॥ পৃথ্বীশ দত্ত ॥
(C)Image:ছবি
সেই ছেলে ও মেয়েটি, কী যেন নাম ? না, তখনও
নাম জানা যায়নি । এখন মেয়েটি উধাও । তবু ছেলেটি রুটিন মেনে যায় ।
ছেলেটি রোজ সেই বৃক্ষের কাছে যায় । তার সাথে কথা বলে । ভাদ্রের তাল পাকা দুপুরে, সূর্যের রৌদ্র শাসনে, তপ্ততা যখন দিগন্তব্যাপী, ছেলেটি তখন অশ্বত্থ ছায়ের শীতলতায় বসে নিঃশব্দে গল্প করে । গল্পের ছলে খেলা করে । বুকের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামে বেদনার পাথর । একটু হালকা লাগে । আবারও পাথর গড়িয়ে নামে । বার বার । এ যেন বুক ও দহনের নিরন্তর খেলা !
সহস্র প্রসারিত হাতে ছায়া মেলে রাখে অশ্বত্থ গাছ । গাছ নয়, সে বৃক্ষ । সেও কথা বলে ছেলেটির সাথে । তার চপল পল্লব হেসে হেসে প্রমোদ ছড়ায় । ভালো লাগা দিতে চায় পরম আশ্রিতকে ।
কোন মানুষ এখানে আসে না । কোনও প্রয়োজন নেই এখানে আসার । জঙ্গলাকীর্ণ চারপাশ । তবু এই নির্জনতা ভরে আছে কত স্মৃতি, কত কথার গুঞ্জন, কত স্পর্শের উষ্ণতায় । এখানেই ওরা বসত । গল্প করত, গল্প রচিত করত দুজনে । সেই গল্পের ভাষা বৃক্ষটি জানত। সে শুনতে পেত তাদের কথার গভীরে কত স্বপ্নের ধ্যান । আজ ছেলেটি মৌন । তবু কিসের টানে সে বৃক্ষের পদতলে আসে ! স্মৃতি সততই নির্জনতা বিলাসী ।
একদিন সেই বৃক্ষের প্রসারিত শেকড়-চরণে ছেলেটি বসত মেয়েটিকে নিয়ে । সে কোনও একদিন । তরল স্বপ্নের রঙ নিয়ে নিবিড় লোফালুফি খেলত । গল্পের মৃদুভাষ ছড়িয়ে পড়ত বৃক্ষের শরীর জড়িয়ে । কল্পকালির টানে নানা স্বপ্নের কোলাজ এখানেই রচিত হত । এই অশ্বত্থ জানে প্রেমিকের মায়া মেদুরতা । সে জানে প্রেমের কথামালা কেমন করে কাব্য হয়ে ফুটে ওঠে । সে জানে প্রেম ও প্রতারণার অলৌকিক সম্মোহন । রঙ মুছে গেলে ক্যানভাসের পাতাগুলো বারবনিতার মত আরোপিত রূপ নিয়ে পড়ে থাকে ।
ছেলেটি এখন একা । এখন সে অবসাদে নিথর । তার স্বপ্নময় মারীচ হরিণী । তবু সে অশ্বত্থের কাছে যায় । অশ্বত্থই তার প্রেমের সাক্ষী । তার কাছে বসে, তারই কোলে শরীর এলিয়ে স্মৃতি-তর্পণে ডুবে যায় । কত কথা কত গল্প, স্বপ্ন ভাঙার আকুল ঢেউ আছড়ে পড়ে মনতটে । এ বড়োই বেদনাসুধা । এই বৃক্ষের বাকলে এখনো খোদাই করা আছে মেয়েটির নাম l যেন সে মেয়েটির ধারক । জড়িয়ে রাখে বাকলাঙ্গের নীরব মমতায় । গাছেরও প্রাণ আছে । গাছেরও প্রেম আছে । সে ছেলেটিকে নিঃশব্দে ডাকে-- ওরে আয়, আয় আয় !
হঠাৎ একদিন এই নির্জন বৃক্ষের চারপাশ ঘিরে মানুষের ভিড় । পুলিস এলো । এলো এম্বুলেন্স । ছেলেটি সত্যিই গাছ হয়ে গেল । গাছেই বিলীন হল অদৃশ্য আকুতি । কারণ, গাছেরও প্রেম আছে ।
কিন্তু তার শরীরটা চলে গেল লাশকাটা ঘরে । মেয়েটি তখন হ্যানিমুনে মত্ত নৈনিতালে । বরফ ও উষ্ণতা নিয়ে মাখামাখি খেলছে তার নিজস্ব পৃথিবীতে, আপন মানুষের সাথে ।
জানা গেল সেই ছেলেটির নাম আবেগ । মেয়েটি মায়া ।
***