“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬


অপরাহ্নে

 ১

এখনো উত্তাল সুখে শরীর আনন্দ করে, দেখো ।
পুলকের ঢেউ ওঠে, ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠে গলায় শরীর,
তরঙ্গ ছড়িয়ে যায় আনন্দের শয্যার উপরে,
বলিরেখাঙ্কিত যবনিকা ভেদ করে
সহসা দর্শন দেয় মদনের সুখদীপ্ত মুখ।
ফুলঝরা বসন্তের বিকেলে আবার
কোথা হতে ফুল ফোটে, কোকিলের ডাক শোনা যায়,
দীর্ঘ বেঁচে থাকবার কামনা ছড়িয়ে যায় প্রতি রোমকূপে ।

-------------------------------------------------------

অপরাহ্নে


সর্বাঙ্গ চাদরে ডেকে শুয়ে আছে ছাদের উপর।
উত্তুরে হাওয়ার শিহরণ, শুধু
মুখখানি ঢাকা নয় ।
হল্‌দে আলোর শেষ তাপটুকু শুষে নেবে বলে
আকাশে তাকিয়ে আছে ।
নীড়ে ফিরে যেতে যেতে বুলবুলি ডেকে বলে,
কেমন আছ ?
তোমার বারান্দার নিচেয় জবা গাছে যে বাসাটা
আমি বেঁধেছি সেদিন,
তাতে ডিম ফুটে শাবক হয়েছে।
কাল তাকে দেখে যেয়ো ।
শেষ কুটো মুখে নিয়ে চড়ুই বলল,
ভালো থেকো ।
নতুন বাঁধছি বাসা তোমার ঘরের আল্‌সেয় ।
কাল থেকে ডিম হবে ।
চুপি চুপি দেখে যেয়ো একবার ।
হলুদ সূর্য মরচে লাল হয়ে
দিগন্তের ওপারে যেতে যেতে বলে যায়,
আজকের গোধূলিই শেষ নয়,
ভোরের আলোয় এসো কালকে আবার ।
দেখা হবে নবারুণ আমার তোমার ।

 

কোন কথা নয়



প্রতিবাদ নয়।
প্রতিরোধ নয়।
প্রতিশোধ নয়।
শুধু দেখে যেতে হবে , শুনে যেতে হবে, কথা হবে না।

যুদ্ধের ক্ষত অবশিষ্ট অভিশাপের বীভৎস সংরাগ!
ইরাক যুদ্ধে জেহাদী আই এস আই এসের যৌন দাসীরা
জীবনের জন্য,  ইয়াজিদি ফুল ফুল মেয়েগুলি
আত্ম সমর্পণে,  ফুলের মত দেহদানে নারাজ ছিলো।
যুদ্ধবাজ, কামুক জেহাদী যুদ্ধবাজ নষ্ট দংশনে
ঐ ফুলের মত যুবতী মেয়েদের দেহ ছেঁড়াখোড়া করে।
আহা! ফুল ফুল বন্দিনী মেয়েগুলি, আহা সন্তানবতীরা!
আজন্ম দেহটাকে, দেহের সম্ভ্রমটাকে একেবারে
একান্ত আপন ভেবেছিলো
এই যুদ্ধের দেশে যুদ্ধবাজদের কামুক বারুদ স্তুপে
মাতা নয়, জায়া নয়, কন্যা নয়, বন্দিনী ধর্ষিতা শুধু!
এইমাত্র পরিচয়ে বেঁচে থাকার ক্লিন্ন ক্লেদাক্ত জীবন?
যে ধর্মকে আত্মা বলে জেনেছিলো
ধর্মবাজ জেহাদী তাও কেড়ে নিলো।
নষ্ট দেহ, হৃত আত্মা এ কেমন জীবন!
এবার শুধু অবসান!  
তাই ঝাঁপ,  মরণঝাঁপ মাউন্ট সিনজার থেকে!

প্রাচীনা এশিরিয় নগরী নিনেভের কাছাকাছি
পশ্চিম তীরে কলোচ্ছ্বাসিত টাইগ্রিসের নবীনা মোসুুল!
উত্তর ইরাকের ঝকমকে মুক্তো ' আল ফায়েহা ', প্যারাডাইস,
সবুজের উত্তাল তরঙ্গ 'আল খাদ্রা ' মোসুল!
উনিশটি যৌবনবতী ইয়াজিদি যৌনদাসী সেদিন
আই এস আই এস কামুক যুদ্ধবাজদের যৌন সঙ্গিনী হলো না।
কী দুঃসহ আস্পর্ধা! কী ভয়ঙ্কর পরিণতি! কী নির্মম শাস্তি!
সুদৃঢ় লোহার খাঁচায় পুরে আগুনে পোড়ানো
জলজ্যান্ত উনিশটি কুসুমিতা নারীকে নিধন!
হাজারে হাজারে দু 'পেয়ে মানুষ নামধারী দর্শক,
কেউ কিছু বললো না,  কোন প্রতিবাদ হলো না
ভীতির কবলে মোসুলের হাজারো সুসভ্য জনতা
দগ্ধ নারীমাংসের দুর্লভ ঘ্রাণে মুগ্ধ ধীরপায়ে হেঁটে
টাইগ্রিসের কুলকুল কান্নায় ডুব দিয়ে নিনেভের
ধ্বংসস্তুপ সভ্যতা পেরিয়ে হাজারো বছর আগের
আরণ্যক অসভ্যতায় চলে গেলো শুধু।

© সুনীতি দেবনাথ 

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সর্বহারাদের কথা

।।শৈলেন দাস।।
(১)
বাড়িটা বিক্রি হয়নি তখন তাই ফিরতে পেরেছে যতীন। হাওর অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে সাতপুরুষের ভিটে বলতে বিস্তৃত টিলার এক কোণে ছোট কুঁড়েঘর,  কয়েকটি আম জামের গাছ সহ চারপাশে ঝোপ জঙ্গল। পরিবারের লোকজন ও কিছু গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে সে ছিল এক সুখের নীড়। তবে এখন সে একাই এসেছে রাতের আঁধারে, পালিয়ে। স্ত্রীপুত্র কেউ সাথে নেই।
মানব সৃষ্ট দূষণের যন্ত্রণায় রুষ্ট হয়ে মাতৃসমা হাওর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় দেনার দায়ে পড়তে হয়েছিল যতীনকে। সুযোগ বুঝে সুদখোর মহাজন চাষের জমির জবরদখল নেয়, বাড়িটার প্রতি আগ্রহ দেখায়নি নিষ্ফলা বলে। রোজগারের অন্যকোন উপায় ছিলনা তাই পরিবার প্রতিপালনের জন্য সে চলে এসেছিল শহরে। শূন্য হাতে সহায় সম্বলহীন যতীন ঘর বেঁধেছিল শহরতলীর এক পরিত্যক্ত জলাভূমিতে।
বিশ্বায়নের ছোঁয়া লেগে শহরের শরীর বাড়ন্ত, তার সাথে ক্রমশ বিত্তশালী হয়ে উঠা শহরের আদি বাসিন্দারা যতীনদের মত সর্বহারাদের তখন আপন করে না নিলেও শহরে তাদের উপস্থিতিকে মেনে নিয়েছিল ক্রমবর্ধমান শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করবে বলে। মাথা গুঁজার ঠাঁই যেমন পেয়েছিল যতীন তেমনি রুজি রোজগারের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল সহজে। যদিও আর্থিক সচ্ছলতা কখনো আসেনি যতীনের জীবনে, তবে না খেয়ে থাকতে হবে এই ভয় আর তাড়া করেনি তাকে। তাই সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর রাতে অঘোরে ঘুমানোর বদ অভ্যাস পেয়ে বসে তাকে। কিন্তু শীতের কোন এক সকালে প্রতিবেশী যুবকের আর্ত চিৎকারে তার অন্তরাত্মা জেগে উঠতে কার্পণ্য করেনি বলে পুলিশ আজ তাকে খুঁজছে।
শৈরাচারীদের অত্যাচারে জর্জরিত হত দরিদ্র জনগণের 'মারের বদলে মার' মনোভাবের প্রতি শহরবাসী সাধারণ জনগণের সায় থাকলেও এককালে বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধরাও বিপ্লব আখ্যা দেয়নি বলে যতীনকে পালাতে হয়েছে ভয়ে। সহজসরল গ্রাম্য জীবন যাপনে অভ্যস্থ যতীন স্বল্প মেয়াদের এই শহুরে জীবনকালে দেখেছে ধর্মীয় উন্মাদনার সাথে রাজনীতির সংমিশ্রণ, মিটিঙে মিছিলে গিয়ে শুনেছে অনেক বিপ্লবীর কথা। সর্বহারাদের মুক্তির আশায় যে মানুষগুলি সবার সমান অধিকারের নীতি অনুসরণ করার বুলি আওড়েছে পথেঘাটে, তারাই মেকি ভদ্র সেজে পথে নেমেছে যতীনদের দুষ্কৃতি আখ্যায়িত করতে অথচ শৈরাচারীর বিরুদ্ধে টুঁশব্দটি নেই!
দুদিন থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আজও দুপুর গড়িয়েছে অনেকটা। বাড়ির পূব দিকে বড় হিজল গাছের ছায়ায় বসে হাওরের দিকে চেয়ে আছে যতীন। কোঁচড়ে গামছার এক মাথায় কয়েক মুটো মুড়ি, যা একটু আগে দিয়ে গেছেন পাশের গ্রামের শুক্কুর চাচা। দুপুরে হাওরে গরু চড়াতে এসেই যতীনকে দেখতে পেয়ে এসেছিলেন। জানিয়ে গেছেন, বাজারের লোকজন নাকি বলাবলি করছে কি সব গণ্ডগোলের জন্য পুলিশ শহরতলী ঘিরে রেখেছে। রেডিওতেও খবর দিয়েছে কোন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে হামলা করে দুষ্কৃতিরা নাকি সবাই পালিয়েছে; বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে নাকি গোটা শহর উত্তাল। যতীন যেন কিছুদিন শহরে না যায়।
(২)
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে শহরতলীর নিজের বাড়িতে শেষবার গিয়েছিল সতীশ। গণ্ডগোলের তিন চার দিন পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নজর এড়িয়ে গোপনে সেখানে যেতে হয়েছিল তাকে। আতঙ্কময় পরিবেশে অনাহারে অর্ধাহারে নারী শিশুর দিন গুজরানো দেখে সেদিন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছিল তার। স্বজনদের এই দুর্দিন  মেনে নিতে পারছিলনা সে, বিশেষ করে যতীনের দুই বছর বয়সী শিশুপুত্রের করুণ মুখ এখনও চোখে ভাসছে। ভদ্রলোকের বাড়িতে গরীবেরা ঢিল ছুড়েছে তাই রুষ্ট হয়েছে সুশীল সমাজ, এমন পরিস্থিতে কাকে বুঝাবে সে- যা রটেছে তা যে আদৌ ঘটেনি, শহরতলীর সর্বহারারা দুষ্কৃতি নয়। সতীশ লক্ষ্য করেছে পরিচিতজনেরাও এই কয়দিন যোগাযোগ করেনি, কি জানি তাকেও দুষ্কৃতি ভেবে বসে আছে কিনা! না, স্পষ্টীকরণ একটা দেওয়া দরকার। তাই চিঠি লিখেছে সে সবকয়টি সংবাদপত্রের পাঠকের মতামত বিভাগে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়নি তার চিঠিটি।
কিছুটা হতাশ এবং বিমর্ষতা নিয়ে শহরের ব্যস্ততম রাজপথে যানজটে আটকা পড়ে সতীশ যখন এসব কথাই ভাবছিল ঠিক তখনই মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল। কোন মতে বাইকটি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে মোবাইল হাতে নিতেই স্ক্রীনে ভেসে উঠল মধু'দির নাম। ছোট একটি সাহিত্য পত্রিকা করে মধু'দি, সতীশ এর মত নতুনদের উৎসাহ দিতে মধু'দির এই প্রয়াস। বোতাম টিপে ফোন কানে ধরতেই মধুদি বললেন 'সতীশ, পিসি কথা বলতে চায় তোমার সাথে।' খরায় শুকিয়ে খাট হয়ে যাওয়া কৃষি জমিতে যেন ঝরঝর করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল কয়েকটি। চরম হতাশার সময়ে আশার আলো খুঁজে পেল সতীশ। বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠার আগেই পিসির কণ্ঠস্বর - 'তুই কোথায় আছিস সতীশ? এতকিছু হয়ে গেল আমাকে একবারও বললি না? একদম মন ছোট করবি না, তুই এখনই আমার কাছে আয়।' লেখালেখির জগতে তার কলম যেমন অনন্য তেমনি সবাইকে ধরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব পিসি সাহিত্যজগতে সতীশদের অভিভাবক। ঘটনার আকস্মিকতা এবং সংকোচের কারণে সে ভুলেই গিয়েছিল পিসির কথা। সতীশের চিঠি দৈনিক পত্রিকাগুলির একটিও ছাপেনি, ছেপেছিল নিতু'দির সাপ্তাহিক 'নতুন দিশা'তে এবং এর ফলেই এক সপ্তাহ পরে পিসি জানতে পেরেছে সতীশরা ভাল নেই।
(৩)
এক মাস কেটে গেছে শহরতলীতে আর পুলিশ আসেনি। যতীনও ফিরে এসে আগের মতই লেগে গেছে রুজিরোজগারে। পিসির এক চিঠিতেই কাজ হয়েছে, মানবাধিকার কর্মীদেরও ঘুম ভেঙ্গেছে ততক্ষণে। সতীশ তার লেখালেখির বিষয়বস্ত তথা ধরণ পাল্টে ফেলেছে, পরিস্থিতির কারণে অনেক পরিণত হয়ে গেছে সে। নিজেই লিখতে শুরু করেছে যতীনের মত সর্বহারাদের কথা।

মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ১৬

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়   ষোল  ---সুব্রতা মজুমদার।)  



ষোল
    
বৈতলের দিন কেটে যায় বুদ্ধির ব্যবহারিক প্রয়োগে । দিনের শরিক অনেক । সঙ্গীহীন রাতের অসহায়তা কাটাতে রাতের উত্তর খুঁজে বেড়ায় দিনের আলোয় বৈতলের চাই স্থায়ী আস্তানা । পশরাহীন মেলার দোকান নয় । ক্যাম্প আর রিফ্যুজি শব্দের অবজ্ঞা থেকে বেরোতে চায় বৈতল । আর বৈতল চাইলেই তার উপায়ও বেরিয়ে আসে যথাসময়ে । হয়ে যায় যোগাযোগ ।
     ইটখোলার তেমাথায় শৈলেন কবিরাজের ঔষধালয় । কবিরাজি দোকান তো নয়, এক বৈঠকখানা । ঘরের তিনদিকে কাঠের আলমারিতে বৈয়াম । কোনোটা ভর্তি কালো কালো বড়িতে কোনোটা খালি । ছোটখাটো চেহারার কবিরাজ মশাই তার চৌকির মধ্যমণি হয়ে গড়গড়ায় প্রথম টান দিয়ে শুরু করেন সান্ধ্য আসর । তখন রোগী থাকে কম, সমবয়স্ক বান্ধব সমাজই প্রধান । বৈতলও ঘরের এক কোণে বসে ওদের কথোপকথন শোনে, কখনও মন্তব্য করে আলটপকা । হেড়ম্ব ভট্টাচার্যের গলাটাই থাকে চড়া । ইটখোলা মালুগ্রাম হরিৎবরণের একমাত্র পুজারি ব্রাহ্মণ । বেঁটে মানুষটি এলাকায় বাট্টি ভট নামেই বেশি পরিচিতি । সবার ভিতরবাড়ির অনেক খবরই তার নখদপর্ণে । গূঢ় সংবাদ পরিবেশনে সতর্কতার কণ্ঠস্বর তার কিছুতেই নিচু থাকে । কারণ বাট্টি ভটের গলার আওয়াজ একই তারে বাজে, কোনও ওঠা পড়া নেই । সব সময় ভম্‌ভম্‌ মুলি বাঁশের গাঁট ফাটা গলা । তাই সাংকেতিক ভাষার ঘেরাটোপ । বৈতলের বুঝতে অসুবিধা হয় । বাট্টি ভট বলে,
--- রাহুয়ে বুঝছইন নি কবিরাজ মশায়, কেতুরে আর রাখাল না । পুড়ি ইগুরে লইয়া যেতা ইচ্ছা করের, যেখানো ইচ্ছা ঘুরের । অউত্ত গেছেগি এক চা বাগানো, ডার্বি না ভুবনডর ।
   পুরনো বই এর দোকানদার বিনোদ চক্রবর্তীও কেচ্ছাগল্পে সমান উৎসাহী । বলে,
--- লগে কিতা ভোলা গেছে না নি ।
--- ভোলায় কিতা করত । ভোলা ইগু তো দালালি করে । বদনাম হয় ভোলার, মাঠা খায় হিগুয়ে । রাহুয়ে ।
--- কেমনে গেল তাই, বাপে ছাড়ল কেনে ।
--- বাপ ছাড়াছাড়ির কে । কালা চেভরলেট অগু চালাইয়া অউত্ত ডাইল ভাত কেতুর । বাগানো গেছে তখন তো উপরি ও পাইব ।
--- অ গাড়ি লই গেছে নি । তে আর কিতা বাপ লগে আছে ।
--- বাপ লগে থাকত কই । ইউনিয়নের জিপ লইয়া গেছে । পানি কাপড়র জিপ ।
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে এসে কিছু সত্য বৈতলের বোধগম্য হয় । কালো গাড়ির সূত্রে কিছু আন্দাজ করে । বৈতল আপন মনে হাসে, রাবণের উপমাটা তার, আর রাহু । দুটোই বেশ জুতসই । কিন্তু পুড়ি কে কেতুই বা কে । অপ্রয়োজনীয় ভাবনাকে দীর্ঘায়ীত করে না বৈতল । জমিদার যমুনাপ্রসাদের এরূপটাও সে ধারণা করেছে, তথ্যে নিশ্চিত করতে পারেনি । তবে বেঁটে মানুষটার উপস্থাপনাতে বেশ মজা আছে । সব কথা বলাও হয়, নামও নেওয়া হয় না । উপস্থিত মধ্যবয়সী জনেরাও তাকে রটনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মানে । তাই আরো তথ্যের খোঁজে বাকিদের হামলে পড়তে দেখে বৈতল প্রমাদ গোনে । সময় বয়ে যাচ্ছে এককথায় সেকথায় । বৈতলে ফিরে যাওয়ার জন্য তৎপর হয় । কম পথ নয়, সাত আটমাইল হবে ইটখোলা মেহেরপুরের দূরত্ব । কবিরাজ মহাশয়কে বলে,
--- কাকুবাবু, আমি ইখানো থাকি কিতা করতাম আম্মকর লাখান । পয়সা দিলাইন যাই গিয়া ।
--- তুমি আম্মক অইতায় কেনে রেবা, আমার কবিরাজির বনাজি অইলায় তুমি । ইতা জড়িবুটি গাছ গাছালি পাতালতা আনিয়া না দিলে অষুদ বানাইলাম নে কেমনে । আইজ থাকিউ যাও, কাইল তুমারে এক লিস্টি দিমু, আনি দেওন লাগব । তুমি তো কইছ বড় হাওরর পারো তুমার বাড়ি, তে ত শালুক চিনো, বনতুলসী শিমূল ভুবি লুকলুকি দুরণ কলমী এরেন্ডা আর শটির কিছু পাতা আনি দিও । তোমারে পুরা পয়সা দিতাম পারতাম নায় একলগে । তুমি তো দেখছউ সবে পুরা পয়সা দেয় না, পয়সা না দিয়াউ লই যায় অষুদ । গাছ গাছালি নায় তুমি দিলায়, কিন্তু মধু তো কিনন লাগে, ধাতুঅ কিনন লাগে । বাড়ির সোনারূপা শেষ অই যার । মার ইতা ভাঙ্গাই দিয়ার । মায়ে তো আর দেখরা না ।
 শৈলেন কবিরাজকে গাছ গাছালির শিকড়। পাতা ফল ফুল দেয় বৈতল । কবিরাজ বৈতলকে মূল্য দেওয়ার কথা বলেন কিন্তু দেওয়া আর হয় না । বৈতল দুচার পয়সার জন্য চাতলা হাওরের পারে বনজঙ্গল থেকে লতাপাতা শিকড় বাকড় আনে না । রোগী দরদী কবিরাজকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য একটা তো আছেই, আর আছে তার স্থায়ি-ঠিকানার খোঁজ, হদিশ । জমিদার বাড়ির পুকুরপারে চালা ঘর একটা দেখে এসেছে । সেই ঘরের গেরস্ত হবে বৈতল । তার আগে তো টোপের মুখে ঢালতে হবে মধু । জানতে হবে ভিতু জমিদারকে কাবু করার কৌশল । গুণের কথা, চরিত্রদোষের কথাও তো জানতে হবে । আর সে-কাজে ভাল মানুষ কবিরাজ যে তার কোনও সহায় হবে না সে জানে বৈতল ।
     জলের জাদুকর বৈতল জানে জাদু দিয়ে কিছু হয় না । জানতে হয় কৌশল । নদী বিল পুকুরে জলের বুড়বুড়ি দেখে, মকা পুঁটি দাড়কিনার চালচলন দেখে বুঝে বড় বোয়ালের হালহদিশ, রুই কাতলার ঠিকানা । কবিরাজ কাকুর সভাঘরের ভিতরও বৈতল কৌশলে খুঁজে নেয় তার ঠিকানা । হেড়ম্ব ভট্টাচার্য ওরফে বাট্টিভটই এখন তার টোপের নিশানা । মোটা গলার মানুষটার শয়তানি তার চোখে মুখে । নিজের সুখ নেই আনন্দ নেই লাভ নেই তবু পরনিন্দা আর পরচর্চায় কাটিয়ে দেয় সময় । যজমান বাড়ি গিয়ে আহরণ করে পারিবারিক আর ব্যক্তিগত কুটকচাল, শৈলেন কবিরাজের ঔষধের বড়িতে মিশিয়ে দেয় কথার বিষভদ্রলোক কবিরাজও মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে বলেন,
--- তাইন যে কিতা মাতইন ।
     কথা শুরু করতেও হেড়ম্ব ভট্টাচার্যর সুতো ধরতে হয় না । সুতো এসে ওর হাতে ধরা দেয় । যেমন বৈতল আহম্মকির কথা । ওই এক কথায়ই তোপ ঘুরিয়ে দেয় বৈতলের দিকে । হুকোর নাইড়চা এদিক থেকে ওদিকে ঘুরিয়ে মুখ লাগিয়ে আয়েস করে দেয় এক টান । ধোঁয়া গেলে একপেট । বৈতলের দিকে ঘুরে ধোঁয়া মিশিয়ে দেয় বাতাসে । বলে,
--- আম্মকির কথা কিতা কইলে বেটা । আমরা কিতা ইনো আম্মকির মাত মাতিয়ারনি ।
--- এ ঠাকুর, ইতা কিতা কইরা। আপনারা তো কিচ্চু মাতলাউ না । আর আমার আম্মকির লগে আপনারার কিতা কইন । আমি অইলাম আম্মক ছয়, যে হক্কল কথাত কয় অয় অয় । আপনার যেতা কইবা সবতাতঅউ আমারে অয় অয় করন লাগব । রিফুজি মানুষ তো কিচ্চু চিনি না । এর লাগিউ কইয়ার যাই গিয়া ।
--- যাইতায়গি কই রেবা, বাবন বাড়িত আইছ না খাইয়া গেলে অইবনি ।
     ব্রাহ্মণ বাড়িতে খাওয়ার অভিজ্ঞতা বৈতলের ভাল নয় কিন্তু শৈলেন কবিরাজের বাড়ি অন্যরকম । খাওয়ার ব্যবস্থা এক সিদ্ধ চাল ডাল সব্জি নুন সব এক সঙ্গে । কবিরাজের পরিবার বলতে এক খোঁড়া কিশোর শিক্ষার্থী । কবিরাজ শিখেছে, বাড়ি ভুবন পাহাড় । ওরা কেউই তার জাত গোত্র জানতে চায় নি । কবিরাজও না তাঁর ছাত্রও না । একসাথে বসে খেয়েছে, নিজেরা নিজের পাত্র ধুয়ে রেখেছে । খাওয়া শেষে এক টুকরো যষ্টিমধু এনে দিয়েছেন কবিরাজ । বলেছেন,
--- খাওরেবা । মিঠা লাগব ।
মিষ্টি মানুষের লোভেই আসে বৈতল । দুর্গাবতীর রাগ সহ্য করে থেকেও যায় ভালমানুষের কাছে দুদণ্ড । নির্লোভ সাধু মানুষের জীবনে শখ দেখতে হলে শুনতে হলে থাকতে হবে এক রাত এক ভোর । রাত ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যায় কবিরাজ ঠাকুরের । পেছন ঘাটা খুলে ভাঙা বালতি আর ঘটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন । অনেক দূরে খাটা পায়খানার কাজ সেরে ফিরেও আসেন তৎক্ষণাৎ । আর ঘরে ঢোকা হয় না, চিলিম উল্টে পোড়া তামাকের গুড়ো মুখে দিয়ে কচর মচর করতে করতে শুরু হয় বাটিসাবানে বুরুষ ঘষে গালে ফেনা তোলা । রেজারে ভারত ব্লেড লাগিয়ে ফটকিরি ঘষে একবার ছোট হাত-আয়নায় দেখে নেওয়া গালের মসৃণতা । বৈতল মাটির বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাকাবাবুর কান্ড কারখানা দেখে আর শোনে মিষ্টি মানুষের মিহি সুরের গান।,
রাইজাগো গো
জাগো শ্যামের মনমোহিনী
তারপর শ্যামাভোগের মুড়ি বাতাসা আর জল আহার শেষে বেরিয়ে পড়া দুপুরের খাওয়া, বলেন, ভোজনং যত্র তত্র । শহরে তো আর আখড়ার অভাব নেই । দুপুর পর্যন্ত ভ্রাম্যমান ঔষধালয়ের চিকিৎসা শেষে ভোগের প্রসাদ । মেহেরপুর কিংবা শিলকুড়ির উদ্বাস্তু শিবিরে গেলে হরিমটরদুর্গার সঙ্গেই প্রথম পরিচয় শৈলেন কবিরাজের রবির বারবেলায় । ক্যাম্পে বিনাপয়সায় রোগী দেখা এবং ঔষধ দেওয়ার দিন রবিবার । ইটখোলা থেকে পায়ে হেঁটে যান মেহেরপুর । সেখানেই পরিচয় এই অকৃতদার চিকিৎসকের সঙ্গে । রোগের লক্ষণ জেনে কালো বড়ি খাইয়ে বাঁচিয়ে দেন দুর্গাবতীকে । বলেন, অতিসারসঙ্গে নুন জলের অনুপান । কৃতজ্ঞতায় বৈতল কাবু হয়ে যায় । তারপর যে-কোনো ছুতোয় চলে যায় অ্যাওলা হরতুকি ব্রাহ্মীশাক যা পায় তা নিয়ে । বিস্বাদ হবিষ্যি আহারের লোভে থেকেও যায় । প্রথম রাতে যষ্টিমধু মুখে দিয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে বৈতল । বলেছে,
--- কবিরাজ মশয় একখান কথা কইতাম নি ।
--- কও না, কে না করছে ।
--- না, বাবন বাড়িত খাইতে আমার খুব ডর লাগত ।
--- কেনে বা ?
--- তারা খুব ছুয়াছুয়ি মানইন ত ।
--- আমিও মানি । আমি চিকিৎসা করি । নিয়ম মানিয়া জীবনধারন করি । তে আমি ছুয়াছুতর বাবন নায় রেবা ।
--- না, আপনার কথা কইয়ার না । আমরার ছাতকো আছিল এক বাবনবাড়ি ।
--- তুমার বাড়ি ছাতক নি । ছাতকর মানুষ বুলে খুব আড়ুয়া ।
--- আমি কুনু আড়ুয়া নি ?
--- না রেবা, ইতা এক কথার কথা । এক ছড়া মনো পড়ল । হুনো,
ছাতক তনে আইলা এক আড়ুয়া, যাইতা বদরপুর ।
সিলট আইয়া জিগার করলা, জৈন্তা কতদূর ।
নেও কও, কিতা কইছলায় ।
--- না, আমরার ছাতকো আছিল জৈন্তেশ্বরীর মন্দির । অউ মন্দিরর পুকইরো এক মাছ ধরি দিছি পুরইতরে । অউ বড় বড় কালিয়ারা । বাবনি এইন আছলা বড় ভালা, কইল খাইয়া যাইছ বেটা । আমি তো আদরর পাগল, খাইলাম । জীবনে ভুলতাম নায় সোয়াদ । পুস্তু বাটিয়া রান্দচইন কালিয়ার মাছর ঝুল, পিয়াইজ উয়াইজ ছাড়া । অত আদর করি খাওয়াইলা মাসীয়ে । খাওয়াইয়া দেখি হক্কলর উছিত উঠাইলা, ধইয়া আনি রাখলা, আমার উছিত উঠাইলা না । শেষে উঠাইলা, উঠাইয়া ছান করিয়া আইলা ।
--- কেনে ?
--- আমি নু ...
 বৈতলের মনে পড়ে দুর্গাবতীর কথা । দেশভাগের কথা, ওপারের বৈতল কৈবর্ত, এপারে যে শর্মা । ব্রাহ্মণ । তাই বৈতল শুদ্ধ করে নিজের বয়ান । বলে,
--- তারা নু চক্রবর্তী বাবন । সবর উপরে ।
--- তুমার কিতা ?
--- আমার শর্মা । অগ্রদানী বাবন ।
হেড়ম্ব ভট্টাচার্য বা বাট্টি ভট সন্তুষ্ট নয় বৈতলের জবাবে । বলে,
--- আম্মক ছয় কইলে কেনে বেটা । আমরা কুনু আম্মক পাঁচ নি ? বেশ চালাকি করিছ না, পুরা কতা ক ?
--- পুরা কথা কইতাম কেমনে, আপনারা কে কিতা কুনু জানি নি ?
--- আবার চালাকি কররে । ফকরামি নি ?
--- আইচ্ছা, ঠিক আছে কইয়ার, হুন্ততাউ যখন হুনইন । গাইল্লাইন না যেন ।
আম্মক এক-অল্প বয়সে লয় ভেক ।
আম্মক দুই-চাল ছাইয়া টুল্লিত থয় খুট ।
আম্মক তিন-যে ছুটলুকর কাছে করে ঋণ ।
আম্মক চাইর-যে থাকে শরিকি বাড়ি ।
আম্মক পাচ যে শরিক অইয়া মাছ কিনে ।
আর আমি অইলাম আম্মক ছয় । অউ শেষ ।
--- না আরো আছে আমি জানি । তুই আমারে কইরে, আমি ঘরজামাই এর লাগি কইরে । ক কইলা আম্মক চৌদ্দ কিতা ? তুইতো বেটা ছয় নায় খালি, তুই আম্মক এগারো ও, তুই পরর কাম করছ বেগার । ই কবিরাজর বেগার খাটিয়া কিতা লাভ তর । এর থনে জমিদারর বেগার খাট, পয়সা পাইবে ।
--- পয়সা দিলে খাটতাম না কেনে । কত দিবা ।
--- যত চাছ দিব । ইতা কুনু নাড়ী টিপিয়া জ্বর দেখা আর ছালি দিয়া বড়ি বানানি নি । জমিদার বাড়িত সব পাইবে । বিয়া করচছনি, বৌ আছেনি ।                
বাট্টি ভট দরিদ্র কবিরাজকে অবজ্ঞা করলেও সোজা কথার মানুষটিকে ভয় পায় বিলক্ষণ । তাই শৈলেন ঠাকুরের সামনে সব কথা বলার সাহস করেনি । বৈতলকে একান্তে ডেকে জানায় যমুনাপ্রসাদ জমিদারের দুর্বলতা । বলে,

--- সুন্দর সান্দর না অইলেও অইব, গতর থাকন লাগব ।


চলবে                 

চলবে

 < উজান পর্ব ১৫ পড়ুন                                                                    উজান পর্ব ১৭ পড়ুন >