ফটো: গুগল সৌজন্য |
অনবরত ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল! মাথার খদাবংগের উপরে একটি তালপাতার ছাতা বেঁধেছিল ভিঞ্চি। হাঁটু জলে নেমে জাকৈ মারতে মারতে মাছ ধরে চলছিল ভিঞ্চি ও তার সঙ্গীরা । কোমরে বাঁধা খালুইতে মাছ ধরে রাখছিল তারা । মাছ বেশি ধরতে পারলে খুশিতে ঝলমল করছিল আর মাছ না পেলে কায়মনোবাক্যে তাদের উপাস্যের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছিল! কত যে দায়িত্ব তাদের ওপর! সহজ সরল টান টান চামড়ার স্নেহ ভরা চেহারাটা দেখলে কি বুঝা যায়? রোদে পুড়ে কিংবা কাঁদা- জলে, মাঠে- বিলে কাজ করেও ক্লান্তির ছাপ খুব একটা পড়ে না এই মহিলাদের চেহারায়! তারা দায়িত্ব নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত! কাজ করে তারা অভ্যস্ত! তারা দলবদ্ধ হয়ে মাছ ধরে, মাঠে কাজ করে, বাজারে মাছ শাক-সবজি ইত্যাদি বিক্রি করতে যায়! তাদের পেট - পিঠের ভাবনা আছে! সংসার আছে, পেটের সন্তান আছে, স্বামী-পরিবার আছে!
ভিঞ্চির মত মহিলারা ছাতারও প্রয়োজন বোধ করে না! কিন্তু ভিঞ্চি মেয়ের আদেশ, 'মা!ছাতা মাথায় বেঁধে বৃষ্টিতে বের হবে নাইলে বের হবে না ঘর থেকে!'
ভিঞ্চির মাথায় তালপাতার ছাতা ছিল তাই খদাবংগটা ভিজে নি কিন্তু খোলা কাঁধ বেয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছিল তার সারা শরীর জুড়ে!
কোমর থেকে ঝুলানো রিফান বা লেমাফোটা, বুক থেকে ঝুলানো কামবংগ বা আংচা - সমস্ত পোশাক ভিজে চিপকে গিয়েছিল তার ছিপছিপে গায়ে। ভিঞ্চির শরীর ঠাণ্ডা - গরম সব সহে!
ভিঞ্চির ঘরে সেদিন না ছিল আলু - ডাল, না ছিল টাকা - পয়সা! তাই তার চারটে মাছের খুব প্রয়োজন! সে ভেবে রেখেছিল নিজের ভাগের মাছগুলো থেকে কিছুটা গাঁওবুড়ার বাড়িতে বিক্রি করবে আর চারটে মাছ নিয়ে যাবে মেয়ের জন্য! মেয়ে পিঙ্কি খুব মাছ খেতে ভালোবাসে কিন্তু ছেলে বিট্টু মাছ খাওয়া তো দূরের কথা মাছের গন্ধই সহ্য করতে পারে না! তাই তার জন্য ডিম কিনতে হবে আর আলু-ডাল- পিঁয়াজ যতটুক পারা যায় কিনতে হবে! তারপর কিছু টাকা বাঁচিয়ে না নিয়ে গেলে কি পিঠ বাঁচবে! "দূর! যা হয় হবে! এতো চিন্তা করে লাভ কী? এ তো নিত্যদিনের ব্যাপার!' সব দুঃখ- কষ্ট- চিন্তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয় ভিঞ্চি। কারণ জীবনের টানাপড়েন নিয়ে বেশি ভাবলে তার মাথাটা ঝিমঝিম করে, বুকটা ধড়পড় করে, কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে! তাই তো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দলের সর্দারনীর গানের সাথে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে আনন্দে মাছ ধরত থাকল সে!
সবাই মাছ ধরা শেষ করে সব মাছ একত্রিত করল। তারপর দলের সব সদস্যের মাঝে সমানে ভাগ করে নিল। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় তারা বেশি মাছ ধরতে পারেনি । ভিঞ্চির ভাগে প্রায় এক কেজি পরিমাণ মাছ পড়েছিল। এর থেকে আড়াইশ গ্রামের মত মেয়েটির জন্য রেখে বাকি গুলো বিক্রি করে দিয়েছিল গাঁও বুড়ার বাড়িতে। মাছগুলো কেটে কুটে দিয়ে যেতে পারলে আরও দশ টাকা পেত। কিন্তু সমস্ত পোশাক ভিজে গেছিল তাই এই অবস্থায় কেমনে বসে মাছ কাটবে! মুদির দোকান থেকে দুইটা ডিম, চারটে আলু আর চারটে পিঁয়াজ কিনার পর যে কয়টা পয়সা অবশিষ্ট ছিল সেগুলো পলিথিনের ঠোঙায় ভরে কোমরে গুঁজে রাখল যতনে। যদি তার স্বামী জয়রামকে মদ কিনার পয়সা দিতে না পারে তবে যে আস্ত ছাড়বে না তাকে! জয়রাম সকাল - বিকাল মদ গিলে টালমাটাল হয়ে পড়ে থাকে! কোনো কাজ কর্ম করতে অক্ষম সে!
ভিঞ্চির মনে পড়ে সেই পুরনো দিনের কথা! যখন জয়রামের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তখন ভিঞ্চির বয়স পনের - ষোলো বছর! ভিঞ্চি মায়ের সঙ্গে মাঠে কাজ করতে যেত। সেখানেই কাজ করত জয়রাম রাভা - হাল বাওয়া, মাটি কুঁড়া, জল সেচ যা পায় তাই করত দিন হাজিরা হিসেবে।
তখন তার বয়স প্রায় বিশ - একুশ বছর। আসা যাওয়ার পথে দেখাদেখি, চোখাচোখি, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম শেষমেশ বিয়ে! কী যে মিষ্টি মধুর দিন ছিল তখন! আপনাআপনি এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল ভিঞ্চির বুকের গভীর থেকে! একদিন তাদের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসল ফুটফুটে পিঙ্কি! মেয়েকে কোলে নিয়ে সেদিন কী আনন্দ বাবা জয়রামের! মেয়ের গোলাপি চেহারা দেখে সে তার নাম দিল পিঙ্কি! বকো খণ্ড প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সব কর্মচারীদের মিষ্টি মুখ করাল সেদিন সে! তখন এত নেশা করত না জয়রাম। ভিঞ্চির তখন মাঠে কাজ করতেও হত না। ঘরোয়া কাজ কর্ম করত, বাড়িতে বসেই লোকের বাঁশ বেতের জিনিস পত্র তৈরি করে দিত। তার নিজের বাড়িতে বাঁশ, বেত নেই। যারা তৈরি করতে দিত তারাই বাঁশ, বেত দিয়ে দিত আর বানানোর পারিশ্রমিকটা তাকে দিত । এতে ভিঞ্চির টুকটাক হাত খরচের পয়সা হয়ে যেত আর পিঙ্কির খুব যত্ন করতে পারত!
একবার বাইখো উৎসবের সময় পিঙ্কির খুব জ্বর ছিল তাই বাইরে বের হয়নি ভিঞ্চি। জয়রাম তার বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিল উৎসব উদযাপন করতে। সেদিন রাতে জয়রাম ঘরে ফিরল এক অন্য জয়রাম হয়ে! তার টালমাটাল অবস্থা দেখে স্তম্ভিত ভিঞ্চি! ভালোবাসার মানুষটির ওপর খুব জোর খাটাতো সে তাই সেই দাবি নিয়ে জয়রামকে একটুখানি শাসনের সুরে দুচারটে কথা শুনাতে গিয়ে আরও অবাক হতে হল ভিঞ্চিকে! প্রথম বার জয়রাম তাকে মারল! মারতে পারল সে! কেমনে পারল! জয়রাম না কত্ত ভালোবাসত ভিঞ্চিকে! এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল জয়রাম! ভিঞ্চি চোখে ঘুম নেই! কাঁদতে লাগল আর আগন্তুক দিনের কথা চিন্তা করল! বুকটা তার কেঁপে উঠল! বাবার কথা মনে পড়ল! তার চোখের সামনে দেখেছিল বাবার মাতাল রূপ ও মায়ের কষ্টের জীবন! সেই বাবার মূর্তিটা আজ সে দেখেছিল জয়রামের মধ্যে! জয়রাম পরদিন সকালে খুব কাকুতি মিনতি করেছিল ভিঞ্চির কাছে, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছিল! ভিঞ্চির সব ভুলে বুকে টেনে নিয়েছিল তাকে! প্রতিজ্ঞা করিয়ে ছিল কিন্তু সেই রাতের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকল! কয়েকদিন চলল ক্ষমা চাওয়া, প্রতিজ্ঞা করা! ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে উঠল জয়রাম! ভিঞ্চির ভালোবাসা তাকে আর আটকাতে পারল না! এভাবেই রাত পোহাতে লাগল দিন কাটতে থাকল! পিঙ্কির যখন ছয় বছর বয়স তখন কোল আলো করে বিট্টু আসল! কিন্তু জয়রামের আগের মত কোনো উচ্ছ্বাস নেই! সব কিছু একাই সামলে চলল ভিঞ্চি!
বাড়িতে ঢুকে পিঙ্কিকে হাঁক দিতে দিতে বারান্দায় হাত থেকে জাকৈ আর কোমর থেকে খালুই খুলে রাখল ভিঞ্চি।
ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসল পিঙ্কি, 'মা তুমি আমায় ডাকছিলেন?'
"হ্যাঁ মাজনী! ঘর থেকে আমায় গামছা, রিফান আর খদাবংগ দেয় তো । একেবারে ভিজে কাক হয়ে গেছি যে!'
"মা তুমি এতো ঝড় বৃষ্টির মধ্যে মাছ ধরতে যাও কেন? আমার খুব ভয় করে! যতক্ষণ তুমি ঘরে না আসা অব্দি খুব চিন্তা হয়!'
"মাজনী রে! আমার বাইরের ঝড় বৃষ্টি কোনো কিছুর ভয় করে না রে! ভয় করে ঘরে ঝড় উঠলে ! কী দিয়ে দুমুঠো ভাত খাবে? খাওয়ার জন্য যে কিছুই নেই ঘরে!'
"মা তুমি এতো চিন্তা কর কেন? আমরা নুন ভাত খেয়ে নিতাম!' বিট্টু ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলল।
ছেলে-মেয়ে দুটোর কথা শুনে সব কষ্ট যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল ভিঞ্চির! প্রশান্তিময় একটা দীর্ঘশ্বাস আপনাআপনি বুক থেকে বেরিয়ে আসল তার! "শুন মাজনী! তুই পড়াশোনা করে যখন বড় পুলিশ অফিসার হবি তখন তোর মা কি আর মাছ ধরতে যাবে? পড়াশোনা যখন নেই তখন তো পেটের জ্বালা মেটাতে কিছু একটা করতে হবে! স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গিয়েছিলাম! সব ক্লাসে প্রথম হতাম! ছোট ছোট চারটে সন্তানের মধ্যে মা-বাবার বড় মেয়ে আমি! ঠাকুমাকে নিয়ে সাত জনের সংসার মায়ের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল হচ্ছিল তাই স্কুল ছেড়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে কাজে নেমে পড়েছিলাম!' বলতে বলতে পিঙ্কির হাতে ঠোঙাটা ধরিয়ে দিতে উদ্যত হল ভিঞ্চি।
মাঝখান থেকে হেঁচকা মেরে খাদ্য বস্তুর ঠোঙাটা নিয়ে গেল জয়রাম! ভেতরটা হাতড়ে ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে! ডিম দুটো পড়ে ফেটে গড়িয়ে গেল ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে বারান্দায়! ভিঞ্চির গালে টাশটুশ করে চড় মারতে মারতে চেঁচিয়ে উঠল, "আমার জন্য মাল আনিস্ নি কেন? তুই কি জানিস না আমার মাল ছাড়া চলে না!'
"হেই পিঙ্কি তুই মায়ের সঙ্গে কাজে যাস্ না কেন? চৌদ্দ-পনের বছর বয়স হল এখনও বসে বসে খাবে?' বলতে বলতে পিঙ্কির দিকে ধেয়ে গেল সে! পিঙ্কিকে মারতে হাত উঠাতেই খপ করে সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ধরে ফেলল ভিঞ্চি! জয়রাম হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করল । কিন্তু মাতাল দুর্বল জয়রাম পেরে উঠল না রোদ-বৃষ্টিতে কাজ করা শক্তপোক্ত ভিঞ্চির সাথে! জয়রামের হাতটা মুচড়ে দিয়ে সে বলল, "আমার সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই কর কিন্তু আমার মেয়ের সঙ্গে কোনো অন্যায় আমি হতে দেব না! পিঙ্কির পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য যতটুকু পরিশ্রম করতে লাগে আমি করব! ওর পড়াশোনা কিংবা শরীর চর্চা কোনটারই ক্ষতি হতে দেব না আমি! কোন ধরনের শারীরিক বা মানসিক কষ্ট যেন আমার মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাধা না হয়! কান ভরে শুনে রেখো! মন মস্তিষ্কে গুজে রেখো!' বলে কোমরে গুঁজে রাখা পলিথিনের ঠোঙাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, "এই নাও টাকা! যত ইচ্ছে তত মদ গিল! কিন্তু আমার মেয়ে ও ছেলের ওপর নজর দিওনা!'
টাকা হাতে পেয়ে খুশি হয়ে ভিঞ্চিকে আদর করতে এগিয়ে গেল কিন্তু ভিঞ্চি তাকে পাত্তা না দিয়ে হনহনিয়ে টিউবওয়েল থাকা একচালা টিনের ছোট্ট স্নান ঘরটাতে ঢুকে গেল ভিজে কাপড় বদলাতে!
পিঙ্কি মা ফিরে আসার আগেই ভাত রেঁধে রেখেছিল। মাছগুলো পুড়ে পিঁয়াজ ও মরিচ কুচি দিয়ে চাটনি মেখে নিল । বিট্টুর জন্য আলাদা করে আলু চাটনি করল। বাবা ডিমগুলো ভেঙে ফেলল! এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল তার বুকের ভেতর থেকে। মা ও ভাইকে ভাত খেতে ডাকল । তিনজনে খেতে বসল। জয়রামের কোনো পাত্তাই নেই! টাকা হাতে পেয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়িতে থেকে যে বেরিয়ে গেছে আর কখন ফিরবে এর কোনো ঠিক নেই!
পিঙ্কি বলল, "মা! আমি একটা কথা ভাবছি!'
"কী কথা মাজনী!'
"মা বাবা আসলে ইচ্ছে করে এমন করে না। তাঁর হুস নেই! বুঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে!'
"আমি বুঝতে পারি রে মা! তাইতো সব সহ্য করি! তুই কী বলবি?বল!'
"মা! বিট্টুকে এই পরিবেশ থেকে দূরে সরাতে হবে!'
" কোথায়?'
"মা বিট্টু সব ক্লাসে প্রথম হয়ে আসছে বরাবর! এবার ক্লাস সে ফাইভে পড়ছে। ভালো করে পড়াশোনা করে নবোদয় বিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য প্রবেশ পরীক্ষাটা দিলে নিশ্চয়ই সুযোগ পেয়ে যাবে! ক্লাস সিক্স থেকে ওখানে চলে যাবে!'
"আমরা বিট্টু বাবুকে ছেড়ে থাকতে পারব কি? সে পারবে কি আমাদের ছেড়ে থাকতে?'
"মা! আমাদের পারতেই হবে! বিট্টু তোকে পারতেই হবে! দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই এই দুর্দশার থেকে মুক্তির!'
"আমি পারব মা! তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি এই জিনিসটা কখনও ছুঁয়ে দেখবনা যা বাবাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে!' বিট্টু মায়ের মাথায় হাত রেখে আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলে উঠল।
মা ছেলে মেয়ে দুটোকে জড়িয়ে ধরল ! তিনজনে গলাগলি করে ধরে খুব কাঁদল!
প্রকৃতি ঝড়বৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে ধুয়ে মুছে হালকা ঝরঝরে করে দিয়েছে! সব ধুলো ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার করে মিষ্টি মিষ্টি রোদ উঠেছে পৃথিবীর বুকে!
ভিঞ্চি, পিঙ্কি ও বিট্টু কেঁদে নিল কিছুক্ষণ! বুকের ভেতরের দুঃখ কষ্ট ধুয়ে মুছে একটু হালকা অনুভব করছে তারা।
***
ভিঞ্চি আজ খুব ব্যস্ত! তাদের মাটির ঝুপড়িটা আজ ঝকঝক চকচক করছে! লেপে পোঁছে সুন্দর পরিপাটি করে রেখেছে! কতোটা দিন ধরে সে অপেক্ষা করছিল এই দিনটির জন্য! একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে আজকের দিনে পরিধান করার জন্য নতুন খদাবংগ, কামবংগ ও রিফান কিনেছে সাথে রং মিলিয়ে একটা ব্লাউজও কিনেছে নিজের জন্য! জয়রামের জন্য কিনেছে আঠুঁমুরিয়া(গামোচা), জামা ও পজার!
জয়রামকে স্নান করিয়ে পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। নিজে সাজগোজ করেছে মনপ্রাণ ভরে । আহ্ কী শান্তি লাগছে আজ! নবোদয় বিদ্যালয়ে ছুটি চলছে তাই বিট্টু বাড়িতে এসেছে। সে বেরিয়ে গেছে সাব ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ মিস্ পিঙ্কি রাভাকে স্যালুট জানিয়ে নিয়ে আসতে!
উঠোনে ভিড় করেছে গ্রামবাসী! কারো হাতে আসামের ঐতিহ্যবাহী গামোছা, কারো হাতে ফুলের তোড়া, কারো বা হাতে মিঠাইয়ের বাক্স! ধন্য ধন্য করছে সবাই ভিঞ্চিকে! হঠাৎ টুং টুং শব্দ! বারান্দায় রাখা মিষ্টির হাঁড়ি দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য জয়রাম ভেঙে ফেলেছে লাঠি দিয়ে! ভিঞ্চি মেয়েকে দেখতে আসা লোকজনকে খাওয়াবে বলে কিনে এনেছিল রসগোল্লার মাটির হাঁড়ি! কিন্তু সবাই হৈচৈ করলেও ভিঞ্চির নড়চড় নাই! সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব পরিস্থিতির! আজকাল সে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না, প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ কিছুই করে না সে!
পিঙ্কি সবাইকে নমস্কার জানিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়াল বাবার সামনে! বাবাকে জড়িয়ে ধরে মাকে বলল, "মা চল!'
"কোথায়?'
"বাবাকে গুয়াহাটিতে নেশা মুক্তি কেন্দ্রে নিয়ে যাব!'
তিনজনে মিলে জয়রামকে টেনেটুনে গাড়িতে উঠিয়ে চলে গেল ! তাদের যাওয়ার পথে হা করে তাকিয়ে থাকল গ্রামবাসী! গামোছা, ফুলের তোড়া কিংবা মিঠাইয়ের বাক্স নিজ নিজ হাতেই রয়ে গেল!