প্রবন্ধগুলো পড়তে পড়তে একটি বিষাদে আমার মন ভরে গিয়েছিল। তার একটি কারণ এই --১৯ সংখ্যক প্রবন্ধে আছে--আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক করতে গেলে অনেকে লজ্জাতে অনুশীলনে আসে না। ‘সুন্দর সুন্দর স্বপ্নিল নাচগানে ভরপুর হিন্দী সিনেমা দেখানো হয়। কত ভালো লাগে মনটা একেবারে সেঁটে থাকে আর কোথায় সাঁওতালী নাটক! হোক না তা স্বাধীনতার জন্যে সাওঁতাল বীরের কাহিনী!’ এই যখন অবস্থা--তখন তাঁর এই বই পড়বেন কারা? আদিবাসী পাঠক পড়বেন তো? বাঙালী পড়বেন? --এই প্রশ্ন হয়তো লেখিকার মনে কাজ করে। ফলে আত্মবিশ্বাসের একটি অভাব নজরে না পড়ে থাকে না। অগত্যা কী পরামর্শ দেওয়া দরকার নিজেও ভেবে পাচ্ছি না। তাঁকে চিনি কলেজ জীবন থেকেই। অন্তত নাম তো শুনেইছি। বছর কয় আগে বন্ধু বিশ্বজিৎ দাসের সঙ্গে বাড়িও গেছি। বরাক উপত্যকাতে আদিবাসী জীবনের সুখ দুঃখ নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন এমন ব্যক্তি এই সমাজ থেকে দ্বিতীয় আছেন বলে আমি অন্তত জানি না। এক দশকের মতো হল তিনি শিক্ষিকা জীবন থেকে অবসর নিয়েও লেগে আছেন। যদি এই সমাজের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু আশার আলো, উদ্দীপনার তেজ ছড়াতে পারেন। 'হামদের বাত' বলে একটি কাগজও প্রকাশ করেন--যদিও অনিয়মিত। এই সব কাজেরই অংশ এই বই। দুটি সাদ্রি ভাষাতে প্রবন্ধ আছে। আমার পড়তে সামান্যও সমস্যা হয় নি। ফলে পরামর্শ থাকবে আগামীতে পুরো একখানা বইই তিনি এই ভাষাতে সাজাবেন। এই বইতেও প্রবন্ধ দুটিই সবার শুরুতে দিয়ে সম্মানের আসনে বসাতে পারতেন। বসান যে নি,সেটিকেই আমি বিশ্বাসের অভাব বলতে চাই।
'উপভাষা','উপজাতি' শব্দগুলো অপমান জনক তিনি লিখেছেন। উচিত ছিল আগাগোড়া নিজেও 'জনজাতি' শব্দটি ব্যবহার করা, আর 'উপভাষা'র বিকল্প শব্দ ব্যবহার করা। করেন নি। আর সাদ্রিকে 'উপভাষা' বলাই কেন? আদিবাসী সমাজের সমস্যাই হচ্ছে যে শুধু সাওঁতালি নয় --প্রায় প্রতিটি ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠী আজকাল নিজের নিজের ভাষার স্বীকৃতি দাবী করছেন। আমাদের বন্ধু দেবব্রত শর্মাও দেখছি সব ভাষার স্বীকৃতির পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়েন। তাতে বাস্তব সমস্যা আছে। পরিকাঠামোগত তো বটেই। তার থেকে ভালো কি নয় একটি ‘প্রমিত' ভাষার পাশে সবার দাঁড়িয়ে যাওয়া? আর প্রমিত ভাষা হিসেবে 'সাদ্রির' দাবী সবার উপরে। সেখানে সামান্য তফাৎ আছে বলে ছিলোমিলো ভাষার দাবিকেও তুলে ধরলে সমস্যা। এহেন ভাষা বৈচিত্র্য বাংলা হিন্দিতে আরও ব্যাপক। তাই বলে কেউ কেউ সিলেটিকেও স্বতন্ত্র ভাষার দাবি জানান। সিলেটি আর কাছাড়িতে তফাৎ নেই? ঢাকাই চট্টগ্রামীর কী হবে তবে? এই ভাবে এগোতে এগোতে বাংলা বলেও কী থাকবে কিছু? একই কথা 'সাদ্রি' সম্পর্কে। লেখিকার 'সাদ্রি'কে 'উপভাষা' ভাবাই ঠিক হয়নি। নির্দ্বিধাতে একে প্রমিত ভাষা বলে প্রতিষ্ঠার আয়োজন করা ভালো। এই ভাষাতে এখন সাহিত্যিক সম্পদও ব্যাপক। এর লিপি অসমে বাংলা বা অসমিয়া হলে সমস্যা নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে পাঞ্জাবির মতো ভাষারও গুরুমুখি, আরবি, রোমান---তিনটি হরফ চালু আছে। না থাকলে ভালো ছিল। আছে তো কী করা যাবে? সাদ্রি দেবনাগরিতে লেখারও একটি চাপ অসমের বাইরে রয়েছে। সেখানে থাক, অসমে এত চাপ না নিলেই হল। তা নইলে ‘চা-জনগোষ্ঠী বাগানীভাষা’- এই সব অপবাদ থেকে বেরোনো কঠিন হবে। এই সব জনগোষ্ঠীর নাম হয় বুঝি? কিন্তু কোনও এক ভাষার পাশে না দাঁড়ালে সেই অপবাদ থাকবেই।
‘বরাকের চা-নারীদের অবস্থান ‘ লেখাতে তিনি একটি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। (পৃষ্ঠা ৭৫)আমার মতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এই নিয়ে একটি স্বতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ লেখা থাকা উচিত ছিল। আমার অনুমান এই ঘটনাই আদিবাসীদের চা-বাগানের বন্দি দশার থেকে মুক্ত করে দিচ্ছে। নিছক পাশের গ্রামে ‘প্রাক্তন চা-শ্রমিক’দের দিয়ে এই ঘটনা সম্ভব ছিল না। কারণ তাঁরা চা-বাগিচার অস্থায়ী শ্রমিকের যোগানদার ছিলেন চিরদিন। এখন আরও বাড়ছে এই অস্থায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ---তিনি নিজেই লিখেছেন। যদি বাড়তেই থাকে তবে বাগান থেকে দূরে নবীন প্রজন্ম চলে যাবেন খুবই স্বাভাবিক। ফলে যাদের পূর্বপুরুষ এককালে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড এলাকার থেকে অসমে ত্রিপুরাতে উত্তর বাংলাতে চা বাগানে কাজ করতে এসেছিলেন---তারা এখন এক উলটো প্রব্রজন শুরু করেছেন। ‘চরগোলা এক্সোডাসে’র শতবর্ষে এই প্রব্রজনের অধ্যয়ন করবেন না? কেন কেউ এখন এই উল্টোযাত্রাকে আটকাচ্ছে না?
বাকি যে কোনও জনগোষ্ঠীরই মতো আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা আবার রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে গিয়ে ভিড়ছেন। কী পরিচয় নিয়ে আছেন তারা সেখানে? তাঁদের তো কেউ সেখানে ‘চা-শ্রমিক’ বা ‘বাগানীয়া' বলবেন না। এরই জন্যেই কি নানান ভাষার নামে চিহ্নিত হবার এত তাগিদ? জানি না। কিন্তু বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে এই পরিঘটনা যে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে চলেছে এটি নিশ্চিত।
‘নবশাখ’ সম্প্রদায়ের মতো কিছু কিছু মানুষের বাঙালিতে মিশে যাবার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, অসমিয়া সমাজে মিশে যাবার প্রবণতা তো ব্রহ্মপুত্রে অনেক ব্যাপক, বরাকে এবং উত্তর বাংলাতে হিন্দিতে মিশে যাবারও প্রবণতা রয়েছে। সম্প্রতি দেখলাম উত্তর বাংলার কিছু সংগঠন হিন্দি মাধ্যমের স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াবার দাবি জানাচ্ছেন। এই সব থাকবে। কিন্তু যদি কোনও দৃঢ় বিকল্প দাঁড় করাবার ব্যর্থতা থাকে তবে সবারই তাই হবে। এই সব অসমে বাঙালি সহ আরও বহু জনগোষ্ঠীর রয়েছে। কেবল আদিবাসীদেরই নেই। তাই সাদ্রি না ছিলোমিলো এই দ্বিধার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এক জায়গাতে লেখা আছে ‘১৮৬৩ সন থেকে পশ্চিম বঙ্গ, উড়িশা, শিলচর, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং অন্ধ্র প্রদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি শুরু হয়’ (পৃঃ ১৬) এই বাক্যে ‘শিলচর’ কেন? ছাপাখানার ভূত? এরকম বেশ কিছু জায়গাতে আছে/ শুরুতে উদ্ধার কথা অংশেও দেখুন বাক্য গঠনে সমস্যা আছে। আমি বুঝি, বাইরে ভেতরে কোন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে তিনি লিখছেন। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের স্বার্থেই এই সব ভ্রান্তির বাইরে বেরোতে হবে। নইলে বাঙালি পাঠকও ব্যক্তিগতভাবে যারা তাঁকে চেনেন না, বইটি সিরিয়াসলি নেবেন না। এর থেকে সপ্তম ও অষ্টম প্রবন্ধের শিরোনাম—যথাক্রমে ‘ ‘দুদিন সাংস্কৃতিক পরবে হামদের সপোন সময় যাপন’ এবং ‘আন্ধা বিশোয়াস’ পড়তে কারও কোনও সমস্যা হচ্ছে? কোনও বাঙালির? আর আদিবাসী কারও তো সমস্যা হবারই কথা নয়। তবে এই ভাষাটাই হোক না আত্মপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠার ভাষা? সেখানে এখনই কেউ ভাষার ভুলভাল নিয়ে বেশি প্রশ্ন তুলবেন না। আর তুললে ভালোই। ভাষা চিন্তা এগোবে। ভাষা কেবল ‘শুদ্ধ’ করে লেখাই সবটা নয়, তাঁকে সুন্দর করে তোলাও একটা কাজ। বেশি বেশি ব্যবহারেই এটি সম্ভব। তাও লেখাতে। মৌখিক ভাষার বিশেষ মর্যাদা নেই। লিখিত ভাষার কদর যত।
প্রতিটি প্রবন্ধের নিচে কোন পত্রিকাতে কবে প্রকাশিত হয়েছে সেই সব উল্লেখ আছে। তাতে লেখিকা হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠাটি বুঝতে সুবিধে হয়। তাই বলে নিজের বইতে ‘লেখিকা আসামের বাসিন্দা ও আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী’ –লেখা কেন? এই অংশ বাদ দিলেই ভালো হত।
নিজের সম্পাদিত ‘হামদের বাত’ বাদ দিলে এর সব কটিই বাংলা পত্রিকা। বাংলা পত্রিকার থেকে পাওয়া এই সম্মান অভিনন্দন যোগ্য। বাংলা কাগজগুলো যদি আদিবাসীদের মধ্যেও গিয়ে পৌঁছচ্ছে তবে কোনও প্রশ্ন নেই। কিছু কিছু তো গেছেই। যেমন মর্লি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্মরণিকা ‘শালবনী’ পৌঁছুবেই –এই নিয়ে প্রশ্ন নেই। বা মার্চ ২০১৮-তে কলকাতার থেকে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রকাশ করেছে ‘অন্য নারী’ নামে যে পত্রিকা—সেটিও পৌঁছেই থাকবে। এর আগের বছরে নবনীতা দেবসেন ‘ভূমিকন্যা’ নামে সইমেলাতে যখন তাঁকে ডাকেন সেই প্রক্রিয়াতে পরোক্ষে আমারও কিছু সংযোগ ছিল। জানতাম তাঁকে কেন ডাকা হচ্ছে। এর পরেই এই লেখা। নিশ্চয় সেটিও গেছে। দেওয়ান বাগানের ‘শিল্পী সংসদ’ দীর্ঘদিন আদিবাসী ও বাঙালি উভয় সমাজে সাংস্কৃতিক বোধের বিকাশে ভালো কাজ করেছেন আমরা জানি। তাদের কাগজ ‘স্রোতস্বিনী’ও নিশ্চয় পৌঁছত আদিবাসী পাঠকের কাছে। ‘আমাদের সমকাল’ পৌঁছেই থাকে। ‘প্রবাহ’ সম্প্রতি একটি আদিবাসী সংখ্যা করেছে। কাজল দেমতার লেখা ছাড়া সেই সংখ্যা সম্পূর্ণ হতেই পারত না। সেই সব ঠিকই আছে। কিন্তু ‘সাদ্রি’ পত্রিকার সংখ্যা বাড়ুক নিশ্চয় লেখিকা স্বপ্ন দেখেন, আমরাও দেখি। কীভাবে কী করতে হবে আমরা বলব না। বলা যত সহজ করা তত কঠিন না। সে কাজল দেমতাই ভালো জানেন।
কিন্তু ভেবে দেখুন তো আজকের দিনে আমি এই আলোচনা যখন লিখছি তিনসুকিয়ার থেকে কাজল দেমতা দিনের মধ্যেই তা পড়ে ফেলবেন উধারবন্ধ থেকে। ছাপা কাগজের হ্যাপার থেকে এই কাজ এখন অনেক সহজ। হোক না সেই কাজ আন্তর্জালেই/ ব্লগে হোক। লিখে হোক। বলে হোক। ভিডিও পোর্টাল তো হতেই পারে। কম করে হলেও এই সব কাজ পশ্চিম বাংলা ঝাড়খণ্ডে হচ্ছেই। ভোজপুরির মতো যদিও নাচে গানের ভিড় অনেক। ভোজপুরি গানের মতোই তারও অধিকাংশের প্রবণতা খুব স্বাস্থ্যকরও না। বলিউডের মতো হয়ে উঠবার ঝোঁক ব্যাপক। তবু এই পথ তো ধরা যেতেই পারে। খানিক প্রায়োগিক কাজ নিজেরা শিখে নিতে হবে শুধু।
যত বই পত্রিকা আমার হাতে আসে সব বই পত্রিকা নিয়ে আমি লিখি না। এই বই নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হল ভালো মন্দ এই সব ভাবনা পৌঁছে দেবার জন্যেই। মনে হল এই বই নিয়ে উদাসীন থাকা অপরাধ হত।
📞📞📞📞📞☎☎☎📞📞📞📞📞
লেখিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে এখানে টিপুন।
অথবা ফোন করুন 📲📲 9954160344
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন