“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

তালাক-ই-বিদ্দত কেন নিষিদ্ধ


( ৩ সেপ্টেম্বর, দৈনিক সংবাদে , ১৩ পৃষ্ঠাতে প্রকাশিত )



।। সুদীপ নাথ ।।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪১ ও ১৪২ অনুযায়ী ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতের মুসলিম সমাজের প্রচলিত তালাক-ই-বাদাত অসাংবিধানিক বলে রায় ঘোষণা করেছে। সুদীর্ঘ রায়ের অপারেটিভ পোর্শন তথা কার্যকর অংশটি হচ্ছে: In view of the different opinions recorded, by the majority of 3-2 the practice of ‘talaq-e-biddat’ –triple talaq is set aside.

মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত যে রায়  ঘোষণা করেছে তাতে মুসলিম সমাজে প্রচলিত অন্য ধরণের তালাকের পদ্ধতিগুলো নিয়েও আলোচনা করেছে। যেমন talaq-e-ahsan এবং talaq-e-hasan/talaq-e-ehasan ইত্যাদি। এমতাবস্থায় এটাতে বিভ্রান্তির অবকাশ মোটেই নেই যেঐ সমাজে কয়েক ধরণের তালাকই প্রচলিত।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ২২-৮-২০১৭ তারিখে ঐ রায়ে মুসলমানদের এই তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে। পর পর তিনবার তালাক উচ্চারণ করে অথবা চিঠি লিখেসামাজিক মাধ্যম বা ফোনে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেওয়া হয়তার বিরুদ্ধে ৫জন মুসলিম নারী সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেছিলেন। তারই প্রেক্ষিতে ৫ সদস্যক  এক সাংবিধানিক বেঞ্চের ২ জন বিপক্ষে ও ৩ জন পক্ষে এই রায় দিয়েছে। এই রায় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে ভারতের মুসলমান প্রধান এলাকাগুলোতেও।
কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মত মুসলমান-প্রধান দেশ সহ বিভিন্ন দেশে এই তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়েছে দীর্ঘদিন আগেই। পাকিস্তান সৃষ্টির লগ্ন থেকেই নারী আন্দোলন কর্মীরা তিন তালাক বন্ধের জন্য চাপ দিচ্ছিল। পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খান ছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে। নারী অধিকার কর্মীরা তখন হুমকি দিয়েছিলএই তিন তালাক তথা তালাক-ই-বাদাত বিষয়ে মুসলিম পারিবারিক আইনে যদি পরিবর্তন না আনা হয়তাহলে তারা আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলবেন। ফলে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনে সংস্কার সাধন করতে একরকম বাধয় হয়েছিল আইয়ুব খান সরকার। তখন বলা হয়েছিলমুখে-মুখে তিন তালাকের কোন আইনগত বৈধতা থাকবে না। আইয়ুব খান সরকার তালাকের ক্ষেত্রে যে সংস্কার এনেছিল সেটি এখনো বাংলাদেশে চালু আছে। বাংলাদেশে আদালতের মাধ্যমে এবং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেও বিবাহ বিচ্ছেদ এখন সম্ভব।
এবার ঐসব বিভিন্ন ধরণের তালাকগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। বিভিন্ন দেশে, পদ্ধতিগত দিক দিয়ে, পুরুষ কর্তৃক দেয় তালাক মুখ্যত তিন প্রকার:-
ক) তালাক-ই-আহসান বা সর্বোত্তম তালাক
খ) তাকাল-ই-হাসান বা উত্তম তালাক
গ) তালাক-ই-বিদ্দাত বা শরিয়া বিরুদ্ধ তালাক

আবার ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকার:- তালাক-ই-সুন্নাততালাক-ই-বাদীতালাক-ই-তাফবীজতালাক-ই-মোবারত এবং খোলা তালাক। কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকার:- তালাকে রেজী ও তালাকে বাইন। এই তালাক-ই-বাইন আবার দুই প্রকার:- বাইন-ই-সগির ও বাইন-ই-কবির। মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকেও তালাক চার প্রকার হয়যেমন হারামমাকরুহমুস্তাহাব ও ওয়াজিব।

এবার বিভিন্ন রকমের তালাক পদ্ধতি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। তালাক-ই-হাসান তাকে বলেযে তুহুরে অর্থাৎ মাসিক রজঃস্রাবের মধ্যবর্তী সময়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সহবাসজায়েজ অবস্থা কিংবা গর্ভাবস্থা নেই। উল্লেখিত অবস্থা সমূহ নেই এমন তুহুর অবস্থায়শুধু মাত্র এক তালাক দিয়ে ইদ্দত পূর্ণ হতে দেওয়া। অর্থাৎ তিন তুহুর অতিক্রম করলে তালাকটি কার্যকর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্য যে কোন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে কিংবা তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী ইচ্ছা করলে এবং স্বামী চাইলে তারা পুনঃ বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে। এই ধরনের তালককে বলা হয় তালাকে আহসান।
হাসান তালাক হলো প্রত্যেক তুহুরে একটি করে তালাক দেয়ার পদ্ধতি তথা নিয়ম। এই নিয়মে তিন তুহুরে তিন তালাক দেওয়ার নিয়ম কে তালাক-ই-হাসান বলে। এই তালাক-ই-হাসান দিলে অর্থাৎ তিন তুহুরে তিন তালাক দিলেসেই স্ত্রী তার স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। সে তার স্বামীর নিকট রেজাত বা পুনঃ বিবাহে আসতে পারবেনা। তবে স্ত্রীর যদি অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ হয় এবং দ্বিতীয় স্বামী যদি কোনো দৈবাৎ কারণে তালাক দেয় কিংবা মৃত্যু বরণ করেতবে ইচ্ছা করলে আগের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।

তালাক-ই-বিদ্দাত হলোকোনো ব্যক্তি কর্তৃকএকসাথে তিন তালাক দিয়ে দেওয়া বা জায়েজ অবস্থায় তিন তালাক দেওয়া অথবা যে তুহুরে সহবাস করেছে সেই তুহুরে তিন তালাক দেওয়া। উল্লেখিত যে কোন প্রকারে তালাক দেওয়া হউক না কেন তালাক দাতা গুনাহগার হবে গর্ভাবস্থা প্রকাশ পায়নি এমন সন্দেহ জনক অবস্থায় তিন তালাক প্রদান করাও বিদায়াত বা হারাম। এই তালাক-ই-বিদ্দাত সম্পূর্ণ শরিয়া বিরুদ্ধ তালাক পদ্ধতিযা মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আমাদের সংবিধান সম্মত নয় বলে নিশ্চিত করেছে উল্লেখিত আইনে।  বর্তমান সময়ে অধিকাংশ তালাক অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অথবা শরীয়ত প্রবর্তিত পদ্ধতির কোনটাই ভারতে ঠিকমতো অনুসরণ করা হচ্ছিলো না। বাংলাদেশেস্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে চেয়ারম্যানমেম্বার বা কোন গণ্য মান্য ব্যক্তি তালাকের নোটিশ স্বাক্ষর করলেইএই তালাক হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা তালাকের ঘোষণা দেন নাআবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় তালাকের নোটিশে লিখা হয় এক তালাকদুই তালাকতিন তালাক ও বাইন তালাক। এমন ধরনের তালাক , তালাক-ই-বিদ্দাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং যারা এধরনের তালাক অনুষ্ঠিত করিয়া থাকেন তারা সবাই গুনাহগার হয় বাংলাদেশে।
ইসলাম ধর্মানুসারে তালাকের পর তালাক প্রাপ্তা মহিলাকে ইদ্দত পালন করতে হয়। ঐ সময়ে কোনো মুসলিম নারীর পক্ষে পুনর্বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্বামীর মৃত্যুতেও বিধবাদের ইদ্দত পালন করতে হয়। ইদ্দতের নিয়মানুসারে তালাক বা বিধবা হবার পর নব্বই দিন অথবা তিনিটি চান্দ্র মাস মহিলাদের অপেক্ষা করতে হয় পুনর্বিবাহের জন্যে। এমতাবস্থায়তালাকের পরে ইচ্ছে করলেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া স্বামী ও স্ত্রী পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। এই শর্তটি হচ্ছে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী ওই স্ত্রীকে অন্য কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং নূতন স্বামীর মৃত্যু বা নূতন স্বামী কর্তৃক আবার তালাক প্রাপ্তা হতে হবে। তবেইপুরোনো স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ সম্ভব। এই শর্তটি খুবই কঠিনকারণ বাস্তবে এমন পরিস্থিতি সচরাচর ঘটে না। এক কথায় বলা যায়কথায় কথায় ঘর ভাঙ্গা আর গড়া একপ্রকার অসম্ভব।
প্রাচীন সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে গেলে তারা আবার বিয়ে করতে চাইলে মধ্যবর্তীসময়ে স্ত্রীকে আরেকটি বিয়ে করতে হত। এই দ্বিতীয় বিয়ের ব্যক্তি তথা নতুন স্বামীস্ত্রীকে তালাক দিলে বা মারা গেলে তবেই স্ত্রী পুনরায় প্রথম স্বামীকে বিয়ে করতে পারত। এই মধ্যবর্তীকালীন বিয়েকে ‘হিল্লা’ বিয়ে বলে। তবে বর্তমানে হিল্লা বিয়েকেও কোথাও কোথাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
         এবার বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা একটু দেখে নেয়া যাক। বাংলাদেশে মুসলিম বৈবাহিক আইনে 'তালাক-ই-আহসানএবং 'তালাক-ই-ইহসানবলে দুটো পদ্ধতি আছে। সে দুটো মিলিয়ে 'তালাক-ই-তৌফিজপদ্ধতি সবার জন্য বৈধ করে দেয়া হয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসারে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে তারা যদি মত পরিবর্তন করে ফেলেন তাহলে সেই তালাক কার্যকরী হবে না। তিন মাসের মধ্যে যদি তারা মত না বদলান , তাহলে তিনমাস পরে সেই তালাক কার্যকরী হবে। কেউ যদি বিচ্ছেদের ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে সেটি একটি সালিশি বোর্ডের কাছে চলে যাবে। এ সালিশি বোর্ড তিন সদস্য বিশিষ্ট হয়। সেখানে একজন জনপ্রতিনিধি এবং স্ত্রী ও স্বামীর পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি থাকে।
বাংলাদেশে যারা তালাকের জন্য ইচ্ছা পোষণ করেনতারা যদি মনে করেন , তাহলে সালিশের মাধ্যমে একটি সমাধান নিতে পারেন। যদি সেটা না হয়তাহলে তিনমাস পরে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। বাংলাদেশে কেউ যদি তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইনগত সুরক্ষা চায়তাহলে তাকে সেটি দেয়া হয়। কারণ তিন তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ বাংলাদেশে বৈধ নয়। কিন্তু 'তিন তালাকউচ্চারণের মাধ্যমে কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে তাকে শাস্তি দেবার বিধান নেই। তবে সে তালাক আইনগত-ভাবে কার্যকরী হবে না। তখন স্ত্রীকে তার মর্যাদা দিতে হবে এবং তাকে ভরণ-পোষণ দিতে হবে।
পাকিস্তানের ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়েকে বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৬১ সালের আইনে তালাকের পর স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে হিল্লা বিয়ের দরকার হয় না। তবে পর পর ৩ বার তালাক হলে তৃতীয় বারের পর স্বামী ১ম স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে স্ত্রীকে আরেকটি বিয়ে দিয়েতারপর সেই বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়েপ্রথম স্বামী স্ত্রীকে আবার বিয়ে করতে পারতেন।বাংলাদেশে  বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হলো১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারেযে নোটিশ তাকে দেয়া হয় তা পাবার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষকে ডেকে সালিশের ব্যবস্থা  করা । সালিশে পুনর্মিলনের একটি সম্ভাবনা থাকে বলে এখানে চেয়ারম্যান ও সালিশি পরিষদের ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশে তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও স্ত্রী কর্তৃক শর্ত সাপেক্ষে তালাকের অধিকার প্রদানসহ মুসলিম পরিবারের পারিবারিক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন এবং ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন জারি করা হয়। স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে এই আইনকে পরিমার্জন ও গ্রহণযোগ্য করা হয়।
এদিকে ভারতে মুসলিম মহিলারা তিন ভাবে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার সুযোগ পায় বর্তমানে। এই তিনটে পদ্ধতি হচ্ছে;-
১) তালাক-ই-তাফয়েজ
২) লিয়ান
৩) মুসলিম বিবাহ আইন ১০৩৯ অনুযায়ী

তবে এই বিধিগুলো পুরুষদের মত তত বেশি স্বাধীনতা দেয়নি মহিলাদের। পুরুষেরা কোনো কারণ না দেখিয়েই তালাক পদ্ধতিতে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে এখনো। মুসলিম পার্সোনাল ল অনুযায়ী মুসলিম মেয়েরা ডিভোর্স দিতে পারেন না। তবে মুসলিম উইমেন প্রোটেকশন অন রাইটস অফ ডিভোর্স ১৯৮৬ অনুযায়ীস্ত্রীধন সম্পত্তি ফেরত পাবেন। ডিভোর্সের পর স্বামীর সম্পত্তিতে অবশ্য তাঁদের অধিকার মাত্র তিন মাস পর্যন্ত (ইদ্দত পিরিয়ড)। তখন স্বামীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে মহিলাদের কোনও অধিকার নেই। তবে পরিত্যক্ত মহিলারা ওয়াকফ বোর্ডে আর্জি জানাতে পারেন আর্থিক সাহায্যের জন্য। বোর্ড খোরপোষের ব্যবস্থা করতে পারে। মুসলিম মেয়েরাও ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ নম্বর ধারায় স্বামীর কাছে খোরপোষ দাবি করতে পারেন।  মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী কখনও কখনও স্বামী-স্ত্রী আলোচনা করে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন। ইসলাম ধর্মে এই পদ্ধতি হল ‘খুল্লা এতে বিচ্ছেদ করতে গেলে স্ত্রী বিয়ের সময় যা যা যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেনতার সবটা না-হলেও আংশিক ফেরত দিতে হয়। এই ফেরত দেওয়াকে বলা হয় ‘মুবরাত
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে মুসলিম বিবাহ তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন প্রণীত হয়। মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর বৈধ সত্ত্ব-স্বার্থ নির্ধারণ করে, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন একত্রীকরণ ও সংশোধন করে এটি প্রণয়ন করা হয়। এরপর বিবাহ-তালাক বিধিমালা রেজিস্ট্রেশন ১৯৭৫ সালে জারি করা হয়। বিবাহ- বিচ্ছেদদাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারদেনমোহরভরণপোষণঅভিভাবকত্ব ইত্যাদি পারিবারিক বিষয়াদির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ প্রণীত হয়। বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইনে তালাক সম্পর্কে বলা হয়েছেবিয়ে একটি চুক্তিতাই এ চুক্তি নানা কারণে সমাপ্ত করা যায়। মুসলিম পারিবারিক আইনে বিয়ের চুক্তি ভেঙ্গে বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটানো সম্ভব।
তবে বাংলাদেশে একজন স্ত্রী যখন ইচ্ছা তখন স্বামীকে তালাক দিতে পারেন না। কিন্তু মুসলিম আইনেস্বামীকে তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রী সীমিত অধিকার ভোগ করেন। যে সকল উপায়ে একজন স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারেনসেগুলো হচ্ছেস্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। স্ত্রী তালাক-ই-তৌফিজ-এর মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। তারা খুলার মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনই মুবারতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
বাংলাদেশে একজন মুসলিম পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কের পুরুষযে কোন সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু সে মুখে বা লিখে যেভাবে তালাক দিক না কেনোসেই তালাক সাথে সাথে কার্যকর হবে না। ঐ দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান উভয় পক্ষকে ডেকে সালিশের ব্যবস্থা করতে পারেন।
এক্ষেত্রে কাজীও অনেক দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কাজীর দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছেজন্ম ও বিবাহের মতোতালাকও রেজিস্ট্রি করা। নিকাহ নিবন্ধক কাজী তার এখতিয়ারভূক্ত এলাকার মধ্যে আবেদনপত্রের ভিত্তিতে তালাক রেজিস্ট্রি করেন। তালাক রেজিস্ট্রির জন্য নিকাহ নিবন্ধক নির্দিষ্ট ফি নিতে পারেন যা সময়ে সময়ে সরকার দ্বারা পরিবর্তন করা হয়। যে ব্যক্তি তালাক কার্যকর করবেসে-ই রেজিস্ট্রির জন্য আবেদন করবে এবং ফি দেবে। এটা তালাক দাতার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে সত্যি সত্যিই তালাক কার্যকর হয়েছিল কিনাতা নিকাহ নিবন্ধক পরীক্ষা করে দেখেন।
বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী কাজীর মাধ্যমে তালাক দিতে হয় এবং তালাকের নোটিশ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনকে পাঠাতে হয়।. মুখে মুখে তালাক দিলে তালাক কার্যকর হয় না। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নোটিশ প্রদান ছাড়া তালাক দিলে তালাক কার্যকর হবেতবে নোটিশ প্রদান না করায় স্বামীর ১ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। এ এক অদ্ভুত আইন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে তালাক কার্যকর হয় না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী নোটিশ প্রদান করে ৯০দিন পর তালাক কার্যকর করতে হয়। ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭ (৬) ধারা অনুসারে তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলেবিচ্ছেদপ্রাপ্ত অর্থাৎ তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী পুনরায় একত্রে ঘর-সংসার করতে চাইলেনতুন করে নিয়ম অনুসারে বিয়ে করতে হবে। তবে পুনর্বিবাহ করে ঘর-সংসার করায় আইনত: কোন বাধা নেই।
কাবিন নামা’ অনুযায়ী স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষমতা দেয়াকে ‘তালাক-ই-তৌফিজ’ বলে। এই ‘তালাক-ই-তৌফিজের’ ক্ষমতা দেয়া থাকলে স্ত্রী আদালতের আশ্রয় ছাড়াই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এক্ষেত্রে স্বামীর মতোই স্ত্রী তালাকের নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবেন ও এক কপি স্বামীর কাছে পাঠাবেন। নোটিশ প্রাপ্তির ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। আর খুলা তালাক হলোস্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর দাম্পত্য অধিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রস্তাব। এক্ষেত্রে স্ত্রী কোনো কিছুর বিনিময়েস্বামীকে বিচ্ছেদের বিষয়ে রাজী করানোর চেষ্টা করেন। স্বামী রাজী থাকলেএভাবে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। বিচ্ছেদের উদ্যোগ তখন অবশ্যই স্ত্রীর কাছ থেকে হতে হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে-বিচ্ছেদ সম্পন্ন হলে তাকে মুবারত বলে। যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদের ইচ্ছা পারস্পরিক হয়তখন একপক্ষ প্রস্তাব করে এবং চুক্তির মাধ্যমে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। যিনি বিয়ে বিচ্ছেদের প্রস্তাব দিবেন তিনিই নোটিশ পাঠাবেন।
এমতাবস্থায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ছয় মাসের জন্যে শুধুমাত্র যা শরীয়তে নেই, সেই তালাক-ই-বাদাত নিষিদ্ধ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে হুকুম জারি করেছেআগামী ঐ সময়ের মধ্যেভারতের উপযোগী নতুন আইন তৈরি করে তা কার্যকর করতে। আশা করা অনুচিত হবে না যেএই নূতন আইন বাংলাদেশের থেকেও আরও অধিকতর উপযোগী হবেআমাদের দেশের জন্যে।(প্রকাশ কাল ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং)

তথ্যসূত্র:  বাংলাদেশ ই-তথ্যকোষ ও অন্যান্য ওয়েবসাইট )


কোন মন্তব্য নেই: