(মনিপুরি লোককথা)
।। সুব্রতা মজুমদার ।।
বাবার অনুপস্থিতিতে দিন এরকমই চলতে লাগল আর সৎমাও
হাইয়াইনুর প্রতি নিষ্ঠুর থেকে আরও নিষ্ঠুর হতে থাকে। হাইয়াইনুও দৈহিক আর মানসিক
যন্ত্রণা পেতে পেতে দুঃখী আর নিঃস্ব হতে থাকে দিন দিন। একদিন হাইয়াইনু যখন তার
বন্ধুদের সাথে নদীতে চুলে চাল আর ডালের জলে তৈরি পরম্পরাগত ‘চেঙহী’ দিয়ে স্নান
করতে ব্যস্ত তখন সৎমা দুপুরের খাবার খেয়ে ভাত ঘুমে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে কিছু গরু
এসে তাদের বাগানে ঢুকে গেছে। সৎমা ভাবল এটা হাইয়াইনুর অবহেলার জন্যই হয়েছে।
হাইয়াইনু বাড়ি ফেরার পর সৎমা তাকে বকাবকির পর মারতে শুরু করে। হাইয়াইনুর সৎ ভাইয়ের
তা দেখে দিদির জন্য কষ্ট হয়। সে তার দিদিকে খুব ভালবাসত, কিন্তু সেও তখন অসহায় কিছুই
করতে পারে না দিদির জন্য। হাইয়াইনু তার বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করুক, খেলা করুক
কোনো সামজিক অনুষ্ঠানে যাক তা তার সৎমার একদম পছন্দ ছিল না, তাই তার বন্ধুরা যখন এসে
তাকে প্রলোভিত করে ‘লাইহরাওবা’ অনুষ্ঠানে যেতে সে রাজি হয় ঠিকই কিন্তু বন্ধুদের
বলে তাকে এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে। সৎমা তাদের কথাগুলো লুকিয়ে শুনে নেয় এবং
হাইয়াইনু সব জামা কাপড় গয়না লুকিয়ে রেখে দেয় আর হাইয়াইনুর চুল ধরে মারধর করে ।
সৎমা কোনো সময়েই মেয়েটিকে অবসর বসে থাকতে দেখতে
পারত না বরাবরই কোনো না কোনো কাজ সমঝে দেয়। কাজ করতে করতে কোনো কারণে
যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে মেয়েটিকে তো মারধর করতই এমনকি মেয়েটির মৃত মাকেও গালাগালি
দিত। যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটির বাবা মেয়েটির সঙ্গে থাকত মেয়েটি নিরাপদে থাকত, বাবা
কাজে বেরোলেই শুরু হত সৎমায়ের অত্যাচার। মেয়েটির তখন তার বাবার কথা খুব মনে পড়তে
থাকে, সে ভাবে বাবা কবে বাড়ি ফিরবে! তার মা যদি বেঁচে থাকত! তাহলে তো সে কত যত্নে
থাকত! পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলো এসে মেয়েটির মুখে পড়তে চোখের জল চিকচিক করে ওঠে।
বারান্দায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে মেয়েটি অনেককিছু ভাবতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে
মেয়েটি খুব দুঃখী হয়ে পড়ে। ঘরে তখন তার সৎমা ছোটভাইকে নিয়ে পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে। সে
ঘরে ঢোকে মাটিতে করে রাখা তার বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে সে তার মৃত মা কে স্বপ্নে
দেখে। মা বলে,
--- ও হাইয়াইনু, আমার কন্যা! আমি তোকে এভাবে দুঃখী
দেখতে পারছি না মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোর যন্ত্রণা দেখে। এইসব মানুষদের মাঝখানে
থাকতে না পারলে এখানে চলে আয় মা, ধনেশ পাখির দলে ধনেশ পাখি হয়ে। তুই যে নদীতে যাস
সেখানে দেখবি প্রতিদিন ধনেশ পাখির একটি দল
আসে। তুই দেখিস তাদের অনুরোধ করে রোজ তোর জন্য কিছু পালক ফেলে যাওয়ার জন্য। তুই সেই
পালকগুলো এক জায়গায় জমাতে থাকিস, সেলাই করে নিস তোর জামার সঙ্গে এবং চেষ্টা করিস
উড়ে আসার, ধনেশ পাখিদের এই সুন্দর পৃথিবীতে চলে আয়, আমাকেও পাবি তুই এখানে।
ঘুম ভাঙতেই হাইয়াইনু দৌড়তে দৌড়তে নদীতে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে সত্যি সেখানে কিছু ধনেশ পাখির দল ওড়াউড়ি করছে। পাখিদের দেখে মেয়েটিরও ইচ্ছে করে সব দুঃখ কষ্ট থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাদের মতো তাদের দলের হয়ে এরকম উন্মুক্ত আকাশে উড়ে যাওয়ার। সে তাদের ডাকতে থাকে,
--- “ও ধনেশ পাখি আমার উপর কৃপা করো! আমি আর আমার
সৎমায়ের অত্যাচার সইতে পারছি না।”
ধনেশ পাখিরা সবাই একসাথে উত্তর দেয়,
--- বলো বলো মেয়ে কী হয়েছে?
--- আমি তোমাদের সঙ্গে উড়ে যেতে যাই। আমাকে নিয়ে
যাও তোমাদের সঙ্গে।
--- তুমি পারবে না, পারবে না আমাদের মতো উড়তে,
তোমার ডানা নেই, ডানা নেই।
চোখের জল মুছতে মুছতে হাইয়াইনু বলে,---
--- পারব, পারব। তোমরা আমাকে সাহায্য কর উড়তে। আমি এই
দুখ দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, উড়ে যেতে চাই খোলা আকাশে, ঠিক তোমাদের মতো। দয়া
করে আমাকে তোমরা তোমাদের দলে যুক্ত করো।
ধনেশ পাখির দল উত্তর দেয়,
--- আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলো কী করে তোমায় আমরা
সাহায্য করব?
--- তোমরা কী প্রতিদিন তোমাদের একটি করে পালক দেবে আমাকে?
ঝুড়ি ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি জমাব। ঝুড়ি ভরে গেলেই ডানা মেলে আমি উড়ে চলে আসব
তোমাদের কাছে!
হাইয়াইনুর কথা শুনে ধনেশ পাখিদের খুব দুঃখ বোধ হয় এবং
তারা সম্মতি জানায়,
--- আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে!
ধনেশ পাখিরা তাদের কথা মতোই রোজ একটা করে পালক ফেলে যায় মাটিতে। হাইয়াইনু তা জড়ো করতে থাকে একটা ঝুড়িতে। ঝুড়ি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে যাতে তার সৎমা তা দেখতে না পায়। এরকম পালক কুড়িয়ে জমাতে জমাতে একদিন হাইয়াইনু দেখল তার ঝুড়ি ভর্তি হয়ে গেছে, তখন সে সেই পালকগুলোকে সেলাই করে ডানা বানাতে লাগল। ছোটভাই দরজার আড়াল থেকে দেখে নেয় দিদিকে পালক সেলাই করতে, সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,
--- এগুলো দিয়ে কী করবে দিদি?
--- আমি উড়ে যাব ধনেশ হয়ে। এখানে আর থাকতে ভালো
লাগছে না রে ভাই।
--- আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না দিদি!
বলে দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে ছোটভাই। হাইয়াইনুও
পালক সেলাই ছেড়ে ছোটভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, ও ভাই!
পালক সেলাই শেষ হলে হাইয়াইনু ধনেশ পাখিদের দেখে
এবং তাদের ডেকে বলে তাকে উড়ে যেতে সাহায্য করার জন্য। ধনেশ পাখিরাও সাহায্য করে।
অতপর মেয়েটিও ডানা মেলে পাখি হয়ে উড়ে যায় আকাশে, মিশে যায় ধনেশ পাখির দলের সাথে।
পাশে অসহায় ভাই শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখতে থাকে তার দিদির আকাশে উড়ে যাওয়া। ছোটভাই
দৌড়ে গিয়ে মাকে জানায় কথাটি, মা শুনে শুধু একটি কথাই বলে,
--- ভালো হেয়ালি!
কিছুদিন পর হাইয়াইনুর বাবা তার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে
আসে মেয়ের জন্য অনেকগুলো জামাকাপড়, অলঙ্কার এবং কিছু ফলমূল নিয়ে; কিন্তু মেয়েকে
বাড়িতে কোথাও দেখতে পায় না। খুঁজতে থাকে এদিক ওদিক। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে স্ত্রী
কিছু উত্তর করে না। তখন ছেলেটি আসে তার বাবার কাছে এবং বলে যে কী করে তার দিদি হাইয়াইনু
ধনেশ পাখিদের সাথে উড়ে গেছে আর সে কোনোদিন তাদের মধ্যে ফিরে আসবে না। ছেলের কথা
শুনে হাইয়াইনুর বাবা হাইয়াইনুর সৎমাকে গালাগাল দেয় যে তার অত্যাচারের জন্যই আজ
তাদের মেয়ে এরকম দূরে চলে গেছে। সৎমাও তার কর্মের জন্য ভেতর ভেতর অনুতপ্ত হতে থাকে।
মেয়েকে
এভাবে হারিয়ে হাইয়াইনুর বাবা অত্যন্ত দুঃখী হয়ে পড়ে। খাওয়া ঘুম ছেড়ে দেয় প্রায়।
রোজই উঠোনে দাঁড়িয়ে মেয়েকে ডাকতে থাকে,
---‘ও হাইয়াইনু! হাইয়াইনু! প্রিয় মামনি! দ্যাখ আমি
তোর জন্য কী কী এনেছি! বাবার কাছে ফিরে আয় মা! দেখ তোর জন্য যে কত কাপড় চোপড় গয়না
এনেছি কে পরবে ওগুলো! আমার কষ্ট হচ্ছে মা তোকে ছেড়ে থাকতে!
প্রতিদিন এরকম কাঁদতে কাঁদতে একদিন হাইয়াইনুর বাবা
দেখতে পেল যে তাদের বাড়ির উঠোনের উপর দিয়ে একঝাঁক ধনেশ পাখি উড়ে যাচ্ছে এবং সেই
দলে তার মেয়ে হাইয়াইনুও আছে। সে মেয়েকে ডেকে ঘরের ভেতর থেকে এক থালা ভাত এনে দিল
এবং বলল তার মেয়েকে খেয়ে যেতে। হাইয়াইনু এসে বাবার পাশে দাঁড়ায়, কেঁদে বলে,
--- “বাবাগো, আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমার অসহায়
কন্যা তোমার বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষাও করতে পারে নি। আমি আর মানুষের মাঝখানে বসবাস
করতে পারছিলাম না। এখন তোমার দেয়া এই খাবারও আমি খেতে পারব না বাবা, আমি এখন ধনেশ
পাখিদের দলের একজন, আমার খাওয়া অন্য। আমি অনেক সুখে আছি এখন ওদের সঙ্গে। আমার মাও
আছে আমার সঙ্গে। দয়া করে ক্ষমা করে দিও তোমার অবোধ শিশুকে। বিদায় বাবা!
যেতে যেতে আবার দাঁড়িয়ে বলে,
--- আর হ্যাঁ বাবা, এই জন্মে আর হবে না, পরের
জন্মে আমাদের দেখা হবে আবার। তোমার মেয়ে হয়েই ফিরে আসব। ভাইয়ের খেয়াল রাখবে, যত্নে
রাখবে ওকে। আর মামনিকেও ক্ষমা করে দিও। কেঁদো না বাবা! তুমি যখনই ‘লাইহরাওবা’
অনুষ্ঠানে যাবে তুমি যেখানে বসবে ঠিক তার পাশের বসার জায়গাটা আমার জন্য খালি রেখে
দিও, আমি ঠিক এসে বসব কিন্তু!
হাইয়াইনুর সব পাখি বন্ধুরা তাকে ডাকতে শুরু করে যে
দেরি হয়ে যাচ্ছে ফিরে যাওয়ার জন্য। হাইয়াইনু তাই এইটুকু বলেই বাবার কাছ থেকে বিদায়
নিয়ে তার পাখি বন্ধুদের সাথে সোনালী আকাশে উড়ে যায়! হাইয়াইনুর বাবাও সেই আশা নিয়েই
বাঁচতে থাকে তার মেয়ে হাইয়াইনু কোনো একদিন কোনো একজন্মে আবার ফিরে আসবে তার বাবার
কাছে!
*****