সাহিত্যের শিক্ষককে বহু কিছু জানতে হয়। তার উপরে প্রমথ চৌধুরী সেই কবেই আশা
ব্যক্ত করে গেছেন ‘মনগঙ্গার ...পূর্ণ
স্রোত আবহমানকাল সাহিত্যের ভেতরই সোল্লাসে সবেগে বয়ে চলেছে।’ আমাদের সেই
গঙ্গাতে অবগাহন করে ‘সকল পাপ’ থেকে মুক্ত হতে হবে। আর যায় কোথায়। সাহিত্যের ছাত্র
বা শিক্ষককে তো শুরুর কাজটি করতেই হবে। ফলে শিক্ষকের পক্ষে বলা কঠিন, তিনি গান
শুনেন -- কিন্তু জানেন না। তার উপরে যদি জানার প্রশ্নটি রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে হয়? যাই হোক, চর্যাগীতি থেকে শুরু করে গানের কথা কখনো সখনো পড়ানোটা আমার পেশা,
শুনাটা নেশা। গান শেখানো নয়। ফলে আমি গানের গ জানি না। অমন কথা অপরের মুখে
শুনলে যতটা বিব্রত হতে হয় -- নিরানন্দে পায়,
নিজের আঙুলে লিখলে পরে সুব্রত হবার আনন্দে
ছায়। সেই আনন্দেই আঙুল চালিয়ে কম্প্যুটারের বোতাম টিপে দেবার সাহস করা।
অবশ্য এমন কোনো কথাও নেই, জেনেই লিখতে হবে। লিখতে গিয়েও জানা হয়। কেউ যেন
একবার লিখেছিলেন, লেখা মানেই হচ্ছে ভালো করে পড়া। তো পড়তে বসেই দেখি, সাহস বাড়িয়ে
দেবার কাজটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই করে রেখেছেন। গান নিয়ে তিনিও বেশি লেখালেখি করেন
নি। খুব কম বয়সেই লিখেছিলেন, তারুণ্যের উৎসাহে বেশ সকৌতুকে লিখেছিলেন, “অলংকারশাস্ত্রের
পিঞ্জর হইতে মুক্ত হওয়াতে সম্প্রতি কবিতার কণ্ঠ বাংলার আকাশে উঠিয়াছে; আমার ইচ্ছা যে, কবিতার
সহচর সংগীতকেও শাস্ত্রের লৌহকারা হইতে মুক্ত করিয়া উভয়ের মধ্যে বিবাহ দেওয়া হউক।”১ বড়ো বয়সে আরো স্পষ্ট করেই লিখেছেন, “সংগীত সম্বন্ধে কিছু বলিবার জন্য
সংগীতসংঘ হইতে আমাকে অনুরোধ করা হইয়াছে। ফর্মাশ এই যে, দিশি বিলাতি কোনোটাকে যেন বাদ দেওয়া না হয়। বিষয়টা গুরুতর এবং তাহা আলোচনা
করিবার একটিমাত্র যোগ্যতা আমার আছে–তাহা
এই যে,দিশি এবং বিলাতি কোনো সংগীতই
আমি জানি না।”২ তবে
কিনা তিনি সেই ‘লৌহকারা’র কারিগরিটা কিছু হলেও জানতেন, আমাদের সেটুকুও না জেনেই
‘ওস্তাদি’। তিনি কেন, কীভাবে জানতেন সেই গল্পেই শুরু হোক।
আমরা এই পড়তে পড়তে আর পড়াতে পড়াতে কাল কাটিয়ে দিয়েছি, যে
ছাপাখানা এলো, ভাষা গদ্যে দাঁড়িয়ে গেল আর পদ্যের দুটি ভাগ গান আর কবিতা আলগা হয়ে
গেল। এর আগে ভারতচন্দ্র রামপ্রসাদ অব্দি
যা কিছুকে সাহিত্য বলে জানি সবই ছিল একাধারে গান। সেদিন এক বিদগ্ধ বাংলা গানের
পণ্ডিত, গান নিয়ে যার একাধিক বই পত্র রয়েছে,
রাজ্যেশ্বর মিত্রের কটি বাক্য পড়ে প্রথমে বেশ চমকে যেতেই হলো। তিনি
লিখেছেন,“বাংলা গানের আদিপর্ব অনেকটাই অনুমানের ব্যাপার, কেননা সুপ্রাচীন যুগ থেকে
ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বাংলা বিবর্তনের ইতিহাস পাওয়া যায় না।”৩ আমরা মাঝের
কিছু কথা কৌতূহল বাঁচিয়ে রেখে সচেতনভাবেই ছেড়ে যাচ্ছি। তিনি আরো লিখেছেন,“কোথাও
উনিশ শতকের বাংলা গান আসলে কাব্যসংগীতের সংগঠন এবং তার আদিপর্ব জানতে গেলে
পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলিতে বাংলার লিরিক গান কীভাবে প্রচলিত ছিল তার উদাহরণ পাওয়া
দরকার; কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা দুর্লভ বা অপ্রাপ্য বললে অতিশয়োক্তি হয় না।”৪
আমাদের সাহিত্যের মাস্টারমশাইদের অনেকেরই অবস্থা কাহিল হতে এইটুকুন যথেষ্ট। তিনি চর্যার
যুগ থেকে বোঝবার চেষ্টা করেছেন। এবং চর্যাকে মোটেও বাংলার গান বলে মানতে রাজি হন
নি।এগুলো সর্বভারতীয় গান, নানা ভাষাতে সাধকেরা গাইতেন মাত্র। আমরা কষ্ট করে যেটুকুন
বুঝলাম তিনি মূলত রাগাশ্রয়ী গানের কথা বলতে চেয়েছেন। খণ্ডগীতিকবিতাকেই তিনি
কাব্যসংগীত বলছেন। রাজসভার বা জমিদারবাড়ির রোজকার গান। অনুমান করতে
পারি ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল লিখবেন, আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদদের বিনোদন
সেখানেই আটকে থাকবে সেরকম তো হবার কথা ছিল না। অন্য আরো বহু গান সেখানে হতো। তাঁর
রাজসভাতে বিশ্রাম খাঁও ছিলেন,যিনি মূলত হিন্দি
রাগাশ্রয়ী গান গাইতেন।যার কথা আমরা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়িনি। যেমন ধরুন আমরা পড়িনি
এক শতক পরে অবধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের কথা,যিনি ব্রিটিশের কাছে মসনদ হারিয়ে
কলকাতাতে নজরবন্দি তথা আশ্রিত ছিলেন। ১৮৫৮ থেকে ৮৭ প্রায় উনত্রিশ বছরে তিনি
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে কলকাতার সংগীত জগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন। তাঁর দৌলতে
বাংলায় হিন্দি গানের জনপ্রিয়তা এতো ব্যাপক বাড়ে যে বাংলা গানকে বেশ কিছু দিন
প্রান্তেই চলে যেতে হয়। সেই সব প্রশ্ন তুলে দিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা
গানের ধারাটাই ধরবার চেষ্টা করি—যে ধারাতে এসে রবীন্দ্রনাথের উদয় সম্ভব হলো।
‘কাব্যসংগীতের’ ধারণাটিকে আরো স্পষ্ট করে রাজ্যেশ্বর মিত্রই অন্যত্র লিখেছেন“ রামনিধি
গুপ্ত (নিধুবাবু) অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কাব্যসংগীতকে সংগঠিত করেছেন,তাঁর
সমসাময়িক কালী মির্জা গান লিখেছেন—গেয়েছেন, রাধামোহন সেন সংগীতের ইতিবৃত্ত প্রণয়ন
করেছেন”৫ নিধুবাবু সারি মিঞা নামে এক ওস্তাদের কাছে গান শেখেন। ইংরেজি
ফার্সি জানতেন, হিন্দিও জানতেন। ইতিমধ্যে জনপ্রিয় টপ্পা এবং আখড়াই গানের সংস্কার করে কিছু ‘জাতে’ তুলেন। প্রচুর
হিন্দি গানের অনুবাদও করেন। ‘গীতিরত্ন’ নামে নিজের একটি গানের সংকলনও প্রকাশ
করেছিলেন । কলকাতাতে নিজেও একটি আখড়া তথা গানের স্কুল খুলেন ১৮০৪এ। সেই গানের ধারা
খেঁউড় পাঁচালির গানের ধারার সঙ্গে মিশে আমজনতার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে যে রূপ নিল—তাতে
সেকালের ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাতরা তো সেই গানের ধারার থেকে নজর ফিরিয়েছিলেনই একুশ
শতকেও রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখছেন ‘এদের প্রসার প্রতিপত্তি ঘটল ইতর সম্প্রদায়ের
মধ্যে।’ কারণটি তিনি লিখেছেন,অত্যধিক প্রেম বিষয়ের গানে গুরুত্ব দেওয়াতে এটি
হয়েছিল। আমরা ‘ইতর সম্প্রদায়’ বলতে বুঝে নিতে পারি অবৌদ্ধিক
সম্প্রদায়---শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে –যারা বাংলা গান নিয়ে বেশি ভাবেন নি।বাবু বা
জমিদার শ্রেণির অধিকাংশের কাছে গান বিলাসের সামগ্রীমাত্র ছিল,শিল্পের মর্যাদা দিতে
তাঁরা শেখেন নি বিশেষ। ফলে নিজেদের সময়কালে রামনিধি গুপ্ত বা কালী মির্জারা সমস্ত
যোগ্যতা সত্ত্বেও নজর কাড়তে পারেন নি,বা স্বীকৃতি পান নি। এবং টপ্পা গানের ধারাটি হালকা কথার হালকা
সুরের ধারাতে হারিয়ে গেল।
শিল্পের মর্যাদা দিতে জানতেন অবধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ।
তাঁর দরবারে বহু পশ্চিম তথা আজকের উত্তর
ভারতের উস্তাদদের আনাগোনা লেগে থাকত। বহু উস্তাদ এই ক্ষমতাচ্যুত নবাবের আমন্ত্রণ এবং স্বীকৃতিতে কৃতার্থ বোধ করতেন।
বহু বাঙালি গাইয়েরাও ভিড় করেন। তাতে হিন্দি গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা বাড়ে। হিন্দি
গানের আদলে বাংলা গানকে গড়াপেটার কথা ভাবা যেতে পারত---তাও কেউ ভাবেন নি। কেবল
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে চতুর্দশ শতকে মল্লরাজাদের কালে প্রতিষ্ঠিত এবং শেষ-মোঘল
যুগে ভারতীয় সঙ্গীতের অন্যতম ঘরানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুপুর ঘরানা ছিল তখনো
ব্যতিক্রম। ওয়াজেদ আলির সংগীত সভার প্রভাবে অনেকের মনে ঘরানার প্রতি আকর্ষণ বাড়ে,
সেই সুযোগে বিষ্ণুপুর ঘরানার দিকেও নজর পড়ে অনেকের। এই ঘরানা বাংলার নিজস্ব। মূলত
কীর্তন গান নিয়েই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলত। কালে গিয়ে টপ্পা ঠুংরি চর্চাও চলে। কিন্তু
ধ্রুপদ ঘরানাটি গড়ে উঠে রামশঙ্কর
ভট্টাচার্যের দ্বারা আঠারো শতকের শেষে। তিনি তানসেনের বংশধর বাহাদুর খানের শিষ্য
ছিলেন বলে অভিমত চালু আছে। আরো অনেকের থেকে গান শেখেন, তার মধ্যে হিন্দুস্তানি
ধ্রুপদও আছে। এই বিষ্ণুপুর ঘরানার শিক্ষক যদু ভট্ট রবীন্দ্রনাথকেও ছেলেবেলা গান
শেখাতে গেলে তিনি পালিয়ে বেড়াতেন সেই গল্পে আমরা পরে আসছি।
যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে সর্বজনীন গানের ধারা বলে তখন কিছু
নেই। গান এবং গানচিন্তা দুই বৃত্তে বাঁধা পড়েছিল। ধ্রুপদাআদি জমিদার বাবু বৈঠকখানার
বিলাসের সামগ্রী হয়ে থাকে। আমজনতার স্রোতে গিয়ে মেশে টপ্পা,আখড়াই,খেঁউড়, ইত্যাদি।
কবিগান বা পাঁচালি,কীর্তন আগে থেকে
ছিলই। পরে যেগুলোকে আমরা বাউল ভাটিয়ালি
ভাওয়াইয়া বলে জানছি সেগুলো যে রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ পাতে নেবার জিনিস মনে করেন নি
— সে তো সবাই জানেন। রবীন্দ্রনাথ বাউল কীর্তনকে তুলে ধরবার পথ ধরেই ভাটিয়ালি
ভাওয়াইয়ার দিকেও শহুরেদের নজর যায়। ঐ দুই বৃত্ত ভেঙে গানের পথে মোড় ফেরাবার কাজটি কোনো
সংগীত শিল্পী বা চিন্তক ঘটালেন না,ঘটালো সমাজ এবং ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার গোঁড়ার দিকে রাজা
রামমোহনের মনে হলো আত্মীয়সভার উপযোগী গান চাই। তিনি নিজে গান জানতেন।কালী মির্জার
সঙ্গেও আলাপ ছিল।কিছু তাঁর থেকেও শিখেছেন।সমাজের সদস্যরা নিধুবাবুকেও ধরেছিলেন
ব্রহ্মসংগীত লিখে দিতে। গানের রীতি কিছুই বদলায় নি। টপ্পা, আখড়াই বা ধ্রুপদই হতো
হয়তো। বিষয় পালটে গেল। পালটে গেল রস। সেই ধারার অনুবর্তন করলেন দেবেন্দ্রনাথ। তাঁর
নেতৃত্বে ব্রহ্মসংগীত তো পুরো সমাজের সংগীত হতে শুরু করল ।স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর
নিজের পরিবারের লোকজনও তাতে যোগ দিলেন।তাদের মধ্যে প্রধান দ্বিজেন্দ্রনাথ,সত্যেন্দ্রনাথ
এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। পরে যোগ দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। দেবেন্দ্রনাথের ধ্রুপদ
গানের প্রতি পক্ষপাত ছিল। খাঁটি বাংলা ধ্রুপদ। রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখছেন,“এঁরা
ধ্রুপদের অনুরাগী হয়েও সহসা যে হিন্দি গান থেকে বাংলা গানের রূপান্তর সৃষ্টি করেন
নি এটি একটি অসাধারণ সংগীতচিন্তার ফল।” ৬ কিন্তু তিনিই এর আগে
জানাচ্ছেন ব্রহ্মসংগীতের আদি যুগে বিষ্ণু চক্রবর্তীর ব্যাপক প্রভাব ছিল। তিনি
বাংলা ব্রহ্মসংগীত গাইলেও প্রধানত ছিলেন ধ্রুপদ গায়ক।তাঁর শেখানো হিন্দি গান ভেঙে
বহু ব্রহ্মসংগীত তৈরি হয়েছে।এই হিন্দি গান ভাঙার ব্যাপারটি আসলে শুরু করেন
সত্যেন্দ্রনাথ। এই ব্রহ্মসংগীতের জন্যে দ্বিজেন্দ্রনাথই প্রথম বাংলাতে স্বরলিপি
তৈরির চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথ যে
পরবর্তী কালে রাগ-রাগিণী তথা ‘শাস্ত্রের
লৌহকারা’ থেকে সংগীতকে মুক্ত করে নিজের গানেরও পশ্চিমা রীতিতে স্বরলিপি তৈরি করবার
কাজে জোর দেবেন,তার ক্ষেত্র এভাবে তৈরি হচ্ছে। ১৮৬৯-এর অক্টোবরের তত্ত্ববোধিনীতে
‘সংগীত লিপিবদ্ধ করিবার চিহ্নাবলী’-র সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে পাঁচটি ব্রহ্মসঙ্গীতের
স্বরলিপি ছাপা হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিন সংগীতজ্ঞ---রমাপতি
বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজচন্দ্র রায় এবং যদু ভট্টাচার্য।এই শেষের জন যদুভট্ট নামে
পরিচিত।তাঁর কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতেও লিখেছেন। ১৮৭৫-এর মাঝামাঝি ‘আষাঢ়’ সংখ্যা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে বেরুলো একটি বিজ্ঞাপন- ‘ব্রহ্মসংগীতের উন্নতির জন্য শুরু হচ্ছে সংগীত শিক্ষার স্কুল।
ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরের দ্বিতলায় প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে এই স্কুল। সংগীত শেখাবেন
বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী যদুনাথ ভট্টাচার্য।’৭ এঁদের বা অন্য কারো কোনো গান ভালো লাগলেই দ্বিজেন্দ্রনাথ
এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেটি টুকে নিয়ে ব্রহ্মসংগীত লিখতে বসে যেতেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অব্দি আসতে আসতে স্বরলিপি চিন্তা বেশ
বিকশিত হয়। কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায় ‘গীতিসূত্রসার’ নামে একটি বইও লেখেন। কিন্তু তিনি
চাইছিলেন পশ্চিমা ‘স্টাফনোটেশন’ বাংলাতে চালু করতে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চাইছিলেন
আকার মাত্রিক স্বরলিপি। এই নিয়ে দু’জনে বেশ তর্ক বিতর্কও হয়। দুটির মধ্যে তফাৎ
নিয়ে লিখতে গেলে পরিসর বাড়াতে হয়। আমরা বুঝিও না --- স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
কিন্তু বিতর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জয় হয়েছিল। রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখছেন, ‘ঊনবিংশ
শতাব্দীর সংগীতচেতনার মূলে তিনিই ছিলেন।’ আমরা সাহিত্যের ছাত্রেরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুরের নাটক এবং কিছু অনুবাদের কথা জানি। গান জানতেন ,তাও জানি। এই জানা এরকম যে
ঠাকুর বাড়ির কে বা গান জানে না। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নইলে গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ
হতেন কি না আমরা অনেকেই ভেবে দেখিনি।
সাহিত্যের ইতিহাসে অবশ্য খাটো করে সেগুলো লেখা থাকে। কিন্তু আমাদের পাঠ্য থাকে না
বলে দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।৮ নাটক করতে গিয়েই গানের বিষয় বেরিয়ে গেছিল ব্রহ্মসঙ্গীতের
বাইরে। বস্তুত ‘হিন্দুমেলার’ নামে যে স্বদেশিয়ানা শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের
বাল্যকালে সেই সামাজিক আন্দোলন দেশপ্রেমের গান বাঁধতে উৎসাহিত করে অনেকেই। আর
জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নাটকের জন্যে গান বাঁধতে হয়েছিল। হার্মোনিয়াম,ক্ল্রেরিওনেট,
চেলো, পিয়ানো আদি বিদেশি বাদ্যযন্ত্রও তাঁর দৌলতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। পিয়ানো
বাজিয়ে বাজিয়ে তিনি নানা রকম সুরের ছক তৈরি করতেন, অনুরাগীরা সেই ছকে গান বাঁধতেন।
সেরকম গানের সংকলন ‘স্বরলিপি গানমালা’। এই সময় এবং পরবর্তীকালে গান নিয়ে প্রচুর বই বেরোতে শুরু
করে।বাংলাতে ইংরেজিতে।বঙ্গদর্শন,বালক,ভারতী,সাধনা ইত্যাদি পত্রিকাতেও অনেকে কলম
ধরেন নিয়মিত।এভাবে “রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তীরা সংগীতকে আমোদলিপ্সু অর্ধশিক্ষিত
শ্রোতৃসমাজ থেকে উদ্ধার করে রুচিশীল, সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
কাব্যসংগীতকে তাঁরা সাহিত্যের পর্যায়ে স্থাপন করেছেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে,
সভা-সমিতিতে সংগীত একটি নিয়মিত অঙ্গ
হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করবার মূলে তাঁদের একাগ্র প্রচেষ্টা বর্তমান।”৯ তাঁর
এই কথাগুলো পড়লে মনে হবে যেন আর আগে সভাসমিতি,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খুব ছিল। ছিল না
কেবল সংগীত। ইতিহাস আসলে ভিন্ন। এই দুই ধারাই যুগল হিসেবেই বিকশিত হচ্ছিল,আমরা সেই নিয়ে
পরিসর আপাতত বাড়াবো না। ধর্মনিরপেক্ষ সভাসমিতি হতেই তো শুরু করে এই সময়েই। বিদ্যাসাগরের
বিধবাবিবাহ প্রচলনের আন্দোলন, কৌলীন্যপ্রথা তথা বহু বিবাহ বিরোধী আন্দোলনও প্রচুর
গান তৈরিতে প্রেরণা যুগিয়েছিল।অনেকেই ছিলেন।রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেই
আন্দোলনের এক বড় সমর্থক। বহু গান নিজে বেঁধে অন্যদের বাঁধতে উৎসাহিত করতেন। সেগুলো
লোকসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে মিশে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের মধ্যেও জনপ্রিয় হচ্ছিল। তিনি
তাঁর ‘জীবনবৃত্তান্তে’ লিখেছেন, দ্বিতীয় বিবাহ কেউ করতে গেলেই মেয়েরা প্রচলিত
‘অশ্লীল’গান গুলো ছেড়ে তাঁদের বাঁধা নতুন গান গাইতে শুরু করলেন। তাতে বহুবিবাহ
সম্পর্কে অনেকেরই মত বদল ঘটতে শুরু করে। সেগুলোতে না ছিল বায়বীয় বা বিমূর্ত
দেশপ্রেম, না ছিল নিরাকার পরমেশ্বর বন্দনা। রাসবিহারীর অনুরাগী ঢাকার রামচন্দ্র
চক্রবর্তীর একটি গানের কলি এরকম,“কেম্বলেকে
মা মহারাণী কর রণে নিয়োজন।/ (রাজা) বল্লালেরি চেলাদলে করিতে দমন/ কাজ নাই সিক
সিফাইগণ,চাই না গোলা বরিষণ, (একটু) আইন অসি খরষাণ কর গো অর্পণ,/ বিদ্যাসাগর
সেনাপতি,/ মোদের রাজবিহারো হবে রথী,/ মোরা কুলীন যুবতী সেনা যে এখন”১০ একেবারেই
একালের ‘গণসংগীত’ বা ‘জীবনমুখী’ গানের প্রথম যুগের গান কি নয় এগুলো? সিপাহী বিদ্রোহের সমকালে বহু কিছু পালটে গেছিল
ভারতে। কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে গেছিল দেশ। তার আগে থেকেই রেল
এসেছিল। এমন আরো বহু কারণে বেড়েছিল চাকরি। চাকরির দরকারে দেশীয়দের মধ্যে বিস্তৃত
হয়েছিল শিক্ষা। কলকাতা মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছিল। স্ত্রী শিক্ষাতেও জোর পড়ছিল। শিক্ষার ফলে গড়ে উঠেছিল নতুন
মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এবং তাদের দরকার ছিল নতুন সভা ও সংস্কৃতি। নগরের বাইরে বা
প্রান্তেও এমন বহু পরিবর্তন চলছিল।মতুয়াদের মতো প্রান্তিক ধর্মান্দোলনের সঙ্গেও
বিকশিত হচ্ছিল কীর্তন গানের নতুন ধারা। বাউল ফকিরি এই সব ছিল। রবীন্দ্রনাথ
প্রসঙ্গে এর কোনো কিছুকেই ব্রাত্য রাখা যাবে না। কিন্তু তাঁর প্রাথমিক পাঠের
ক্ষেত্রটি অবশ্যই ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি এবং একে কেন্দ্র করে বিকশিত গানের
ধারা।
রবীন্দ্রনাথের গান চিন্তায় চর্চাতে বাড়ির পরিজন এবং স্বজন
অনেকেরই প্রভাব ছিল নিশ্চয়। কিন্তু সর্বাধিক ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বস্তুত
রবীন্দ্রনাথের শৈশবে লেখা প্রথম গানটি তাঁর না নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের
এই নিয়ে একটি তর্ক আছে। একটি ব্রহ্মসংগীত -- ‘গগনের থালে রবি
চন্দ্র দীপক জ্বলে’। গানটি গুরু নানক
রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ। তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮১ (জানুয়ারি, ১৯৭৫) সংখ্যায়
এটি প্রকাশিত হয়।১১ তাঁর শেষ গানটি হল ‘হে নূতন দেখা দিক
আর বার’। ১৯৪১ সালে জীবদ্দশায় শেষ জন্মদিনে এটি পরিবেশিত হয়েছিল। ২২৩১টি
বাংলা গানের বৈচিত্র্যে তিনি স্বয়ং বাংলা গানের একটি ধারা তৈরি করেছেন। কিন্তু কেউ
একে ‘রবীন্দ্র ঘরানা’ বলে চিহ্নিত করেন নি। সম্ভবত রাগসঙ্গীতের সঙ্গে তিনি যে
বৈরিতা তৈরি করে ছিলেন—সেই জন্যেই দীর্ঘদিন সংশয় ছিল তাঁর গানগুলোকে কী নামে
চিহ্নিত করা হবে। বস্তুত তাঁর গানের জনপ্রিয়তাও ছিল না,না ছিল গায়ক মহলে সেরকম
স্বীকৃতি।‘আমোদলিপ্সু অর্ধশিক্ষিত শ্রোতৃসমাজ’ বলে যাদের এই একুশ শতকেও ব্রাত্য
করছেন রাজ্যেশ্বর মিত্র,সেরকম ব্রাত্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানও প্রথম যুগে
হয়েছিল। রবীন্দ্রসংগীত প্রথম সংকলিতও হয়েছিল যে বইগুলোতে সেগুলোর নাম
এরকম---‘কলিকাতার বেশ্যাসংগীত’ (১৮৯৪), ‘থিয়েটার সংগীত ও বেশ্যাসংগীত’ (১৮৯৭),
‘বেশ্যাসংগীত’ (১৯১১) ‘বাইজী সংগীত’
(১৯২৯)। এবং কারো কারো
কাছে ‘বেবুস্যের ছলাগীতি’ বলে নিন্দিত হচ্ছিল।১২ ১৯৩৭এ প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত এবং অভিনীত ছায়াছবি
‘মুক্তি’তে পঙ্কজ কুমার মল্লিক রবীন্দ্রনাথের ‘শেষখেয়া’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে
গাইলেন। সঙ্গে আরো তিনটি গান।এমন আরো কেউ কেউ গাইতে শুরু করলেন। কিন্তু তবু কিন্তু
রবীন্দ্র সংগীত জাতে উঠে নি। দেবব্রত বিশ্বাসও এই সময় থেকেই তাঁর গান করেন। কিন্তু
তিনিও স্বভাবে রবীন্দ্রনাথের মতোই। শান্তিনিকেতনে থাকতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঠ নেন
নি। তিনি গাইতেন আপন স্বভাবে। ফলে আজীবন বিশ্বভারতীর সঙ্গে গান নিয়ে তাঁর বিরোধ
লেগেই ছিল। সেই দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর ছেলেবেলাতে চেনা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে
হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে এক সাক্ষাৎকারে
জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি কোনো আকর্ষণই ছিল
না। জনাকয় রবীন্দ্রভক্ত ছাড়া রবীন্দ্রসংগীতকে কেউ ‘পাত্তা’ই দিতেন না। “...তখনকার
দিনে আজকালকার মতো স্বরবিতান নামধারী কোন স্বরলিপির বই ছিল না। ছিল কয়েক খণ্ড
গীতলিপি আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারখন্ড স্বরলিপি বই।’১৩ শান্তি
নিকেতনে তখন দিনেন্দ্রনাথ স্বয়ং এবং ইন্দিরা দেবী, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ জনাকয় শিক্ষক
গান শেখাতেন। সুচিত্রা মিত্র, জর্জ বিশ্বাস প্রমুখ যাদেরই নাম আমরা পরবর্তী কালে
রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী বলে চিনি তাঁরা সবাই ১৯৪১এর পরে পরিচিতি লাভ করেন। জীবৎ
কালে রবীন্দ্রনাথের গান যে সেরকম জনপ্রিয় ছিল না এর সাক্ষী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। এর
কারণও তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করছেন, স্বভাবসুলভ রসিকতা করেই ১৯৪০এর একটি বক্তৃতাতে “বাল্যকালে আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল
না; সুদূর থেকে অযোধ্যা গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে,
ওস্তাদ আসত। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ওস্তাদ
ঘরেও বাঁধা ছিল। কিন্তু
আমার একটা গুণ আছে–তখনো কিছু শিখি নি,
মাস্টারির ভঙ্গি দেখালেই দৌড় দিয়েছি। যদুভট্ট
আমাদের গানের মাস্টার আমায় ধরবার চেষ্টা করতেন। আমি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় দিতাম। তিনি আমাদের
কানাড়া গান শিখাতে চাইতেন। বাংলাদেশে এরকম ওস্তাদ জন্মায় নি। তাঁর প্রত্যেক গানে একটা originality
ছিল, যাকে আমি বলি স্বকীয়তা। আমি অত্যন্ত ‘পলাতকা’ ছিলুম
বলে কিছু শিখি নি,নইলে কি তোমাদের কাছে
আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম,পালিয়ে না বেড়াতুম,তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই
আমি এক
কৌশল করেছি–কবিতার-কাছঘেঁষা সুর
লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ
বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো।
সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব’লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে,
আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে–অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে
আমি গান শিখি নি–এতে সহজে শেখা যায় না,
শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি।”১৪
অনুরাগীরা ‘রবীন্দ্রবাবুর গান’ গাইতেন, শুনতেন। ‘রবীন্দ্রসংগীত’
শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৯এ।
এরও বেশ কছর বেতারে তাঁর গান প্রচারিত হতে শুরু করলে তাঁরা ‘রবীন্দ্রসংগীত’
কথাটির ব্যবহার শুরু করেন। একই সময়ে গ্রামাফোন রেকর্ডের শিল্পী পরিচিতিতে কখনো বা
‘রবীন্দ্রসংগীত’ কথাটি ব্যবহৃত হলেও তাঁদের লেবেলে লেখা থাকত ‘রবীন্দ্র-গীতি’।১৫ তখন থেকে তাঁর
জন্মশতবার্ষিকী অব্দি বাংলা আধুনিক গানের
অন্যান্যদের গানের ভিড়ে পরিচিতি বিভ্রান্তি নিয়েই এগোচ্ছিল রবীন্দ্রসংগীত। ১৯৪১-এ
রবীন্দ্রনাথের আশি-সংখ্যক জন্মদিনে বুদ্ধদের বসু তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকার একটি নিবন্ধে ঘোষণা দিলেন, “সমগ্র
রচনাবলীর মধ্যে গানগুলি সবচেয়ে রাবীন্দ্রিক।” সেই প্রবন্ধের নাম ছিল ‘রবীন্দ্রনাথের গান’।১৬ জন্মশতবর্ষে গোটা
ভারতেই, এবং বিশেষ করে যেখানেই বাঙালি থাকেন--- তাঁকে নিয়ে নতুন চর্চা শুরু হয়।
তাঁর রচনাবলীর নয়া সংকলনের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে বহু বই পত্রপত্রিকা যেমন বেরোয়, বহু
সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠানাদি হয়। তাঁর নাটকগুলো হতে থাকে...। বছর কয় আগেই শম্ভু মিত্র –তৃপ্তমিত্র
জুটি ‘রক্তকরবী’ করেছেন। ‘চার অধ্যায়ে’র নাট্যরূপান্তর মঞ্চস্থ করেছেন। এর পরে যখন
ঋত্বিক ঘটক ১৯৬০এ ‘মেঘে ঢাকা তারা’
ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ শুরু করলেন,তিনি নিজে তো বটেই সত্যজিৎ
রায়,তপন সিংহের মতো একাধিক পরিচালক পরপর একাধিক ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপক প্রয়োগ করবার ফলে স্বতন্ত্র মর্যাদা নিয়ে
গানগুলো ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। বাকি ভারতীয়ের কাছে যেমন তেমন বাঙালির যাবতীয় সংগ্রাম
থেকে সংস্কার সবকিছুর আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে গেল রবীন্দ্র সংগীত। এই না হলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের
জাতীয় সংগীত হতো কিনা রবীন্দ্রসংগীত সংশয় আছে। যদিও পুবপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত
নিষিদ্ধ হওয়াও এর প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এরপরে জন্মের ১২৫ বছর, ১৫০ বছরে
সাগরের ফিরে ফিরে আসা ঢেউয়ের মতো ফিরে এসেছে রবীন্দ্রগানের প্রতি মানুষের আগ্রহ।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন শতকে রবীন্দ্ররচনার উপর থেকে বিশ্বভারতীর বিধিনিষেধ
উঠে যাওয়া। তাতে ‘উহ লা লা’-র পাগলা হাওয়াও বইছে।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গান নিয়েই বিভ্রান্তি একটা ছিলই। বাংলা
গীতাঞ্জলিতেই ১৫৭টি কবিতার ৮৫টি ছিল সুরারোপিত গান। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে তাই মূল
গীতাঞ্জলি থেকে ৫৩টি মাত্র কবিতা নিয়ে অন্যান্য কবিতার বই থেকেও বহু কবিতা অনুবাদে
সংকলিত হতে দেখি। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-তে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের যে ষোলটি
কবিতা নির্বাচন করেছিলেন তাতে চারটি গানও রয়েছে। পরবর্তীকালে ‘সঞ্চয়িতা’ এবং ‘গীতবিতানে’ সংকলিত পদ্যগুলো
দেখে লোকে সহজেই গান কবিতা পৃথক করে ফেলেন। গান ও কবিতা নিয়ে থাকেন এমন আমজনতার মধ্যে দেখেছি, অনেকেই ‘গীতাঞ্জলি’কে
আলগা করে ধরে এ দুটিকেই রবীন্দ্ররচনা ‘সমগ্র’ বলে জানেন, এবং মানেন। সবার তো আর
‘রচনাবলী’ দেখার এবং রাখার সৌভাগ্য হয় না, ফলে পড়বারও আগ্রহ হয় না। তো, সেই ‘গীতবিতানে’র
জন্মকথা ধরে এগোলেও কিছু ধারণা মিলবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা কতটুকু কী ছিল। ১৯৩১এ
রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর পূর্তিকে উপলক্ষ করে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে,
সুধীর চন্দ্র করের সম্পাদনায় বিশ্বভারতী থেকে তাঁর ‘গান’গুলোকে একত্র করে প্রকাশিত
হয় গীতবিতান ১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯৩২এ ৩য় খণ্ড। প্রতিটি খণ্ডের মুদ্রণ সংখ্যা ছিল ২২০০। এর প্রচুর কপি অবিক্রীত পড়েছিল। তবু দিনেন্দ্রনাথের অকাল
মৃত্যুর পরে ১৯৩৯-৪০এ দুইখণ্ডে
রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পাদনাতে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন।এবারে গানগুলোকে
পূজা,স্বদেশ, প্রেম,প্রকৃতি, বিচিত্র এবং আনুষ্ঠানিক নামে পর্যায় বিভাগে সাজিয়ে
নেন। সেটির প্রতিলিপি খুব কম ছাপা হয়েছিল, তাও বেশি চলেনি। তবু আবার কিছু রদবদল
করে মৃত্যুর ছয়মাস পরে ১৯৪২এ আবার ছেপে বেরোয় সেই দুই খণ্ড। ১৯৪৫-এ এর আবার ৩য়
খণ্ড প্রকাশিত হয় নৃত্যনাট্য এবং অন্যান্য সূত্র থেকে কিছু গান নিয়ে।১৯৬৫র শেষের
দিকে প্রকাশিত হয় অখণ্ড ‘গীতবিতান’। এই অখণ্ড গীতবিতানই এর পরে থেকে ঘরে ঘরে পৌঁছুতে শুরু করে।
সময়টি তাঁর শতবর্ষ পরবর্তীকাল, এটা মনে রাখতে হবে। এই গীতবিতানে এমন কিছু গানও ছিল
যেগুলো কোনো কবিতার বইতে নেই। উলটো দিকে,তাঁর গানকে কবিতা বলে পড়ে ফেলবার বা
পড়াবার প্রবণতা এতোই যে এখনো দেখা যায় অনেকে গীতবিতান থেকে আবৃত্তি করছেন। অবশ্য
বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রশতবর্ষেই একটি প্রবন্ধে লক্ষ্য করেছিলেন, “শিক্ষিত তরুণেরাও
গানের দ্বারা যতদূর মোহিত তাঁর পঠনীয় রচনাদির সঙ্গে ততদূর পরিচিত নন”১৭
এই ‘শিক্ষিত তরুণ’ দের সংখ্যা তখনো খুব বেশি হবার কথা নয়, আর সব শিক্ষিতদের
সম্পর্কে কথাটি এখনো সত্য নয়। কিন্তু যারা গান জানেন চেনেন তাঁরা রবীন্দ্র সংগীতকে
দেবব্রত বিশ্বাসের ছেলেবেলার মতো ‘পাত্তা’ দিতেন না — এটি এখন দেখা যাবে না বললেই
চলে। কারণ এখন রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী দিয়েই বাঙালির ছেলেমেয়েদের গানের পাঠ শুরু হয়।
এই ‘পাত্তা’ না দেবার মূল কারণটি তৈরি করেছিলেন প্রথমে
স্বয়ং ঠাকুর বাড়ি,পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি সব ‘ঘরানা’র থেকে সজ্ঞানে বেরিয়ে
এসেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এখন যদিও লেখা প্রবন্ধ গুণে শেষ করা কঠিন, স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথ গান নিয়ে বেশি লেখেন নি। যদিও প্রথম প্রবন্ধ ‘সংগীত ও ভাব’ লিখেছিলেন
মাত্র বিশ বছর বয়সে ১৮৮১তে। সেটি আদতে ছিল বেথুন সোসাইটির আহ্বানে মেডিকেল কলেজ
হলে অনুষ্ঠিত একটি সভাতে দেওয়া বক্তৃতা। সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেন ইয়ং বেঙ্গল দলের
তখনো জীবিত সদস্য রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।১৮ সেখানেই তিনি
‘শাস্ত্রের লৌহকারা’ থেকে গানকে মুক্ত করে দেবার কথা
লিখেছেন, আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। ওই প্রবন্ধে তারুণ্যের উৎসাহে তাঁর লেখা এই কথাগুলো সংগীত চিন্তার সামাজিক কালটি বুঝতে সাহায্য করে,
“আমাদের বঙ্গসমাজে একটা আন্দোলন উপস্থিত
হইয়াছে, এমন-কি, সে আন্দোলনের এক-একটা তরঙ্গ য়ুরোপের উপকূলে গিয়া
পৌঁছাইতেছে। এখন হাজার চেষ্টা করো-না, হাজার
কোলাহল করো-না কেন, এ তরঙ্গ রোধ করে
কাহার সাধ্য! এই নূতন আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে সংগীতের নব অভ্যুদয় হইয়াছে। সংগীত সবে
জাগিয়া উঠিয়াছে
মাত্র, কাজ ভালো করিয়া আরম্ভ
হয় নাই। এখনো সংগীত লইয়া নানা প্রকার আলোচনা আরম্ভ হয় নাই, নানা
নূতন মতামত উত্থিত হইয়া আমাদের দেশের সংগীতশাস্ত্রের বদ্ধ জলে একটা জীবন্ত তরঙ্গিত স্রোতের সৃষ্টি
করে নাই। কিন্তু
দিন দিন সংগীত-শিক্ষার যেরূপ বিস্তার হইতেছে, তাহাতে সংগীত-বিষয়ে একটা আন্দোলন হইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে
বোধ করি। এ বিষয় লইয়া একটা তর্ক-বিতর্ক দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্ব না হইলে ইহার তেমন একটা
দ্রুত উন্নতি হইবে
না।”১৯ অর্থাৎ
সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশের বিষয়টিতে
রবীন্দ্রনাথ সেই বয়সেই সচেতন ছিলেন। ওখানেই লিখছেন, খানিক পরে “আমরা যখন কবিতা পাঠ করি তখন তাহাতে
অঙ্গহীনতা থাকিয়া যায়; সংগীত
আর কিছু নয়–সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে
কবিতা পাঠ করা।”২০ তিনি রাগ-রাগিণীকে নিষিদ্ধ করতে বলেন
নি। তাঁর বক্তব্য ছিল, যখন সেগুলোর উদ্ভব হয়েছিল ভাবের বাহন হতেই হয়েছিল। “কিন্তু এখন তাহা কী হইয়া দাঁড়াইয়াছে?
এখন রাগরাগিণীই উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে
রাগরাগিণীর হস্তে ভাবটিকে সমর্পণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সে রাগরাগিণী আজ বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক ভাবটিকে হত্যা করিয়া স্বয়ং
সিংহাসন দখল করিয়া
বসিয়া আছেন। আজ গান শুনিলেই সকলে দেখিতে চান, জয়জয়ন্তী, বেহাগ
বা কানেড়া
বজায় আছে কি না।”২১ বক্তৃতাটির শেষে তাঁর নিবেদন, “গায়কেরা সংগীতকে যে আসন দেন, আমি সংগীতকে তদপেক্ষা উচ্চ আসন দিই; তাঁহারা সংগীতকে কতকগুলা চেতনাহীন জড় সুরের উপর স্থাপন করেন, আমি তাহাকে জীবন্ত অমর ভাবের উপর স্থাপন
করি। তাঁহারা গানের কথার উপরে সুরকে দাঁড় করাইতে চান, আমি গানের কথাগুলিকে সুরের উপরে দাঁড় করাইতে চাই। তাঁহারা কথা
বসাইয়া যান সুর
বাহির করিবার জন্য, আমি সুর বসাইয়া যাই
কথা বাহির করিবার জন্য।”২২
তাঁর প্রস্তাব, “আমাদের
সংগীতবিদ্যালয়ে সুর-অভ্যাস ও রাগরাগিণী-শিক্ষার শ্রেণী আছে, সেখানে রাগরাগিণীর ভাব-শিক্ষারও শ্রেণী স্থাপিত হউক।”২৩ এই বক্তৃতার কথাগুলোকেই আরো খানিক গভীরে
নিয়ে গিয়েছেন, একই বছরের পরের লেখাতে । সংগীত নিয়ে হার্বার্ট স্পেনসরের অভিমত
বুঝবার চেষ্টা করেছেন। প্রথমটিতে যেখানে রাগের উপরে ভাবকে চড়িয়ে এগুতে চাইছেন,
এইবারে ভাবের সামাজিক উপযোগিতার কথা লিখছেন, “সংগীতের উপযোগিতা সম্বন্ধে স্পেন্সর বলিতেছেন–আপাতত মনে হয় যেন সংগীত শুনিয়া যে অব্যবহিত
সুখ হয়, তাহাই সাধন করা
সংগীতের কার্য। কিন্তু সচরাচর দেখা যায়, যাহাতে
আমরা অব্যবহিত সুখ পাই তাহাই তাহার চরম ফল নহে। আহার করিলে ক্ষুধা-নিবৃত্তির সুখ হয় কিন্তু
তাহার চরম ফল শরীর-পোষণ, মাতা স্নেহের বশবর্তী হইয়া
আত্মসুখসাধনের জন্য যাহা করেন তাহাতে সন্তানের মঙ্গলসাধন হয়...”২৪ সেখানেই শেষে উদাহরণ
যোগে স্পষ্ট করছেন, তিনি কেমন গান চাইছেন, “সংগীতকে যদি শুদ্ধ কেবল শিল্প, কেবল মনোহারিণী বিদ্যা বলিয়া ধরা যায়, তাহা হইলেও স্বীকার করিতে হয় যে, আমাদের দেশীয় অনুভাবশূন্য সংগীত নিকৃষ্ট শ্রেণীর। চিত্রশিল্প দুই প্রকারের আছে।
এক–অনুভাবপূর্ণ মুখশ্রী ও প্রকৃতির অনুকৃতি, দ্বিতীয়–যথাযথ রেখাবিন্যাস-দ্বারা একটা নেত্ররঞ্জক আকৃতি নির্মাণ করা। কেহই অস্বীকার
করিবেন না যে, প্রথমটিই উচ্চতম
শ্রেণীর চিত্রবিদ্যা। আমাদের দেশে শালের উপরে, নানাবিধ কাপড়ের পাড়ে, রেখাবিন্যাস
ও বর্ণবিন্যাস দ্বারা
বিবিধ নয়নরঞ্জক আকৃতি-সকল চিত্রিত হয়, কিন্তু
শুদ্ধ তাহাতেই আমরা ইটালীয়দের
ন্যায় চিত্রশিল্পী বলিয়া বিখ্যাত হইব না। আমাদের সংগীতও সেইরূপ সুরবিন্যাস মাত্র,
যতক্ষণ আমরা তাহার মধ্যে অনুভাব না
আনিতে পারিব, ততক্ষণে আমরা উচ্চশ্রেণীর
সংগীতবিৎ বলিয়া গর্ব করিতে পারিব না।”২৫
এই দুই প্রবন্ধের
কথাগুলোর প্রতিধ্বনি পড়া যাবে প্রায় একই সময়ে লেখা ‘সংগীত ও কবিতা’ প্রবন্ধে।
প্রবন্ধটি তাঁর প্রথম যৌবনেই আটের দশকে প্রকাশিত ‘সমালোচনা’ বইতে সংকলিত হয়েছিল।
বইটির সব প্রবন্ধই সম্ভবত ‘ভারতী’ পত্রিকাতে বেরিয়েছিল।পরে রচনাবলীর মূল অংশ থেকে
বর্জিত হয়েছিল। সেই বইতেই একটি প্রবন্ধ আছে ‘বাউলের গান’। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, এই নামে
তিনি ১৮৮৩ এবং ৮৪তে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু আমরা ১২৫ বছরে বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী এবং ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা
পরিষদের রবীন্দ্ররচনাবলীর ওয়েব সংস্করণে দুটি প্রবন্ধ পাইনি। সুকুমার সেনের
‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে’ও ‘সমালোচনা’ বইতে প্রকাশিত এই একটি প্রবন্ধের কথাই
রয়েছে। বাউল গানের একটি সংকলনের সমালোচনা
প্রসঙ্গে প্রবন্ধটি লেখা। বইটির নামের উল্লেখ কোথাও নেই।২৬ ‘ভাব’ নিয়ে
কথাগুলো বলে আসবার পরে পরেই ‘বাউলে’র কথাতে চলে আসতে হলো বলে, আরেকটি কথা অবশ্য
লিখে রাখা ভালো যে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের সেই ‘ভাব’কে বাউলের ভাবের সঙ্গে একাকার
করে ভাবেন। অর্থাৎ ভাব যেন আধ্যাত্মসাধনার বিষয়। সুকুমার সেনও সেইদিকটিতে জোর
দিয়েছেন। আমরা সেরকম মনে করি না। সেরকম হলে গীতবিতানের ‘পর্যায়’ বিভাজনটির দরকার
পড়ত না। গানের ভাব কথাটির মানে সেখানেই তিনি স্পষ্ট করেছিলেন। বস্তুত ১৩১২ বাংলাতে
তিনি ‘বাউল’ নামে একটি গানের পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন যেগুলো আসলে স্বদেশী গান,
রীতি এবং সুর বাউলের।২৭ আমরা উল্লেখ করে এসেছি রাজ্যেশ্বর মিত্রের কথা
পড়লে মনে হবে তিনি বাউল,কীর্তন আদি গানকে
ব্রাত্য তথা ‘ইতর সম্প্রদায়ের’ গান মনে করছেন। যদিও স্পষ্ট সেরকম লেখেন নি।
রবীন্দ্রনাথ মাত্র ২৩/২৪ বছর বয়সেই ‘বাউলের গানে’ আগ্রহী হচ্ছেন। একই সময়ে ১৮৮৪তে ‘ভানুসিংহ
ঠাকুরের পদাবলী’ প্রকাশিত হচ্ছে, এই কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। এবং সেই আগ্রহ
আজীবন তাঁর বজায় থাকবে। ‘বাউল গান’ শীর্ষক আরেকটি নিবন্ধ ‘সংগীত চিন্তা’ বইতেও
সংকলিত রয়েছে। সেটি মুহম্মদ মন্সুর উদ্দিনের ‘হারামণি’ নামে বাউল গানের একটি মহতি
সংকলনের ১ম খণ্ডের ভূমিকা,তিনি লিখে দিয়েছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের
বয়স যখন সত্তরের ঘরে। বাংলা ১৩৩৭এ। লিখে
দেবার কারণটি হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্নাতকোত্তর দশম শ্রেণিতে পড়বার
কালেই প্রবাসী পত্রিকাতে রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত লালনের গান পড়ে নিজেও সংগ্রহে
আকৃষ্ট হন। এবং ১১ খণ্ডে লালন সহ আরো বহু
সাধকের গানের সংকলনটি প্রকাশ করেন। বাকি খণ্ডগুলো বেশ কিছু দশক ধরে একে একে
প্রকাশিত হতে থাকে , পুব পাকিস্তানে এবং পরে বাংলাদেশেও। পাঁচ হাজারের বেশি গান
তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। ২১শে পদক সহ বাংলাদেশের সেরা সব জাতীয় পুরস্কারে তিনি
সম্মানিত হয়েছিলেন।
যাই হোক, যেদুটি প্রবন্ধের কথা আমরা লিখছি---তাতে
রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুই প্রবন্ধের ভাবনারই বিস্তার হচ্ছে। প্রথম দুটিতে যদি তিনি গানকে প্রাচীন অভিজাতদের
বৈঠকি আসরের বাইরে টেনে নিয়ে আসবার আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন, তবে ‘বাউলের গানে’ স্পষ্ট
তিনি বাইরের জগতটিকে টেনে বেশ গভীরে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে স্পষ্ট যে নতুন শিক্ষিত
মধ্যবিত্তরুচির কাছে আত্মসমর্পণের কথাও তিনি ভাবেন নি। বরং এই সমাজটির দৃষ্টি
গ্রাম-মফস্বলের দিকে আকর্ষণ করছেন। সত্য বটে অনাগরিক সেই সব গানকে এনে মধ্যবিত্ত
রুচিকেও গড়ে তুলবার চেষ্টা নিচ্ছেন, এবং তাদের মধ্যে সেগুলোর প্রতিষ্ঠা করছেন। এই
প্রবন্ধে তিনি বেশ স্পষ্ট করেই লিখছেন, “প্রকাশকের
সহিত এক বিষয়ে কেবল আমাদের ঝগড়া আছে। তিনি ব্রহ্মসংগীত ও আধুনিক ইংরাজিওয়ালাদিগের রচনাকে ইহার
মধ্যে স্থান দিলেন কেন? আমরা
ত ভাল গান
শুনিবার জন্য এ বই কিনিতে চাই না। অশিক্ষিত অকৃত্রিম হৃদয়ের সরল গান শুনিতে চাই। প্রকাশক
স্থানে স্থানে তাহার বড়ই ব্যাঘাত করিয়াছেন।”২৮ এই ক্ষোভের কারণটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর
পরে পরেই লিখছেন, “আমরা কেন যে প্রাচীন
ও ইংরাজিতে অশিক্ষিত লোকের রচিত সংগীত বিশেষ করিয়া দেখিতে চাই তাহার কারণ আছে। আধুনিক
শিক্ষিত লোকদিগের অবস্থা পরস্পরের সহিত প্রায় সমান। আমরা সকলেই একত্রে শিক্ষালাভ করি, আমাদের সকলের হৃদয় প্রায় এক ছাঁচে ঢালাই করা। এই নিমিত্ত আধুনিক হৃদয়ের নিকট হইতে আমাদের হৃদয়ের
প্রতিধ্বনি পাইলে আমরা তেমন চমৎকৃত হই
না। কিন্তু প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে যদি আমরা আমাদের প্রাণের একটা মিল খুঁজিয়া পাই, তবে আমাদের কী বিস্ময়, কী আনন্দ! আনন্দ কেন হয়? তৎক্ষণাৎ সহসা মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতালোকে আমাদের
হৃদয়ের অতি বিপুল স্থায়ী প্রতিষ্ঠাভূমি দেখিতে পাই বলিয়া...”২৯ । দ্বিতীয় যে প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করলাম,
সেটির শুরুতে তিনি মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং কাজের প্রশংসা করে যে কথাটি লিখলেন, সেখানে সেই
রাগসংগীত নিয়ে গতানুগতিকতার অভিযোগটি
যেরকম তার ছিল, সেই অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি শুনা গেল,“সকল সাহিত্যে যেমন লোকসাহিত্যেও তেমন, তার ভালোমন্দর ভেদ আছে। কবির প্রতিভা থেকে যে রসধারা বয় মন্দাকিনীর মতো,
অলক্ষ্যলোক থেকে সে নেমে আসে; তার পর একদল লোক আসে যারা খাল কেটে সেই জল
চাষের ক্ষেতে আনতে লেগে যায়। তারা মজুরি করে; তাদের হাতে এই ধারার গভীরতা, এর বিশুদ্ধতা চলে যায়–কৃত্রিমতায়
নানা প্রকারে
বিকৃত হতে থাকে।”৩০
কিন্তু সংগীতটি লোকসংগীত বলেই লোকগানের কৃত্রিমতা দেখে ফেলে দিতে তিনি রাজি নন।
কারণ, “তবু তার ঐতিহাসিক
মূল্য আছে। অর্থাৎ, এর থেকে স্বদেশের
চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়।”৩১
গান নিয়ে লিখবেন বলে সেরকম প্রবন্ধ
তিনি লেখেনই নি। বিশ বছর বয়সের দুটির একটি যেমন বক্তৃতা, বাউল গান নিয়ে লেখা দুটির
একটি সমালোচনা, আরটি ভূমিকা---সেরকম বহু পরে ১৯১৫, ১৯১৭তে এবং ১৯২১শে সংগীতসঙ্ঘে তিনটি ভাষণ দেন।এর
প্রথমটি ‘সোনার কাঠি’ নামে ‘পরিচয়’ বইতে সংকলিত আছে। আর দুটি সংগীতচিন্তা সংকলনে—নাম
‘সঙ্গীতের মুক্তি’ ও ‘আমাদের সংগীত’। আরো কিছু ভাষণ,
চিঠিপত্রে তাঁর সংগীত ভাবনা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু মূল সারাৎসারটি ‘সঙ্গীতের মুক্তি’
প্রবন্ধে ধরা আছে। তাতে তাঁর সংগীতভাবনার মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ধারণাগুলো
স্পষ্টতর হয়েছে বা করেছেন মাত্র। তাই শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি,“রবীন্দ্রনাথের
গানভাবনা তাঁর প্রথম যৌবনেই এমন পাকা হয়ে গিয়েছিল যে, ‘পুনরুক্তির সম্রাট’
রবীন্দ্রনাথ তা নিয়ে পরিণত বয়সে নিদেন পক্ষে সুষ্ঠু প্রবন্ধাকারে, তেমন কচলাননি।”৩২
মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৪০ এ একটি বক্তৃতা দিতে
গিয়ে নিজেই বলছেন, “গানের কথা আমি বলি
গানেতেই,গানের কথা আমাকে ফের
যদি বলতে হয় ভাষাতে,তবে আমার উপর কি জুলুম হয়
না? পুরানো পুঁথিপত্র খুঁজলে দেখবে গান
সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ
কী বলেছে–যথেষ্ট বলেছে।”৩৩
‘সোনার কাঠি’-র
রূপকটি কোন রূপকথার গল্প থেকে নেওয়া সবাই জানেন। সেখানে তিনি সহজ নজির দিয়ে সহজ
করে কথাগুলো বলছেন, “আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে
গান জিনিসটা চলছে না।ওস্তাদরা বলছেন,গান
জিনিসটা তো চলবার জন্যে হয় নি, সে
বৈঠকে বসে থাকবে তোমরা এসে সমের কাছে খুব জোরে মাথা নেড়ে যাবে;কিন্তু মুশকিল এই যে, আমাদের বৈঠকখানার যুগ চলে
গেছে, এখন আমরা যেখানে একটু
বিশ্রাম করতে পাই সে মুসাফিরখানায়।
যা - কিছু স্থির হয়ে আছে তার খাতিরে আমরা স্থির হয়ে থাকতে পারব না। আমরা যে নদী বেয়ে চলছি সে নদী
চলছে, যদি নৌকোটা না চলে
তবে খুব দামি
নৌকো হলেও তাকে ত্যাগ করে যেতে হবে।” ৩৪এই দামি নৌকা ত্যাগ করে যাবার ব্যাপারটি
বাংলাতে আগেও ঘটেছিল। শ্রীচৈতন্যের কালে। তিনি লিখছেন, “চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্ম যে হিল্লোল তুলিয়াছিল
সে একটা শাস্ত্রছাড়া
ব্যাপার। তাহাতে মানুষের মুক্তি-পাওয়া চিত্ত ভক্তিরসের আবেগে
আত্মপ্রকাশ করিতে ব্যাকুল হইল। ... তখন পয়ার ত্রিপদীর বাঁধা ছন্দে প্রচলিত
বাঁধা কাহিনী পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা আর চলিল না। বাঁধন ভাঙিল–সেই বাঁধন [ভাঙা] বস্তুত প্রলয় নহে, তাহা সৃষ্টির উদ্যম। ...
বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণবকাব্যেই সেই বৈচিত্র্যচেষ্টা প্রথম দেখিতে পাই। ...এই স্বাতন্ত্র্যচেষ্টা কেবল কাব্যছন্দের মধ্যে নয়, সংগীতেও দেখা দিল।
সেই উদ্যমের মুখে কালোয়াতি গান আর
টিঁকিল না। তখন সংগীত এমন-সকল সুর খুঁজিতে লাগিল যাহা হৃদয়াবেগের বিশেষত্বগুলিকে প্রকাশ করে,
রাগরাগিণীর সাধারণ রূপগুলিকে নয়। তাই সেদিন
বৈষ্ণবধর্ম শাস্ত্রিক পণ্ডিতের কাছে যেমন অবজ্ঞা পাইয়াছি।ওস্তাদির
কাছে কীর্তন গানের তেমনই অনাদর ঘটিয়াছে।৩৫ গানের কিছুই জানেন
না বলে শুরু করে এই বক্তৃতাতে তিনি সুর তাল লয় ছন্দ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন
এবং এক জায়গাতে এসে রাগ-রাগিণীর অনুকূলেও এই কথা বলছেন, “...তবু যত দৌরাত্ম্যই করি-না কেন, রাগরাগিণীর এলাকা একেবারে পার হইতে পারি নাই। দেখিলাম তাদের খাঁচাটা এড়ানো চলে,
কিন্তু বাসাটা তাদেরই বজায় থাকে। আমার বিশ্বাস এই
রকমটাই চলিবে।কেননা,আর্টের পায়ের বেড়িটাই
দোষের,কিন্তু তার চলার বাঁধা পথটায়
তাকে বাঁধে না।”৩৬
একে অনেকেই তাঁর ‘সমে ফেরা’ বলে দাবি করেন। আসলে কিন্তু তিনি আছেন, তাঁতেই।
কীর্তনের প্রসঙ্গে যেমন কালের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন, বাউল গানের প্রসঙ্গে তিনি
স্থানের গভীরে ভ্রমণ করতে নগর থেকে বেরিয়ে গিয়ে লিখছেন, “একবার যদি আমাদের বাউলের সুরগুলি আলোচনা করিয়া দেখি তবে দেখিতে
পাইব যে, তাহাতে আমাদের
সংগীতের মূল আদর্শটাও বজায় আছে, অথচ
সেই সুরগুলা স্বাধীন। ক্ষণে ক্ষণে এ রাগিণী,ও
রাগিণীর আভাস পাই, কিন্তু ধরিতে পারা
যায় না। অনেক কীর্তন
ও বাউলের সুর বৈঠকি গানের একেবারে গা ঘেঁষিয়া গিয়াও তাহাকে স্পর্শ করে না। ওস্তাদের আইন
অনুসারে এটা অপরাধ। কিন্তু বাউলের সুর যে একঘরে, রাগরাগিণী যতই চোখ রাঙাক সে কিসের কেয়ার করে!এই সুরগুলিকে কোনো রাগকৌলীন্যের জাতের
কোঠায় ফেলা যায় না বটে, তবু
এদের জাতির পরিচয় সম্বন্ধে ভুল হয় না–স্পষ্ট
বোঝা যায় এ আমাদের দেশেরই সুর, বিলিতি
সুর নয়।” ৩৭এইভাবে নিজের ভাবনাগুলো যে তাঁর আদৌ একক ভাবনা নয়,
বাংলার প্রবহমান পরম্পরার উত্তরাধিকার সেই কথাটি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন পরের
বক্তৃতাতে, “মানুষের মধ্যে
প্রকৃতিভেদ আছে, সেই ভেদ অনুসারে
সংগীতের এই দুই রকমের অভিব্যক্তি হয়। তার প্রমাণ দেখা যায় হিন্দুস্থানে আর
বাংলাদেশে। কোনো সন্দেহ
নেই যে, বাংলাদেশে সংগীত
কবিতার অনুচর না হোক, সহচর বটে। কিন্তু পশ্চিম হিন্দুস্থানে
সে স্বরাজে প্রতিষ্ঠিত; বাণী
তার ‘ছায়েবানুগতা’ ভজন-সংগীতের কথা যদি ছেড়ে দিই, তবে দেখতে পাই পশ্চিমে সংগীত যে বাক্য আশ্রয় করে তা অতি তুচ্ছ।
সংগীত সেখানে স্বতন্ত্র, সে
আপনাকেই প্রকাশ করে। বাংলাদেশে হৃদয়ভাবের স্বাভাবিক প্রকাশ ... বাণীর প্রতিই বাঙালির অন্তরের টান;এইজন্যেই ভারতের মধ্যে এই প্রদেশেই
বাণীর সাধনা
সব চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু একা বাণীর মধ্যে তো মানুষের প্রকাশের পূর্ণতা হয়
না-এইজন্যে বাংলাদেশে সংগীতের স্বতন্ত্র পঙ্ক্তি নয়, বাণীর পাশেই তার আসন। এর প্রমাণ দেখো আমাদের কীর্তনে।এই কীর্তনের সংগীত অপরূপ কিন্তু
সংগীত যুগল
ভাবে গড়া–পদের সঙ্গে মিলন হয়ে
তবেই এর সার্থকতা। পদাবলীর সঙ্গেই যেন তার রাসলীলা;স্বাতন্ত্র্য
সে সইতেই পারবে না।”৩৮অবশ্য বাংলার বাইরের লোকগান নিয়ে বলতে গেলে হয়তো তিনি
বাংলাদেশেরই মতো ‘বাণীর প্রতিই ... অন্তরের টান’-এর সন্ধান পেতেন। এই কথাটি মনে রাখা
ভালো। তো, এই রাসলীলাতেই তিনি আশা করছেন, “এমনি
করিয়া আমাদের আধুনিক সুরগুলি স্বতন্ত্র হইয়া উঠিবে বটে, কিন্তু তবুও তারা একটা বড়ো আদর্শ হইতে বিচ্যুত হইবে না। তাদের জাত
যাইবে বটে, কিন্তু জাতি যাইবে
না। তারা সচল হইবে, তাদের সাহস বাড়িবে,
নানারকম সংযোগের দ্বারা তাদের মধ্যে নানাপ্রকার শক্তি ও
সৌন্দর্য ফুটিয়া উঠিবে।”৩৯
রবীন্দ্রনাথের
‘জীবনদেবতা’ তত্ত্বটি যারা জানেন, তাঁরা তাঁর চিন্তায় বৈপরীত্যের ঐক্যটি জানেন।
রাগ-রাগিণীর বাঁধন অস্বীকার করাতে অনেকেই যে তাঁর গানকে গুরুত্ব দিতেন না সেই কথা
আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। লীলা মজুমদার তাঁর আত্মজীবনীতে দ্বিজেন্দ্রলালের ভাইপো
রবীন্দ্রলালের একটি উক্তির উল্লেখ করছেন। তিনি নিজেও সংগীত বিশারদ ছিলেন। লীলা
মজুমদারকে বলছিলেন,“‘রবীন্দ্রসংগীতকে গান বল মামিমা।’ আমি তো অবাক! ‘গান নয় বুঝি?
তবে কি? ‘ওগুলো হল সুর দেওয়া কবিতা।’’’ ৪০ তো, এমন খোটা তাঁকে শুনতেই
হতো। নিজের ক্ষোভের কথা ধূর্জটিপ্রসাদকে চিঠিতে লিখেছিলেন এই বলে, “বাংলাদেশে আমার নামে অনেক প্রবাদ
প্রচলিত; তারই অন্তর্গত একটি জনশ্রুতি আছে
যে, আমি হিন্দুস্থানী গান জানি নে, বুঝি নে। ... ইচ্ছা করলেও সংগীতকে আমি প্রত্যাখ্যান
করতে পারি নে; সেই সংগীত থেকেই আমি
প্রেরণা লাভ করি এ কথা যারা জানে না তারাই হিন্দুস্থানী সংগীত জানে না। হিন্দুস্থানী গানকে আচারের শিকলে যাঁরা অচল করে বেঁধেছেন,সেই ডিক্টেটারদের আমি মানি নে।” ৪১এর আগের চিঠিতে কথাগুলো
আরো স্পষ্ট করে লিখছেন, “আমাদের
গানেও হিন্দুস্থানী যতই বাঙালি হয়ে উঠবে ততই মঙ্গল, অর্থাৎ সৃষ্টির দিকে। স্বভবনে হিন্দুস্থানী স্বতন্ত্র, সেখানে
আমরা তার আতিথ্য ভোগ করতে
পারি—কিন্তু বাঙালির ঘরে
সে তো আতিথ্য দিতে আসবে না–সে নিজেকে দেবে, নইলে উভয়ের মিলন হবে না। যেখানে পাওয়াটা সম্পূর্ণ নয় সেখানে সে
পাওয়াটা ঋণ। আসল পাওয়ার ঋণের দায় ঘুচে যায়–যেমন
স্ত্রী, তাকে নিয়ে দেনায় পাওনায় কাটাকাটি হয়ে
গেছে। হিন্দুস্থানী সংগীত সম্বন্ধে আমার মনের ভাবটা ঐ। তাকে আমরা শিখব পাওয়ার জন্যে,
ওস্তাদি করবার জন্যে নয়।” ৪২ তা
এই ‘ওস্তাদি’টা করবেন না বলেই নিজের গানে রাগরাগিণীর উল্লেখ করতে তিনি নিষেধ
করেছিলেন। শুরুর দিকে কিছু কিছু গানে সেই সব উল্লেখ থাকত, এখনো থাকে। কিন্তু
সেগুলো আদৌ চেনা রাগতত্ত্বের সঙ্গে খাপ খায় না। ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’-তেই তাঁর গানের
সচেতন পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। ইংরেজি সুর প্রভাবিত গানেও রাগ লেখা থাকে জংলা ভূপালি
বা মিশ্রকেদারা ---ইত্যাদি। ফলে তিনি দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে
যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই স্বরলিপির পথ ধরেই এগোলেন। নিজে করেন নি। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর,রমা
কর,শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ অনেকে স্বরলিপিতে হাত দিয়েছিলেন। এবং ‘স্বরবিতান’ নামে৬৪খণ্ডে তাঁর আরেক বিখ্যাত সংকলন রয়েছে। আমরা এর পরিচয় নিয়ে কথা বাড়াব না। কেবল
বলব,কৈশোর তারুণ্যে নাটকে তাঁর গানের প্রয়োগ হওয়া শুরু থেকে ঠাকুরবাড়ির বাইরের
মঞ্চেও কিছু কিছু নাটক অন্যেরাও অভিনয় করতে শুরু করেন। সেখানে বাইজীদের দিয়ে
স্ত্রীচরিত্রে অভিনয় করানো শুরু হয়েছিল। সেটি নিশ্চয় বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে একটি অগ্রপদক্ষেপ ছিল।
এবং সেখানেও ‘ভাবে’র আধিপত্য চলত। কিন্তু দর্শক মনোরঞ্জনের জন্যেই হোক, আর নিজেদের
রুচি বা শিক্ষার অনুসরণ করেই হোক---গানের ভাব পালটে যেত, অতএব সুরও। কখনো বা কথাও
পালটে দিতেন। সবটা হয়তো অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের নিজেদের ইচ্ছেতে হতো না। প্রযোজক
বা পরিচালকদের চাপেও হতো। এবং গীতিকবির নামে নয়,গানগুলো জনপ্রিয় হতো অভিনেতা বা
অভিনেত্রীর নামে। একালে সিনেমাতে যেমন হয়, অনেকেই গায়কের নাম জানেন না, জানলেও
গীতিকবি বা সুরকারদের নাম তো আরো না। ফলে ‘বেশ্যাসংগীত’ জাতীয় বইতে বটতলা থেকে
সংকলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান বাড়ির মেয়ে মহলেও ঢুকে যাচ্ছে, তখন তাঁর গান ‘বেবুশ্যের
ছলাগীতি’ বলে অপবাদও যে কিছু জুটিয়েছিল সে আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু এহেন
ঘটনা সর্বত্র ঘটছিল। নিজেও সুর সবসময় মনে রাখতে পারতেন না। ফলে তিনি রাগ-রাগিণীর
উল্লেখে নিষেধ করছেন ঠিকই, ইন্দিরা দেবীকে ১৯৩৫এর জানুয়ারিতে এক চিঠিতে লিখছেন, “গানের কাগজে রাগ রাগিণীর নাম-নির্দেশ না
থাকাই ভালো। নামের মধ্যে তর্কের হেতু থাকে, রূপের
মধ্যে না। কোন রাগিণী গাওয়া হচ্ছে বলবার কোনো দরকার নেই।
কী গাওয়া হচ্ছে সেইটেই মুখ্য কথা কেননা তার সত্যতা তার নিজের মধ্যেই চরম। নামের সত্যতা দশের মুখে, সেই দশের মধ্যে মতের
মিল না থাকতে পারে। কলিযুগে শুনেছি নামেই মুক্তি, কিন্তু
গান চিরকালই সত্যযুগে।”৪৩ দেড় বছরেও ইন্দিরা দেবী মতটি মানতে পারেন নি। ফলে পরের বছরে
জুনে আবার তাঁকে লিখছেন, “আমার
আধুনিক গানে রাগ-তালের উল্লেখ না থাকাতে আক্ষেপ করেছিস। সাবধানের বিনাশ নেই। ওস্তাদরা জানেন আমরা গানে রূপের দোষ আছে, তার
পরে যদি নামেরও ভুল হয় তা হলে দাঁড়াব কোথায়? ধূর্জটিকে
দিয়ে নামকরণ করিয়ে নিস।”৪৪
এখন, ধূর্জটি কী করেছিলেন আমরা সেই সন্ধানে গিয়ে পরিসর বাড়াচ্ছি না, তাঁর সঙ্গেও
কী আলাপ হয়েছিল আমরা দেখে এলাম। কিন্তু রাগের উল্লেখ থেকেও কঠিন কাজে অনুরাগে অনেককে
নামতে হলো। যিনি বলছিলেন, গানের মূল কথাটি হচ্ছে ভাব---সেই তিনি মোটেও রাজি ছিলেন
না--- গায়কের গলাতে পড়ে তাঁর নিজের ‘ভাব’টি ক্লিষে হয়ে মারা যাক। ১৯৪০এর জুনে,ছাত্রছাত্রীদের
কাছে বলছিলেন, কথাগুলো বহুবার বহুভাবে পুনরুল্লেখ হয়েছে, “খুব মনে পড়ে এই গান যেদিন শিখি। বড়দাদা সেজদাদারা দরজা বন্ধ
করে গান শিখতেন। ছেলেমানুষ, আমার
তথায় প্রবেশ ছিল না।কারণ,তখনকার দিনে ছেলেমানুষের
অনেক অপরাধ ছিল। তানপুরার কান কখনো মুড়ি নি। তবু দরজার পাশে কান
দিয়ে শুনেছি, সেটা হয়তো মনে রয়ে গেল।এমনি করে ছুঁয়ে
ছুঁয়ে যা শিখেছি তাই তোমাদের কাছে আওড়ালাম।তোমাদের যা
দিয়েছি,এই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যা শিখেছি তাই
দিয়েছি। আমার গান যাতে আমার গান ব’লে
মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে-তাদের মাটি
করে দাও-না, আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে
আমার মিনতি–তোমাদের গান যেন আমার
গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের
গান কিনা বুঝতে পারি না।
মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা
যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ
যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও
যেন আমার পক্ষে সেই রকম।”৪৫
প্রেম পর্যায়ে
তাঁর একটি গানের কথা আছে এরকম: পাছে
সুর ভুলি এই ভয় হয়–/পাছে ছিন্ন তারের
জয় হয়॥/পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন, পুণ্য লগন/হেলায় খেলায় ক্ষয় হয়–/পাছে বিনা গানেই
মিলনবেলা ক্ষয় হয়॥/যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে/পাছে
তার তালে মোর তাল না মেলে সেই
ঝড়ে।/যখন মরণ এসে ডাকবে শেষে বরণ-গানে, পাছে প্রাণে/মোর বাণী সব লয় হয়–/পাছে বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়॥
বাস্তব সেরকমটি হয় নি। গীতবিতান,স্বরবিতানের
প্রয়াস সেরকম হওয়ার থেকে তাঁর গানকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সমকালীন প্রায়
কোনো কবির গান সংরক্ষণের জন্যে কোনো পাকা ব্যবস্থা ছিল না। নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল,
অতুলপ্রসাদ—সবার সম্বন্ধে কথাগুলো সত্য। দ্বিজেন্দ্রনাথের গান তো তাঁর ছেলে দিলীপ
কুমার রায়ই অন্যরকম গাইতেন।৪৬ রবীন্দ্রনাথের বেলা সেটি সম্ভব করেছিল
বিশ্বভারতী। কিন্তু যে ‘শাস্ত্রের
লৌহকারা’ থেকে রবীন্দ্রনাথ গানের মুক্তি দাবি করেছিলেন—সেই কারাতে তাঁর গানও পরে বন্দি হয়েছিল। সে আরেক নয়া কারা। নয়া অধ্যায়।
যার জন্যে দেবব্রত বিশ্বাসের মতো অনেক শিল্পীর সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছিল।
দিনেন্দ্রনাথের কাজে রবীন্দ্রনাথ সবটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবু একটা অনুমোদন ছিল।কারণ
বহু গানের সংবাদ তাঁর কাছেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের পরে বিশ্বভারতী নিজেদের স্বরলিপি
দিনেন্দ্রনাথের নামে চালিয়েছে এমনটাও হয়েছে।এবং বিশ শতকের শেষে এসে দেখেছি আমরা
অনেকেই বিশ্বভারতীর কপিরাইট সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু
করেছিলেন। নতুন শতকে সেটি উঠলেই কেবল যে ‘বং কানেকশন’ ছবিতে শ্রেয়া ঘোষাল, নচিকেতা
সংস্করণের ‘উহ লা লালা পাগলা হাওয়ার বাদল
দিনে’-ই শ্রোতার দরবারে এসেছে তাই না,এর থেকেও বাজে জিনিস পত্র হয়েছে—যা নিয়ে
সাধারণত বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রে এখনো আলোচনা তেমন হয় নি। এই গানটি তবু রুচি রক্ষা
করে আম জনতার কাছে রবীন্দ্রনাথের গানকে নতুন করে পৌঁছে দিয়েছে। গেল এক শতক না হলেও
আধা শতকের বেশি কাল জুড়ে রবীন্দ্রসংগীত সবচাইতে পরিচিত একটি ‘ঘরানা’ হয়ে উঠেছে।
শুনে শুনে লোকে চিনতে পারেন কোনটি রবীন্দ্র সংগীত আর কোনটি নয়। তাই অভ্র বসু
লেখেন, “... গায়কীর তফাৎ হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে স্বীকৃতি পায়—কিন্তু সুরের ব্যত্যয়
একেবারেই গ্রাহ্য হয় না। অজয় চক্রবর্তীর মতো প্রতিষ্ঠিত এবং জনপ্রিয় শাস্ত্রীয়
সংগীত শিল্পী যখন রবীন্দ্রনাথের গানে শাস্ত্রীয় সংগীতের পরম্পরা মেনে ইম্প্রোভাইজ
করার চেষ্টা করেন---তখন সেটি কার্যত প্রত্যাখ্যাত হয়।”৪৭ অমিতাভ বচ্চনও
মাঝে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গেয়ে স্বয়ং দেশে একলা চলার চমক দেখিয়েছিলেন।
এই মাত্র। ফলে এখনই আমাদেরও আশঙ্কা করবার কোনো কারণ দেখি না, রবীন্দ্রনাথের
গান ‘ হেলায় খেলায় ক্ষয়’ হবে । তাঁরই তো ‘শেষবর্ষণ’
গীতিনাট্যের একটি গানে আছে : গান আমার যায় ভেসে যায়–/চাস্ নে ফিরে, দে তারে বিদায়॥/ সে যে দখিনহাওয়ায়
মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা,/সে যে
শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায়॥/কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা–/ মেঘের গায়ে রঙের
মায়া, খেলার পরে খেলা।/ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি গেল চলে কতই তরী–/উজান বায়ে ফেরে যদি কেহ রয় সে আশায়॥
আমরা সেই আশাতেই রইতেই পারি। নটরাজ সেই
গানের আগে বলছিলেন, “‘তার পরে’ প্রশ্নের উত্তর নেই
সব চুপ। এই তো সৃষ্টির লীলা এ তো কৃপণের পুঁজি নয়। এ
যে আনন্দের অমিতব্যয়। মুকুল ধরেও যেমন ঝরেও তেমনি। বাঁশিতে
যদি গান বেজে থাকে সেই তো চরম। তার পরে? কেউ চুপ করে শোনে, কেউ
গলা ছেড়ে তর্ক করে। কেউ মনে রাখে, কেউ
ভোলে,কেউ ব্যঙ্গ করে।তাতে কী আসে যায়?”৪৮
তথ্যসূত্র:
৩.রাজ্যেশ্বর মিত্র; বাংলা গানের আদিপর্ব : উনিশ শতকের বাংলা গান; প্রসঙ্গ : বাংলা
গান; ক্রোড়পত্র ২; অনুষ্টুপ; প্রাক-শারদীয় সংগীত সংখ্যা, ২০১৪ ;
পৃ: ৪৫৬
৪. রাজ্যেশ্বর মিত্র;প্রাগুক্ত।
৫.রাজ্যেশ্বর মিত্র; রবীন্দ্র-অভ্যুদয়ের
প্রাক্কালে বাংলার সংগীত : বাংলা গান; ক্রোড়পত্র ২; অনুষ্টুপ; প্রাক-শারদীয়
সংগীত সংখ্যা, ২০১৪; পৃ : ৪৭৩ ।
৬. রাজ্যেশ্বর মিত্র; প্রাগুক্ত; পৃ : ৪৭৬ ।
।
৮.সুকুমার সেন; বাঙ্গালা
সাহিত্যের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা; আনন্দ সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ
১৯৯৮; পৃ:৪২৯।
৯.রাজ্যেশ্বর মিত্র; রবীন্দ্র-অভ্যুদয়ের
প্রাক্কালে বাংলার সংগীত : বাংলা গান; ক্রোড়পত্র ২; অনুষ্টুপ; প্রাক-শারদীয়
সংগীত সংখ্যা, ২০১৪; পৃ : ৪৮৩ ।
১০. বিনয় ঘোষ; বিদ্যাসাগর ও
বাঙালী সমাজ; ৩য় খণ্ড,বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা, ১৩৩৮; পৃষ্ঠা ২৫৮।
১২.শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়;রবীন্দ্রনাথের
গান : একটি ব্যক্তিগত প্রতিবেদন; ক্রোড়পত্র ১ : রবীন্দ্রনাথ ; অনুষ্টুপ—শারদীয় ২০১৪ সংখ্যা, ৪৯ বর্ষ, ১ম
সংখ্যা; কলকাতা ৯; সম্পাদক অনিল আচার্য; পৃষ্ঠা: ৩৭০।
১৩. দেবব্রত বিশ্বাস ; হেমাঙ্গ
বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ১৯৮০ থেকে নিজের প্রবন্ধে তথ্যসূত্রে উল্লেখ করেছেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রাগুক্ত; পৃ:
৩৮১ ।
১৫. শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৬৩।
১৬. শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৭২।
১৭.বুদ্ধদেব বসু; রবীন্দ্রনাথের
প্রবন্ধ ও গদ্যশিল্প; সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ, এম সি সরকার অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৭৭ পৃ: ১৩৬
থেকে শিবাজী
বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ব্যবহৃত উদ্ধৃতি; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৭৩।
১৮.শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৭৪।
২০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত।
২১.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সংগীত ও ভাব; প্রাগুক্ত।
২২.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সংগীত ও ভাব; প্রাগুক্ত।
২৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সংগীত ও ভাব; প্রাগুক্ত।
২৪.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সংগীতের উৎপত্তি
ও উপযোগিতা; প্রাগুক্ত।
২৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রাগুক্ত।
২৬.সুকুমার সেন;বাঙ্গালা
সাহিত্যের ইতিহাস চতুর্থ খণ্ড; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড; কলকাতা; পৃ:১১৬।
২৭. সুকুমার সেন;বাঙ্গালা
সাহিত্যের ইতিহাস চতুর্থ খণ্ড; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড; কলকাতা; পৃ:১১৭।
২৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; বাউলের গান;প্রাগুক্ত।
৩১.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত।
৩২.শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৭৪।
৪০.লীলা মজুমদার; পাকদণ্ডী; আনন্দ
পাবলিশার্স; পৃ : ২৬৬; কথাগুলোর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন অভ্র বসু তাঁর রাগরাগিণীর ভাব ও
রবীন্দ্রনাথের গান
প্রবন্ধে। অনুষ্টুপ; প্রাক-শারদীয়
সংখ্যা, ২০১৪; বর্ষ ৪৮, সংখ্যা ৪; কলকাতা; পৃ:১০৫।
৪১.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সুর ও সংগতি; রবীন্দ্রনাথ ওধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পত্রালাপ; সংযোজন;সংগীত চিন্তা; রবীন্দ্র-রচনাসমগ্র;।
৪৪.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রাগুক্ত।
৪৬.অভ্র বসু; রাগরাগিণীর ভাব
ও রবীন্দ্রনাথের গান; অনুষ্টুপ—প্রাক শারদীয় সংগীত সংখ্যা;বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ৪; কলকাতা; সম্পাদক অনিল আচার্য; পৃ:১০৭।
৪৭.অভ্র বসু; রাগরাগিণীর ভাব
ও রবীন্দ্রনাথের গান; অনুষ্টুপ—প্রাক শারদীয় সংগীত সংখ্যা;বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ৪; কলকাতা; সম্পাদক অনিল আচার্য; পৃ:
১০৯।