“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আলোক দূষণে বিপদ বাড়ছে

 ।। সুদীপ নাথ ।।
          
(C)Imageঃছবি
  
লো ছাড়া সভ্যতার কথা ভাবাই যায়না। কিন্তু অতিরিক্ত আলোও সবার জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
 আজকের এই উন্নত তথা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা বিশ্ব, আলোক দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে সমগ্র জীবজগতকে। এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা তো দূরের কথা, আমরা আলো ছাড়া এখন যেন আর কিছু ভাবতেই পারি না। অন্ধকার হলো খারাপের প্রতীক, আর আলো হলো সব ভালোর প্রতীক। বিজ্ঞান কিন্তু বলছে অন্যরকম কথা। বিজ্ঞান বলছে, আলোর যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমন অন্ধকারেরও দরকার আছে। স্নায়ুর শৈথিল্য এবং ঘুমের জন্য অন্ধকার অত্যন্ত জরুরি একটা উপাদান। নইলে জৈবিক ঘড়ি তথা বায়োলজিক্যাল ক্লক বিঘ্নিত হবেইএর ফলে নানা ধরণের মানসিক ব্যাধির সূত্রপাত হতে পারে যেকোনো ব্যক্তির।

শৈশবে আমাদের পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে সকালে ঘুম ভাঙতবিকেলেও পাখির ডাক শুনতে পেতামকিন্তু এখন যে ভাবে রাস্তার আলো জ্বলে থাকে তাতে পাখিরা মনে হয় দিন-রাত বুঝতেই পারে না। আধুনিক জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে সবাই ছুটছে আলোর পিছনেআলোয় ঝলমল করছে সারা শহরমায়াবী আলোয় চেনা শহরকেও যেন অচেনা লাগেকিন্তু কে জানত, সেই আলোর আড়ালে লুকিয়ে বিপদের ঘন অন্ধকার। ১৮৭৯ সালে টমাস আলভা এডিশন আবিষ্কৃত ইনক্যানডিসেন্ট বাল্ব প্রথম জ্বলতে শুরু করে নিউ ইয়র্ক শহরেসেই থেকেই শুরুবলতে গেলে ওই সময় থেকেই বৈদ্যুতিক আলোর নতুন অধ্যায়ের শুরুশহরকে আলোকমালায় সাজিয়ে তুলতে এখন বিশ্বজুড়ে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছেআবাসিক বাড়ি, অফিস ভবন, সেতু, ফ্লাইওভার, শহরের রাজপথ, হাইওয়ে, সর্বত্র আলোর বন্যাহাজার হাজার ওয়াটের আলোয় ঝলসে যাচ্ছে চোখমুছে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারআর সেটাই সভ্যতার কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছেঅত্যধিক আলোর ব্যবহার জন্ম দিচ্ছে আলোক দূষণ বা লাইট পলিউশন’-এর

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আলোক দূষণনিয়ে গবেষণা তো দূরের কথা, কোনো ভাবনাচিন্তাই শুরু হয়নিফলে সবার অজান্তেই আলোক দূষণের শিকার হচ্ছেন  সাধারণ নাগরিকরাসবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহরাঞ্চলের মানুষআলোর প্রভাবে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিরও শিকার হচ্ছে মানুষতালিকায় রয়েছে মাথাব্যথা, চর্মরোগ, শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদউবে যাচ্ছে রাতের ঘুমবাড়ছে মানসিক উদ্বেগতৈরি হচ্ছে যৌন অক্ষমতাদৃষ্টি ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে

একসময় রাতের অন্ধকারে খালি চোখেই মহাজাগতিক দৃশ্য দেখতে পাওয়া যেতমহাকাশে নক্ষত্রদের বিচরণ, ছায়াপথ সব কিছুই মায়াবী হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠতকিন্তু আলোর দাপটে শহুরে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে রাতকয়েক বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার’ (আইএআরসি ) মারণরোগটির জন্য যে সব বিষয়কে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, তার অন্যতম রাতের ডিউটিসমীক্ষায় দেখা গেছে, রাতে যাঁদের কর্মস্থলে কাটাতে হয়, তাঁদের মধ্যে স্তন ও প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশিঅতিরিক্ত আলো মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চলতে থাকলে হরমোন ক্ষরণের উপর প্রভাব পড়েবাস্তুতন্ত্রে আঘাত রাতের আলো যে শুধু মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে তা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্যও সমূলে বিনষ্ট করছে

দিনের আলো এবং রাতের আঁধারের সাথে ভারসাম্য গড়ে উঠেছে প্রাণীর প্রাকৃতিক কারণেই। দিনে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, কাজকর্ম ও চলাচল বাড়ে, মেলাটনিন থাইরোট্রপিন গ্রোল্যাকটিন ও কর্টিকোট্রপিন ইত্যাদি হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। রাতে শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপ কমে যায় এবং মেলাটনিল সহ অন্য কিছু হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। দৈনিক এই আবর্তন এবং বাৎসরিক ঋতুচক্রের সাথে আমাদের বন্ধন বায়োলজিক্যালি সেট আপ হয়ে রয়েছে বংশানুক্রমে। এই সেট আপের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নের তহবিলে গড়ে উঠা রাতের আলোক সজ্জা। আমরা রাত জেগে আলোর বন্যায় অন্দরমহলে পড়াশোনা, কাজকর্ম করি, কম্পিউটার চালাই, টিভির সামনে কারণে অকারণে হাঁ করে বসে থাকি। তখন আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। লক্ষ বছর ধরে গড়ে উঠা অভিযোজন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। 

জীবজগতে বেশ কিছু কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, যারা পুরোপুরি উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীলএমনকি, তাদের বাসস্থান এবং খাদ্য উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে আসেঅনেক উদ্ভিদ আছে যাদের ফুল রাতে ফোটেরাতের অন্ধকারেই কীটপতঙ্গরা ফুলে গিয়ে বসে এবং সেখান থেকে তাদের আহার সংগ্রহ করেখাবারের টানেই এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ঘুরে বেড়ায় তারাএর মাধ্যমে তারা অজান্তেই পরাগ সংযোগ ঘটায়। তা থেকেই যে ওই সব উদ্ভিদের ফল এবং বীজের জন্ম হয়, তা সকলেরই জানাএভাবে অনেক উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে কীটপতঙ্গরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় বাধার প্রাচীর গড়ে তুলছে রাতের কৃত্রিম আলো। তাছাড়া, কৃত্রিম আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনেক সময় এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে যে, নিশাচর সব কীটপতঙ্গ রাতে আস্তানা ছেড়ে বেরোতেই ভয় পাচ্ছেফলে তারা ফুলে গিয়ে বসতে পারছে নাতার জেরেই এ ধরনের উদ্ভিদের বংশবিস্তার থমকে যাচ্ছেআলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্রভাবে উদ্ভিদের স্টমাটা বা পত্ররন্ধ্রও সারারাত খোলা থাকছেফলে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় রস বাষ্প আকারে বেরিয়ে যাচ্ছেতাতে জলের অভাব ঘটছে উদ্ভিদের দেহেআর সেই কারণেও শহরে গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, গাছের মেটাবলিজম চূড়ান্ত ভেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেউদ্ভিদের শারীরবৃত্তিয় কার্যকলাপে ফটো পিরিয়ডিজমবা আলোক পর্যায়বৃত্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেযেখানে একটি উদ্ভিদের লাইট পিরিয়ড এবং ডার্ক পিরিয়ড’—দুটোর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট অনুপাত থাকেযা উদ্ভিদের ফুল ফোটানো নিয়ন্ত্রণ করেকুঁড়ি উত্পাদনেও সাহায্য করেকিন্তু রাতভর আলো জ্বলে থাকায় সেই ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটছেজীবজন্তু এবং জলজ প্রাণীর জীবনেও গভীর বিপদ ডেকে আনছে এই কৃত্রিম রাতের আলো

নয়া এক গবেষণা থেকে প্রকাশ, বিশ্ব জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ মানুষ রাতে আলোক দূষণের মধ্যে থাকে। রাত্রিতে অন্ধকার যদি গোধূলির সময়ের চেয়ে অধিক না হয়, তাহলে নিশাচর প্রাণীরা অসুবিধায় পড়ে কষ্ট পায়। শুধু তাই নয়, মানুষও কষ্ট পায় অনিদ্রা সহ বিভিন্ন রোগে, যে রোগগুলো আলোক দূষণের সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমানে সব থেকে আলোকোজ্জ্বল রাত পাচ্ছে সিঙ্গাপুর, কুয়েত এবং কাতার। ফলে এই দেশগুলোর মানুষ রয়েছে তীব্র আলোক দূষণের মধ্যে। রাত্রিকালীন আলোক দূষণ হয় আফ্রিকার দেশ চাঁদ এবং মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও মাদাগাস্কারে। একটি তথ্যে দেখা যায়, বিশ্ব জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ এবং আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ স্বাভাবিক তারাভরা রাতের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি উজ্জ্বল আলোর আকাশের নীচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।   

এটাও আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত সত্যি যে, মানুষের জীবনের সৃষ্টির সময় থেকে প্রকৃতির সাথে যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তা যদি নড়ে যায়, তাহলে মানব মনেও তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অন্ধকার আর আলোর সাথে চিরায়ত যে সম্পর্ক শরীরের তৈরি হয়েছে, তার যদি ছন্দপতন ঘটে, তাহলে শরীরের বায়োলজিক্যাল কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। মস্তিষ্কের ভিতরের কার্যকলাপ বাইরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। দেখা দেয় ক্লান্তি, অবসাদ, রক্ত চাপের, পরিপাকের এবং ঘুমের সমস্যা সহ অনেক সমস্যা এবং সর্বোপরি অলসতা। আমাদের চোখের রেটিনায় আলো এসে নার্ভের মাধ্যমে হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থিতে ঘনীভূত মেলাটোনিন হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আলোর অনুপস্থিতিতে মেলাটোনিন নিঃসরণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত মেলাটোনিনের নিঃসরণে যেমন আমাদের মস্তিষ্কে অবসাদ তথা ডিপ্রেশন তথা নিস্তেজনা সৃষ্ট হয়, বিপরীতে অতিরিক্ত আলো আমাদের ঘুম ব্যাহত করে এবং ম্যানিক সাইকোসিস ও অন্যান্য অনেক উত্তেজিত মানসিক ভারসাম্যহীন রোগও সৃষ্টি করেদিন-রাতের দৈর্ঘ্যের তারতম্যের ফলে শীত ও গ্রীষ্মে অবসাদ ও উত্তেজনার রকমফের আজ ক্রনোবায়োলিজির বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিক্ষিত সত্য।
(সূত্র: ইন্টারনেট ও কিছু পুস্তক)
***  

কোন মন্তব্য নেই: