“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের ‘আমার জগৎ’ (প্রথম পর্ব)

।। রজত কান্তি দাস।।
বিতা ও বিজ্ঞানের মধ্যে মূল তফাতটা যে কবিতায় ভাষাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় যেখানে ভাবটা কখনও বা গৌণ হয়ে যায়। তাই কবিতা সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে যে 'Poetry is made with words, not with ideas' কিন্তু একজন বিজ্ঞানীর কাছে সত্যটাই মুখ্য। ভাষাকে তিনি ব্যবহার করেন শুধুমাত্র সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। শব্দের মাধুর্য সেখানে গৌণ। তাই প্রয়োজনে তিনি সাংকেতিক কিংবা গাণিতিক ভাষা ব্যবহারেও কুণ্ঠিত নন।

এদিকে শব্দকে প্রাধান্য না দিলে তো কবিতা হয় না। তাই কবির কাছে শব্দের ছন্দবদ্ধ প্রকাশ যদিও মুখ্য কিন্তু শব্দের মোহজালে কবি যেন সত্যভ্রষ্ট না হন সেটাও দেখা দরকার। এখানে আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলব। কবিতা আমি লেখি না ঠিকই। তবে একবার অতি উৎসাহে একটি কবিতা লিখে ফেলেছিলাম, যদিও সেটা কবিতা হয় নি। সেখানে আমি এক জায়গায় লিখেছিলাম 'আপাত বিশৃঙ্খল এই বিশ্বে'একজন প্রথিতযশা কবি আমাকে বললেন তোমার কবিতার ‘আপাত’ কথাটা সরিয়ে দিলে ছন্দটা মিলবে। উনার কথা শুনে আমি কিছু বলিনি। তবে রঞ্জিত দে নামে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বললেন "আমি জানি রজত এই ‘আপাত’ কথাটাকে ছন্দের খাতিরে কাটতে পারবে না। কারণ ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানে যে ডিটারমিনিজমের ব্যাপারটা আছে তা নিয়ে কোয়ান্টাম থিওরির যে সংঘাত তৈরি হয়েছে এর বিতর্কের এখনও অবসান হয় নি। এই বিশ্বজগৎ সত্যি সত্যি বিশৃঙ্খল কি না এই নিয়ে রজতের লেখা আমি পড়েছি। তাই চট করে শুধু ছন্দের খাতিরে আপাত কথাটাকে সে উড়িয়ে দিতে পারবে না। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে কবিতা লেখা আমার কর্ম নয়। এর পর আর ও পথ মাড়াইনি।
তাই বলব সেই কবিই প্রকৃত কবি যিনি ভাবকেই প্রাধান্য দেন এবং সেই ভাবকেই তিনি প্রকাশ করেন তাঁর অনুপম ভাষাশৈলীতে, শব্দের দ্যোতনায়, এক অপরূপ ভঙ্গিতে। সমস্যাটা হলো যে চিন্তা করতেও তো ভাষার প্রয়োজন হয়। ভাষা ছাড়া তো মাথায় চিন্তাও আসে না। তাই কবির পক্ষে ভাষার মোহজালে জড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সত্যের প্রতিও সমান নিষ্ঠা বজায় রাখা যে কত কঠিন তা আমাদের বোঝতে কষ্ট হয় না। তাই যে কবি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েও ভাবের ঘরে চুরি করতে কুণ্ঠাবোধ করেন তিনিই প্রকৃত কবি। আমি বলি তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
 রবীন্দ্রনাথকে সত্যদ্রষ্টা বলাটা হয়ত বা কিছুটা অতিশয়োক্তি হয়ে যাবে কারণ সত্যের স্বরূপই সম্ভবত এখনো নির্ধারিত হয় নি। কবি বলবেন ‘সত্য তাহাই যাহা রচিবে তুমি’। আবার বিজ্ঞানী বলবেন ‘সত্য হলো যা মানব মনের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত’অর্থাৎ সত্য subjective না objective এই বিতর্কের যেখানে অবসান ঘটেনি তাই সত্যদ্রষ্টা কাউকেই বলা যাবে না। তবে রবীন্দ্রনাথের সত্যনিষ্ঠা যা সত্যের স্বরূপকে জানতে সদা তৎপর ছিল তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তাঁর সমগ্র রচনায়। কবির মনে সত্যের স্বরূপ নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল তারই সংঘাতে তাঁর মনন সবচাইতে উন্মেষের দিকে গেছে বলে আমার ধারণা। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই সুনির্দিষ্টভাবে সত্যের  কোন এক বিশেষ স্বরূপকে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁর কবিমানসে এই বিরোধ ছিল একান্তই স্ববিরোধ। এই স্ববিরোধই তাঁর সত্যনিষ্ঠার সবচাইতে বড় প্রমাণ। কারণ স্ববিরোধ থাকে না কেবল কট্টরদের। কবির এই সত্যনিষ্ঠাই আমাকে আপ্লুত করেছে সব চাইতে বেশি। মনে হয় এটাই তাঁর সবচাইতে প্রীতিকর দিক। কারণ সত্যনিষ্ঠা ও স্ববিরোধিতা একই মুদ্রার দুটো দিক তাই মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তাঁর ‘Song of Myself কবিতায় লিখেছেন - 
'Do I contradict myself?
Very well then I contradict myself.
I am large, I contain multitudes.

প্রচলিত ধর্মমত যে রবীন্দ্রনাথকে কোনদিনও আকৃষ্ট করতে পারেনি তার কারণ ধর্মনিষ্ঠা ও সত্যনিষ্ঠা যে এক নয় এটা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বহু আগেই। কিশোর বয়সে কবি যখন পিতার সঙ্গে পাহাড়ে যেতেন সেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কিশোর কবির মনকে দুটো বিষয়ের উপর প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন,উপনিষদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান। তাই রবীন্দ্রনাথ উপনিষদীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হলেও তাঁর জীবনভর সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি বিজ্ঞানচর্চাও অব্যাহত রেখেছিলেন অক্লান্তভাবে। বিদেশ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক বই সংগ্রহ করতেন। এছাড়া ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ নামের ঐতিহ্যশালী মাসিক পত্রিকার তিনি ছিলেন নিয়মিত গ্রাহক। দেখা যায় প্রফুল্ল রায়কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি আক্ষেপ করে লিখছেন যে কয়েকমাস বিদেশে থাকার কারণে এই পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যা তিনি পড়তে পারেন নি। এছাড়া সত্যেন বসুকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, “আজ বয়সের শেষ পর্বে মন অভিভূত নব্যপ্রকৃতিতত্ত্বে - বৈজ্ঞানিক মায়াবাদে। তখন যা পড়েছিলুম তার সবটা বুঝি নি। কিন্তু পড়ে চলেছিলুম। আজও যা পড়ি তার সবটা বোঝা আমার পক্ষে অসম্ভব, অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের পক্ষেও তাই।” 
একজন বিজ্ঞানী যিনি মানবমন নিরপেক্ষ সত্যের সন্ধান করেন তাঁর পক্ষে এক পরম সত্যকে উদ্ঘাটন করা হয়ত বা সম্ভব কিন্তু চরম সত্যকে উদ্ঘাটন করাটা হয়ত মানব জাতির পক্ষেই অসম্ভব। তাই চরম সত্য যেখানে আজও অলীক হয়েই আছে তাই মানুষ মাত্রেই কোনো এক ভাবনার প্রতি আসক্ত থাকে। সত্যসাধনারত যুক্তিনিষ্ঠ মনও কোনো এক বিশেষ সত্যকে খুঁজে বেড়ায় যার প্রতি থাকে তাঁর স্বাভাবিক আকর্ষণ। এই আসক্তি থেকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা আইনস্টাইন কেউই মুক্ত ছিলেন না। তাই কোয়ান্টামতত্ত্বের আবিষ্কারে আইনস্টাইন যেমন মোহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন তেমনি আবার রবীন্দ্রনাথের কবিমন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানের এই মায়াবাদ নিয়ে তিনি ১৯৩০ সালে আইনস্টাইনের সঙ্গে বার্তালাপ করেছিলেন এবং এর সমর্থনে অত্যন্ত জোরালো যুক্তিও দেখিয়েছিলেন। অথচ দেখা যায় এর বছরখানেক পরই জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এই মত ব্যক্ত করছেন যে মানবমনের বাইরে যে সত্য তাই প্রকৃত সত্য, আধুনিক কবিতার দায় এই সত্যকেই মানুষের পৌঁছে দেওয়ার। অথচ এর কিছুদিন আগেই তিনি লিখেছেন ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’তাই দেখা যায় যে রবীন্দ্রমানস উপনিষদীয় ভাবধারায় আপ্লুত থাকলেও বারবার মানব বহির্ভূত সত্যের প্রতি তাঁর সদাজাগ্রত মন এক দ্যোতনার মধ্যে থেকে কবির অন্তর্জগতে এক ভাবের খেলা চালিয়েছিল যার পরিণাম স্বরূপ এক সত্যনিষ্ঠ কবির মানসিক দোলাচলের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই তাঁর সমগ্র রচনার মধ্য দিয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথ সত্যদ্রষ্টা না হলেও তাঁকে সত্যনিষ্ঠ বলতে আমার মনে কোন দ্বিধা নেই। আমি তাঁকে সত্যদ্রষ্টা তখনই বলতে পারতাম যদি আমি নিজে জানতাম যে সত্য আসলে কি। 
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যিক হিসেবে এতটাই খ্যাতি অর্জন করেছেন যে আমরা প্রায় ভুলেই গেছি যে বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর রচনাসম্ভার কলেবরে নেহাত খাটো নয়। কবির বিজ্ঞানভিত্তিক রচনাগুলোর মধ্যে আছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাণিতত্ত্ব, সমুদ্রবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, গতিবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব সহ আরো অনেক বিষয়। ১২৮১ বঙ্গাব্দে (ইং ১৮৭৩) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’ শীর্ষক একটি অস্বাক্ষরিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই রচনাটি ছিল একটি ধারাবাহিক রচনার প্রথম কিস্তি তবে একটি কিস্তি বেরোনোর পর আর কোন কিস্তি প্রকাশিত হয় নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উত্তর জীবনে অন্তত দু জায়গায় এই রচনাটির উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের অনুমান যে এটাই ছিল কবির প্রথম প্রকাশিত গদ্য। ঐ সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে বারো বছর। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্য রচনাটি ছিল একটি বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা। এর পরও তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। এমন কি শেষ বয়সে ‘বিশ্ব পরিচয়’ লিখে বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা লিখতে আমাদের উৎসাহিত করে গেছেন। তবে এই সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে তাঁর কবি পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাঁর কাব্য প্রতিভা তাঁর নিজেরই অন্য সমস্ত গুণাবলীকে ছাড়িয়ে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছিল যা তাঁর অন্যান্য দিকগুলোকে কিছুটা হলেও ম্লান করে রেখেছে যদিও কবির বিজ্ঞান সচেতন মন তাঁর সমকালীন বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে অনুধাবন করতে সদা তৎপর ছিল।

কোন মন্তব্য নেই: