।।শৈলেন
দাস।।
শহরের শরীর ক্রমশ: বেড়ে
চলেছে। নতুন নতুন এলাকা যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার উপর সরকার পৌরসভাকে পৌরনিগমে
উন্নীত করার অধিসূচনা জারি করায় শহরের লাগোয়া একপশলা জমিও এখন শহরের
অন্তর্ভুক্ত। এমতাবস্থায় একসময়ের শহরতলী দুর্গাবিল এখন শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে।
শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের বসতবাড়ি যেন 'গোল্ড ফিল্ড' সদৃশ।
তাই এখানকার বাসিন্দাদের জমির পাট্টা দেওয়ার জন্য সরকারি প্রক্রিয়া অনেকদূর
এগিয়েও বাতিল হয়ে গিয়েছে। সতীশ লক্ষ করেছে দুর্গাবিলের প্রান্তিক মানুষের সাথে
ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠুর আচরণ, রাজনীতিবিদদের ইকোফ্রেন্ডলি চক্রান্ত এবং ভদ্রজনদের চিরাচরিত অবজ্ঞার
সাথে নতুন সংযোজন অমানবিক অপপ্রচার। মানুষের ভুল এবং গাফিলতির ফলে বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে
বন্যার জল যখন ঘরের চালের উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখনও এক শ্রেণীর মানুষ বলতে থাকেন এর
কারণও নাকি ঐ দুর্গাবিলের জবর দখল।
কয়েকদিন আগে স্থানীয়
পত্রিকায় একটি সংবাদ বেরিয়েছিল - শহরে বহু কোটি টাকা ব্যয়ে বিনোদন পার্ক তৈরি
হবে, এর জন্য জমিও নাকি চিহ্নিত হয়ে গেছে। সামান্য কিছু প্রতিবন্ধকতার
জন্য জায়গাটির নাম উল্লেখ করা হয়নি। আজ দুর্গাবিলের যতীন এবং অন্য আরও কয়েকজন
সতীশের ভাড়া বাড়িতে এসেছে। হাতে সবার সরকারি নোটিশ। যতীনরা যেন নিজের থেকেই
দুর্গাবিলকে জবরদখল মুক্ত করে সরে যায় অন্যথায় সরকার বাধ্য হয়ে উচ্ছেদ অভিযান
চালাবে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বুলডোজার চালিয়ে উচ্ছেদ অভিযানের খবর প্রতিদিনই
আসছে। সতীশের আশঙ্কা ছিল একদিন তার প্রয়োগ দুর্গাবিলেও হতে পারে কিন্তু তা যে এত
তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সে ধারণা তার ছিল না। যতীন বলল - এই মুহূর্তে আমরা কি করব? কার কাছে
যাব? পনের দিন পর যে মাথার উপর আর ছাদ থাকবে না। সতীশ তাদের কি সান্ত্বনা
দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। বলল - তোমরা বাড়ি যাও এবং নিজেরা সংগঠিত হও। আমি দেখি
কতদূর কি করা যায়। সবাইকে এক থাকতে হবে কিন্তু।
সেদিন
যতীনরা চলে যাওয়ার পরেই সতীশ কাজে নেমে পড়ল। তাদের দেওয়া নোটিশ এর সূত্র ধরে
খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে গভীর চক্রান্তের হদিস পেল সে। শহরের একাংশ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ভুমাফিয়ারা
সম্মিলিতভাবে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছে দুর্গাবিলের প্রান্তিক মানুষগুলোকে উচ্ছেদ
করার। সেখানে অত্যাধুনিক বিনোদন পার্ক তৈরি করে নিজেদের অংশীদারিত্ব অনুযায়ী
মুনাফা লুটার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করবে তারা। সরকারি
অফিস এবং সংবাদ জগতের ভেতরের খবর যারা জানে তাদের কয়েকজনের সাথে নিজের
সুসম্পর্কের দরুন সতীশ এমন কিছু তথ্য জোগাড় করতে সক্ষম হল যা থেকে এটা স্পষ্ট যে দুর্গাবিলের
মানুষগুলি শয়তানদের কুনজরে পড়েছে। আসন্ন বিপদ থেকে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে
বাঁচানো তার দ্বারা সম্ভব হবে না। এই অসম লড়াইয়ে চাই এমন একজন যোদ্ধা যে
প্রান্তিক মানুষের আর্তনাদ শুনলে অস্থির হয়ে উঠবে এবং রুখে দাঁড়াবে সর্বশক্তি
দিয়ে। যাকে দেখলে বধ্যভূমিতেও পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে প্রান্তিক মানুষের মনোবল।
সংসদীয়
নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিজেদের জয় ধরে রাখতে বিভিন্ন কার্যসূচি
হাতে নিয়েছে তাই ফুরসত নেই দলীয় নেতাদের। ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পর সতীশের ডাক
পড়েছে ভিতরে যাওয়ার। বসার ঘরে এখনও জনাকয়েক মানুষ রয়ে গেছে। একজন ভেতরের দরজা
দিয়ে সতীশকে উপরে চলে যেতে ইঙ্গিত করল। উপরে উঠেই সতীশ দেখল ড্রইং রুমের সোফায়
আরাম করে বসে আছে হরিভানু কৌস্তভ,
সোশ্যাল মিডিয়ায় সতীশের সাথে সোসিও পলিটিক্যাল
ইস্যুতে যার তর্ক বিতর্ক চলে প্রায়ই। এমতাবস্থায় সে যখন চলে আসবে কিনা ভাবছিল
ঠিক তখনই ভিতরের রুম থেকে বেরিয়ে আসল সৌম্য দর্শন সুবাহু যুবক দিব্যাংশু। 'সতীশদা
হরিভানুকে নিয়ে কোন সংকোচ নেই। ভিতরে এস, ও আমাদেরই লোক' বলেই
নিজের চেয়ারে বসল সে। সতীশ সামান্য কুশল বিনিময় করে সংক্ষেপে তুলে ধরল
দুর্গাবিলের যতীনদের কথা। দিব্য বলল 'আমি কি করতে পারি তাতে?' 'মানে?' পাল্টা
প্রশ্ন করল সতীশ। 'স্বার্থান্বেষী কিছু ক্ষমতাবান লোক আমাদের মানুষগুলিকে সমূলে উপড়ে
ফেলবে আর আমরা চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকব? প্রতিরোধ গড়ে তুলব না? সতীশকে
উত্তেজিত হতে দেখে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল দিব্য। শান্ত স্বরে বলল 'ইন্টারনেটে
বিদ্রোহের ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে তুমি আবেগিক হয়ে গেছ সতীশদা, তাই এরকম
বলছ। ভেবে দেখ একবার, সামান্য কয়েকটি পরিবারের জন্য শহর উন্নয়নের এত বড় মেগা প্রকল্পে
আমি বাগড়া দেই কি করে? পার্টি আমাকে মোর্চার দায়িত্ব দিয়েছে, তা
সামলাব না এইসব ঝামেলায় জড়াব?'
হরিভানু বলল 'এবার আমাদের সংসদীয় আসনটি
সংরক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মোর্চার দায়িত্ব ভালভাবে সামলালে পার্টি
দিব্যকে প্রার্থী করতে পারে। এ কথাটা মাথায় রাখতে হবে আমাদের।' গ্লাসটা
টেবিলে রেখেই উঠে পড়ল সতীশ। ক্রুদ্ধ স্বরে হরিভানুকে লক্ষ্য করে বলল 'ভাই, আনুগত্য
আমাদের ধাতে নেই। আমাদের ইতিহাস বিদ্রোহের ইতিহাস।' দিব্যকে বলল - সংরক্ষিত
আসনে প্রার্থী হওয়ার বাসনা পোষণ করছ মনে অথচ যাদের নামে এই আসন সংরক্ষিত হবে
তাদের আর্তনাদে তোমার হৃদয় কেঁপে উঠবে না না? চলি ভাই। বলেই বেরিয়ে পড়ল
সে। পেছন ফিরে দেখল না আর দিব্যর দিকে।
দুর্গাবিলের
তিন দিক থেকে বুলডোজার ঢুকে উপড়ে ফেলছে প্রান্তিক মানুষের বাড়িঘর। সেখানে
উপস্থিত হয়ে সতীশ কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে "পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না
করে এভাবে প্রান্তিক মানুষের বসতবাড়ি ভেঙ্গে ফেলা অন্যায়। এখানে বসবাস করার জন্য
ল্যান্ড এডভাইসারি কমিটির অনুমোদন রয়েছে তাদের।' কাগজপত্র দেখিয়েও কোন লাভ
হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে এসব নাকি ভুয়ো। সরকারি রেকর্ডে এটা শুধুই এক জলাভূমি, যা আজ
খালি করাতে হবে যে কোন মূল্যে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে সতীশের। দিব্যাংশুকে
বারবার ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল সুইচ অফ রয়েছে তার। ব্যক্তিগত অসুবিধার
কারণে বুলডোজারের সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়াতে পারছে না সে নিজেও। শ পাঁচেক
অসহায় নারী পুরুষ অপেক্ষায় প্রহর গুনছে বাস্তুচ্যুত হওয়ার। ঠিক এমন সময়
দুর্গাবিলের দক্ষিণ দিক থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে 'জয় ভীম, জয় ভারত'। সতীশ
বুঝতে পেরেছে এটা দিব্যরই কাজ। নিজের অজান্তেই তার ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠলো। 'জয় ভীম, জয় ভীম' বলে
চিৎকার করতে থাকলো কর্তৃপক্ষের সামনে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যতীনকে বলল - 'আর
প্রতিবাদ করে কাজ হবে না দাদা,
সবাইকে নিয়ে প্রতিরোধে নেমে পড়ো। দিব্য আসছে।' মুহূর্তের
মধ্যে 'জয় ভীম' ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল দুর্গাবিল। নারী-পুরুষ সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে
পড়ল বুলডোজারের উপর, শুরু হল পুলিশ জনতা খণ্ড যুদ্ধ।
শতাধিক
মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করে দুর্গাবিলের দিকে এগিয়ে আসছে দিব্যাংশু। মাইকযোগে
প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরছে সতীশের জোগাড় করা তথ্যগুলি। কুচক্রী জনপ্রতিনিধি এবং
ভূমাফিয়াদের নাম উল্লেখ করে ধিক্কার সূচক বক্তব্য রাখছে সে এবং পার্শ্ববর্তী
জনগণের প্রতি আবেদন রাখছে এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। এদিকে
পূর্ব নির্ধারিত সূচী অনুযায়ী আজই মোর্চার প্রতিটি মণ্ডলের মিটিং চলছিল। গুগল মিট
এর মাধ্যমে মোর্চার জেলা প্রধান হিসাবে কথা ছিল দিব্য মত বিনিময় করবে তাদের সাথে।
হরিভানু নিজের মোবাইল দিয়ে সেই মিটিংয়ে সম্প্রচার করে দিয়েছে দিব্যোর এই
প্রতিবাদী কার্যসূচি। কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিকদের পাশাপাশি দিব্যর
কিছু ছেলেরাও দুর্গাবিলের উচ্ছেদ অভিযানের মর্মান্তিক দৃশ্য লাইভ টেলিকাস্ট করছে
বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যম নেটওয়ার্কে। এসবই দিব্যর মস্তিষ্ক প্রসূত।
দিব্যাংশুর
আবেদনে কাজ হয়েছে। ধীরে ধীরে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে মানুষ। গোটা উপত্যকার বিভিন্ন
প্রান্ত থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে দুর্গাবিলের
অসহায় জনগণের আর্তনাদ পৌঁছে গেছে সর্বত্র। উপত্যকার হাওর এবং প্রান্তিক অঞ্চলগুলি
থেকে শ'য়ে শ'য়ে জনতা গাড়ি করে শহর অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার ভিডিও আসছে ঘন ঘন।
অল্প সময়ের মধ্যেই 'জয় ভীম, জয় ভারত' স্লোগান সম্বলিত পোষ্টে ছেয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালগুলি।
এদিকে সতীশকে পুলিশের লাঠির আঘাত থেকে বাঁচাতে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পরল দিব্যাংশু।
বাহুবলে ছুড়ে ফেলল কয়েকজন পুলিশ কর্মীকে। দিব্যাংশুকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে
দুর্গাবিলের পীড়িতরা উজ্জীবিত হয়ে উঠল নতুন উদ্যমে। তাদের আর্তনাদ হয়ে উঠল
আক্রমণের ডাক। আহত সতীশের মনে হল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, দিব্যাংশুই
যেন ঐতিহাসিক চরিত্র দিব্বোক!
প্রায়
ঘন্টাখানেক পর উপর মহলের টনক নড়েছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বন্ধ হয়েছে
দুর্গাবিলের উচ্ছেদ অভিযান। স্থানে স্থানে রুখে দেওয়া হয়েছে শহর অভিমুখে আসা
আমজনতার গাড়িগুলিকে। জেলাধিপতি সহ পার্টির জেলা সভাপতি স্বয়ং উপস্থিত হয়ে
আশ্বস্ত করেছে জনগণকে। তবে সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং জনগণকে উত্তেজিত করার
অভিযোগে দিব্যাংশু ও সতীশকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দলীয় অনুশাসন ভঙ্গ করায়
দিব্যাংশু ছয় বছরের জন্য নিলম্বিত হয়েছে পার্টি থেকে।
হরিভানু
অদূরে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজের তৈরি ছকে দুর্দান্ত সাফল্য এসেছে তবুও
চোখ মুখ তার প্রতিক্রিয়াহীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন