সেদিন সকালে খবর বেরুলো জিসানের মায়ের করোনা পজিটিভ ! ওর মা প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষিকা । স্কুল যাওয়া - আসা করছিলেন । কোথা থেকে কীভাবে সংক্রামিত হয়েছেন কোভিড-১৯ ভাইরাসে। সংক্রামণের ভয়ে গলির সবাই গৃহ বন্দি । ফোনের মাধ্যমে জিসানের ঘরের খবরাখবর রাখা হচ্ছে। শিশুদের সাইকেলে এখন জং ধরছে। ফুটবলগুলো পড়ে আছে ঘরের কোনো এক কোণে নয়তো খাটের নিচে।ক্রিকেট এর ব্যাট গুলো বলের বিরহে মলিন হলে পড়ে আছে ঘরের নয়তো বারান্দার কোনো এক কোণে ।
শান্তি পথের দুধারে ঘাস - লতাপাতায় ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে। অজানা অচেনা যত সব আগাছায় সুন্দর মনমুগ্ধকর ফুল ফোটে করে তুলেছে এই পথকে অনন্য। সাদিকার নানার বাগানের আম গাছে কাঁচা কচি আম হাতের নাগালে । কিন্তু নেই কোনো দুষ্টু - মিষ্টি ছেলে যে দুটো আম পেড়ে পালাবে ।
হাউস নাম্বার-দুইয়ের প্রথম তলার সাফিন, আদিব ও দ্বিতীয় তলার ফারহান আর হাউস নাম্বার-চারের দ্বিতীয় তলার দানিশ, আমানী, নিচের তলার মামু।মাঝখানে হাউস নম্বর তিনে এখনও শুধু গ্রাউন্ড ফ্লোর অব্দি কাজ হয়েছে। তাই উপরটা খোলামেলা। দক্ষিণ দিকের ডনবসকো ইউনিভার্সিটির স্টাফ কোয়ার্টারের ফ্ল্যাটে আছে কিছু শিশু।এই কয়েকজনের মধ্যে জানলা কিংবা ব্যালকনি দিয়ে চলতে থাকে আলাপ। জানালার কিংবা ব্যালকনির গ্রিলে লটকে লটকে চিৎকার করে করে চলে বার্তালাপ । আকাশে - বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে শিশুদের মিষ্টি মধুর সুর । গ্রিল ভেঙে যেন বেরুতে মন চায় তাদের । আকাশে ভেসে চলা মেঘের মতো হাওয়ায় ভেসে ভেসে খেলা করতে মন চায় । পাখির মতো স্বাধীনভাবে বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে শূন্যে উড়ে চলতে মন চায় ।
নিচের তলার মামু এসে সঙ্গী হয় দানিশ- আমানীর । তাদের জন্য বেডরুমটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । যা খুশি করে এখানে । বিছানার উপর জানালার গ্রিলের সাথে রশি টাঙ্গিয়ে তার উপর বিছানা চাদর দিয়ে তৈরি করে তাবু । জানলার পরদা সরিয়ে দেখায় ফারহান, সাফিন -দের । সাফিন আর আদিব উঠে চলে আসে ফারহানের ঘরে । এখানেও জানালার গ্রিল আর টেবিলের পায়ের সাথে বিছানা চাদর কিংবা মায়ের ওড়না বেঁধে তৈরি হয় ওদের তাবু ।
আমানী ডাকে ‘ফারহান ! ফারহান!' । ফারহান জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে সাড়া দেয় । আমানী বলে, ‘ফারহান ! একটু গ্রিলে লটকে ব্যায়াম করো তো।' মেদহীন ফারহান গ্রিলে লটকে কিছু কারিশমা দেখাতে উস্তাদ ।
দানিশ বলে, ‘ফারহান ! আজ অনলাইন ক্লাস নেই নাকি ?'
ফারহান বলে, ‘আছে । কিন্তু এখন নয়, পরে হবে । এই দেখ আমার কাছে কী কী খেলনা আছে । আমি কী তৈরি করেছি। দেখ, দেখ।'
দানিশ বলে, ‘হাই পাঙ্কু ! তুই মাইন্ড ক্রাফট ভিডিও গেম খেলিস ?'
‘হ্যাঁ!........দানিশ তুমি খেলো না ‘।'
‘মা মোবাইলে ডাউনলোড করতে দেয় না যে। আমাদের ঘরে এসেছিল আদনান ও ফাহিম ওদের মোবাইলে খেলেছি । আরও কিছু ইউটিউব থেকে দেখে দেখে শিখে ফেলেছি।'
পাঙ্কু জিজ্ঞেস করে, ‘দানিশ ! আজ তোমার ঘরে ইফতারে কী বানিয়েছে ?' কিংবা ‘তোমাদের ইদ, না ? কী কী খাবার তৈরি করে ইদে ।'
আদিব জানলা দিয়ে ডাকে, ‘দানিশ ! দানিশ !'
চশমা চোখে ক্ষীণকায় নয়/দশ বছরের মেয়ে লিপি কোয়াটারের এক ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছে আর শুনছে সবাইকে ।
সাফিন বলে, ‘হাই ! তোমার নাম কী?'
‘আমার নাম লিপি । তোমার নাম কী?' এভাবে সবার সাথে পরিচয় হয় ওর ।
মামু জিজ্ঞেস করে, ‘লিপি তোমার চোখে চশমা কেন? এটা বুঝি তোমার স্টাইল?'
‘না না ! স্টাইল বলছ ! আমার একদম ভালো লাগে চশমা চোখে দিতে।'
দানিশ জিজ্ঞেস করে, ' এটা কি পাওয়ার থাকা চশমা ?'
‘হ্যাঁ !'
‘হ্যাঁ!!! কী বলছ !' এক সঙ্গে সবাই আঁতকে উঠে ।
পাঙ্কু বলে,‘ও যে সব সময় মোবাইল নাইলে ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে তাই ওর চোখ খারাপ হয়ে গেছে।'
‘তাই নাকি লিপি ?' বাকিরা জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ ! আমি তো এমনিতেই ইউটিউব আর ভিডিও গেম ভালোবাসি।তারপর এই মহামারিতে স্কুলের অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি বাড়তি অনলাইন মাধ্যমে অ্যাবাকাসের ক্লাস,মিউজিকের ক্লাস,আর্ট ক্লাস,কোডিং শিখার ক্লাস, যোগ-ব্যায়ামের ক্লাস ইত্যাদি করতে গিয়ে সারাদিন মোবাইল আর ল্যাপটপের সামনে বসে বসে আমার চোখ শেষ !' ছোট্ট লিপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেবো আমার ছবি আঁকার বিষয়।তোমাদের চিৎকার চেঁচামেচির ধ্বনি- প্রতিধ্বনি থেকে খুঁজে নেবো মিউজিক। মায়ের কাছ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখব। অ্যাবাকাস আমায় যেন একটি মেশিনে তৈরি করছে।তাই আমি ছেড়ে দিয়েছি এসব কিছু।শুধু স্কুলের ক্লাস করব।নিচের মাঠে ইচ্ছে মত ভলিবল খেলব। তোমরা আমার বন্ধু হবে ?'
‘নিশ্চয়ই ! নিশ্চয়ই ! আমরা সবাই খুব ভালো বন্ধু ।' সবাই একসাথে বলে উঠল মিষ্টি মধুর সুরে।
ঘরে বসে বসে ঘরোয়া পুষ্টিকর খাবার খেয়ে খেয়ে শিশুদের খুব শারীরিক বৃদ্ধি হচ্ছে। গায়ে রোদ লাগছে না তাই গায়ের রঙ অনেক ফর্সা হয়ে গেছে। আগের থেকে যেন একটু বেশিই সুস্থ-সবল-সুন্দর হয়ে উঠেছে শিশুরা। বয়সের থেকে যেন একটু বেশিই বড় হয়েছে।একদিন আমানীর বাবা মেয়েকে আদর করে বললেন, ‘মা ! তুমি বড় হয়ে যেও না। ছুট্টটি থেকো।বেশি বেশি করে কোলে নিতে পারব ।'
আমানী উত্তর দিল, ‘তুমি কি যে বল আব্বা । বড় কি আমি নিজে নিজে করছি আব্বা ! আমি তো আপনা আপনিই বড় হচ্ছি !'
ফারহান মা-বাবার কাছে বায়না করে, ‘আমার একটি বোন লাগে।সবার ছোট ভাই কিংবা বোন আছে। শুধু আমার নেই।'
মামু তো অনেক ঘরোয়া খুঁটিনাটি কাজ কর্ম শিখে ফেলেছে ! যখন স্কুল খোলা ছিল যে মামু নিজে নিজে খাওয়া দাওয়া করার সময় পেতো না সেই মামু এখন ছোটভাই ছয়মাসের যিবানের এর কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখতে জানে,ঘর দোর পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে জানে,ডাইনিং টেবিলে অতিথি আপ্যায়ন করতে জানে!স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েরা মায়েদের ঘরোয়া কাজে টুকটাক সহায়তা করছে।পড়াশোনার চাপ নেই আগের মতো।মা-মেয়েদের দিন খুব ভালোই যাচ্ছে,কিছুটা মা-ঠাকুমার দিনের মতো ।
সাফিন ও সারাদিন ছোট ভাই আদিবের পিছে পিছে ঘুরে । স্কুল খোলা থাকলে কি পারত সাফিন আদিবকে এতো সময় দিতে ? ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য রেডি হওয়া, সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়া । বিকেল দুটো তিরিশ মিনিটে এক গাদা গৃহকর্ম নিয়ে ঘরে ফেরা। হাত-মুখ ধুয়ে, খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নেওয়া। তারপর বিশ্রাম করে উঠে স্কুলের গৃহকর্ম নিয়ে বসে পড়া। এই ছিল প্রাত্যহিক রুটিন। ভাইয়ের মুখটাই ভালো করে দেখার সময় পেতো না।করোনা মহামারির বন্ধ বোধহয় শিশুদের উপর থেকে কিছুটা অযথা চাপ কমিয়ে দিয়েছে।পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পড়াশোনার নামে শিশুদের উপর প্রাইভেট স্কুলের যে জুলুম হচ্ছিল তা একটু কমেছে ।
সাহিল ছেলেটা বড্ড ভালো । ওরা কয়েকটি পরিবার শান্তি পথের একটি আসাম টাইপ বাড়িতে বসবাস করে । গতবছর ঐ বাড়িতে থাকা মুন্নার মা হাসপাতালে জন্ম দেয় একটি কন্যা সন্তান । সঙ্গে সঙ্গে খবর আসে মুন্নার মা করোনা পজিটিভ । তখন করোনা পজিটিভ হলে তো হয়রানির শেষ ছিল না । মুন্নার মায়ের চৌদ্দগুষ্টি ‘কোয়ারান্টাইনে' । ঐ বাড়িতে যত ছিল সবাই চৌদ্দ দিনের নিভৃতবাসে। অনেক কষ্টে দিন কাটিয়ে ছিল লোকগুলো । ভাগ্যিস আর কারও পজিটিভ হয়নি । সাহিল সরকারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে । চটপটে হালকা পাতলা ছোট ছেলে । কেউ যদি কোনো দরকারে ডাকে, ঝটপট হাজির সে । মা-বাবা বা যেকোনো লোকের সাহায্য সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোট্ট সাহিল। কিন্তু তার নিজের পড়াশোনা লাটে উঠেছে করোনা মহামারির জন্য ।
বেচারা জিসান! বাইরে বেরুনো তো বন্ধ, ঘরের ভিতরে ঢুকাও বন্ধ। মায়ের পাশে যেতে পারে না। ঘরের সম্মুখের বারান্দায় খেলতে থাকে সারাদিন । একা একা কী আর খেলা যায় ! বিরক্ত হয়ে উঠে । অকারণে রাগ হয় । ছুঁড়ে ফেলে দেয় খেলনাগুলো। মায়ের উপর অভিমান করে । মাঝে মাঝে বিনা কারণে কাঁদে । দু'দিন পর ওর নানিরও করোনা পজিটিভ ! জিসানরা থাকে ওর নানির ঘরে। নানা মারা গেছেন সেই কবে। মামা তো নেই। শুধু মা আর মাসি।বড় মাসি নিজের শ্বশুর বাড়িতে থাকে।জিসানের বাবার কর্মস্থল এখান থেকে কাছাকাছি স্থানে। তাই ওর মা-বাবা ওকে নিয়ে নানির সাথে থাকেন।নানির একাকীত্ব ও ভালোই কেটে যায়। জিসান নানির অন্তঃ প্রাণ।এখন জিসানের খুব কষ্ট - নানি কাছে ডাকে না,আদর করে না ভাত খাইয়ে দেয় না ! আগে তো মা-বাবার চেয়েও বেশি সময় কাটাত নানি সাথে।মা কাছে ডাকে না, আদর করে না, পড়াতে বসে না, বকাবকি ও করে না ! বাবা কী সব রান্না করে মুখে তুলা যায় না ! বাবার হাতে একটুও স্বাদ নেই । এক গ্রাস ভাত যদি নানি খাইয়ে দিত । কী স্বাদই না লাগত ! এখন মামু-রা ও খেলতে ডাকে না ! কেউই রাস্তায় বেরই হয় না খেলতে !
করোনা মহামারির জন্য কচি -কাঁচা শিশুরা আজ তাদের শৈশব উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত । পারছে না স্বাধীনভাবে এখানে- সেখানে বিচরণ করতে । স্কুল ও স্কুলের বন্ধুদের খুব মিস করছে । ঘরে বসে আর কত আঁকবে প্রিয় কার্টুন চরিত্র ? কত গাইবে ছড়াগান ? কত খেলবে রান্না-বাটি ? কত কাটাবে সময় জড় পুতুলের সাথে ? ভীষণ বিরক্ত লাগছে ! অসহ্য হয়ে উঠছে এই বন্দি জীবন ! কখন যে কাটবে মহামারির এ আতঙ্ক ! আজ করোনা স্বাধীন, তারা বন্দি ! এমন দিন কখন আসবে - যেদিন করোনা হবে বন্দি আর তারা হবে মুক্ত ? ভাবনার পাহাড় আজ শিশুদের মনে । মাঝে মাঝে মন চায় রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে । মন চায় একটু বেড়াতে যেতে পার্কে নয়তো কোনো আত্মীয় - স্বজনের ঘরে । কিন্তু তারা তো ঘর থেকে বেরুতেই পারছেনা । বিল্ডিং এর নিচে গিয়ে একটু দৌড়াতে ও পারছেনা । পারছেনা সবাই মিলে হৈচৈ করতে। শুঁকতে পারছেনা কাঁচা মাটির গন্ধ । তাইতো তারা বিল্ডিং গুলোর ছাদে উঠে একসাথে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে স্লোগান দেয় ‘গো, করোনা গো!'