“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

।। এক কিপটে ও এক দল ইঁদুর।।

 
             ।। মাসকুরা বেগম ।।

    -'মা-ই গো!ও মা-ই! তুমি কইয়া দেওনা আমার মাঝে কিতা কিতা দোষ আছে! তোমার এই নির্বোধ বেটার ওপর আল্লাহ বোধহয় খুব নারাজ আছইন! নাইলে এত আপদ - বিপদ আইতো কেনে? এই চার-পাঁচ বছরে কি কম লোকসান অইছে! তুমি যদি আঙুইল দিয়া দোষ ত্রুটি দেখাইয়া না দেও তাইলে আমার যে ইহ-পরকাল সব ধংস অই যাইব মাই!' ফজরের নামাজের পর মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের পা দাবাতে দাবাতে অনুতপ্ত আমিরুল বলছে আর মাঝে মাঝে পরনের সাদা পাঞ্জাবির হাতায় চোখের জল মুছে চলেছে। 

     আমিরুল একজন খুবই কর্মঠ ও সৎ ব্যবসায়ী । সে ও তার স্ত্রী দুজনেই খুব মেহনতি। খাটে প্রচুর। হেলায়- ফেলায় দিন কাটায় না। খরচ করে খুব মেপে-জোখে । লোকজনের সঙ্গে তারা বেশি সম্পর্ক রাখে না । একা একা থাকতে পছন্দ করে। তারা মনে করে সব সম্পর্কের মাঝে কোন না কোন স্বার্থ জড়িত থাকে । আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী তাঁদেরকে 'অসামাজিক' 'কিপটে' ইত্যাদি বিশেষনে বিশেষিত করে! কিন্তু তাদের মতে তারা একটু মিতব্যয়ী মাত্র ! আসলে বেশির ভাগ মানুষই তো নিজের সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে পারে না। নিজের ভুলটাকেও যুক্তি দিয়ে সঠিক ধরে নেওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। 

 আজ থেকে প্রায় চার বছর আগের কথা। একদিন সন্ধ্যার পর আমিরুলের অসহায় দুস্থ বোন মারিয়া তার কাছে এসেছিল । একটু সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিল,
-' ভাইজান! একটু টাকা পয়সা দিয়া আমারে সাহায্য করইন। আমার ফুয়াটার স্কুলর সারা বছরর ফি বাকি আছে। ফি দিতে না পারলে যে ফাইনাল পরিক্ষায় বসতে দিব না স্কুল।'

- 'আইজকাইল তো স্কুল ফি লাগে না।'

- ' ভাইজান ইতা সুবিধা তো সরকারি স্কুলর ছাত্ররা পায় । আমার মনির যে বেসরকারি স্কুল পড়াশোনা করের....।'

- ' তাইলে সরকারি স্কুল পড়তে পাঠাও।'

-' হি যে ক্লাস এইট অব্দি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে এখন হঠাৎ করিয়া সরকারি স্কুল বাংলা মাধ্যম পড়ব কিলা?'

-' খরচ চালাইতে পারো না যদি বেসরকারি স্কুল দিলায় কেনে?'

-' তার আব্বায় দিছে।'

-' তাইলে তার আব্বা টাকা দিব। আমি কেনে দিমু?'

-' তুমি তো জানো ভাইজান তার আব্বার মেঘালয়র কয়লার ব্যবসা আর আগর মত চলের না। দিনে দুই বেলা ভাতের যোগাড়ই অয় না ভালা করিয়া !'

- ' তাইলে ও দিনমজুর করউক, তুমি কাজ কর, নাইলে ছেলের পড়া বাদ দিয়া কাজে পাঠাও । পরের কাছে আত পাততে আসো কেনে? একেবারে লজ্জা শরমের মাথা খাইছো!'
 
     মারিয়ার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরুলো না! দুচোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের শশুরের গুন পোকায় ধরা কাঠের তৈরি পুরোনো আমলের জমিদার বাড়ির ভগ্নাবশেষ এ চলে গেল। কাউকে বলল না ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া অপমানের কথা। তার মনে পড়ে 'ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন '। আপনজনের বদনাম তো লোকের কাছে করা যায় না। তাই হজম করে নিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! 

      বোন যদিও কাউকে কিছু বলল না কিন্তু ওপরে থাকা নিরাকার একজন সব দেখলেন, শুনলেন। আর তার সঙ্গে চোখের জল ফেলল আমিরুলের ঘরে লুকিয়ে থাকা একদল ইঁদুর!

      - 'ও আমির! বাপজানরে আল্লাহ তোমায় অত দিছে, একটু সাহায্য করলে তো পারতায়! ফুড়িটারে ইলা খালি আতে বিদায় করা কী ঠিক অইছে?' আমিরুলের বৃদ্ধ মা  ভয়ে ভয়ে ছেলেকে বললেন।

-'' মা তুমি আমার ঘরো শান্তিতে থাকো তো। খাও-দাও, ঘুমাও । অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে যাইও না। আমি মেহনত করে দুইকে চার করছি, দান-খয়রাত করে বিলিয়ে দেবার লাগি নায়। আমার কষ্টর উপার্জনে শুধু আমারই অধিকার! আলসেমি করে দিন কাটাচ্ছে আর আমার কাছে আসে 'সাহায্য লাগে' বলে। আরে বাবা আঁচল যতটুকু ততটুকু মেলো না! যত্তসব!'' রাগে গজগজ করে আমিরুল বলল।

    মা নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে ভয়ে চুপচাপ কেটে পড়লেন।

     রাত নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সভা বসল ইঁদুরদের। সভায় আলোচনার বিষয় হল কেমন করে এই আমিরুলকে শিক্ষা দেওয়া যায়। বড্ড অহংকার বেড়েছে যে তার! ইঁদুরের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আজ রাতেই হামলা করতে হবে আমিরুলের লাইব্রেরিতে! সব তছনছ করে দিতে হবে! নানা ধরনের বই দিয়ে সারি সারি করে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছে কাঁচের আধুনিক ডিজাইনের আলমারি । কোনদিন একটাও বই হাতে নিয়ে পড়তে তো দেখা যায় না তাকে। শুধু শুধু লোক দেখানো কারবার! পরের ছেলেকে একটু পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারে না আর নিজের কচি ছেলের জন্য এত সংগ্রহ!

       আরেকদিনের কথা ।   আমিরুলের বড় ভাই আসলেন কিছু টাকার সাহায্য চেয়ে। 

-'ভাইরে! ও ভাই! তোর ভাবীর বড্ড অসুখ ! ডাক্তরে কইছে ইখানো ট্রিটমেন্ট সম্ভব নায়! চেন্নাই নিয়া যাইতে অইব। কীতা করতাম এখন! অত টাকা তো আমার গেছে নাই। থুড়া সায্য কর না আমারে টাকা দিয়া।'

-' কোন ডাক্তরে কইছে? আইজকাইল ডাক্তর ইতাও সব ব্যবসায়ী অই গেছইন। সরকারি মেডিকেল কলেজ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকতে অত খরচ করে চেন্নাই যাওয়ার কী দরকার !' আমিরুল বলল।

-' সোজাসুজি কইয়া দেয় না যে দিতে পারবি না । উপদেশ দিতে যাস্ কেনে? ভাইগ্নাটারে পড়াশোনার লাগি একটু সাহায্য করলি না। আটকাইছে না তার পড়াশোনা। তোর এই ভাবী তাইর হাঁস মুরগি পালন করিয়া জমানো টেকা দিয়া সাহায্যর আত বাড়াইয়া দিছে ভাইগ্নাটারে। তারার দোয়ায় তাই সুস্থ অইয়া উঠব।তোর সায্য লাগতনায়! দেখিস্ তুই!' আমিরুলের কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে বড় ভাই গদগদ করে চলে গেলেন ।

      সব শুনে ইঁদুরের দল এবার সিদ্ধান্ত নিল আমিরুলের টাকার সিন্দুকে হামলা করবে! সে ব্যাংকে টাকা জমা রাখেনা কর দিতে হবে বলে। স্ত্রী বায়না এবার স্কুল ছুটির সময় বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে । আমিরুলের ও প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না ।  তার একজন মাসির বিয়ে হয়েছিল সিলেটে । তাই মাকেও নিয়ে যাবে । মা তাঁর বোনকে দেখে আসবেন । বেশ কয়েক বছর হল দুবোনের সরাসরি দেখাই হয়নি । বরাক উপত্যকার মানুষের কেমন যেন একটা প্রানের টান আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। আত্মীয়তার বন্ধন ।   ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ সব মিলে তো এক দেশই ছিল - ভারত । সবারই তো ছিল একই মিশন, একই ভিশন, একই স্লোগান - একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ! স্বাধীন ভারত! কিন্তু ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রের  ফল স্বরূপ এক দেশ শুধু ভাঙলেই না; পরস্পর চির শত্রু হয়ে রয়ে গেল । যাই হোক সেটা সাতাত্তর বছর আগের কথা! তারপর ফাটল ধরল পাকিস্তানে মাতৃভাষা বাংলার স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার শঙ্কায় ! ফলস্বরূপ জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ! দেশ ভাগের ফলে আমিরুলের স্ত্রীর অনেক আত্মীয় স্বজন বাংলাদেশ রয়ে গেছে । কেউবা সেখানে চাকুরীরত ছিল কেউবা বিয়ে হয়ে সেখানকার বাসিন্দা । ছেলে আবুর ইচ্ছে সিঙ্গাপুর যাবে । 

আমিরুল বলল, ' এখন না আব্বু! তোমার দাদিজীরে নিয়া হজ্জ করিয়া ফিরিয়া আসি তারপর সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব তোমাদের । আরও দুবছর অপেক্ষা করতে হবে । ঠিক আছে!' 

ছেলে বলল, ' ঠিক আছে হবে! তুমি দাদিজীকে নিয়ে হজ্জ করে এসো তারপর আমরা সিঙ্গাপুর যাব। এখন নাহয় বাংলাদেশ ঘুরে আসি।' 
 
     বিদেশ-ভ্রমণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছু টাকা সিন্দুকে জমা রাখা আছে । ইঁদুরের সর্দার বললেন, ' ভাইকে একটু সাহায্য করতে পারে না আবার নিজে স্ত্রী পুত্র নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করবে! চল! করাচ্ছি বিদেশ ভ্রমণ বেটাকে!' সবাই বলল,' চলো! চলো! টাকার পুঁটলি খুলো! সব চিবিয়ে ফেলো!'

     আমিরুলের স্ত্রী আমিরুলের আত্মীয় স্বজনদের বেশি পাত্তা দিত না। এতে আমিরুল স্ত্রীর ওপর খুশি। শুধু তার মায়ের সাথে যেন কোনো খারাপ ব্যবহার না করে সেটা কিন্তু সতর্ক করে দিয়েছে। মাকে খুব ভালোবাসে সে। মায়ের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখে না। মায়ের কষ্ট হবে ভেবে অভাবী ভাই বোনের ঘরে মাকে থাকতে দেয় না। মা চটপট করেন কিন্তু কিছু বলেন না । তিনি ভাবেন, 'নিজর না আছে জন, না আছে ধন! বাবা! ছেলের ইচ্ছে মত চলাই ভালো!'

     আমিরুলের গেল বছরের ধান খেয়ে দেয়ে, বিক্রি করে এখনও প্রচুর পরিমাণে গোলায় মজুদ রয়েছে। ভেবেছে নতুন ধান উঠানোর আগে বিক্রি করে দেবে - যেটুকু অতিরিক্ত থাকবে। একদিন এক বিধবা বৃদ্ধা এসে আমিরুলের স্ত্রীর কাছে হাত পাতলেন, 
- ' কিছুটা ধান দেও মাই গো? আমার ঘরো চাউল নাই! ঢেকিত বানিয়া কয়টা চাউল ছফা করিয়া ভাত রান্দিতে পারলাম অনে। '
-' টেকা নিয়া আইছো নি ? বাকি নিয়া ফাঁকি দিবায় নি?' আমিরুলের স্ত্রী বলল।
-' আমি মানুষর দুয়ারো দুয়ারো খুঁজিয়া খাওয়া মানুষ গো!  এক সপ্তাহর জ্বরে ভুগিয়া  ফুয়া গেছে গিয়া দুনিয়া ছাড়িয়া। বউ নাতি নাতনি আর আমারে নিয়া পাঁচটা পেট। তোমাদের তো অঢেল দিছে আল্লাহ! আল্লাহর ওয়াআছতে একটু সাহায্য করলে কমবে না।'

-' ইখান কিতা বন্টনখানা নি যে সব আই যাও ইনো! আমরা বিলাইয়া দেওয়ার লাগি ধন সম্পদ সঞ্চয় করি নাই। আমারার ভবিষ্যৎ আছে! ছেলের ভবিষ্যৎ আছে! তখন আমরা বিপদে পড়লে কি তুমি দেখবায়? যাও ইখান থাকি।' আমিরুলের স্ত্রীর তিরস্কার শুনে বৃদ্ধা আপন মনে বিড়বিড় করে চলে গেলেন।

    আমিরুলের স্ত্রী ঘরে মেহমান আসলে শরবত দিলে চা দেয় না আর চায়ের সঙ্গে নাস্তা  দিলে ভাত দেয় না আর ভাত খাওয়ালে চা দেয় না ! কাজের মাসিকে খড়ায়-গন্ডায় হিসেব করে মাইনে দেয় । কোনদিন যদি কোনো কারণ বসত মাসি কাজে আসতে পারে না সেদিনের মাইনে কেটে দেয়।

     ক্ষেতের মাঠে কচি কচি চারা ধানে চারদিকে সবুজের সমারোহ। আহঃ কী নয়ন ভোলানো অপূর্ব দৃশ্য! ক্লান্ত দুচোখ যেন সতেজ হয়ে উঠে ! আরও ক'দিন পরে চারা গাছগুলো বেড়ে উঠবে । ফুটবে ফুল, ছাড়বে ধান। তারপর পাকা সোনালী ধানের মো-মো গন্ধে সুবাসিত হয়ে উঠবে মাঠ-ঘাট ! সে অপেক্ষায় আছে ইঁদুরের দল। নিমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছে নিজের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু- বান্ধবদের। বুড়ি মা-কে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার বদলা নেবে তারা!

      পাসপোর্ট হয়ে গেছে সবার । বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য জমানো টাকার সিন্দুক খোলা হলো। সিন্দুক খুলে সবার মাথায় হাত! একি সব টাকা-পয়সা তছনছ! শুধু মাত্র হজ্জে যাওয়ার জন্য জমানো টাকার পুঁটলিটা অক্ষত অবস্থায় আছে ! 

    আমিরুলের স্ত্রী বলে উঠল, ' হজ্জে যাওয়া তো এখনও অনেক  দেরি আছে । কিছুই তো ঠিক হয়নি।  তবে ঐ টাকাগুলো দিয়ে এখন বাংলাদেশ ঘুরে আসি.....।' তার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রান্নাঘর থেকে প্রেশার কুকারের সিটি বেজে উঠল। তাই সে দৌড়ে গেল রান্নাঘরে । সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল সে রান্নাঘর থেকে! চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ' কি হয়েছে?' 
সে কুঁকড়ে কুঁকড়ে বলল, 
-' আঁধারের মাঝে ইঁদুর আমার পায়ে কামড় মারিয়া দিছে!'
-' কী! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! এখনি ডাক্তরের কাছে নিয়া যাইতে অইব! ভ্যাকসিন নিতে অইব! তাড়াতাড়ি চল! আমি গাড়ি বাইর করছি !' আমিরুল এই বলে দৌড়ে গিয়ে গাড়ি বের করে স্ত্রীকে গাড়িতে তুলে ছুটল হাসপাতালে ।

      আমিরুলের চাষবাস দেখা শোনা করে কুটিমিয়া । সে পরদিন সকাল সকাল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, -' মালিক সর্বনাশ অই গেছে ! মাঠর সব পাকনা ধান নষ্ট করিয়া দিছে ইঁদুর ! কাইল  তো দেখলাম সব ঠিক আছে । এক রাইতে এত ধান নষ্ট করল কী কিলা!' 

    এমনিতেই আগের রাতে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে অনুশোচনায় দগ্ধ আমিরুল! অনবরত কেঁদে চলেছে মায়ের পায়ের কাছে বসে আর আত্ম-সমালোচনা করে নিজেকে শুধরানোর পণ করছে। তার ওপর এই সর্বনাশের খবর! স্তব্ধ হয়ে গেছে সে । সে শুধু কুটি মিয়ার কথা গুলো শুনল মায়ের পায়ের কাছে বসে । কিছুই বলতে পারল না কুটিমিয়াকে । 

    আমিরুলের মা উঠে বসলেন। বুকে টেনে নিলেন ছেলেকে। আঁচল দিয়ে ছেলের দুচোখ মুছে দিয়ে আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, -'' দেখো বাবা! তুমি অনুতপ্ত অইছ, নিজে নিজর দোষ খুঁজার চেষ্টা করছ - ইতা খুবই ভালা লক্ষণ। তোমার মাঝে কিছু দোষ আছে। মানুষ মাত্রই দোষ - গুন থাকে। ইতা স্বাভাবিক। আমার কর্তব্য আসলো, তোমার ভুলকে দেখাইয়া দেওয়া। কিন্তু অসহায় নারী নিজর স্বার্থটাই দেখে! ভালো পরামর্শ বা উপদেশ দিতেও চিন্তা করে 'যদি বাবা নারাজ হন কিংবা যদি ভাই নারাজ হন কিংবা যদি স্বামী নারাজ হন, তখন এই পরজীবী বাঁচব কেমন করে?' এই ডরে আমরা বেটিনতে নিজর পেটর সন্তানের ওপরেও দাবি কাটাইতে পারি না !''

-' মাইগো! তোমার এত জ্ঞান!' অবাক হয়ে আমিরুল বলল, ' তুমি আইজ থাকিয়া তোমার এই অপদার্থ অদম ফুয়ারে নিঃসংকোচে উপদেশ দিও, গালি দিও, মারিও পিটিও। যে ছেলেকে মা ভয় করছে সে ছেলের পরকাল কি হবে? আমি এতদিন দুনিয়ার মোহ মায়ায় অন্ধ ছিলাম! এখন আমার চোখ খুলছে। তুমি যা আদেশ - উপদেশ দিবে আমি মাথা পাতিয়া নিমু । আইজ তুমি কইবায়, আমি শুনমু।'

-'' সবই আল্লাহর ইচ্ছায় অয় ! আইজ আমার ফুয়ার অন্তর আত্মা খুলছে - এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া ! দেখ বাবা! তোমার ধন সম্পদ তুমি নিজে কষ্ট করিয়া উপার্জন করেছ ঠিকই কিন্তু এতে তোমার পরিবারের, সমাজের, আত্মীয় স্বজনের,  পাড়া প্রতিবেশীর সবারই কমবেশি হক আছে। দান খয়রাত করলে বালা - মুসিবত দূর অয় । কেউররে খালি হাতে ফিরাইয়া দিও না তাইলে তোমার দুনিয়া আখেরাত ভালো অইব। তোমার বাবার তেমন কিছুই আসলো না তবুও যতটুকু পারতা দান-খয়রাত করতা । কইতা, 'দানে ধন কমে না'।''
  
- ' তুমি একদম ঠিক কইছো মা! আমি আমার মনে একটি ভুল ধারণা পোষণ করিয়া আসলাম যে আব্বা কেউ যখন কিছু চাইতেই দিয়া দিতেন বলিয়া আমরার ধন সম্পদ সঞ্চয় অইছে না আর সময় সময় আমরার অভাব অনটনে পড়তে অইছে ।এর লাগি আমি আমার ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী কাউকে মূল্য দেই নাই ! কারও প্রয়োজনে সাহায্য করি নাই !  ফল স্বরূপ আমার আলমারি ভর্তি বই নষ্ট হয়েছে, গোলা ভরা ধান নষ্ট হয়েছে, সিন্দুক ভর্তি টাকা নষ্ট হয়েছে, মাঠে পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। শেষমেশ আবুর মাকে পর্যন্ত কামড়ালো ইঁদুর ! কিন্তু মা! দেখলে মা! কী আশ্চর্য কাণ্ড! শুধু মাত্র আব্বার বদলা হজ্জের জন্য আর তোমার হজ্জের জন্য যেটুকু টাকা জমা করেছিলাম, সেটুকু যেভাবে রেখেছিলাম সেভাবেই আছে । ' 

     পাশে বসে সব শুনছে আমিরুলের স্ত্রী আর চোখের জল ফেলছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ' আম্মাজান! আমার বেআদবি মাফ করবা ! অনেক কিপটামি করছি! কিন্তু আম্মা আইজ বুঝতে পারতেছি কিপটামি করিয়া করিয়া কতটা বিবেক হারাইয়া ফালাইছি! আত্মীয় স্বজনর স্নেহ - মমতা - ভালোবাসার সম্পর্ক গুলোর গুরুত্ব ভুলিয়া গেছি । একটুও সাহায্য সহায়তা করিনি কেউররে কোনদিন । শুধু নিজর কথা ভাবছি । ছিঃ ছিঃ ! নিজর ওপরেই নিজর ঘিন্না লাগের ! এতো অদম আমি! এতো নীচ!'

-'একটা কাম করা যাউক্! কাইল একটা দোয়া - দুরুদ, খানা- দানার আয়োজন করা যাউক্ ! মা তুমি ফোন করিয়া ভাইসাব ও মারিয়ারে এখনই সবরে নিয়া আমরার ঘরো আইতা কইয়া দেও। আমরার হজ্জ্ব যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়াও আলোচনা করতে লাগবো । তখন তো আবু ও তার মার দেখাশোনা তারারেউ করতে অইব । সবরে সঙ্গে নিয়া আয়োজন করব। অসহায় গরীব দুঃখী দুঃস্থদের খাওয়ানো অইব দুবেলা পেট ভরে ।' আমিরুল বলল। 

 আমিরুলের স্ত্রীও খুশি হয়ে বলল, ' অয় অয়! ওটাই কর! ভালা অইব। ভাইসাব ও মারিয়ার মনে আমরা কম কষ্ট দিছিনি? এখন তারা কত খুশি অইবা দেখিও !'

বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৪

নামেই আসে-যায়। – একটি আবেদন

 নামে কি আসে-যায়? —- নামেই আসে-যায়। – একটি আবেদন


নামে কি আসে-যায়? —- নামেই আসে-যায়। 

নামেই আসে-যায় কারন গোলাপ কে যে নামেই ডাকা হোক, সে গোলাপ থাকলেও, কেন, যে পাড়ায় অনেক গোলাপ গাছ, বাগান, চাষ,  সে পাড়ার নাম —- “গোলাপ পাড়া” না “রোজ স্ট্রিট” নিয়ে তর্ক ওঠে? ঝগড়া বাঁধে? এবং অন্তিমে, সেই ঝগড়ায় জয় কাদের হয়? কেন হয়? কেন নাজি বা নাৎসীরা, একদা, বদলে দিয়েছিল অসংখ্য স্থান-নাম? যেমন পূর্ব প্রুশিয়া’তে ১৯৩৮ সালে ১৫০০-এরও বেশি স্থান নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। জার্মানি এবং দখলকৃত অঞ্চলগুলির শহরগুলির অনেক রাস্তা এবং চত্বর নাৎসি নেতাদের সম্মানে এবং যুদ্ধ করতে গিয়ে অক্কা পাওয়া বড় সব জার্মান অফিসারদের নামে নামকরণ করা হয়েছিল। উদাহরণ : অ্যাডল্ফ হিটলার, হারম্যান গোরিং, হর্স্ট ওয়েসেল ইত্যাদি। বিভিন্ন রাস্তা এবং চত্বর অ্যাডল্ফ হিটলারের নামে নামকরণ করা তো হয়েইছিল। 

কিন্তু কেন? 

উত্তরে যদি বলি, এই পরিবর্তনগুলি নাৎসীদের দ্বারা দখলীকৃত ও  নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, তাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ আরোপের ব্যাপক কৌশলের অংশ ছিল। লক্ষ্য ছিল নাৎসীদের মতাদর্শ প্রচার করা এবং অ-জার্মান সমস্ত কিছু মুছে ফেলা। লক্ষ্য করা যায়, বদলে-ফেলার আগে, সেই নামগুলি ছিল পুরানো প্রুশিয়ান, লিথুয়ানিয়ান এবং পোলিশ উত্সের। – এভাবে বললে হয়তো বলাটি বেশ ভারী হয় কিন্তু বোধ্যতা তাতে কমে যায়। যেতে বাধ্য। বরং ফিরে যাই সেই “গোলাপ পাড়া” র গল্পে। 

ধরা যাক গোলাপ পাড়া’র বাসিন্দারা ছিল গোলাপ-চাষী। তিন পুরুষ ধরে কিংবা সাত পুরুষ ধরে। অতঃপর গোলাপের সৌরভে, সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে, প্রমোটার বাবুগণ, কিছু-জন গোলাপ-চাষীকে পটিয়ে, কিছু-জন কে ভয় দেখিয়ে “কব্জা” করে নিলো খানিকটা জমি আর তাতে তুল্লো তল্লাটের প্রথম ফ্ল্যাটবাড়িটি যেখানে খোপ-কোঠা কিনে বাস করতে এলেন গোলাপ-মাধুর্য্যে মাতোয়ারা উচ্চ ও মধ্য মধ্যবিত্তের দল যাঁদের আয়ের উৎস – চাকুরী, ব্যবসায় অথবা দালালি, যাঁদের বাক্যে, ভুলে-শুদ্ধে ইংরেজি মিশে গিয়েছে। “গোলাপ পাড়া” র না্ম “রোজ স্ট্রীট” হ’লে বেশি ভালো হয় কেননা অমুক অমুক দেশে রয়েছে এমতো স্ট্রীট-নাম – এই প্রস্তাবটি আসবে ওই বাবুদের নিকট থেকেই। কিন্তু প্রস্তাবটি ততোক্ষন জোরালো হবেনা যতোক্ষন না গোলাপ-প্রিয় প্রোমোটার দিগের দ্বারা আরও কিছু গোলাপ-জমি গ্রাস করে তাতে আরো কিছু ফ্ল্যাট না ওঠে। অর্থাৎ যে মুহুর্তে “কোয়ান্টিটি” ভারি হতে আরম্ভ হবে - উচ্চ ও মধ্য মধ্যবিত্তের দল যাঁদের আয়ের উৎস – চাকুরী, ব্যবসায় অথবা দালালি – তাদের —- তখনই “রোজ স্ট্রীট” বনাম “গোলাপ পাড়া” ঝগড়ার পরণতি যাবে “রোজ স্ট্রিট” এর পক্ষে। পক্ষান্তরে, যদি একটি আজগুবি পরিস্থিতির কথা ভাবা যায়, যেমন থাকে “ডিসডোপিয়ান” ওয়েব-সিরিজ গুলিতে, যে, এই “রোজ স্ট্রীট” এ একদিন ফিরে এলো সব সাবেক গোলাপ-চাষীরা এবং সেই পাড়াতে বাসও করতে লাগলো, তখন, কোয়ান্টিটি’র ভারে, আবারো “গোলাপ-রোজ” দরবার নিশ্চিত এবং এবারে নিষ্পত্তি যে “গোলাপ পাড়া”র পক্ষেই যাবে, এ’ও নিশ্চিত।

অর্থাৎ, স্থান-নামের পরিবর্তন আদতে ক্ষমতারই প্রদর্শন, নিদর্শন। ক্ষমতা প্রদর্শনের এই প্রতীকী খেলাতে জয় তারই হয়, যার হাতে ক্ষমতা। আরো স্পষ্ট করে বললে, রাজনৈতিক ক্ষমতা যার, সে’ই এই খেলাতে জেতে। এইহেতুই উপনিবেশ গুলিতে স্থান-নাম,রাস্তা-নাম – হয় ঔপনিবেশিক দের নামে, যেমন “বেন্টিংক্ট স্ট্রিট”। আর তাদের বিকৃত উচ্চারনে “নেটিভ” নাম, যথা, বর্ধমান হয়ে যায় “বড়ডোয়ান”। — এই সমস্তই ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রতীকী প্রদর্শন। আমাদের “গোলাপ পাড়া” গপ্পে, গোলাপ-চাষীদের পাড়ায় উঠে আসা পেটি বুর্জোয়া বাবুরা ওই ঔপনিবেশিকদের ভূমিকাটি পালন করেন এবং পালন করতে সক্ষম তখনই হন, যখন, তল্লাটের রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীরা এসে দাঁড়ায়, অবশ্যই তাদের নিজস্ব স্বার্থে, ভোটবাজি ইত্যাদির দরকারে। 

অর্থ হয়, স্থান-নাম বদলের এই খেলা শুধুমাত্র ক্ষমতারই। ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শন কে গ্রহনযোগ্য করে হাজির করতে, ক্ষমতাসীনেরা ইতিহাস, সাহিত্য থেকে ধর্ম – যে কোনো অজুহাত বেছে নেয়, নিতে পারে, নিয়েছে, নিচ্ছে আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই আদত সাহিত্য,ইতিহাস বা ধর্ম-পুঁথি’কে তারা বিকৃত করেছে। কাজেই, ২০২৪ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে, উক্তিকে বিকৃত করা হয়, তখন আশ্চর্য হইনা। ভীত হই। ভীত হই, কেননা – যাঁরা সরিষার থেকে তেল নিঙড়ে নেওয়ার কাজটি করতেন, তাঁদের পাড়ার নাম, স্বাভাবিক ভাবেই, তেলীপাড়া, যাঁরা ফুলের কারবার করতেন, অর্থাৎ মালী, তাঁদের পাড়ার নাম মালীপাড়া – স্বাভাবিক ভাবেই। লঙ্গাই নামক নদীর কিনারে যে পাড়া, তার নামও হয়েছিল ‘লঙ্গাই রোড”। অবলীল। – এইবার ‘মালী পাড়া’ নাম বদলে দিয়ে, ক্ষমতাসীনেরা “সারদা পল্লী” করে দিলে, আদতে যা দাঁড়ায়, তা, ওই “মালী” নামক জীবিকা যাঁদের বা ওই জীবিকা যাঁদের পূর্ব পুরুষের – তাঁদের সক্কলকে এক কথায় নাকচ করে দেওয়া। এর দ্বারা না’ত হয় রামকৃষ্ণ-পত্নী সারদাদেবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, না অন্য কিছু। ঠিক যেভাবে লঙাই নদীর পাড়ের পাড়া লঙ্গাই রোড কে “সৎসঙ্গ রোড” করে দেওয়া। – এই সমস্তই আদতে আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এবং আরেকটি তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, নাৎসীরা যেমন পুরানো প্রুশিয়ান, লিথুয়ানিয়ান এবং পোলিশ উত্সের দিকে চালিয়েছিল তাদের সার্বিক আগ্রাসনের বুলডোজার, তেমনি, এই দেশ ভারতবর্ষে আগ্রাসনের শিকার অ-হিন্দু জনগোষ্ঠী আর স্থান নাম বদলেও তা’ই প্রতিভাত। 

এখানে  অ্যান্টোনিও গ্রামসি-র সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ধারণার কথাটি অতি সংক্ষেপে বলে রাখছি কেননা এ’টি এই আগ্রাসনের চরিত্রকে বুঝে নিতে খুবই জরুরী।  ইতিহাসকে মার্ক্সবাদী পন্থায় বিশ্লেষণ করে গ্রামসি দেখিয়েছেন, যে, শাসক শ্রেণি শুধু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নয়, সাংস্কৃতিক ঐক্যমত্য তৈরির মাধ্যমেও ক্ষমতা বজায় রাখে । তাদের আধিপত্যের  সমর্থনে তারা নানা রকম গপ্পো, ধারনা নির্মাণ করে এবং ছড়িয়ে দেয়। ফলে, এক সময়  জনতা শাসক শ্রেণির মতাদর্শকেই স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক এবং অনিবার্য বলে মনে করতে বাধ্য হয়ে পড়ে।

 ঠিক যেমন এই মুহুর্তে ১৮৭৬ সালে, আসাম গেজেটে, যে স্থানটিকে “করিমগঞ্জ” বলা হয়েছে, তাকে ২০২৪ এ, রাজনৈতিক স্বার্থে এবং অ-হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ভীত করতে, “শ্রীভূমি” বলে দেওয়ায়, জনতার একাংশ বাজি পোড়ান। মস্তি মারেন। মস্তি মারেন, কেননা, তাঁদের মগজে ক্রিয়াশীল শাসকশ্রেনীর বানানো গপ্পো, যা গ্রামসির ভাষায় “হেজিমনি”।


এই প্রসঙ্গে, মার্ক্সবাদী উপায়ে ইতিহাস বিশ্লেষণের দ্বারা গ্রামসী যে দ্বিতীয় কথাটি বলেন, তা এই, যে,  স্থানগুলির নাম পরিবর্তন করার দ্বারা, শাসক শ্রেণি তাদের মূল্যবোধ এবং ঐতিহাসিক আখ্যানগুলিকে বৈধতা দিতে প্রয়াস পায় । পারে নিজেদের মত কে শারীরিক ভূদৃশ্যে মুদ্রণ করতে। এই প্রক্রিয়াটি তাদের শাসনকে বৈধ করতে এবং বিকল্প ইতিহাসকে অবমূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।

  বর্তমান ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অপব্যবহার তার নিদর্শন। এই অপব্যবহারের ব্যাখ্যা-বিস্তারে যাবোনা কেননা তা প্রায় সর্বজনবিদিত। শুধু প্রসেনজিৎ চৌধুরী’র নিবন্ধ “বাঙালির করিমগঞ্জ এখন শ্রীভূমি, রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীভূমি কোনটি? তিনি কেন লিখেছিলেন?” থেকে এটুকু অংশই উদ্ধার করে দিচ্ছিঃ

“রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীভূমি কোনটি? তিনি কেন লিখেছিলেন?

১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হয়। মর্মাহত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই ঘটনার মাস চারেক পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে শিলং এসেছিলেন। তখন শিলং আসামের (অসম) রাজধানী। আর এই বিভাগের তৎকালীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল সিলেট (শ্রীহট্ট)। বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ সিলেট। রবীন্দ্রনাথ শিলং এসেছেন শুনে সিলেটের ব্রাহ্মসমাজ সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দনারায়ণ সিংহ মজুমদার উদ্যোগ নেন কবিকে সিলেট দর্শন করানোর। তাঁর উদ্যোগে স্থানীয় আঞ্জুমানে ইসলাম, শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি এবং বিভিন্ন সংগঠনের তরফেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিলং থেকে গৌহাটি (গুয়াহাটি) হয়ে পাহাড়ি রেলপথ ধরে লামডিং হয়ে সিলেটে আসেন রবীন্দ্রনাথ।


শ্রীহট্ট তথা সিলেটের প্রাকৃতিক শোভা ও বড় সংখ্যায় উচ্চশিক্ষিত বাংলাভাষীদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-

“মমতাবিহীন কালস্রোতে

বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে

নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি।

ভারতী আপন পুণ্যহাতে

বাঙালীর হৃদয়ের সাথে

বাণীমাল্য দিয়া

বাঁধে তব হিয়া।

সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে

বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’’


রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের স্মারক গ্রন্থ ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইতে সিলেট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত ‘কবি প্রণাম’ এবং  নামে স্বাক্ষরিত ছিল কবিতাটি। এই কবিতায় লেখা ‘শ্রীভূমি’ শব্দটি অসমের করিমগঞ্জ জেলার নতুন নাম হিসেবে সে রাজ্যের সরকার আনল।” [ সূত্রঃ https://kolkata24x7.in/india/assam-renames-karimganj-to-shreebhumi-in-honor-of-rabindranath-tagore/}


স্থান-নাম পরিবর্তনের আরো একটি হেতু, গ্রামসীর বিশ্লেষণ মতে, “বিরোধী পরিচয়গুলি মুছে ফেলা” এবং  “জনস্মৃতির নিয়ন্ত্রণ”। 


বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে “করিমগঞ্জ” শব্দটি, জনমানসে যে অ-হিন্দু আমলের স্মৃতিকে জীইয়ে রাখছে, তা বররমান শাসকেরা চায় না। চায় না, কেননা “করিমগঞ্জ” অঞ্চলটির উন্নতি ও উৎকর্ষের অন্দরে অ-হিন্দুদের যে বিরাট ভূমিকা তা এরা অস্বিকার করিতে চায়। “করিমগঞ্জ” একটি শব্দবন্ধ ফার “করিম” অংশটি আরবি এবং “গঞ্জ” ফারসি। গঞ্জ অর্থ হাট। করিমগঞ্জ ছিল বড় অথবা ব্যস্ত একটি হাট – এতোদূর আন্দাজ করেছেন ইতিহাসবীদেরা। কিন্তু আরবি-ফারসি মিশে থাকায় আরো তথ্য প্রমাণের প্রয়োজন সম্পূর্ণ নামটিকে বুঝে নিতে। – কিন্তু যা স্পষ্ট, তা হলো, অ-হিন্দু প্রাধাণ্য আর একেই জনতার স্মৃতি থেকে মুছে দেওয়ার প্রয়াস শাসক শ্রেণীর। এটি মুছে দিলে, এ’ও মুছে যাবে, অচিরেই, যে, একদা করিমগঞ্জের বদরপুর, যাকে “বুন্দাশীল” বলা হতো, সেই অব্দি ছিল তুর্ক-আফগানদের শাসনাধীন ও পরে মোগল শাসনে। ফলত এই স্থানটি এবং তার ক্রমোৎকর্ষের মূল যে অ-হিন্দু শাসনে নিহিত, এই সত্যটি মুছে দিতে তৎপর, এই মুহুর্তে ভারতীয় নাৎসীরা।

এই তৎপরতা আজকের নয় আর “করিমগঞ্জ” ও নয় এই আগ্রাসনের প্রথম শিকার। এ’ও বহুজনবিদিত। তথাপি এই আবেদনটি যে লিখতে হলো, তার প্রথম হেতু, আমার নিজের নাড়ি প্রোথিত ওই করিমগঞ্জ শহরে। ফলে এই আগ্রাসন আমাকে আহত করে বেশী, ক্ষত করে গভীরতর। এই আবেদনের দ্বিতীয় হেতু, আবেদন। শুধুই আবেদন। আর

আবেদন টি খুবই সরল। যাঁরাই আমার এই ভাবনার সঙ্গে একমত, তাঁরা প্রত্যেকে এটিকে ছড়িয়ে দিন, তথাকথিত সামাজিক মাধ্যম থেকে জেরক্স, প্রিন্ট-আউট, যে কোনো ভাবে। যাঁরাই এই নাম-বদলের অন্তর্গত রাজনীতির, ক্ষমতার —- খেলাটি দেখতে পাচ্ছেন, প্রত্যেকেই চেষ্টা নিন, শাসক গোষ্ঠীর বানানো গপ্পো, ‘হেজিমনি’র দ্বারা বিভ্রান্ত সহ-নাগরিক, সহ-গ্রাম-গঞ্জ-বাসীকে যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলার। 

এই নাম বদল, এই সকল নাম-বদল, আদতে, প্রত্যেকের গালে, এই শাসক-গোষ্ঠীর এক একটি সপাট থাপ্পড়। 

এই রকমের থাপ্পড় আমরা আর কতো মেনে নেবো? 

চলুন, গর্জে উঠতে না পারি, অন্তত প্রতিরোধের পথে হাঁটা আরম্ভ করি। চেষ্টা নিই ব্যারীকেড গড়ার।


সপ্তর্ষি বিশ্বাস

২০ নভেম্বর ২০২৪, বেঙ্গালোর