্প এন্ড্ দ্য পীসেন্ট্স্’ ব্র্যাডের সেই হঠাৎ টাকা হওয়া মাতাল চাষীটির মতোই হয়ে ওঠে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ আর নেই ...
আমি মরে গেছি। সন্দেহ নেই। আমার সন্তানদের আমি ছিন্নমূল করেছি। তাদের কোনো জন্মভূমি, জন্মস্থান নেই ...জানি ... তথাপি মাঝে মাঝে মনেপড়ে সেই কারেন্ট না থাকা রাত্রি, সেই আষাঢ়ের, শ্রাবণের ... আমাদের বাড়ির পেছনের খাল জলে ভরে গিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছে উঠোন, পেছনের বারান্দার সিঁড়ি ... সিঁড়িতে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিচ্ছে ঢেউ ... আর ঐ বিষ্টি-বাদ্লার রাত্রে ছোট্ট খেয়া নৌকা দিয়ে কারা যেন চলেছে কোথায় ... তারা গান গাইছে ‘ নাইয়া’রে নাও’এর বাদাম তুইল্লা কুন্ দেশে যাও চইল্লা ...’ মনেপড়ে সেই তারাপদ’কে যে এমনি নৌকা’র থেকে ভেসে আসা গানের টানে পেছনে ফেলে সমস্ত সুখের হাতছানি,ঝাঁপিয়ে পরেছিল জলে, সাঁতরে গিয়ে উঠেছিল ঐ নৌকায় ...
আমি মরে গেছি। সন্দেহ নেই। আমার সন্তানদের আমি ছিন্নমূল করেছি। তাদের কোনো জন্মভূমি, জন্মস্থান নেই ...জানি ... তথাপি দেবতা, হে আমার নিজস্ব দেবতা, তোমার কাছে কি নেই তেমন সঙ্গীত যা’র স্পর্শে মৃতও প্রাণ পেতে পারে ... সাঁতরে পার হয়ে যেতে পারে এই ফলাট-জীবন, এই আইটি যাপন? ... দেবতা, হে আমার নিজস্ব দেবতা, সেই বাদলের রাত্রে আমার ঝাঁপানো হয়নি জলে, আমাকে ক্ষমা করো ... আমাকে ক্ষমা করো আর ... আর যেহেতু তুমি দেবতা তা’ই সব ভুলে আরেক বার, আর শুধু একবার গেয়ে ওঠো সেই গানটি ‘ নাইয়া’রে নাও’এর বাদাম তুইল্লা কুন্ দেশে যাও চইল্লা ...’ ... এবারো যদি সাড়া না দিতে পারি তোমার ডাকে তাহলে সত্যই আমাকে মৃত বলে ঘোষনা করে তুমিও না হয় ফেলে চলে যেও ... কিন্তু তার আগে নয় ...
দেবতা হে, হে আমার নিজস্ব দেবতা, আমাকে আর একবার সুযোগ দাও ...’
১৭/০২/২০১২ - ১৭/০৩/২০১২