“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৯ জুলাই, ২০২৩

আশ্রিতা

      ছবি : গুগল সৌজন্য 

         " উড়ে এসে জুড়ে বসে এখন সব কিছুতেই কেমন যেন কর্তৃত্ব দেখায় ! একদম ভালো লাগে না! দেখোনা মা! সেদিন সে আমার নামে কেমন আজেবাজে কথা বলল তাই আজ ভাইয়া আমাকে এত কথা শুনালো !"

" ঠিক বলেছিস রে মামনি! ঘরের সবকিছুতেই কেমন যেন দাবি দেখায়! আমার সন্দেহ হয় রে শেষমেশ আমার ছেলেটাকে ও বশ করে নিল নাকি! কেমন যেন মনে হয় ওর কথা একটু বেশিই বিশ্বাস করে আজকাল!"

' হ্যাঁ মা ! এখন থেকে সাবধান না হলে পরে ও এই ঘরের রাজরানী হবে! আমাদের কী হবে! একবার ভেবে দেখেছো তুমি!

'তাইতো ভাবছি! কলির যুগের মেয়ে তো! কোন্ বুদ্ধি মাথায় নিয়ে এখানে এসে উঠেছে! কে জানে? ছেলেটাকে পটিয়ে- ফাটিয়ে নিজে এই ঘরের রানী হওয়ার ফন্দি আঁটছে না তো ?'

আমাকে নিয়ে মা-মেয়ের মন্তব্য এতটুকু শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না । বাকি কথা গুলো আর শুনতে ইচ্ছে করেনি । কানে আঙুল দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম নিজের বিছানায় । বাঁধ-ভাঙা নীরব কান্নায় বালিশটা ভিজে গেছে । নিজেকেই তিরস্কার করছি, 'কেন যে বিছানা থেকে উঠতে গেলাম ? না গেলে কথাগুলো শুনতেও পেতাম না, মনে এত কষ্টও পেতাম না !' 

    আসলে ঘুম আসছিল না আমার অনেক্ষণ ধরে! হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই বোধহয় ঘুম আসছে না । খুব তেষ্টা পেয়েছিল তাই একটু জল পান করার জন্য যাচ্ছিলাম রান্না ঘরের দিকে । আমার থাকার রুম থেকে রান্না ঘরে যাবার পথে মামির রুম । মামাতো বোন নিরু মামির সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোয় । রাতে ঘুমানোর আগে মা-মেয়ের মধ্যে সারা দুনিয়ার যত মানুষের যত দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা পর্ব তো নিত্যদিনের ব্যাপার । এ দুনিয়ায় তারা দুই ত্রুটিহীন প্রানী ছাড়া বাকি সব মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো দোষ- ত্রুটি আছেই আছে ! আমার জল পান করা আর হল না ! চোখের নোনা জলের ফোঁটায় ঠোঁট ভিজিয়ে মিটিয়ে নিলাম জলের তেষ্টা ! 

     আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যে আমি হব সেটা কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি! নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছি না ! আমি মনে করতাম আমাকে খুব ভালোবাসে তারা ! তাইতো আমার কাছে নিরুর যত আবদার !
 - ' রিমা দিদি দেখো না এই পার্টি ওয়ার গাউনটা কী সুন্দর ! মা'কে কিছু কেনার কথা বললেই টাকা নেই পয়সা নেই বলে একদম মাথা নষ্ট করে ফেলে । নিজের মা তো বলতে নেই, আসলে কি জানো দিদি, মা খুব কিপটে!'

- 'মায়ের সম্পর্কে এমনটি বলতে নেই নিরু । সংসার চালাতে কত খরচা হয় ! তাই হিসেব করে চলতে হয় । আমি তোকে গাউনটা কিনে দেবো । অর্ডার কর ! দাম কত?' 

- ' সত্যি দিদি! তুমি কিনে দিবে ? তুমি কত ভালো দিদি ! এই দেখোনা দিদি ! দাম মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ।'

   এরকম কত কিছু কেনাকাটা করে দেই নিরু আর মামিকে । তাদের উপহার দিলে নিজের মনটা কেমন যেন আনন্দে ভরে উঠে ! কাউকে কিছু দেওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম ! নিরু তার পছন্দের বার্থডে গিফট একজোড়া ছোট্ট কানের দুল আমার কাছ থেকে পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিল তার চেয়েও শতগুণ বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি - তার খুশি ভরা মুখটা দেখে। মামি সোনার আংটি পরার শখের কথা শুনাতেন বার বার আর তাঁর যে একমাত্র আংটিটা অভাবের তাড়নায় বিক্রি করতে হয়েছিল, এ কথাটা বলে চোখের জল ফেলে খুব আফসোস করতেন - সেটা আমাকে খুব কষ্ট দিত । তাই মাদাসরস্ ডে উপলক্ষে মামির জন্য আংটি কিনে আনলাম । আংটি পেয়ে মামি আমাকে বুকে জড়িয়ে কত যে আদর করেছেন! আমি এই আদরকে মাতৃ-স্নেহ ভেবে উপভোগ করেছি খুব। স্নেহের কাঙাল আমি ! কারোর কাছে থেকে স্নেহ ভরা একটু হাসি পেলে কিংবা স্নেহ ভরা একটি শব্দ শুনতে পেলে আনন্দে আপ্লুত হয়ে যাই আমি ! হৃদয় মন উজাড় করে স্নেহ - মমতা, শ্রম, টাকা - পয়সা, যা যা সম্ভব দিয়ে দিতে মন চায় আমার, পরিবর্তে চাই শুধু একটু স্নেহ - মমতা - ভালোবাসা !

   আজ বিকেলে নিরুর গাউনটা যখন ডেলিভারি বয় এর কাছ থেকে রিসিভ করছি তখন আমিন ভাই সামনে ছিলেন । আমার মামাতো ভাই আমিনুল মামি আর নিরুর সামনেই বলে উঠেছিলেন, 

-' রিমা তোকে তো সুতির চার/পাঁচ শ টাকা দামের সালোয়ার কামিজ ছাড়া এর চেয়ে বেশি দামের কোনো পোশাকে আজ পর্যন্ত দেখিনি । কানে দুল আছে কি না তাও দেখা যায় না । কেন এত বাজে খরচ করিস ? তোর নিজের ভবিষ্যৎ নাই নাকি ? অতীতে পাওয়া দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেলি নাকি ?' 
   আমিন ভাইয়ের কথাগুলো শুনে আমি তো হা করে দাঁড়িয়ে থাকি ! কেন যে, কি মনে করে আমিন ভাই এমন কথা বললেন আমি বুঝতে পারিনি ! 

   একদিন আমি নিরুকে একটি বখাটে ছেলের সঙ্গে দেখেছিলাম কফিশপে । আমাদের হাসপাতালের ডাক্তার মমতার জন্মদিন ছিল সেদিন । আমরা সবাই ঘিরে ফেলি তাঁকে - পার্টি চাই পার্টি চাই বলে! তাই তাঁর জন্মদিন উদযাপন করতে গিয়েছিলাম ঐ কফিশপে । ঘরে ফিরে কাউকে কিছু না বলে রাতে নিরুকে একা অনেক বুঝিয়েছি । নিরু প্রতিজ্ঞা করেছিল আর মিশবে না ওই ছেলেটার সঙ্গে । কিন্তু তারপরও বুঝতে পারি নিরু এখন ও লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে ওই ছেলেটার সঙ্গে! 
   
   এরপর একদিন মামি গিয়েছিলেন তাঁর অসুস্থ বোনকে দেখতে, আমিন ভাই গিয়েছিলেন নিজের কাজে, আমিও গিয়েছিলাম হাসপাতালে আর নিরু ওর কলেজে । প্রত্যেকের কাছে ঘরের চাবি আছে । আমার মাথায় খুব ব্যাথা করছিল সঙ্গে জ্বর তাই অর্ধ ছুটি নিয়ে ঘরে ফিরে আসি । ঘরে ফিরে নিরুর সঙ্গে একা ওই ছেলেটাকে ঘরে পাই । ছেলেটা পালিয়ে যায় । এই কথা মামি ও আমিন ভাইকে জানানোর পর থেকেই নিরুর চক্ষুশূল হয়েছি আমি! আর মামির অবিশ্বাসের পাত্রি!

    আমার বয়স যখন দশ বছর একদিন বাবা অসুস্থ মাকে কাটিগড়া থেকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন বদরপুর শহরে । বরাক নদী পার হতে গিয়ে প্রচন্ড ঝড় তুফানে কাঠের নৌকা ডুবে গিয়ে সলিল সমাধি ঘটেছে মা বাবার । মা'কে বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীর স্রোত !

মা-বাবাকে হারিয়ে খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম । নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিল মা বাবার জীবন, এখন আমার জীবন স্রোত ভাসবে কোন দিকে - কিছুই বুঝতে পারিনি ! শুধু খুঁজছিলাম মা-বাবাকে আর কাঁদছিলাম । তখন মামা নিয়ে এসেছিলেন এখানে, শিলচরে । মামি তখনই বলেছিলেন, - ' তোমার কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই ? আমি তিনটি বাচ্চা বড় করব কিভাবে ? শুনি ! তার উপর আরেকটি বোঝা এনে কাঁধে তুললে । উফ্ !' 

   মামা মামির কথায় কর্ণপাত করেননি। আমাকে নিজের কাছে ছেলে-মেয়ের মত আদরে রেখেছিলেন। ভালো স্কুলে নাম ভর্তি করিয়েছিলেন।

     কিন্তু হায়! কী কপাল আমার! কোনো সুখ সহ্য হয় না ! একবছর পর আকস্মাৎ মামাও মারা গেলেন ! তারপর? আমি সারাদিনে একবেলা নাহয় দুবেলা দুমুঠো খেতে পেতাম! ঘরের সমস্ত কাজ করতাম - চাল পরিস্কার করা, সবজি কাটা, পুকুর ঘাটে গিয়ে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, ঘরদোর ঝাড়ু দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি! 

   তখন জানুয়ারি মাস । স্কুলে নতুন ক্লাসে নাম ভর্তির সময় । বড়দি মানে আমার মামাতো বড় বোন ক্লাস টুয়েলভ এ পড়তেন । আমিন ভাই ক্লাস টেনে প্রমোশন পেয়েছেন। আমি ক্লাস সিক্স পাশ করে ক্লাস সেভেন এ প্রমোশন পেয়েছি - ক্লাসে প্রথম হয়ে । বড়দি স্কুল থেকে এসে দুপুরের খাবার খেতে খেতে বললেন, - ' রিমা কাল থেকে তোদের ক্লাস শুরু হবে আমার বান্ধবী দিপ্তি বলছিল । ওর বোন মাম্পি ও যে তোর সঙ্গে পড়ে। আর জানিস ! তোর খুব প্রশংসা করছিল রে ! শুনে আমার গর্বে বুক ভরে উঠেছে । খুব মন দিয়ে পড়াশোনা কর্ ! তুই ভালো ফলাফল করতে পারবি !'

- ' হয়েছে থাক্! ও আর স্কুলে যাবে না । আমি কিভাবে এতজনের খরচা বহন করব?' মামি বড়দিকে থামিয়ে বললেন ।

- ' কিন্তু মা.....'। বড়দির কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই গর্জে উঠলেন মামি ! বড়দি, আমিন ভাই ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে মামির সামনে থেকে চলে গেলেন । 

    পাঁচ বছরের নিরু তখন খুশিতে মিটি মিটি হাসছে আর আমাকে লক্ষ্য করে মুখ ভেঙচি কাটছে ! ছেলেমানুষির ছলে নিরু আমাকে মারত, খুব জ্বালাতন করত। মামি কিছু বলতেন না । আমারও মায়া হত, তাই সহ্য করে নিতাম। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে রান্নাঘরের এক কোনে রাখা জালের বাক্সটার আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম । পরের দিন থেকে স্কুলে গেলাম না আর কোনদিন যাবার কথা মুখেই আনলাম না!

    প্রায় তিন মাস পর একদিন বড়দি ও আমিন ভাই ফিসফিস করে লুকিয়ে লুকিয়ে কী যেন আলোচনা করছিলেন! তারপর আমাকে ইশারায় ডেকে নিলেন বড়দি ! কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, - ' তুই রেডি থাকবি । মা কাল নিরুকে সঙ্গে নিয়ে নানিকে দেখতে যাবেন । সপ্তাহখানেক থাকবেন। এই সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না । আমিন আর আমি তোকে নিয়ে গিয়ে একজায়গায় রেখে আসব । সেখানে তুই অন্তত পড়াশোনা করতে পারবি ।'

   আমি চোখ বড় বড় করে শুধু তাকিয়ে রইলাম আর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম ।

    পরদিন মামি নিজের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পর ওরা দুজনে মিলে আমাকে একটি এতিমখানায় রেখে আসল ! মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দি ও আমিন ভাই আমার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন! কেমন আছি, পড়াশোনা করতে পারছি কি না খবরাখবর নিতেন । আমি খুব ভালোই ছিলাম এতিমখানায় ! দৈনন্দিন জীবনে দরকারি সব ধরনের শিক্ষা পেয়েছি সেখানে । আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়া, মানুষের সেবা করা !

   একদিন বড়দি এসে বললেন যে তাঁর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে । বড়দি খুব কাঁদলেন । বললেন, - ' জানিনা তোর সঙ্গে আর দেখা হবে কি না বোন আমার ! আমার বর কেমন হবে জানিনা ! আসতে যদি না দেয় অসহায় বড়দির উপর অভিমান করিস না ।.........।'

  সত্যি তাই হল ! বড়দি আর কোনদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসলেন না ! আমিন ভাই আসতেন নিয়মিত । 

   আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হল না । এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অল্পের জন্য আটকে গেলাম । দ্বিতীয় বার আর বসলাম না । বিএসসি নার্সিং এ সুযোগ পেলে গেলাম প্রথম বারেই । ভর্তি হয়ে গেলাম । কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলাম । চাকুরি পেলাম মামার বাড়ির পাশের হাসপাতালে । 

   আমিন ভাই একদিন এসে বললেন, - ' একটি কথা বলব রিমা ! তুই যদি কিছু মনে না করিস । তোর জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না ।'

-' বলোনা ভাই ! কি বলবে ? বলো !'

-' তু - ই! তুই ঘর ভাড়া না নিয়ে আমাদের বাড়িতেই তো থাকতে পারবি । মা'কে বলেছিলাম, মা ও রাজি । নিরু ও শুনে খুব এক্সাইটেড তোর সঙ্গে থাকবে বলে ! তোর সফলতার গল্প শুনেছে কিন্তু তোকে তো জানা হয়নি ওর । 

- ' তাহলে আমার আপত্তি কোথায় ? কালকেই গাড়ি নিয়ে এসো!'

    আমি খুব খুশি হয়েছিলাম । নিজের মানুষগুলোর সঙ্গে থাকতে পারব । একটি পরিবারের সদস্য হয়ে! একই ছাদের নিচে! একসাথে বসবাস করব !

  মামিও খুব সাদরে অভ্যর্থনা করলেন ! নিরুর কাছে বড়দি থেকেও বেশি আপন হয়ে গিয়েছিলাম আমি, সরকারি চাকুরিজীবি দিদি ! 

  করোনা ভাইরাস এর সংক্রামনের ভয়ে সরকার সম্পূর্ণ তালাবন্ধ ( লকডাউন) ঘোষণা করল । মানুষের ব্যবসা- বানিজ্য সব বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হল । চারিদিকে হাহাকার ! মানুষের পেটে ক্ষুধার জ্বালা কিন্তু পকেট খালি ! শুধু ঔষধের দোকান ও খাদ্য সামগ্রীর দোকান খোলা কিছু সময়ের জন্য । রেস্টুরেন্ট, দোকান-পাট, যানবাহন চলাচল সবই বন্ধ !

   মামার একটি রেস্টুরেন্ট ছিল । মামা মারা যাওয়ার পর মামি কিছু কর্মচারী রেখে কোনোমতে সেটা চালাচ্ছিলেন । আমিন ভাই কমার্স গ্র্যাজুয়েট হয়ে সেই রেস্টুরেন্টের হাল ফেরালেন । তার হাতে খুব ভালোই চলছিল রেস্টুরেন্টটি ! ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক খাদ্যের বিভিন্ন আইটেমের মেলবন্ধনে নতুন উদ্যমে, নতুন স্বাদে, নতুন সুনামে !

  এই রেস্টুরেন্টটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সম্পূর্ণ তালাবন্ধ ঘোষণা করার কারণে। আমি বুঝতে পারলাম আমিন ভাইয়ের পক্ষে পরিবারটি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে । যদিও তিনি মুখ ফোটে কিছু বলছেন না । আমি প্রতিমাসে মামির হাতে সংসারের খরচাপাতির জন্য কিছুটা টাকা গুঁজে দিতে লাগলাম । মামির চিন্তা মুক্ত মুখটা দেখে আমার মনটা দারুন শান্তি পেত। আপনজনদের কিছু দেবার আনন্দটাই আলাদা ! 

  লকডাইন শেষ হওয়ার পর আমিন ভাই আবার নিজের ব্যবসা শুরু করবে । যদিও আমিন ভাই আমাকে বলছেন না তবুও আমি বুঝতে পারছি তার হাতে কিন্তু কানাকড়িও নেই নতুন করে ব্যবসা শুরু করার। আমিন ভাইয়ের প্রতি আমার ও তো দ্বায়িত্ব আছে । আমি ভুলে যাই নি আমিন ভাই আর বড়দিদির জন্যই আজ আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি ! তা না হলে, জীবন কি ? বুঝে উঠার আগেই সেই কবে হয়তো হারিয়ে যেতাম কোন অতল সমুদ্রে!  

  আমিন ভাইয়ের হাতে নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলাম । তিনি নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন,
- 'না রিমা ! আমি তোর হাত থেকে কিছু নিতে পারব না ! তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি আর এখন নির্লজ্জের মত হাত পাতবো? আমি চেষ্টা করছি ! কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।'

- 'না ভাই! তুমি ঠিক বলনি! আসলে আমি আজ যেখানে সেটা তুমি আর বড়দির জন্যই সম্ভব হয়েছে! তোমার কষ্টের দিনে যদি পাশে দাঁড়াতে না পারি তবে কেমন বোন আমি? তুমি টাকাগুলো না নিলে আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকব না।' অভিমানী সুরে বলেছিলাম।

- ' ঠিক তো বাবা! রিমা ঠিকই বলেছে তো! ভাই যদি বোনের হাত থেকে নেবে না তো কার কাছে থেকে নেবে? ভাই বোনের সম্পর্কই তো এরকম - একজন আরেকজনের পাশে থাকে সুখে-দুঃখে !' মামি বিজ্ঞ জনের মত বলেছিলেন!

  আমিন ভাই প্রথমে টাকা নিতে চাইলেন না, পরে আমি জোর করায় নিয়েছেন কিন্তু ধার হিসেবে নিয়েছে। আমি কিন্তু ফেরত নেওয়ার জন্য দেইনি।

   মামির সেদিনের সংলাপটা মনে পড়তেই আমার হাসি পাচ্ছে ! মামির ভাই-বোনের সম্পর্কের এতো সুন্দর সংলাপের পরিবর্তিত রূপ দেখে ! আজ এই সম্পর্ককে কলঙ্কিত করতে একটুও বাঁধল না মামির মুখে, মামির বিবেকে !
কী স্বার্থপর!

নাহ্! আর নয়! আর কাঁদব না আমি! কারো কাছে থেকে সুখ পাওয়ার আশা রাখব না মনে, তাহলে মন ও দুঃখী হবে না! নিজেকে ভালোবাসব, নিজে সুখী থাকার জন্য পরের উপকার করে যাব বিনা বিনিময়ে। থাকবনা আমি আর কারো আশ্রিতা হয়ে! সকাল হতেই চলে যাব এখান থেকে । আশ্রয়ের জন্য একটি ঘর ভাড়া নিয়ে নেব এখন! জমানো কিছু টাকাপয়সা আছে আর ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে নেব ! একটি বাড়ি করব! একটি ঘর হবে! আমার নিজের ঘর!

বিষয়-আশয় : ছোটগল্প।
লেখক: মাসকুরা বেগম।
গুয়াহাটি। আসাম।

 



কোন মন্তব্য নেই: