“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০২৩

।। অবলা ।।

      ।। মাসকুরা বেগম।।

       ফটো: গুগল সৌজন্য 
       
       বসন্তের সকাল। পরিষ্কার নীল আকাশ। বেলা দশটার সূর্য ঝলমল করছে। চারদিকে বইছে মিষ্টি বাতাস। সবুজে ভরপুর গাছে গাছে ফল-ফুল আর কোকিলের কুহু কুহু ধ্বনি। নিলু বেরিয়ে আসল ঘর থেকে, কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ছাতা নিয়ে। বাইরে রোদে ভেজা কাপড় শুকোতে দিচ্ছে জেনি। ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিলু বলল - ' জেনি আব্বার দিকে লক্ষ্য রাখিস কিন্তু !'
'আচ্ছা দিদি ! তুমি কি স্কুলে যাচ্ছ ?'
'না রে । সুমনা মেডাম বলল আজ নাকি স্কুল বন্ধ । তাই আমি রুনা ও মামুনকে পড়াতে যাচ্ছি।'
'দিদি আব্বার ঔষধটা বোধহয় আনতে লাগবে।'
'হ্যাঁ আমি দেখেছি । ঘরে ফেরার সময় নিয়ে আসব। আব্বা এখন ঘুমাচ্ছেন জেগে ওঠার পর এক গ্লাস দুধ খাইয়ে দিস । ভুলে যাস না কিন্তু !'
'আচ্ছা! ঠিক আছে দিদি! আমার কি কোনো দায়িত্ব নেই আব্বার প্রতি। শুধু একা তোমার আছে নাকি ?' অভিমানী সুরে জেনি বলল ।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে আদর দিয়ে নিলু বলল, 'আচ্ছা লক্ষ্মী বোন আমার! খুব আছে, কেমন! আমি এখন চললাম। আল্লাহ হাফিজ!'
'আল্লাহ হাফিজ!'

নিলু বেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার পাশে যেতে পিছন থেকে জেনি বলে উঠল, 'দিদি সাবধানে যেও কিন্তু !'

সকালের মিষ্টি মৃদু বাতাস কথাগুলো পৌঁছে দিল নিলুর কানে, কান থেকে বুকের গভীরে। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল বুক! তারপর সমস্ত শরীর কথাগুলোর শিহরণে শিহরিত হয়ে উঠল! চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকটি পাপিষ্ঠ শয়তানের মুখ! রাগে মাথা গজগজ করে উঠল ।

ওদের বাড়ির গলি থেকে মেইন রোডে এসে সে দেখল একটিও গাড়ি নেই এমনকি রিক্সাও চলাচল করছে না । লোকজন চলাফেরা কম। হটাৎ বৃদ্ধি রিক্সাওয়ালা মদনকে এদিকে আসতে দেখে বলল 'মদন কাকা যাবে না ?'

'না মা আজ শহরে যানবাহন চলাচল বন্ধ একটি রিক্সাকে একটি ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে, রিক্সাওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে । তাই আজ বন্ধ ডাকা হয়েছে ।'

নিলু চিন্তায় পড়ে গেল! আজ যে ওকে রুনাদের ঘরে যেতেই হবে। রিক্সাওয়ালা ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ' তুমি কোথায় যাবে মা ?'

'এই তো ডিগ্রি কলেজের পাশেই, ইঞ্জিনিয়ার আহমদ সাহেবের ঘরে।'

' তাহলে তুমি এই গলি দিয়ে হেঁটে যাইতে পারবে । বেশি সময় লাগবে না। একেবারে শর্টকাট রাস্তা।'

নিলু একটু ভেবেচিন্তে হাঁটতে শুরু করল গলিপথটা ছোট হলে ও ট্যাক্সি কিংবা ভেন মুটামুটি যেতে পারবে । কিন্তু রাস্তাটা এত ফাঁকা যে মনে হচ্ছে সবাই বোধহয় জানে যে আজ বন্ধ। শুধু ও-ই জানে না। ওর মতো বোধহয় সবাইকে এত দায়িত্ব মাথায় নিয়ে চলতে হয় না ‌। রুনাদের ঘরে যেতেই যে হবে ওকে। আগামী মাসের অগ্রিম বেতনটা নিতে হবে কারণ তার ভাই নুরের পরিক্ষা ফি দিতে হবে । ফি দিতে না পারলে তার মেধাবী ভাইটা যে পরিক্ষায় বসতে পারবে না। ভাবতে ভাবতেই ওর চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। মনকে শক্ত করে ও আরও জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল। 

নিলুফারের বয়স প্রায় ২৫ বছর। বি.এ. পাস। অবিবাহিতা। মা আদর করে ডাকতেন নিলু । বাকি সকলেই ওকে এই নামেই ডাকে। ছোট বোন জেনিফারের বয়স যখন এগার বছর ও ভাই নুরুদ্দিনের বয়স যখন আট বছর তখন ম্যালারিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মা  মারা যান। তখন থেকেই নিলুকে মেয়ের দায়িত্বের পাশাপাশি মায়ের দায়িত্ব ও পালন করতে হচ্ছে। বাবা, ছোট বোন, ভাই সবাইকে দেখাশোনা করা সংসারের কাজকর্ম করা সব কিছুরই দায়িত্ব এসে পড়ল ওর উপর। সব দায়িত্ব নিলু পালন করে নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যায়। ওর স্বপ্ন পড়াশোনা করে মানুষের মত মানুষ হয়ে মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। ওকে অনুসরণ করবে ওর ছোট দুটি ভাই-বোন। 

নিলু তখন সবেমাত্র বি.এ. ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু রেজাল্ট বেরোবার আগে তার বাবা হঠাৎ স্ট্রোক হয়। বাবা চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। বাবা ছিলেন স্বল্প বেতনের চতুর্থ বর্গের কর্মচারী । তাই তাঁর পেনশন ও স্বল্প । নিলুকে এখন মা-বাবার অসম্পূর্ণ কাজ জেনি ও নুরকে মানুষ করতে হবে । বাবার পেনশনের টাকায় সংসার খরচাপাতি কোনমতে চলে। এদিকে বাবার ঔষধ পত্র, ওদের পড়ার খরচাপাতি কিভাবে চলবে? নিলু ভেবেচিন্তে প্রাইভেট টিউশনি শুরু করল। যথাসময়ে রেজাল্ট বেরুলো। রেজাল্ট ভালোই হয়েছে ওর। একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ানো আরম্ভ করল । সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনি। সরকারি চাকুরির চেষ্টা করতে থাকল। 
    
     ইদানিং অনলাইন ডি. এল. এড. করার সুযোগ পেয়ে এই টিচার্স ট্রেইনিং কোর্সে ভর্তি হয়েছে ।  ঘরের কাজ সামলানো, স্কুলে পড়ানো, টিউশনি, নিজের অধ্যয়ন ইত্যাদি এত কষ্ট করার পরও ও ছিল সুখী। কারণ জেনি ও নুর ওর স্বপ্ন বৃথা হতে দেবে না। ওরা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। বাবা ও মাতৃ সম দিদির কষ্টের প্রতিদান ও নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা ওরা করছে । ওরা সংসারের দুঃখ মোচনের চেষ্টা করবেই। জেনি গনিতে অনার্স নিয়ে ডিগ্রি করছে আর নুর হায়ার সেকেন্ডারি দ্বিতীয় বর্ষের বিজ্ঞান শাখার ছাত্র। ওর স্বপ্ন একজন ডাক্তার হওয়ার।

নিলু সেই যে সকালে রুনাদের ঘরে পড়াতে গেল তারপর দিন গড়িয়ে যায় বেলা একটা -দুটা করে চারটা বেজে গেল কিন্তু ও বাড়ি ফিরল না। নুর কলেজ থেকে ফিরে এসেছে । খাওয়া-দাওয়া না করে ওরা সবাই বসে নিলুর জন্য অপেক্ষা করছে! কিন্তু কি যে হল! নিলু আজ ফিরল না! এমন তো কোনদিন হয় না! সবাই ভীষন চিন্তায় পড়ে গেল। 

ঘড়িতে ছয়টা বেজে গেছে দেখে নুর বলল, 'আর বসে থাকা যায় না । আমি দিদির খুজে বেরুচ্ছি।'
বাবা বললেন, 'যা বাবা! যা! তাড়াতাড়ি যা।'
'যাচ্ছি বাবা! তুমি শুধু দোয়া করো।'
'নুর তুই কিছু খেয়ে নেয় ভাই । কলেজ থেকে এসে কিছুই খাস নি ।'
'না রে  ছোড়দি, আমি কিছু খেতে পারব না। দিদিকে ছাড়া কিভাবে খাব ? দিদি আমাদের ছেড়ে কোনোদিন ভাত খেয়েছে ? আমাকে শুধু একগ্লাস জল দে ।'
'আমি ও তোর সঙ্গে যাব।' বলে জেনি ও বেরুল।
'আচ্ছা চল ।'

সম্ভাব্য সব জায়গায় ওরা ফোন করল। চারিদিকে খুঁজল। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ পেলে না। নিলুর নিজের কোন মোবাইল ফোনও ছিল না। বাড়তি খরচা হবে বলে নিলু ওর কাছে কোন ফোন রাখত না । শুধু বাবার কাছেই রাখা থাকত একটি মোবাইল ফোন। বাইরে গেলে বাবার খবর নেওয়া যায় আর ওদের প্রয়োজনও মিটে যায় এটিতে। যেমন - অনলাইন লাইভ ক্লাসে জয়েন করা কিংবা গুগল, ইউটিউব থেকে পড়াশোনার সামগ্রী যোগাড় করা ।

রুনাদের ঘরে গিয়ে ওরা খবর নিল।
রুনার মা বললেন, 'নিলু এসেছিল কিন্তু একটার মধ্যেই চলে গেছে।' নিলু বাড়ি ফেরেনি শুনে তারাও চিন্তায় পড়ে গেলেন । রুনাদের বাবা থানায় যেতে বললেন।
তারা নীলুকে আপন মেয়ের মত ভালবাসতেন। যখনই নিলুর টাকা পয়সা কোন কিছু দরকার হতো তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আজও নিলুর হাতে চার হাজার টাকা দিয়েছেন।

নিলুর কোনো খোঁজ না পেয়ে ক্লান্ত জেনি নুরকে বলল, ' নুর আমার খুব ভয় করছে! ওরা দিদির কোনো অনিষ্ট করে নি তো ? পুলিশে জানানো দরকার।' 
' কী বলিস ছোড়দি ! কারা দিদির অনিষ্ট করবে?' উদ্ভিগ্ন নুর জানতে চাইল ।
' কয়েক দিন আগে দিদি বলেছিল....।'
' কী বলেছিল? তাড়াতাড়ি বল!'
'কয়েকদিন থেকে মাস্তান ছেলেদের একটি দল দিদিকে রাস্তা ঘাটে খুব বিরক্ত করছে। সেদিন তাদের দলপতি এসে দিদির সামনে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ ধরে বলেছিল, ''আমি তোমাকে ভালবাসি সুন্দরী! বিয়ে করবে আমায় ?'' দিদি ওদের সাবধান করে দিয়েছিল "আর কোনদিন যদি আমার দিকে নজর দিস তোরা আর রাস্তা আগলে দাঁড়াবে তবে খুব খারাপ হবে তোদের! পুলিশে দেবো - বলে রাখছি!" দিদি চলে যেতে পিছন থেকে ওরা বলেছিল, "ও সুন্দরী সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে জানি আমরা । যা চাই তা ভালোয় ভালোয় না পেলে  আমরা জোর করে আদায় করে নিতে জানি।" তারপর ওরা আবারও গত সপ্তাহে রাস্তা আগলে একই প্রস্তাব রাখে দিদির সামনে "....... কিছু ভেবেছ সুন্দরী ! কবে যাব বর সেজে তোমায় ঘরে তুলতে।" দিদি সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে চপ্পল খুলে ঠাস ঠাস করে দুই ঘা বসিয়ে দিয়েছিল ওর গালে ।'
'তাহলে ছোড়দি তাড়াতাড়ি থানায় যাই! চল!' আতঙ্কিত নুর বলল।

 রাত দশটায় যখন ওরা থানায় গিয়ে উপস্থিত হল। ওরা মাস্তান ছেলেগুলোর নাম ঠিকানা কিছুই বলতে পারল না । পুলিশ ও বেশি গুরুত্ব দিল না। ' ঠিক আছে আমরা দেখছি।' বলে ওদের বিদায় দিয়ে দিল ।

পরদিন সকালেও যখন নিলু ফিরলনা‌ । চারিদিকে শুরু হল ফিসফিস। যুবতী মেয়ে সারারাত ঘরে ফিরে নি । এর চাইতে মুখোরোচক খবর  আর কীইবা হতে পারে ! নিন্দুকের তো আর অভাব নেই । চারিদিকে শুরু হল গেল গেল রব! ঠাট্টা ইয়ার্কি কানা কানি !
' বয়স হয়েছে মেয়ে বিয়ে না দিলে পালিয়ে যাবে না কী বাবার ঘরেই বুড়ো হবে!'
'আরে! মেয়ের যে কামাই খাবে ! বিয়ে দেবে কেন?'
' হয়েছে মজা! এখন খাও কামাই! মেয়ে তো নিজে নিজেই পালিয়ে গেছে । কোনো প্রেমিকের সাথে ।'

'দোহাই আল্লাহর আমার ফুলের মত পবিত্র নিষ্কলঙ্ক মেয়ের উপর এত বড় বড় অপবাদ দিও না ।' বাবা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন ।

'কেউ যদি আমার দিদির সম্বন্ধে আর একটাও বাজে কথা বলছ তবে জিভ উপরে ফেলবো।' রাগে লাল হয়ে চেঁচিয়ে  নুর বলল । শান্ত-শিষ্ট নুরের আজ এই রাগান্বিত রূপ দেখে ভয় পেয়ে কেটে পড়ল সবাই।

সকাল আটটায় আহমদ সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ' কি গো! নিলুফারের কোনো খবর পাওয়া গেছে ?'

'না গো! সকাল ছয়টায় আমি ফোন করেছি । কোনো খবর নেই। ভাবছিলাম তুমি চা নাস্তা করার পর বলব একবার থানায় গিয়ে চাপ দিতে। চাপ না দিলে কি পুলিশ তল্লাশি করবে? আর ওই ছোট ছোট দুটো ভাই বোন কীইবা করতে পারবে? খুব কষ্ট হচ্ছে ওদের জন্য আর নিলুর জন্য দুশ্চিন্তা । রুনাদের স্কুলে পাঠিয়ে আমি একবার ওদের বাড়িতে যাব একটু খাবার নিয়ে ।'

'আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি ! এ তো সাংঘাতিক চিন্তার ‌‌‌‌‌‌‌‌বিষয় ! পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে হবে ।'  বলে আহমদ সাহেব উঠে পড়লেন।

' নিলুর আবার হল কী ভাবী ?' মুখ ভর্তি পান চিবুতে চিবুতে কাজের লোক ফুলেরুন নেছা জিজ্ঞেস করল ।  সোরতা (যাঁতি) দিয়ে কুট কুট করে শুকনো সুপারি কাটছে ও । এদিকে একটা পান শেষ হতে না হতেই আরেকটা পানে চূণ লাগিয়ে, পাতা সাদার টুকরো আর সুপারি মিশিয়ে মুখে পুরছে ফুলেরুন। কালো ঠোঁট লাল হয়ে গেছে। আহমদ সাহেবের ঘরে এসেই বারান্দায় পিড়িতে বসে সুপারি কাঁটা ওর নিত্য দিনের প্রথম কাজ । এই কাজটি প্রথমে শুরু করলে নিজের সারাদিনের পান-সুপারির বন্দোবস্ত ও হয়ে যায় । পান চিবুতে চিবুতে কাজ করা ওর অভ্যাস । 

ফুলেরুন রুনার মাকে নিলুর কথা জিজ্ঞেস করতেই রুনার মায়ের খেয়ালে আসল একটি কথা, যেটা কাল থেকে একবারও মনে পড়ে নি । ' ফুলেরুন! কাল তো নিলু তোর সাথেই বেরিয়েছিল আমাদের  বাড়ি থেকে । তুই কি কিছু জানিস? নিলু কোথায় গেছে?' 

' আমি কেমনে জানব! আমি তো আমার বাড়িতে ঢুকে গেলাম। ও এগিয়ে যেতে থাকল। ওর বাড়ি তো আরও একটু দূরে।' ফুলেরুন সুপারি কাটতে কাটতেই নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল। রুনার মায়ের বুকটা কেমন যেন ছলাৎ করে উঠল ! যেন একটু সন্দেহ হল ফুলেরুকে । মনে হল চোখে চোখ না মিলিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে গেল নাকি ও । পরক্ষনেই ভাবলেন ' ছিঃ! দুশ্চিন্তায় আমি এ কী উল্টা পাল্টা ভাবছি! একজন খেটে খাওয়া গরিব মেয়েলোককেই সন্দেহের চোখে দেখছি ! ছিঃ ছিঃ!' নিজের ওপরই নিজে লজ্জিত হলেন।

আহমদ সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন পুলিশের সঙ্গে খোঁজাখুঁজি করে রাত দশটায় ঘরে ফিরলেন ফ্যাকাশে মুখে। নিলুর কোনো খবর নেই! 

বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে রুনার মায়ের ঘুম আসছে না। ঘড়িতে ভোর একটা - দেড়টা হবে তখন । বার বার ফুলেরুনের আজকের চেহারাটা সামনে ভাসছে। কেন যে কেবল ওর প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়েছেন তিনি। তাঁকে চিন্তামগ্ন দেখে আহমদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, 'রহিমা কি হয়েছে তোমার? কিছু বলবে নাকি? ঘরে ফেরার পর থেকেই দেখছি কেমন যেন খুব অন্যমনস্ক লাগছে তোমায় । নিলুর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে?'  

' হুম! মানে একটি কথা আমার মন বলছে! না! সঠিক না ও হতে পারি আমি ! আমার ভুল হতে পারে!' এলোমেলোভাবে জবাব দিলেন রুনার মা।

' মন কী বলছে? চাপিয়ে যেও না। তাড়াতাড়ি বল তো!'

' কাল ফুলেরুন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে নিলুর সঙ্গেই গিয়েছিল । বলেছিল, " এই শর্টকার্ট গলিপথটা  আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই গিয়েছে। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারবে। একটু দাঁড়াও।" নিলুও সঙ্গ পেয়ে খুশি খুশিই গিয়েছিল ওর সঙ্গে। তারপর সেদিনই নিলু নিখোঁজ! ব্যাপারটা একটু.....।'

' ইস্! তুমি আগে কেন বললে না কথাটা! সন্দেহটা ফেলে দেবার নয়। পুলিশকে জানাতে হবে।' বলে একজন পুলিশ অফিসারকে ফোন করলেন কিন্তু ফোনে পেলেন না। একবার ভাবলেন ছুটে যাবেন ফুলেরুনের বাড়ি! কিন্তু না তা তো সম্ভব নয়। উঠে পড়লেন বিছানা থেকে। পোশাক পাল্টে গাড়ির চাবিটা হাতে নিলেন।

'কোথায় যাবে এই ভোর রাতে?' রুনার মা জিজ্ঞেস করলেন।

' থানায় যাচ্ছি। রহিমা তুমি রুনা ও মামুনকে দেখো । আমি আসছি!' বলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লেন।

      রুনার মা দরজা বন্ধ করে ওজু করে দাঁড়িয়ে পড়লেন নামাজে, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলেন মেয়েটার যেন কোনো অঘটন না ঘটে । সুস্থ-স্বাভাবিক-সুশ্রী-সুন্দর মনের নিলুফার যেন ফিরে আসে যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটি ! সব দুশ্চিন্তা - আশঙ্কা যেন মিছে হয় !

    পুলিশ বাহিনী নিয়ে ভোর তিনটের সময় আহমদ সাহেব উপস্থিত হন ফুলেরুনের বাড়িতে। গিয়ে দেখেন ফুলেরুন স্নান করে ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসেছে মাত্র। থালার অর্ধেক ভর্তি মুরগির মাংস । ঘরে একা ওই । মাটির ঘরটা কাঁচা লেপা! যেন এই মাত্র লেপা হয়েছে! উনুনের ভিতরে পাওয়া গেল ধার দেওয়া দা, কুড়াল । ফুলেরুন নিরব । কোনো কিছু স্বীকার করছে না। ওকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী। ফুলেরুনের চারটি মেয়ে কিন্তু ঘরে একটিও নেই। জিজ্ঞেস করলে বলল, ' দুদিন আগে মামার বাড়িতে গেছে।' 

     ওর স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে। কোনো দিন ওর কিংবা মেয়েদের কারোর খবর নিতে আসে না । স্বামীর ভিটেমাটি বলতে এইটুকুই । এখানে যে ওরা থাকতে পেয়েছে, তাই বেশ। শুনেছে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করছে, ঘর জামাই হয়ে। লোকের ঘরে নিজে কাজ করে যেটুকু পায় তা দিয়েই মেয়েদের ও নিজের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে ফুলেরুন ।
তারপর পুলিশের জেরার মুখে ফুলেরুন বলেছে, মাস্তান ছেলেদের দলপতি যে নিলুফারকে বিরক্ত করত সে হচ্ছে ওর বড় ভাইয়ের ছেলে! ও মোটা অংকের টাকার লোভে ছেলেদের সাহায্য করেছে। পরিকল্পনা মতে ওর ভাইপো ওর মেয়েদের নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল নিলুকে অপহরণ করার আগেই। ওরা নিলুকে ফুলেরুনের ঘরেই রেখেছিল। ওর ভাইপো নিলুকে জবরদস্তি করেও বিয়ে করতে রাজি করাতে না পেরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গণধর্ষণ করে হত্যা করেছে ওর ঘরেই আজ রাতে!
    
এদিকে ফজরের নামাজের পর কবরস্থানে জিয়ারত করতে যাওয়া মসজিদের ইমাম সাহেবের চিৎকার  শুনে লোকজন জড়ো হয়। 'এটা কী ঝোঁপের মধ্যে!' আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠল সবাই ! এ কী! ক্ষত- বিক্ষত - রক্তাক্ত-বিবস্ত্র একটি দেহ ! একটি নারী দেহ! কাপড় দিয়ে মুখ-হাত-পা বাঁধা । আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাপড়-ব্যাগ-ছাতা-চপ্পল ! সবই রক্তে রাঙা! নিস্পাপ সুন্দর মুখশ্রী বিকৃত! 
সারা শরীর আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত! 

থানায় ফোন করা হল । পুলিশ আসল । দেহ নিয়ে গেল। ভাইবোনকে ডাকা হল।  ওরা সিনাক্ত করলে প্রমাণ হয়ে গেল যে এটা নিলুফারের দেহ! 

পাষন্ডরা ও চিৎকার করবে বলে ওর মুখ বেঁধে দিয়েছিল, হাত পায়ের সাহায্যে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে বলে সেগুলোও বেঁধে দিয়েছিল। প্রতিবাদী নিলু আজ নিস্তেজ লাশ! যে নিলু কোনো কিছুর কাছে জীবনে পরাজিত হয়নি। জীবন যুদ্ধে প্রতিটি পদক্ষেপে বীরত্বের সাথে জয়ী হয়েছে যে, আজ সে পড়ে আছে  ক্ষত বিক্ষত অসহায় লাশ হয়ে। কারণ নিলুফার যে এক শারীরিক বল-হীনা নারী - এক অবলা!!!!

বিষয় : ছোটগল্প 

      






Show quoted text

কোন মন্তব্য নেই: