১৮ মে, ২০১৪ যুগশঙ্খ |
অসমীয়া মধ্যশ্রেণির বোধোদয় ও বাঙালি উদারতা
সম্প্রতি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অসমীয়া মধ্যশ্রেণির ইতিহাস নিয়ে মূল্যবান গ্রন্থের লেখক ড০ প্রফুল্ল মহন্তের একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে অসমীয়া এক দৈনিক কাগজে। এই নিবন্ধে লেখক অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া থেকে জনজাতীয়দের দূরে ঠেলে দিয়ে অসমীয়া জাতির ধ্বংস ডেকে আনার জন্য অসম সাহিত্য সভা, কংগ্রেস সরকার ও অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজকে দায়ি করেছেন। গণতন্ত্রের প্রতি এই সজাগতা তার স্বাভাবিক নিয়মে আরও নতুন গঠনমূলক দিক উন্মোচিত করে। এই লেখাটি আসলে অসম সাহিত্য সভার কোন এক অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপ। অসম সাহিত্য সভার মত এক জনপ্রিয় অসমীয়া জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রতিষ্ঠানে এধরনের খোলাখুলি বক্তব্য পেশ এটাই দেখায় যে আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদের দীর্ঘ ইতিহাস অসমীয়া জাতিরও যে সমূহ ক্ষতি সাধন করেছে এই উপলব্ধি অসমীয়া মধ্যশ্রেণির মননে জায়গা করে নিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করেই যে উগ্রজাতিয়তাবাদ তার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে এই উপলব্ধি গড়ে ওঠা জরুরি এবং তার থেকেও জরুরি একে প্রতিহত করার কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা। তবে এই মধ্য শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগেই আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসের লুক্কায়িত তথ্যগুলি একে একে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। অন্য জাতির কল্যাণ সুনিশ্চিত না করে কোন জাতি নিজের কল্যাণ সুনিশ্চিত করতে পারে না – এটাই মানব সভ্যতার অমোঘ নিয়ম। কিন্তু ইতিহাসের করুণ পরিহাস এই যে আসামকে বধ্যভূমি করে তুলে, আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসে বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের লাগাতার গণহত্যার মুখে ঠেলে দিয়ে মানব সভ্যতার এই শিক্ষা নিতে হচ্ছে। এই শিক্ষা কতটা গভীর তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু নিবন্ধের লেখক যদি আরও একটু পেছন দিকে তাকাতেন তাহলে কী তিনি বাঙালির উদারতা - মহৎ আবেগপ্রবণতাকে আবিষ্কার করতেন, না তিনিও আঁতকে উঠতেন কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির ভূমিকার কলঙ্কিত অধ্যায়কে দেখে। এই আঁতকে উঠার কাহিনী নিশ্চিতভাবে একমাত্রিক নয়, এই শ্রেণির অভ্যন্তরেই তার প্রতিকল্প নির্মাণের প্রয়াস নিরন্তর অব্যাহত ছিল। কিন্তু যা প্রাধাণ্যকারী ভূমিকায় ছিল তা আঁতকে ওঠার মতই বৈকি।
ব্রিটিশ প্রভাবান্বিত বাংলার ভাষিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ
ইতিহাস ব্যাখ্যার পদ্ধতির প্রভূত উন্নতির পরও অতীত ও চলমান ঘটনাকে কিছু লক্ষণ ও তথ্য দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা সাধারণকে আচ্ছন্ন করে রাখে – বিশেষ করে বরাক উপত্যকার মত অঞ্চলে যেখানে ইতিহাস চর্চা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু পরিচিতি ও সংস্কৃতির বলয়কে চেনার জন্য শুধুমাত্র চর্চার অভ্যন্তরিণ কাঠামোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চলে না, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে এই চর্চা নির্মিত হয়েছে তার দিকেও তাকাতে হয়। ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল শাসকদের বাংলায় পদার্পণ ও কলকাতায় প্রথম রাজধানী গড়ে ওঠা বাংলার ভাষা-সংস্কৃতিকে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। উপনিবেশিক শাসনের ছত্রছায়ায় ও মদতে অতীত সাবলিল বাঙালি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় ছেদ ঘটিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির যে নতুন বয়ান তৈরি হয় তাকে খণ্ডন করার প্রভূত প্রয়াস সত্ত্বেও বাঙালির হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির মননকে এখনও এই বয়ান আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই এখনও যখন মধ্যযুগকে অন্ধকারময় ও যে সময়ে অসমীয়া জাতিয় চেতনা গড়ে ওঠেনি সেসময়কার অসমীয়াদের প্রতি কলকাতার বাঙালি ব্যক্তিত্ত্বের ভূমিকা ও অবদানকে বাঙালির উদারতার লক্ষণ হিসেবে যখন বরাকের কোন বুদ্ধিজীবী উল্লেখ করেন, তখন মর্মাহত হতে হয় বৈকি। কারণ এভাবে দেখার মধ্যে ব্রিটিশ প্রভাবে কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিদাম্ভিকতার সংমিশ্রণে নির্মিত রেঁনেসার বয়ানেরই পুনরুল্লেখ হিসেবে প্রতিভাত হয়। যদুনাথ সরকারের মত ইতিহাসবিদ এই প্রভাবেই জটিল ইতিহাসকে অতি-সরলিকরণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। ১৭৭০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষকে এঁরা ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠনের রাজত্বকে কখনও দায়ি করেননি। ব্রিটিশ রাজত্বকে কল্যাণকামী হিসেবে দেখার মধ্য দিয়েই জাতিয়তাবাদী রাজনীতির সাথে এক বড়সড় বিচ্ছেদ রেখা টানা হয়। এখান থেকেই নির্মিত হতে থাকে ভদ্দরলোকি আদবকায়দা, হিন্দু সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতা, মুসলমানদের অপর ভাবা, ভাষাকে মুসলিম প্রভাব মুক্ত করা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে নতুন ভাষিক-সাংস্কৃতিক বয়ান। এর পেছনে ছিল এই শ্রেণির জমিদার-মহাজনী স্বার্থের ভাবাবেগ এবং এজন্য এরা কৃষকদের উপর হওয়া কোন অত্যাচারকেই দেখতে অপারগ ছিলেন। তবে এর বিরুদ্ধ বয়ানও এই শ্রেণিভুক্ত কিছু বুদ্ধিজীবীরা নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু এরা কখনওই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে অষ্ট্রীয়া থেকে এক লেখায় সুভাষ বোস ভারতীয় ইতিহাসে ‘মুসলিম যুগের’ উল্লেখের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধকে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলা বিভাজনের ক্ষেত্রে এই বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির ভূমিকাই যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জয়া চাটার্যি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড গ্রন্থে। তাদের আধিপত্য কায়েম করতে তারা বাংলা বিভাজনকে কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন, এর বিনিময়ে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরণেও তাদের আপত্তি ছিল না। সি আর দাশের প্রজা-কৃষক পার্টিকে তারা হেয়র চোখে দেখতেন এবং পরবর্তীতে বাংলা বিভাজন রোখার জন্য শরৎ বোস ও আবুল হাসিমের প্রস্তাবকেও তারা আমল দেয়নি। ব্রিটিশ শাসনের আশ্রয়ে এই শ্রেণিটি যে কীভাবে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে এবং নিম্নবর্ণীয়দের অধিকারের প্রতি উদাসীন থেকেছে তার ব্যাখ্যা পাই আমরা ইতিহাসবিদ শেখর বন্দোপাধ্যায়ের কাস্ট, পলিটিকস অ্যাণ্ড দ্য রাজ গ্রন্থে। মুগল আমলে প্রতিপত্তিশালী কৈবর্ত জমিদার ও স্বচ্ছল কৈবর্ত সমাজের সন্ধান পাওয়া যায় মেদিনীপুর অঞ্চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন মধ্যশ্রেণির সৃষ্টি করে তাতে নিম্নবর্ণীয়রা চিরতরে অধিকারহীন ব্রাত্যতে পর্যবসিত হন। ব্রিটিশদের প্রতি এই নব্য-মধ্যশ্রেণির আনুগত্য ও মুসলিম ও নিম্নবর্ণীয় কৃষক প্রজাদের প্রতি তাদের অবজ্ঞার কারণটি এভাবেই বোঝা যায়। সুতরাং অসমীয়া জাতিয় চেতনা যখন বিকশিতই হয়নি তখন কিছু সংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অসমীয়াদের প্রতি উদারতার সাথে ব্রিটিশ আনুগত্যে নির্মিত মতাদর্শের কোন বিরোধ ছিল না। তাই এই উদারতার নিদর্শনে আমাদের পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বাংলার কায়স্থ সমাজটি যে হিন্দি বলয়ের মত গঠিত হয়নি, তা গঠিত হয়েছিল করণিক শ্রেণি থেকে, যাদেরকে মনু উল্লেখ করেছিলেন ব্রাত্য-কায়স্থ হিসেবে, তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিত্রলেখা গুপ্ত তাঁর দ্য কায়স্থ – এ স্টাডি ইন দ্য ফর্মেশন অ্যাণ্ড আরলি হিস্টরি অব এ কাস্ট গ্রন্থে দেখিয়েছেন। এটা সম্ভবত একটা কারণ যে উপরিকাঠামোয় বাঙালি বর্ণহিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে একটা নমনীয়তাও ছিল এবং এদের মধ্য থেকেই বিরোধিতাও উঠে এসেছিল, কিন্তু সেই বয়ান কখনওই প্রাধান্যকারী অবস্থান নিতে পারেনি। ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগকে বিশিষ্টতা দেওয়ার প্রবণতার মধ্যেও খামতি রয়েছে। দেশ-রাষ্ট্রের সীমানাবিহীন ভাষিকগোষ্ঠী ভাষাকেই আবেগের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, দেশ-রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট হয়ে গেলে ভাষা ও দেশের আবেগ এক জায়গায় মিলে যায়। ভাষিক আবেগ যে গোষ্ঠী আবেগ ও স্বার্থের সীমানা অতিক্রম করেনি বাংলা বিভাজনের ইতিহাসই তার প্রমাণ। এবার বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের সমস্যা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।
নতুন পরিস্থিতিতে উনিশের ঐতিহ্যের পুনর্নিমাণ
বরাক উপত্যকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা যে সাম্প্রদায়িকতা একথা যে কোন পর্যবেক্ষকই স্বীকার করবেন। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা বঞ্চিত এবং তাদের ভাষাও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মত আক্রান্ত। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরাই আক্রান্ত। এই আক্রান্তরা পরিচিতির দিক দিয়ে মূলতঃ বাঙালি-মুসলমান হওয়ায় এখানকার ভাষা-সচেতন বাঙালি হিন্দু সমাজ কি আক্রমণকারীদের মিথ্যা ভাষণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না? নিম্ন অসমের অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে বাংলাদেশি তকমা সেঁটে দিয়ে প্রকারান্তরে হত্যালীলাকেও কি বৈধতা দেওয়া হয় না? এভাবেই তৈরি হয় আক্রান্তদের মধ্যেই আক্রমণকারীর মানসিকতা যে মানসিকতার বশবর্তী হয়েই ভাষা আন্দোলনে শহিদত্ব বরণ করা এই বড়ো জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীরা আজ হত্যার রাজনীতি করছে। শাসক শ্রেণির বঞ্চনা ও মতাদর্শের কাঠামোটি এতই সর্বগ্রাসী ও সুক্ষ্ম যে তা এক বঞ্চিতদের অপরের বিরুদ্ধ লেলিয়ে দিতে পারে। এখানে রাষ্ট্র কাকে মদত দিচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই আক্রান্তরা আক্রমণকারী হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে রাষ্ট্রের এই মদত গ্রহণ করতে প্রস্তুত করে রাখে। মতাদর্শের এই প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে না পারার ক্ষেত্র তৈরি হয় চিন্তা ও কাজের দৈন্যতা থেকে। চিন্তা ও কাজ পরস্পর সম্পৃক্ত। কিছু পূর্বধারণা, কিছু প্রতীক, কিছু প্রচলিত বয়ানকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে মস্তিষ্কের রসায়নকে নিয়ন্ত্রণ করলে কিছু স্টিরিওটাইপ তৈরি হয়। যে প্রতিবেশিকে বাস্তবে দেখা হলো না, আবার যদি বা দেখা হলো তাকে জানার চেষ্টা করা হলো না, কিন্তু তার সম্বন্ধে একটা মত তৈরি করে নেওয়া হলো। এভাবে যে মতটি নিজের বলে ভাবা হলো তা আসলে প্রচলিত আধিপত্যকারী মত। এভাবেই শাসক শ্রেণি তার বয়ানকে চাপিয়ে দেয় এবং মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করার সুপ্ত স্পৃহার বাস্তবায়নের সহজ পথ খুঁজে নেওয়া হয় শাসক শ্রেণির সাম্প্রদায়িক হাতিয়ারের মধ্যে যেখানে কিছু সংখ্যককে অপর বানিয়ে একটি ধর্মীয় বয়ানে অন্যদের উপর আধিপত্য স্থাপন করা যায়। বরাকের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তার উপর এই সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের আধিপত্য বিস্তারের আরেকটি সুবিধে রয়েছে। যেহেতু বরাক উপত্যকার বিশেষ করে শিলচরের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিটি মূলতঃ তৈরি হয়েছে তাদের দিয়ে যারা ছিন্নমূল হয়ে এখানে এসেছিলেন। সুতরাং ছিন্নমূল হওয়ার মর্মবেদনা এবং অতীত সচ্ছলতা হারানোর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে চোখে দেখা, বাস্তব অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনা আংশিক ঘটনাকে তারা সাধারণীকরণ করে ফেলেন এবং তাদের অপরকে খুঁজে পান। সাম্প্রদায়িকতার এই সুবিধা দূর করতে পারে নির্মোহ ইতিহাস চর্চা। বরাক উপত্যকার শিক্ষিত সমাজ হিসেবে আমরা এব্যাপারে বড্ডই স্থাণু। একষট্টির ভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ও বরাকের সমাজে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির শেকড় প্রোথিত করার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডী অতিক্রম করে আম কৃষক-জনতার মধ্যে কোন যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হলো না। ফলে একদিকে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন যেখানে নিম্ন শ্রেণির হিন্দু-মুসলমানরা সমাবেশিত হয়েছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাবেশিত হয়েছিলেন উভয়ই পরাস্ত হলো। পরাজয়ের এক দীর্ঘম্যাদী পথ বেয়ে একানব্বইতে এসে সবাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কাছে আশ্রয় নিল। সুতরাং নতুন গণতান্ত্রিক নির্মাণে আমাদের এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষা নেওয়ার সময় আমাদের একথা মাথায় রাখা জরুরি যে আশির দশক থেকে বিশ্বায়নের অঙ্গ হিসেবে যে কাঠামোগত পুনর্গঠণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বরাকের সমাজের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশুদ্ধ কৃষকের সংখ্যা বরাকের গ্রামাঞ্চলে এখন খুবই সীমিত – কৃষকরা একাধারে শ্রমিকও। তাই ভাষা-পরিচিতির অধিকার,জনগোষ্ঠীগত অধিকার ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের প্রশ্নে আমাদের যুগপৎভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এবারের উনিশ হোক এই পর্যালোচনা শুরু করার দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন