“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৪

বাঙালিয়ানা : বর্হিবঙ্গ বা বৃহৎবঙ্গ

                                      ।। পল্লব ভট্টাচার্য।।

   
সাগ্নিক সম্পাদক , আমাদের মিলন দত্ত মশাই যে বাঙালি , নাম-উপাধি দেখে , তা কি বোঝার কোনও উপায় আছে ? চিত্রাভিনেতা সুনীল দত্ত , সঞ্জয় দত্ত বা গুরু দত্তের সঙ্গে যে তাঁর আত্মীয়তা নেই , বুঝবো কীভাবে ? কিংবা অসমীয়া কবি হীরেন ভট্টাচার্যের ছবির পাশে এই অধম ভট্টাচার্যের ছবি রাখলে , চেহারা দেখে কি এই অধমকে বাঙালি বলে চেনা যাবে ? যায় না যে , সেটা অনেক আগেই শ্রদ্ধেয় অতুল সুর মশাই , বলে গেছেন । বাঙালির একটা নৃতাত্বিক পরিচয় দিতে গিয়ে , বিভিন্ন সমীক্ষার উপর ভর করে , শেষ অব্দি তাঁকে এমন একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছুতে হয়েছিল যে দেহ গঠনে অনেকটা আদি অস্ট্রাল বা অস্ট্রিক জনদের চিহ্ন থাকলেও , কোনও একটি বিশেষ নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির পুরোপুরি ছাপ নেই বাঙালিদের মধ্যে । নৃতাত্বিকভাবে বাঙালি একটি সংকর জাতি ।

    তবু , এই জাতিটি যে খুব একটা নতুন নয় ,ঐতরেয় আরণ্যকের উল্লেখ থেকেই একথা বলা যায় । সেই কবে , মহাকবি কালিদাস জানিয়ে ছিলেন , এদের বসতি যেখানে , সেই দেশটা “গঙ্গাস্রোতহন্তরেষু” । গঙ্গার বিভিন্ন স্রোতের মধ্যে অবস্থিত । আবার দ্বিতীয় শতকের ভুগোলবিদ টলেমিও বলেছেন , গঙ্গার সব মোহনাগুলোই গঙ্গারিদাই বা গঙ্গারিদ নামের অধিবাসীদের দেশভুক্ত ।  সুতরাং আজকের বাংলাদেশের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোও এই দেশের মধ্যে ছিল বলা যায় । যদিও ভুখন্ডের সীমা বারবার পাল্টেছে রাজনৈতিক কারণে ।  যেমন পাল ও সেন আমলে বঙ্গ ছিল পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত , আবার গুপ্ত আমলে  বঙ্গ ও পুন্ড্রবর্ধন আলাদা রাষ্ট্রবিভাগ । কিন্তু বঙ্গ , বঙ্গাল বা বাংলা বলে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভুখন্ড তো মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগে আমরা দেখতে পাই না । বিভিন্ন সময়ের ইতিহাসে রাঢ় , সমতট , হরিকেল , তাম্রলিপ্তি , পুন্ড্রবর্ধন এরকম অজস্র জনপদের উল্লেখ পাচ্ছি । ত্রিপুরাকেও পাচ্ছি কখনও হরিকেল সীমার মধ্যে , তো কখনও সমতটের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে । আবুল ফজলের আইনই আকবরীতে পাচ্ছি , সুবা বঙ্গালের উত্তরে কুচ(বিহার)রাজ্য , দক্ষিণে সমুদ্র ও সুন্দরবন (ভাটি) পূর্বে ত্রিপুরা (বর্তমানের কুমিল্লা ও পার্বত্য ত্রিপুরা সহ)ও আসাম , পশ্চিমে বিহার ।

    এই সীমারেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলটি , মোগল আমল থেকে যা সুবা বঙ্গাল হয়ে উঠেছে বিভিন্ন জনপদ মিলে , তাও তো কোনও স্থির ভুগোল নয় । ইংরেজ আমলে এই প্রদেশ তো আরও প্রসারিত হয়েছিল । তাহলে কোন ভূ-সীমাটিকে আমরা বলবো , বঙ্গ বা বাংলা ? কোন ভূ-সীমার বাইরের সমস্ত ভুগোলকে বলবো বর্হিবঙ্গ ? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায় , এই নির্দিষ্ট ভূখন্ড যাকে বঙ্গ বা বাংলা বলা হচ্ছে , সেখানকার অধিবাসীরাই কি বাঙালি ? ১৪৩২ য়ে মা হুয়ান যে ভূখন্ড ভ্রমন করে তাঁর ইং য়াই শেন লান গ্রন্থে লিখেছিলেন ,-“দেশের ভাষা হিসাবে লোকেরা ব্যবহার করতো পঙ্গ-কো(গো)-লি , যা একটি স্বাধীন ভাষা , যদিও লোকে পা-এরহ-সি ভাষাতেও কথা বলেন ।“ প্রথম ভাষা বোঝাতে মা হুয়ান যে তিনটি চীনা লিপি ব্যবহার করেছেন , ব্রতীন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে , তৎসাময়িক উচ্চারণ অনুযায়ী তা হবে বঙ্গালি বা বাঙ্গালি । এই বঙ্গালি বা বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন , তাদের স্বাভাবিকভাবে বঙ্গালি বলা হবে । যে ভাষায় কথা বলে বা লিখে চর্যাপদের কবি ভুসুক বঙ্গালি হয়েছিলেন , সেই ভাষাভাষী মানুষের প্রধান বাসভূমিটিকে তো স্বাভাবিক কারণেই বঙ্গালি -বঙ্গাল-বঙ্গ বা বাংলা বলা হবে । যদি এই যুক্তি গ্রাহ্য করা যায় , তবে বলতে হয় , বাঙালি নৃতাত্বিকভাবে কোনও বিশুদ্ধ নরগোষ্ঠি না হলেও ভাষাভিত্তিক জাতিতে বা গোষ্ঠিতে পর্যবসিত হয়েছিল বহুবছর আগেই । আর এই ভাষাভিত্তিক জাতিটি , আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ,” দেশের জলবায়ু ও তাহার আনুষাঙ্গিক ফলস্বরূপ এই দেশের উপযোগী বিশেষ জীবনযাত্রার পদ্ধতিকে অবলম্বন করিয়া….গত সহস্র বৎসর ধরিয়া যে বাস্তব , মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি “ গড়ে তুলছেন , “তাহাই বাঙ্গালী সংস্কৃতি “।

    আজকে যখন সেই বিশেষ ভূ-খন্ডটি রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত ; যখন সেই বিভাজিত বাংলার একটি অংশ ভাষা রক্ষার তাগিদে সংগ্রাম করে , বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে , তখন ভারতের একটি প্রদেশ , পশ্চিমবঙ্গ কীভাবে ‌'বর্হিবঙ্গ‌ শব্দটি ব্যবহার করবে ? বর্হিবঙ্গ বলতে কি তাহলে , ভারত রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশটির বাইরের অঞ্চলগুলোকেই বোঝাবে ? তবে তো , বাংলাভাষী মানুষের মূল ভূ-খন্ডটির অস্তিত্বকেই এই বঙ্গ চিন্তার বাইরে রাখতে হয় । আবার বৃহৎবঙ্গ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়  কাঠামো , এবং রাজনৈতিক ভূগোল নিশ্চিতভাবেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ।

    অথচ কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবিগণ , পশ্চিমবঙ্গের বাইরের বিভিন্ন প্রদেশ বসবাসকারী বাঙালিদের নির্দ্বিধায় বর্হিবঙ্গীয় বলে চিহ্নিত করে চলছেন বিগত কয়েক দশক ধরে । সে জন্যই প্রথম যে প্রশ্নটা দিয়ে আমরা কথা বলা শুরু করেছি , তা এই যে বাঙালিকে বাঙালি বলে চিনবো কীভাবে ? উপাধি , নাম বা চেহারায় ভারতবর্ষে বাঙালিকে আলাদা ভাবে চেনার খুব একটা সুযোগ নেই । আমি যে রাজ্যের বাসিন্দা , সেই ত্রিপুরায় ককবরকভাষী জনজাতির মানুষ বাঙালিদের বলেন ,-ওয়ানছা । কথাটির শব্দগত অর্থ অদ্ভুত বা আশ্চর্য মানুষের ছেলে । এবং এই মোঙ্গলয়েড জনগোষ্ঠির মানুষদের মধ্যে দাঁড়ালে , আমার আলাদা চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । যাতে করে আমি বা যে কোনও দর্শকই চেহারা দেখেই বুঝতে পারে আমার আলাদা জাতিসত্তাটি । যা কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে দাঁড়ালে কিন্তু হবে না । এখানেই পশ্চিমবঙ্গীয় দৃষ্টিতে বর্হিবঙ্গীয় আমার সুবিধা । আমার আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি  এখানে অন্তত কোনও দ্বিধার সৃষ্টি করে না । উপরন্তু যে ভাষার কারণে আমার জাতিসত্তাটি চিহ্নিত , তাও কোনও প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হয় না । কারণ , মোগল আমলে গৌড়বঙ্গ যখন ফারসীকে রাজভাষা হিসাবে মেনে নিয়ে , ফারসী শিখে চাকরির উমেদারীতে ব্যস্ত , তখন থেকে এই রাজ্যের রাজভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃত এবং রাজকীয় আদেশগুলো বাংলাতেই বেরুতো ।

    কলকাতাকেন্দ্রিক যে পশ্চিমবঙ্গীয় মেধা আজ , ভিন্ন প্রদেশে বসবাসকারী বাঙালিদের বর্হিবঙ্গীয় বলে চিহ্নিত করছেন , তার পেছনে রয়ে গেছে নিজেকে কেন্দ্র ভাবার সেই প্রচল অভ্যাস এবং কলোনির ঘোর । এটা এমন নয় যে , একটা শব্দমাত্র । এই শব্দ ব্যবহারের মনোভঙ্গিটি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে । আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে সুবিধা পাওয়া সেই মন , প্রতিপত্তিপ্রবণ হয়ে নিজেকে ক্ষমতাকেন্দ্র ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল । ক্ষমতার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ীই তা সার্বিক কর্তৃত্ব চায় । তার ইচ্ছা ও রুচির চেয়ে আলাদা সমস্ত কিছুকেই সে হয় তাচ্ছিল্যে হীন বানিয়ে তোলে , নয়তো অবহেলায় ‘বাহির’ করে রাখে । একটা সময় অব্দি অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিদের মধ্যে নিজেদের রুচি চারিয়ে দেয়া গেলেও , কলকাতা আজ আর তার সত্তায় বাঙালিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করার অবস্থায় নেই । দেশ বিভাগ তার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির হানি ঘটিয়েছে । আর হয়তো তাই , আপ্রাণ সে তার বাঙালিয়ানাকে বিসর্জন দিয়ে , কোনওক্রমে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে চাইছে । তার পোষাকে এখন আর বাঙালিত্বের চিহ্ন নেই । আন্তর্জাতিকতা স্পষ্ট । এমন কি সামাজিক অমুষ্ঠানেও এই পোষাক তাকে বিড়ম্বিত করে । খাদ্যাভাসে সে এখন কসমোপলিটান । এমন কি , দুর্গাপূজা ছাড়া একটি উৎসবও তার নেই , যাকে সে বাঙালির উৎসব বলে চালাতে পারে । তারপরও , যে বাংলাভাষায় তার আত্মপরিচয় নিহিত , সেই বাংলাভাষাটিও সে হারিয়ে ফেলছে অবহেলায় । এখন সে যদি কথা বলে তাও বাংলায় নয় , বাংলা হিন্দি ইংরাজির এক জগাখিচুরি ভাষায় , আর এই খিচুরি ভাষাটাকেই সে চলমান বাংলা বলে চারিয়ে দিতে চাইছে চারপাশে । এটা নতুন কোনও প্রবণতাও নয় , যখন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধার সুযোগে কৃষ্ণনাগরিক বুলিটিকে মান্যভাষা ধরে নিয়ে , বৃহত্তর অংশের বাংলাটিকে উপভাষা বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় নি , সেই উপভাষাভাষী মানুষগুলোকেও অবজ্ঞা ও ঠাট্টার পাত্র করে তুলেছিল , সেই তখনই , মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছিলেন ,” বাঙাল দেখিলে আমরা ঠাট্টা করিতাম ও উৎপাত করিতাম ।“ তখন থেকে বাঙালি ও বাংলাভাষাকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া শুরু হয়েছিল । তবুও সেই সময় অবিভক্ত বাংলার রাজধানীর মর্যাদা ছিল বলে , অনেকেই কলকাত্তাইয়া হতে চাইতো । না পারলে সধবার একাদশীর রামমানিক্যের মতো ভাবতো , “এত কইরাও কলকত্বার মত হবার পারলাম না , তবে এ পাপ দেহেতে আর কাজ কি , আমি জলে জাপ দিই ।“

    আজ যখন বাংলাদেশ নামে এক আলাদা রাজনৈতিক সীমারেখা তৈরি হয়ে গেছে ভাষার ভুগোলেও , তখন ঠাট্টা উৎপাত সহ্য করা বাঙাল ভাষাও কবি আল মাহমুদ , সৈয়দ শামসুল হক , মজনু শাহ , ব্রাত্য রাসু বা মুজিব ইরমদের হাতে হয়ে উঠেছে নান্দনিকতার অস্ত্র । কলকাতা যখন ৩১ ডিসেম্বরের রাতে নববর্ষ পালনের হুজুগে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে ব্যস্ত , তখন ১লা বৈশাখকে ঘিরে বাংলাদেশ গড়ে নিয়েছে বাংলার এক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের রূপ । আর এভাবেই পশ্চিমবঙ্গীয় মূলস্রোতের ধারণাটি আজ আর কোনওভাবেই বাংলাভাষা বা বাঙালিয়ানাকে প্রভাবিত করার অবস্থায় থাকে না ।

    তবুও ‘বর্হিবঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করে সে তার পুরনো প্রতিপত্তির ঘোরটিকেই জানান দিতে চায় হয়তো , কিন্তু এই শব্দটি যাদের প্রতি ব্যবহার করা হচ্ছে , তাদের অবস্থান থেকে এই শব্দটি যে কতদূর অবমাননাকর , তা না ভাবলে , ক্ষতি কিন্তু বাঙালির এবং বাংলাভাষারই ।

    মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর সময় থেকে বা তারও আগে , ক্ষমতার নির্যাতন আর অপমানের যন্ত্রণা নিয়ে বাংলার বহু মানুষ এক বসতি থেকে অন্য কোথাও বসতি গড়ে নেওয়ার জন্য বাধ্য হয়েই ভেসে গেছেন । বহু আকাঙ্খিত স্বাদহীন স্বাধীনতা , বাংলার বহু মানুষকে ভাসিয়ে নিয়েছে এখানে সেখানে । তাদের ভুগোল পাল্টেছে । অভ্যাস পাল্টেছে , তবুও তারা ধরে রেখেছেন তাদের ভাষা । কোথাও এই ভাষাটিকে ধরে রাখার জন্য প্রাণও দিয়েছেন আর আপ্রাণ যুদ্ধ করে চলেছেন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে । স্বাধীন ভারতবর্ষে তাদের ব্যাক্তি পরিচয় মুছে , হীনমন্যতাসূচক এক গোষ্ঠি পরিচয় দেওয়া হয়েছে ,-উদ্বাস্তু ।

    আজ যাদের বর্হিবঙ্গীয় বলে পরিচয় দিয়ে আলাদা করা হচ্ছে , তাদের একটা বড় অংশ এই শিকড় উপড়ানো মানুষ বা তাদের উত্তরপুরুষ । তাদের ধারণ করার মতো স্থান পশ্চিমবঙ্গের ছিল না বলেই , তাদের ছড়িয়ে পড়তে হয়েছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন  প্রদেশে । বহুভাষিক সমাজের বাসিন্দা হয়েও , তারা বাংলাভাষাকে ভুলেন নি । ভাষা রক্ষার প্রশ্নে আসামের বরাক উপত্যকায় তাদেরই ১১ জন শহীদ হলেও , একমাত্র মনীষ ঘটক ছাড়া পশ্চিমবঙ্গীয় উন্নাসিকতা ১৯শে মে’কে স্মরণ করার প্রয়োজন বহুদিন অনুভব করে নি । আজ যখন খোদ পশ্চিমবঙ্গেই বাংলাভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন , তখন কোনও কোনও সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে দিনটিকে স্মরণ করছেন সত্য , কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে কতদূর অনুভব করতে পারছেন , এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায় ।

    পশ্চিমবঙ্গীয় পরিসরে আজ বাংলা বলা ক্রমশই লজ্জাস্কর হয়ে উঠছে । টিকে থাকার জন্য সে ভুলভাল হিন্দি আর মুখ বাঁকানো ইংরেজির দিকে ছুটিয়ে নিয়ে চলছে তার উত্তরপুরুষকে । আমার ছেলেটা না একদম বাংলা পড়তে পারে না ,-বলে আত্মশ্লাঘা বোধ করছেন যে মা-বাবা , তাদেরই কেউ কেউ , উত্তরপূর্বের বাঙালিকে বাংলা বলতে শুনে , অবাক হয়ে বলেন , বাব্বা , আপনি এত ভাল বাংলা জানেন ! আসলে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যে বাঙালি রয়েছে , তারা জীবনযাপনে অনেকদূর অবাঙালি হয়েও , বাংলাভাষাটিকে ঘিরে যে তাদের বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন , এই সামান্য আত্মীয়তাসূচক খোঁজখবরটিও তারা এতদিন রাখেন নি । রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন নি । আজ হঠাৎ তারা বর্হিবঙ্গীয় খোঁজার চেষ্টা করছেন , কিছুটা প্রয়োজনের তাগিদে । ভাষা ও সাহিত্যের বাজারটি খোদ পশ্চিমবঙ্গেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে । সীমান্ত পেরুনোয় আরোপ হয়েছে বিধিনিষেধ । তাই ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসকারী বাঙালিদের বর্হিবঙ্গীয় বলে নিজেকে প্রসারণের এই চেষ্টা , অনেকটাই দায়ে পড়া গোছের ।

    জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে , রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বাঙালি যখন আজ বিশ্বময় ভ্রাম্যমান , বহুভাষিক জগতের বাসিন্দা ; ঐতিহাসিক কারণেই বাংলার ভুগোল তখন বহুধাবিস্তৃত , বহু দ্বীপ সমন্বিত । এই সময়ে , কোনও একটি অঞ্চলকে  বাংলার কেন্দ্র ধরে নিয়ে , বর্হিবঙ্গ বা বৃহৎ বঙ্গের ধারণাটি প্রসারিত করার ইচ্ছা কোনও অর্থেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না ।

    আজ যদি বাংলাকে বাঁচতে হয় , বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় , তবে মেনে নিতে হবে তার বহু দ্বীপ সমন্বিত চরিত্রকে । কোনও কেন্দ্রীয়তার বাঁধনে নয় , তাকে বাঁধতে হবে বাংলাভাষার বন্ধনে । যেখানে দাঁড়িয়ে কোনও তরুণ কবিকে যেন বলতে না হয় ,-‘ঢাকা আর কোলকাতা , পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে ভৌগোলিকভাবে দুটোই পশ্চিমবঙ্গ !’ ‘হায় আত্মবীর্য , হায় বখরাসর্বস্ব চেকপোস্ট , বাংলাভাষা….’!

    কলকাতার কেন্দ্রিক চরিত্র এই বাংলাভাষাটিকেই হারিয়ে ফেলছে । তাই ইদানিংকালে বইয়ের দেশ পত্রিকায় কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে এক সাক্ষাৎকারে বলতে হয় ,-“কলকাতার মানুষ তার ভাষা ভুলে গিয়েছে । আমার তো ভাষাগত আত্মপরিচয় । তাই ভয় হয় , কলকাতায় এলে বাংলা ভুলে যাব ।“

    বাংলাভাষা এখন আর কলকাতায় নয় , বেঁচে আছে গ্রামে গঞ্জে , বিশ্বের বিভিন্ন কোণে , কিছু ব্যাক্তিগত ও গোষ্ঠিগত প্রচেষ্টায় ।ভাষাভুগোলের এইসব খন্ড খন্ড অঞ্চলগুলো , যাকে মূলস্রোতের বাইরের করে রাখা হয়েছে , গ্লানি ও বেদনায় এই অঞ্চলগুলো যদি হারিয়ে যায় ভাষার ভুগোল থেকে , তা কি সেই ভাষাভুগোলেরই ক্ষতি নয় ? পশ্চিমবঙ্গীয় মেধাকে আজ ভাবতে হবে , বাহির বা বৃহৎ ধারণার বাইরে গিয়ে , ভাষার প্রশ্নে একটি নতুন ভুগোল গড়ে নেয়ার ভাবনা । যেখানে অন্তত ভাষাগত আত্মপরিচয়ের সূত্রে গড়ে উঠবে নতুন বাঙালিয়ানা ।

কোন মন্তব্য নেই: